সেই নদী টা হারিয়ে ফেলেছি

সৌরভ এর ছবি
লিখেছেন সৌরভ (তারিখ: মঙ্গল, ২৩/০৬/২০০৯ - ৯:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

।।পাথর-সময়।।
এখন পুরোদস্তুর দ্বিপদ চাকুরিজীবীতে পরিণত হওয়ার পর জীবন হয়ে গেছে অনেক সংক্ষিপ্ত, বাহুল্য অথবা অনিয়ম এখন অনেক দূরের ব্যাপার। সকালে নিয়ম করে উঠতে হয়, দাড়ি পরিষ্কার করতে হয়, দুটো পা ফেলার জায়গা থাকে না এমন ভীড়ের ট্রেনে ঢোকার জন্যে প্রায় শারীরিক কসরত করতে হয়। রাত হলে বাসায় ফিরে মোটামুটি পর্যাপ্ত ঘুমানোর সময় পাই অবশ্য।

তারপর আছে কাজের ঝামেলা, সিঙ্গাপুর থেকে বসেরা ভিডিও কনফারেন্স করেন। তেনারা এটাকে টাউন হল মিটিং বলেন। কথায়-কথায় মনে করিয়ে দেন সামনের দিনের সংস্কারের কথা, বলেন আরো আউটসোর্সিং বাড়ানো হবে ব্যাঙ্গালোরে আর ম্যানিলায়। মানে, ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেন, তোমাদেরকে আর দরকার হবে না আগামী দিনে। এমনিতেই ভয়ে থাকি, আরো ভয় পাই। "রহমান" ব্রাদার্স এর পতনের পর চাকুরিটা নিয়ে স্বস্তি পাই নি এমনিতেই, এখন কাজ করতে শুরু করে আরো ভয় পাই।

গত সপ্তায় একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে সকালে এসে জেনেছে, তাকে আর দরকার নেই ৬ বছর ধরে থাকা এই কাজের ক্ষেত্রে। আমরা জেনেছি পরে, আমাদের ম্যানেজারেরা ছোট ছোট মিটিং করে আমাদেরকে জানিয়েছে তার অনুপস্থিতির কারণ। বিকাল হতে হতেই তার ডেস্ক খালি হয়ে গেছে, নামফলক মুছে গেছে। সবাই থমথমে মুখ ভার করে ছিলো সকালের অংশটা। তবে একটাই দিন। পরের দিন থেকে সেই মেয়েটা যে ছিলো, তার রেশমাত্র নেই সেই ডেস্কটার আশপাশে।

।।অ-সুখ।।
গত মাসে হাসপাতালে ছিলাম কয়েকটা দিন - এক সপ্তাহ মতোন।
অসহায়ভাবে অসুস্থ হয়ে নিরুপায় হাসপাতালে জায়গা নিয়েছিলাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, আর বোধহয় ভালো হওয়া হবে না। কিন্তু হঠাৎ করে কীভাবে যেনো ভালো হয়ে গেছি। বছর চারেক ধরে যে ডাক্তার দেখছে, তার মত, নিজের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার জোরেই ভাল হয়েছি। তবে এখনও জোরে হাঁটি না, অযথা হাঁটাহাঁটি-পরিশ্রম এড়িয়ে চলি।

।।একজন স্বার্থপর মানুষ।।
এইসব দিবস-টিবস নিয়ে আমি খু্ব একটা আগ্রহ বোধ করি না। বাবা দিবসে বাবাকে স্মরণ করে বেদনায় আপ্লুত হই না। আমাদের বাসায় কোনদিন কারও জন্মদিন পালন হয় নি, বাবার জন্মদিনও আমি জানি না। কাজেই সেটাও খুব দূরের কথা। আমি ফেইসবুকে স্ট্যাটাসও লিখে রাখতে পারি না - আমার বাবা আমার আদর্শ। কারণ আমি জানি, সেটা মিথ্যা। আমার বাবা একজন সাদা-মাটা মানুষ, ভুল-ত্রুটি ভরা মানুষ। ভুল-ত্রুটির পরিমাণই বেশি হয়তোবা, আমার দৃষ্টিতে।
বাবার সাথে খুব বেশি কথা হয় না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস? শরীর ভালো? বড়োজোর এইসব। উত্তরে হ্যা-হুঁ। আজ খুব ভাঙা গলায় বললেন, একটা খারাপ খবর দেই - বড় বু মারা গেছে।

