১.
বছর দুয়েক আগে আমি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম সপ্তাহ দুয়েক। পিঠের একটা মাঝারি ধরনের সার্জারির জন্যে। কী হয়েছিলো, সেইসবের গল্পে যাবো না। শুধু, অভিজ্ঞতার কথা বলে নেই। হাসপাতালে ভর্তির আগের সপ্তাহে একগাদা মেডিক্যাল টেস্ট করাতে হয়। সব টেস্টে নাম, কিংবা হাসপাতালের কার্ডের আইডি চাইলো। কিন্তু, একটা চেকআপে কোন কিছুই লাগলো না। একটা লম্বা নম্বর দিয়ে আমাকে, আমার পরিচিতি মুছে ফেললো তারা। আর বললো, এই টেস্টের ফলাফল যদি আপনি নিজের থেকে জানতে না চান, আপনাকে কখনোই জানানো হবে না।
সেই বিশেষ টেস্টটা ছিলো, এইচআইভি র।
যেহেতু সার্জারিতে রক্ত নেয়ার ব্যাপার আছে, সেই প্রস্তুতি হিসেবে বাধ্যতামূলক টেস্ট। মানে, আমাকে যে রক্ত দেয়া হবে তার নিরাপত্তা তারা নিশ্চিত করবে, কিন্তু তার আগে জেনে নেয়া - আমি সুস্থ কি না। শেষ পর্যন্ত সেই যাত্রায় আমাকে কারও রক্ত দিতে হয় নি। ছয় ঘন্টার ছুরি-চালানো-চিকিৎসা শেষে দুপুরে জ্ঞান ফেরার পরে ডাক্তার যা বলেছিলেন, রক্ত অনেক বেরিয়েছে, কিন্তু বয়স কম সেজন্যে আর রক্ত দেবার প্রয়োজন বোধ করেন নি তারা। ভাই-ও-নাই-বান্ধব-ও-নাই এই বিদেশ বিভুঁইয়ে হয়তো ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দেয়া কোন দয়ালু অজানা সাতো বা সুজুকি১ র রক্ত নিতে হতো - কে জানে।
কিন্তু, কখনো ভাবি নি এমন কিছু সেই প্রথম অনুভব করে ফেলি।
২.
ধান ভানতে শীবের গীত হয়ে যাচ্ছে। গত বছরের খবর, বিবিসি থেকে।
পেরুতে শল্য-চিকিৎসার সময়, কেন্দ্রীয় রক্তব্যাংক থেকে রক্ত নেয়ার মাধ্যমে এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছেন চারজন২। জুডিথ রিভেইরা নামের একজন আক্রান্তের কান্না শোনার জন্যে এই লিংক২ থেকে ভিডিওটুকু দেখে আসতে পারেন। রাষ্ট্র পরিচালিত ব্লাড-ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ রক্তে এইচআইভি জীবাণু পাওয়া যায় সেই সময়।
৩.
বাংলাদেশে আসি। গত বছর কোন একটা সময়ে প্রথম আলোয় একটা রিপোর্ট দেখেছিলাম । সেখান থেকেই কয়েক লাইন তুলে ধরি।
উদ্ধৃতি
‘দুই আপা আর আমার রক্ত পরীক্ষার পর সব যেন পাল্টে গেল। আপারা রাতে খাটে ঘুমান; আমি নিচে, মাটিতে। আমার থালা-গেলাস আলাদা। আমার সঙ্গে চাচিরা ঠিকমতো কথা বলেন না। আমাকে কেউ কোথাও নিয়ে যায় না। আমার পজেটিভ, তাতে আমার কী দোষ? আপনারা বলেন, আপাদের বিয়ে হয়ে গেলে আমি কোথায় যাব?’
বাচ্চা একটা মেয়ে । বাবা-মা র মাধ্যমে সংক্রমিত। বাবা-মা মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। বড় বোনদের রক্তে ভাইরাস পাওয়া যায় নি। মেয়েটার আহাজারি ভেসে উঠেছিলো কোন এক কর্মশালায়। আরেকজন সংক্রমিত বলেছিলেন, সরকারী হাসপাতালে তার পজিটিভ ধরা পড়ার পর তাকে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মতোন লোক ডেকে দেখানো হতো৩।
হায় রে মানুষ। কবে মানুষ হবি?
৪.
জাপানে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে আছে, সেই মেয়েটা আরেক্টা ছেলের, এইরকম করে একটা দীর্ঘ মানববন্ধন দেখানোর পরে বলা হয়, আপনার জিয়েফের পুরনো যেই বিয়েফ, তার পুরনো জিয়েফের পুরনো বিয়েফ, সেই বিয়েফের জিয়েফের বিয়েফ.. মনে করুন তার নাম মবিনুদ্দিন। মবিনুদ্দিনকে কি আপনি চেনেন? তারপরে এইডস পরীক্ষার জন্যে বলে দেয়া হয়। প্রেম-পীরিতি স্বল্পায়ু যেসব জগতে, সেইসব জগতের জন্যে বিজ্ঞাপনটা খুব মানানসই মনে হয় মাঝে মাঝে।
৫.
