নভেম্বরের এই শুরুর ভাগে সন্ধ্যেটা নেমে আসে ঝুপ করে। ঘড়ির কাঁটা চারটা পেরোলেই একটা ঠান্ডা বাতাস আমার বসার জায়গার পেছনের জানলা দিয়ে হুহু করে ভেসে আসে। একটু দূরে বসা জ্যৈষ্ঠ সহকর্মীটি জানলা বন্ধ করে দেবার জন্যে তোড়জোড় করতে থাকেন।
আমার আপত্তিতে জোর করেই জানলাটা খোলা রাখা হয়, হালকা ঠাণ্ডায় মায়ের বকুনি খাবার পরেও গরম কাপড় না পরা দুষ্টু উদোম গায়ের বাচ্চাদের মতোন। জানলার কাছে চেয়ারটা সরিয়ে উঁকি দিই বাইরে। অন্ধকার আর আলোর মাঝামাঝি একটা "প্রায়আধার" বাইরে থেকে কেমন যেন অপরাধবোধ নিয়ে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে থাকে, যেনো সে লজ্জ্বা পায় বেশি তাত্তাড়ি এসে পড়ায়, আকাশটাকে কালো করে দেয়ায়। তারপর আমার মুচকি হাসিমুখ দেখে সেও সাহস পায়, পুরোপুরি মুড়ে ফেলে আকাশটাকে, ওপারের নির্জীব ইচো গাছগুলো ড্যাবড্যাব দাঁড়িয়েই পড়ে অন্ধকারেই, বাতাসে ভেসে আসে ওই গাছগুলোর উপরে বাসা বাঁধা টিয়া পাখিদের কিলিকিলি, চিলিচিলি।
এই স্কুলের আন্ডারগ্রেডারেরা, যারা বেশিরভাগই নার্ড এবং স্বভাবতই অন্তর্মূখি, অনেকেই ক্লাস শেষে ক্লান্ত দেহ নিয়ে টেনেটেনে বাড়ি ফেরার জন্যে ইচো গাছগুলোর নীচে ওই রাস্তাটা ধরে হেঁটে হেঁটে চলে। আমি জানলার পাশেই চুপচাপ বসে থাকি। একই রুমে বসা আরেক সহপাঠী কফি খাবো কি না জিজ্ঞেস করে একটা ডাক দেয়, আমি হ্যাঁ-হুঁ মাঝামাঝি কিছু একটা বলে আবার ডুবে যাই বাইরের অন্ধকারের সাথে কথোপকথনে।
একটা সময় ছিলো, যখন হিসেব করতাম - আচ্ছা এখন দেশে কয়টা বাজে, মা কী করছে - আজ কী রান্না হয়েছে - আজকে বাজার কে করেছে। এখন মস্তিষ্কের ওই জায়গাগুলো প্রায় মুছে বসে আছে। ওই কোষগুলো কবে মরে আবার নতুনেরা জায়গা নিয়েছে কে জানে। কিন্তু আজ কতো বছর পর কেনো যেনো ভাবতে ইচ্ছে করছে - দেশে কেবল দুপুর পার হলো, দেশে থাকলে হয়তো শুধু লাউয়ের তরকারি, কোন অপ্রিয় মাছের ঝোল আর তেল দেয়া আলুর ভর্তা দিয়ে হয়তোবা দুপুরের ভাত খেতাম একটা গোসল ছেড়ে এসে।
হয়তোবা, হয়তোবা নয়।
কিংবা ফেলে আসা বন্ধুগুলোর মতোন একটা চাকুরি খুঁজে হাপিত্যেশ হতাম অথবা সস্তায় কোন চাকুরিতে দিন পার করতাম আরো ভালো কোন সুযোগের আশায়। তার থেকে এই বর্তমানই ভালো লাগে। হোক না, মাঝরাতে বাড়ি ফিরি, কিংবা শুকনো রুটি বা ওনিগিরি চিবুতে চিবুতে অনেক কিছু ভুলে থেকে জোর করে দিন পার করি।
এইসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এইবার জানলা থেকে উঠি।
কী হতে কী হইনি, আর কোথায় থেকে কোথায় থাকিনি - এইসব দুঃখবিলাস মাঝেমাঝে নিজের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকে। পানসে কফিতে চুমুক দেই। কফি ভাল্লাগেনা। এই ঘরটায় কফি আমার থেকে কেউ ভালো বানাতে পারেনা। সন্ধ্যেটা আরো বিষণ্ণ আর ঠাণ্ডা হতে থাকে।
নভেম্বর ০৯, সন্ধ্যে
ব্যাখ্যা - ইচো , ওনিগিরি
ছবি - পাঁচ বছর যেখানে কাটিয়েছি, আমার স্কুল
মন্তব্য
আহ, ভাবনার কী অদ্ভুত মিল! পড়তেই ভাল লাগল!