বড় বু মানে - আমার বড় ফুফু । আমি সেই খবর পেয়েছি দু-দিন হয়ে গেছে। বাবা সেটা জানেন না। বড় ফুফুর বার্ধক্যজনিত চলে যাওয়ায় যেরকম কষ্ট পাওয়া উচিত, সেরকম কষ্ট হয়তো অনুভব করতে পারি না। কিন্তু, প্রায়-অচল এবং অসুস্থ বাবা যখন বলেন, বড় বু চলে গেছে এবং তিনি তার বড় বু র সাথে শেষ দেখা করতে পারেন নি - তখন আমি আহত হই। আহত হই নিজের স্বার্থপর অনুভূতিহীনতায়, কষ্টহীনতায়। আমার মনে হতে থাকে - আমি যেন নিজেকে লুকোতে চাইছি আমার বাবার কাছে।

মনে করলাম, বছর তিরিশেক-চল্লিশেক পরে আমারও একটা ছেলে থাকবে। আমারও বড় বু মরে যাবে, আমি তাকে কোন দূরদেশে ফোনে বলবো, বাবা, বড় বু মরে গেছে। আমি হয়তো ভাববো, আমার ছেলে খুব কষ্ট পাচ্ছে, হয়তো আমার ছেলে তখন আমার মতোই সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটা চমৎকার গান শুনতে শুনতে দিব্যি গরম কফি বানিয়ে চুমুক দেবে।

।।সেই নদী।।
সেই নদীটা হারিয়ে ফেলেছি। অসময়ে যাকে আশ্রয় করে, যাকে জড়িয়ে এতোটা পথ এলাম। এখন লিখতে পারি না। সেই নদীর গল্প এখন দু-লাইন এগোয়। কিন্তু থেমে থাকে। নদীটাকে খুঁজে পাই না।

--
জুন ২৩, ২০০৯
টোকিও


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- তোমারে ধইরা মাইর দেয়া হবে শ্বশুর পিতাজি। এতোদিন পরে দেখলাম, ভাবলাম একটু রসায়া রসায়া গফসফ করুম ত'না, আইসাই শুরু করলো! আরে চাকরি বাকরি গেলে যাবে, এইটা কোনো ফ্যাক্টর হলো? বসেরা না খেদালে, একদিন সকালে অপিসে গিয়ে গরম কফির মগ নিয়ে বড় বসের রুমে গিয়ে বলবেন, "তোর চাকুরির নিকুচি করি ব্যাটা ছাগল! এই আমি গেলাম।" ফিনিতো!

অসুখ হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু না। আমার আজকে সকালে বাথরুমের আয়নায় নিজের খোমা দেখে মনে হলো, গত ছয়মাসে আমি ঠিক কয়বার জ্বরের কবলে পড়লাম! এইটা একটা গবেষণার বিষয়। যদিও জ্বরটা স্থায়ী হয় না বেশিদিন, কিন্তু তারপরেও জ্বরজ্বর তো অনুভূত হয়! এতে এতো চিন্তা করলে হয়? শরীরকে এতো প্রাধাণ্য দেয়ার কিছু নাই। বেশি করে পরিশ্রম করেন, আরও বেশি বেশি।

মানুষের চলে যাওয়া গুলো এখন এই যুগে অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখানে সেখানে কতো মানুষ টুপ করে মরে যাচ্ছে, কে কোথায় এতো খবর রাখে। এতো সময় কই আমাদের? এভাবেই কেটে যাবে, একদিন নিজেও টুপ করে মরে যাবো, সচলের বাম দিকের কোণায় দাঁত ভেটকানো একটা ছবি হয়তো ঝুলবে, এলিজি ফেলিজি হবে। কিন্তু মোটা ঘটনা ঐ, হাতে থাকবে গরম কফির মগ, আঙুলের চিপায় ধরা থাকবে দামী সিগারেট কিংবা হাভানা চুরুট। এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম। জীবন হালায় বহমান!