আজকে ডিসেম্বরের পয়লা দিন। বিশ্ব এইডস দিবস। কালকে ওই পাড়ার ব্লগে একটা পোস্ট পড়ছিলাম। একটা ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন একজন। বিদেশে অনেকদিন থাকা এক বাংলাদেশী দেশে গিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ে করার পরে পাত্রী জানতে পারেন, তার সদ্য বিবাহিত স্বামী এইচআইভি পজিটিভ। এইরকম ঘটনা বোধহয় কম না।
আমরা এমন এক সমাজে থাকি, এখনও সেক্স-এডুকেশন যেন আমাদের জন্যে নিষিদ্ধ কোন বইয়ের পৃষ্ঠা। এইচআইভি সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে তৈরি প্রচারণায় সরাসরি কোন বক্তব্য প্রচার করা যায় না। কথা অনেক ঘুরিয়ে যা বলা হয়, অর্ধেক লোক নিরক্ষরের এই দেশে সেইটুকু কতজনে বোঝেন - কে জানে?
লুকোনো জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধ ছাগলদের মৌসুম বুঝে ম্যাঁ ম্যাঁ, রাজনৈতিক ছাগলদের কলা-মূলোর আগাম ভাগাভাগি - হাজারো হতাশার মাঝে এইচআইভি নিয়ে অনেকে হয়তো নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন । সঠিক তথ্য জানি না । তাদের জন্যে ভালোবাসা এবং আলোকিত দিনের শুভ কামনা।
ছবির গল্প-
পজিটিভভাবে বেঁচে থাকা একজন পজিটিভের মুখাবয়ব
ছবি কৃতজ্ঞতা - "মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ", এইচআইভি/এইডস সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে যারা নিবেদিতপ্রাণ।
ছবির স্বত্ত্ব - মুনতাসির মামুন - ফ্লিকার লিংক । তার অনুমতি নিয়ে ব্যবহার। এইচআইভি/এইডস এর দৈত্যকে বধ করবার সংকল্প নিয়ে ওরা কয়েকজন বাইসাইকেলে করে মানুষকে জাগানোর জন্যে গল্প ফেরি করে বেড়াচ্ছেন দুনিয়াজুড়ে। সেই গল্প নিয়মিত লেখা হয় এখানে।
ওদের গ্রুপের পেজ - টুগেদার উই আর
সূত্র-
১. জাপানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পারিবারিক নাম সাতো, তারপরে সুজুকি - লিংক
২. পেরুর ব্লাড ব্যাংক কেলেংকারি- লিংক, ভিডিও
৩. প্রথম আলো রিপোর্ট- লিংক
মন্তব্য
সময়োচিত পোস্ট। হাসপাতালে থাকার সময় ডাক্তার এসে জানালো হাইফাউ টেস্ট করাতে হবে, আমি সম্মত কি না। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, হাইফাউ টেস্ট জিনিসটা কি? ডাক্তার বললো, এইডসের টেস্ট। জার্মান বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, তাই তো! (জার্মান H = হা, I = ই, V = ফাউ)। অবশ্য টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে কোনো লুকোছাপা করে নি।
এইডস ইজ জাস্ট এনাদার ডিজিজ।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মুগ্ধ আর বিষণ্ণ হলাম।
হাঁটুপানির জলদস্যু
সততি কথাটা ব্যপারটা যথেষ্ট শক্ত। আমার অভিজ্ঞতা বিস্তর না। তবে কে উ ভাল ভাবে নেয় না ব্যপারটা।
সেটা দেশ কিংবা বিদেশ োক।
মুনতাসির
www.muntasirmamun.com
মুনতাসির, আপনার কমেন্ট দেখে ভালো লাগলো। ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা। শত পৃষ্ঠা লিখেও যা বলা যায় না, ছবিগুলো তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী মেসেজ দেয়।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
মুক্তাঙ্গন ব্লগে আপনার ছবি-সহ সেই লেখার লিঙ্কটা ওইদিন রাবাবের থেকে পেলাম। দারুন লেগেছিলো।
অভিনন্দন গ্রহণ করুন এত চমৎকার কাজের জন্য।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ইমরান, তোমার সময় কম তা জানি, কিন্তু মন্তব্যটা তো মন দিয়ে লিখবা!