খুব অল্প কিছু মুহূর্ত বা খুব নির্দিষ্ট কিছু টাইমস্ট্যাম্প এইভাবে তুলে আনতে আমার খুব ইচ্ছে করে সবসময়।
আপনার শেষ লেখাটা সেই অর্থে আমার এই লেখার অনুপ্রেরণা বলতে পারেন।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আমি অবশ্য এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা ছেড়ে দিয়েছি। ক্রমাগত অটোসাজেশন (মেডিটেশনের ভাষা) দিয়ে দিয়ে মস্তিষ্কের ওইসব দুর্বল কোষগুলোকে ঘষে ঘষে নতুন শক্তিশালী কোষের জন্ম দিয়েছি। এখন যেখানে রাত, সেখানে কাত; তেমন কোনো অনুভূতি কাজ করে না। দেশে গিয়েও সেই স্মৃতিগুলোর সাথে আকাশ-পাতাল পার্থক্যই চোখে পড়ে শুধু। ধুর, কী আর হবে এসব ভেবে। এই তো আছি। বেঁচে আছি। ভালো আছি!
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
অটোসাজেশনটা শেখান, বস।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আরেকটু বিষন্ন হল মন...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
তোমার শেষ লেখাটা পড়েই তো বিষণ্ণতার শুরু।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আহ!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
কৃতজ্ঞতা।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
ছবিটা দিনের বেলা একরকম দেখায় আর অন্ধকার ঘরে অন্যরকম দেখায়। যারা লক্ষ্য করেননি তাঁরা রাতের বেলা অন্ধকার ঘরে দেখুন। ছবির 'ডিটেলস্' টা অসাধারণ। এমন বাস্তব ছবি আমি খুব কম দেখেছি। ছবিটা দেখে এই গানটা মনে হচ্ছে -
"একদিন আমি হেঁটেই চলছি পথে একা,
কন্ঠে আমার নেই কোন সুর.....
চারিদিকে আঁধার
আঁধার আর আঁধার.."
(ওয়ারফেইজের গান)
- প্রতিটা প্যারাই একেকটা পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা, একেকটা কাহিনী, একেকটা প্রাণ পাওয়া বোতলবন্দী ভূত।
শেষের প্যারায়, শেষের লাইনগুলি অসাধারণ লাগলো। ভাবনার মিলের জন্যেই বোধহয়।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনের বিবাহের কী খবর?
ব্রেকিং নিউজ দিলেন কয়দিন আগে।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আপাতত: এটুকু ছুঁয়ে গেলো।
ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে সবকিছু, ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করে সবসময়।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
মা এখন রান্না করার সময় পায় না
আপনার এই ছবিটির কথা বহুদিন পরে আবার মনে পড়লো। মনে পড়লো কোন এক রাতের আঁধারে মনিটরের পর্দায় ছবিটি দেখে আন্দোলিত হয়েছিলাম। আজ সকালে মেঘের চাদরে ঢাকা প্রকৃতির মাঝে হেঁটে যখন ইউনিভার্সিটিতে আসি তখন ফলের (Fall) ভেজা-ভেজা ম্যাপলের সারি দেখে আপনার ছবিটির কথা মনে পড়ে গেল।
আশ্চর্য ব্যাপার কি জানেন, আপনার ব্লগ ব্রাউজ করে ঠিক ঠিক এই পোস্টটিই খুলেছি। আন্দাজ মিছে হয়নি। তবে ভাবিনি প্রথম প্রচেষ্টাতেই সফল হবো
আপনি ছবি পোস্ট করেন না কেন? আপনারা না ওয়াইড লেন্স আছে?
নতুন মন্তব্য করুন