সবাই মনের মধ্যে একটা করে বিশাল নদী বয়ে বেড়ায়। সবাই...। এটা অপ্রকাশিত থাকাই শ্রেয়।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

ভুতুম এর ছবি

লেখাটা আর এই মন্তব্যটা মিলে মনটা ক্যামন যেন হয়ে গেলো। জীবন হালায় আসলেই বহমান...

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

"সবাই মনের মধ্যে একটা করে বিশাল নদী বয়ে বেড়ায়। সবাই...। এটা অপ্রকাশিত থাকাই শ্রেয়।"
কেনো ধুগো? প্রকাশিত হলে কি হয়? খুব কাছের মানুষটাকেও কি এই নদী দেখাতে নেই?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- কাছের মানুষকে সেই নদী দেখাতে অসুবিধা নেই মোটেও। কিন্তু কে এই কাছের মানুষ। দেখেন সৌরভ তাঁর লেখাতেই কিন্তু বলেছেন আমরা আসলে দূরে সরে গেছি বা যাচ্ছি, যেকোনো বন্ধন থেকেই। এখন কথা হলো, যাকে কাছের বলে ভাবছি, সে কি আসলেই কাছের? তাঁর কাছে কি 'বলা কথা'গুলো ঠিক ততোটাই 'আদরে' রক্ষিত হবে যতোটা আছে আমার ভেতরে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

নিবিড় এর ছবি

অনেকদিন পর আপনাকে দেখা গেল। আশা করি দ্বিপদ সময়ের বাইরে থেকে আমাদের জন্য কিছু সময় বের করবেন। ভাল থাকবেন।


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

কীর্তিনাশা এর ছবি

অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম।

আর কিছু বলতে পারছি না, মনটা বিষণ্ন হয়ে গেছে তাই..................

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হুমম!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অনেকদিন পর, সৌরভ।
অনুভূতিগুলো আসলে ভাবায়। ছুঁয়ে গেলো খুব।
ভালো থাকবেন, আর মাঝে মাঝে সচলের দিকে একটু ফিরে তাকাইয়েন। হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনীক আন্দালিব এর ছবি

অসাধারণ। কারণ সাধারণ মানুষের জীবনের এক একটা দিন, এক একটা মুহূর্তের মধ্যে সব সৌন্দর্য, বিষাদ গাঢ় হয়ে জমা থাকে। আজকে তার এক ঝলক চোখে পড়লো। মন বিপন্ন হয়ে গেল। ভালো লাগল।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এটাই সৌরভ।
সৌরভ এরকমই লিখেন।
সৌরভ মন খারাপের কথা লিখেন
বিষন্নতার কথা লিখেন।

যাপিত জীবনের দীর্ঘশ্বাসের কথা লিখেন...
এমন ছিমছাম দিনলিপি, শুদ্ধ ব্লগিং বিরল।

সৌরভ কি জানেন, তার লেখার জন্য কতোজন অপেক্ষায় থাকে?

তানবীরা এর ছবি

শিমুল এর সাথে একমত।
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

রানা মেহের এর ছবি

শিমুলের অপেক্ষা করার তালিকায় আছি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

কায়েস এর ছবি

আমার অনেক বিষন্ন সন্ধা কেটেছে আপনার ব্লগ পড়ে। প্রতিটা লেখা পড়ার পর আমার একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা হয়।।।।

Brishtibilashini এর ছবি

ছুঁয়ে গেলো খুব। ভালো থাকবেন।

মাসুদ সজীব এর ছবি

বিষন্নতার আবেশে যাপিত জীবনের অব্যক্ত কথাগুলো পড়তে পড়তে মনও ডুবে যায় বিষন্নতায়। সৌরভ, দা সচলে আপনাকে দেখিনা কতকাল হলো? মন খারাপ

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।