ভীষণ দরকারি পোস্ট।
কালো বিড়াল দেখানো বিজ্ঞাপনের চেয়ে বেশী কাজের।
এইচআইভি পজিটিভদের প্রতি সবার আচরণ সহনশীল হোক।
দরকারী একটা পোষ্ট । ভীষণ মুগ্ধ হলাম সৌরভ আপনার লেখনিতে ।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বেঁচে থাকুক এই অবহেলিত মানুষগুলো, তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার নিয়ে; আমাদের মাঝে, আমাদের একজন হয়ে।
দারুন লেগেছে লেখাটা। ধন্যবাদ আপনাকে, ভুলে যাওয়া এই মানুষগুলোকে স্মরণ করার, এবং করিয়ে দেয়ার জন্য।
A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?
৩ নং পয়েন্ট চোখ ভিজিয়ে দিলো।
পজিটিভদের জন্য ভালোবাসা এবং নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন যারা তাদের জন্যও...
=============================
- বহুব্রীহিতে কাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেছিলো, "ভালোবাসা হইলো একটা শরমের ব্যাপার!"
আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থানের প্রেক্ষাপটেও এইডসের বেলায় কথাটা মহাখাঁটি। "এইডস হইলো একটা ছি ছি করার ব্যাপার! যার হইছে তারে চিড়িয়াখানায় পুরে রাখো, পারলে যতোভাবে সম্ভব নিঃগৃহীত করো। ধরে নাও কেবল যৌণতাই তার এই রোগের কারণ!"
তো এই হইলো ঘটনা। যারা বকের ঠ্যাঙে রশি লাগায়া টানে তাগো উপর দিয়া আর কী বলবেন?
জার্মানীতে কোনো লুকছাপ দেখিনা ব্যাপারটা নিয়ে। বাসে ট্রামে দেখছিলাম বিনামূল্যে "হাইফাউ" টেস্ট করার বিজ্ঞাপন, আজকের দিনটিকে সামনে রেখে। সাধারণ থরো চেকাপেও হাইফাউ টেস্ট থাকে মনে হয়। নেগেটিভ হলে সেটা সুন্দর করে লেখা থাকে, পজিটিভ হলেও নিশ্চই তাই। কোনো পর্দার ইন্তেজাম নেই। কারণ এইখানে কেউ কাউরে পুছে না! কেউ এইটা নিয়ে ডিসক্রিমিনেট করলে তারে ধরে দলেদলে মুড়ি খাওয়ানোর নিয়ম।
তাবৎ দুনিয়ার সকল পজেটিভদের জন্য ভালোবাসার হাত বাড়ানো থাকলো ধুসর গোধূলি'র। তাঁদের প্রতি সকল নিঃগৃহীতির অবসান হোক।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সকল পজিটিভদের জন্য ভালবাসা
সৌরভ, এত চমৎকার গুছিয়ে এমন জরুরী বার্তা লিখেন কী করে! ঈর্ষা করি...।
দূর্দান্ত লেগেছে।
এই লেখাটা খুব ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ সৌরভ।
-----------------------------------
মানুষ এত বড় যে ,
আপনি যদি 'মানুষ ' শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ' মানুষ' -
তো আপনি কাঁদবেন!
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।
সকল পজিটিভদের জন্য ভালোবাসা।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
খুব সুন্দর লেখা ! আবেগে-আন্তরিকতায় ছোঁয়া।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
খুব সুন্দর লেখা ! আবেগে-আন্তরিকতায় ছোঁয়া।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
চমৎকার গুছিয়ে লেখা।
গতবছর এক এন জি ও তে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল।HIV + দের মিটিং ছিল।আমাদের দেশেই একঘরভর্তি HIV+ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলাম স্বীকার করি।
বেশিরভাগই ছিলেন মহিলা।বিদেশ ফেরৎ স্বামী দ্বারা আক্রান্ত ঃ(
অবশ্য তাদের সবাইকে বেশ সুখী মানুষ বলেই মনে হয়েছিল আমার।আমরা ওদের সাথে অনেক ছবিও তুলেছিলাম।
অজ্ঞানতা দূর হোক। সবার জন্য ভালোবাসা।
সৌরভকে ধন্যবাদ অসাধারণ লেখাটির জন্য।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সহানুভুতি রইল। সৌরভ ব্রো, এই দিবসগুলো আসলে আমাদের অনুগ্রহ করে ব্যানার তৈরী করার কথা মনে করিয়ে দিবেন। আরো ভালো হয় 965x150 আকারে ব্যানার করে দিলে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
লুকোনো জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধ ছাগলদের মৌসুম বুঝে ম্যাঁ ম্যাঁ, রাজনৈতিক ছাগলদের কলা-মূলোর আগাম ভাগাভাগি -- বাংলাদেশের বাস্তবতা...............
চমতকার পোস্ট.... ধন্যবাদ লেখককে সময়োপযোগী লেখাটির জন্য।
পজিটিভদের জন্য ভালোবাসা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
পজিটিভদের জন্য ভালোবাসা...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন