মা কে মনে পড়ে আমার, মা কে মনে পড়ে। আমি মাঝেমাঝে একা জলকবিতা বুনি। আমি একটা আধা-পাগল স্মৃতিকাতর মানুষ।
১.
ছোটবেলায় আমি পাঁকে পড়ে গিয়েছিলাম। পদ্মায়।
সেইবার, যেবার অনেক পানি হয়েছিল নদীটায়, টি-বাঁধ বন্ধ করে দিয়ে দিনে রাতে বিডিআর এর গাড়ি টহল দিতো বাঁধের উপরে। ঠিক সেইবার, বৃষ্টির মৌসুম শেষে পানি নেমে যাওয়ার পর বেড়াতে গিয়ে। যতই উঠতে চাই কাদা ছেড়ে, ততই টেনে ধরে কে যেনো। অনেক কষ্টে চিৎকার দিই, অভিকর্ষ বলকে পরাহত করতে পারি না, পায়ের সাথে স্যান্ডেলের স্পর্শ খুঁজে পাই না।
মায়ের নরম মুখটা মনে পড়ে, আবার জোরে চিৎকার দিই, আল্লাকে ডাকি, স্কুলের ধর্ম শিক্ষা বই থেকে শেখা যতো দোআ মনে পড়ে, সব বলতে থাকি। দূরে লুঙ্গি মালকোচা মারা মানুষের বিন্দু বড় হতে থাকে, একটা অচেনা মানুষ এসে আমায় তোলে। ধমক-টমকও দিয়েছিল বোধহয়।
তারপরও আমি নদীটাকে ভালবাসতাম। সেই বছরেই পানি বেড়ে যাওয়ায়, টি আকৃতি বাঁধের মাথার অংশটুকু সেই যে বন্ধ করে দিলো, আর খুললোইনা কখনো।
২.
আমার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে প্রথম ট্রেন ভ্রমণের আবছা যে স্মৃতিটুকু সংরক্ষিত, তাকে আমি পুরনো ডায়রির পাতার মতো মাঝেমাঝে খুলে দেখি।
একটা অদ্ভূত দৃশ্য। একটা বাচ্চা, একজন নারী, একজন পুরুষ। আমি, আমার মা ও বাবা।
আমার মা প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর। বাচ্চার দিকে খেয়াল দেওয়ার সময় নেই তার। বছর চারেকের বাচ্চা মানুষটা বিহ্বল ও অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের এই চেহারা সে কখনো দেখেনি।
(বাচ্চাটি বড় হয়ে শুনেছিল, তার মায়ের অসুখ করেছিল ভীষণ, আর তাদের ভ্রমণ ছিল উত্তরের অজপাড়াগাঁ থেকে রংপুর নামের শহরে, চিকিৎসার জন্যে।)
তার পরের বছর সেই বাচ্চাটি হঠাৎ একদিন দেখে, তাদের বাড়ির সব জিনিষপত্র ট্রাকে তোলা হচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা মায়ের হাত ধরে কান্নাকাটি করছে, শান্ত-শীতল মা সবাইকে বলছেন - তিনি আবার আসবেন। বাবা বাড়ি দেখাশোনার জন্যে মামাদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত। তারপর ধূলো উড়িয়ে সেই ট্রাকটায় চড়ে সবাই মিলে হাজির হই একটা মফস্বল শহরে।
পঞ্চগড়, না শহর না গ্রাম - একবারে ধূলো ওড়ানো মফস্বলে চেহারা। করতোয়া নদী চিরে গেছে যার বুক। অনেকবড় একটা বাড়ি, অনেক গাছপালা, আম কিংবা অন্যকিছু। একদঙ্গল ভাই-বোন, সবাইকে আগলে রাখে সেই মমতাভরা মুখ। ছয়জনের মাঝে একেবারে ছয়নম্বর - সেইজন্যেই বুঝি আমাদের গল্পের বাচ্চাটা বড্ড বেশি মা-ন্যাওটা। তারপরও বাবা জোর করে শীতমাখানো সকালে করতোয়া নদীর উপরে ব্রীজে নিয়ে যেতেন, হিমালয় দেখবার জন্যে। রাশভারী বাবার আঙুল জড়িয়ে ছোট বাচ্চাটি হিমালয় দেখার চেষ্টা করে - আর, ভোরে বাইরে গেলে, ভাঁপা পিঠা কিংবা খেজুর রস নিয়ে বাড়ি ফেরা তো আছেই।
কিন্তু, সবচেয়ে বেশি ভাল লাগতো বাবার খসখসে আঙুল জড়িয়ে নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে।
নদীর জন্যে ভালবাসা সেই থেকে শুরু।
পঞ্চগড়ের মফস্বলে থাকা হয়নি বেশিদিন। তারপর রংপুরে অল্প সময়। সবশেষে এসে পড়ি পদ্মা পাশ দিয়ে নেচে নেচে চলে যাওয়া এই শহরটায়। রাজশাহীতে। ততদিনে হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরে বাইরে বেরিয়ে পড়ার বয়স হয়ে গেছে সেই পিচ্চি ছেলেটার।
৩.
পদ্মার ধার ধরে আমি হাঁটতাম।
বুড়োদের মতো। উদ্যমী সকাল অথবা বিষন্ন সন্ধ্যা কাটে আমার ভালবাসার নদীকে ঘিরে। আমার সব দুঃখ মুছে যায় চিকচিকে চাঁদের আলো পড়া জলধারার দিকে তাকিয়ে থাকলে।
তিন-চারঘন্টা টানা বৃষ্টি হলে শহর ডুবে যেতো, আমি থপথপ করে শব্দ তুলে স্কুলের পথে হাঁটা ধরতাম, কাদা মেখে ভিজে ফিরতাম। মা বকতো না। সে শহর বদলে যায়, অনেক ড্রেন তৈরি হয় শহর জুড়ে। আর কাদা হয়না, পানিতে ডোবেনা। শহরে আরো অনেক কিছুই পাল্টায়।
কেবল আমার নদী পাল্টায় না, আমার ভালবাসাও নয়।
আমার মা ও নয়। মায়েরা বদলায় না কেন যেনো।
আমার মা আমাকে কখ্খনো বকে না। আমার মায়ের নরম মুখছবি আমি কঠিন হতে দেখিনা। ১৮ বছর বয়েসে যখন আমি স্বার্থপরের মতো দেশকে ঠেলে বিমানবন্দরের কাঁচের দরজার মুখে মেটাল ডিটেক্টরের বাধাটা পেরিয়ে আসি, তখনও দেখি কাঁচের ওপারে নরম মুখ, জল ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা তাঁর মাঝে। নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে।
৪.
এই গ্রীস্মের কোন এক সন্ধ্যার কথা। আমি ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে আমার বিদ্যাপীঠ থেকে বাসায় ফিরি ও ফোন তুলে নিয়ে প্রায় চারদিন পর নিজের আত্মজনের খোঁজ নেবার আপাত-ব্যর্থ চেষ্টা করি। নরম মুখচ্ছবির সেই কণ্ঠ শুনতে পাই ওপারে। আমার ক্লান্তি কেটে যায় অনেকটা, কিন্তু মনটা খচখচ করতে থাকে।
১৯ বছর আগের ট্রেনে সেই বাচ্চা মানুষের স্মৃতিকোষগুলোতে যে মুখছবি রাখা, ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে শব্দের যে ছবি তার সাথে মেলেনা।
অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পারি, আমার জনক ভালো নেই। আর এবারের আঘাতটা মস্তিষ্কে। শরীরে জেঁকে বসা হৃদরোগ আর ব্লাড সুগারের বিভ্রাট জনিত সমস্যাগুলো তো আগে থেকে আছেই । অপরাধবোধের অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরে। যে সময়ে আমার যেখানে থাকা উচিত, আমি সেই সময়ে সেখানে থাকতে পারিনা।
শান্ত জলধারার নদীর কান্না আমি শুনি। শুধু শুনেই যাই।
আমি এই পরবাসে সুখী মানুষ ও সুখের অভিনয় করে যাওয়া মানুষদের দেখে মুগ্ধ হই, নিজেও সুখের রেসিপি খুঁজি।
তাই আমার সময় হয়না নদীর ডাকে সাড়া দেবার, জননীর পাশে বসে থাকার। এই পাথুরে নগরে আমি খুব স্বাভাবিক নাগরিকের মতো একেকটা দিন পার করতে থাকি।
আমি অনুভব করি, সেই যে পাঁক - ছেলেবেলায় আমায় মুক্তি দিয়েছিল, ধীরেধীরে আমি নিজেই সে পাঁকে তলিয়ে গেছি, স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করেছি সেই পরিণতি।
শুকিয়ে গেছে আমার, ছেলেবেলার ভালবাসার নদী।
২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭
মন্তব্য
ছবিগুলো কত জীবন্ত! দারুণ। একটানে পড়লাম!
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কৃতজ্ঞতা বলাই দা।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
সুন্দর। সুন্দর এবং বিষন্ন। অনুভূতি আটকে আসছে আমার... ভাল থাকুন সৌরভ ভাই।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
অনুভূতিগুলো ছেড়ে দাও কোন লেখায়।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
এইটা পড়ে আমার যে কত কিছু মনে পড়ল...
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হুমম।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আমার এক্ষুনি দেশে ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে । নদীর সাথে বোধ হয় এইভাবে কথা বলা যায়না ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
নদীর কথা বোঝা যায়। ইচ্ছে করলেই বোঝা যায়।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
বরাবরের মতোই সৌরভ সংলাপ।
আচ্ছা, সৌরভ - একটা মন খারাপ করা জোকস বলেন তো, শুনি।
লমুশি য়ামি, তএ ক্তরবি নারেক। মিআ ন্তুকি লতবো নজ্জ্বি।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
রুগু ভরসৌ, লতবো নজ্বি যে নিপআ, টাসে ইকঠি মলাছিঝেবু। কেনাপআ মলাছিলেব - টাকএ নম পরাখা রাক কতুকৌ তেলব। নবেলব?
মিআ লেইতা টাকএ নম পরাখা কতুকৌ লিব। সে মক্রিসইআ রয়াওখা ত্রামা য়েড়িবা ছেয়েদি।
জাপানি ভাষা শিখে গেছি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
নতুন মন্তব্য করুন