স্কুলবেলা

স্পার্টাকাস এর ছবি
লিখেছেন স্পার্টাকাস [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০১/০৫/২০১০ - ১১:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(আমার স্কুলের নাম “জিয়া সার কারখানা কলেজ” । সম্প্রতি বাড়ি গিয়ে দেখি স্কুলের নাম মুছে ফেলেছে, ওখানে লেখা হবে “আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার এন্ড ক্যামিকেল কলেজ”। সরকার এসে হয়ত এক চুটকিতে নাম পরিবর্তন করে দিতে পারে, কিন্তু আমরা যারা গড়ে উঠেছি এই স্কুলে, চলতে ফিরতে, হাতের লেখায় বা ছাপা কাগজে, সুখ বা দুঃস্বপ্নে, স্মৃতি কাতরতায় উঠে আসবে পুরনো নামটিই। জিয়া নামটির মধ্যে হয়ত রাজনৈতিক গন্ধ আছে, কিন্তু যে স্কুলের নাম গত বাইশটি বছর ধরে হৃদয়ে গেঁথে আছে, তাকে কিভাবে সরাই? লেখা খাপছাড়া হয়েছে, কিন্তু কি করব, স্মৃতিতো আর তারিখ মেনে লাইন ধরে আসে না।)

সবাই প্রথম স্কুলে যায় বাবা বা মায়ের হাত ধরে। আর আমাকে স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল এক অপরিচিতের হাত ধরে। আব্বু অফিস থেকে ছুটি নিতে পারেনি, আর আম্মুর রান্নাবান্না, ঘর গোছানো- কত কাজ। তাই আব্বুর এক সহকর্মীর হাত ধরে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল পরীক্ষা দিতে, যাকে আগে কখনো দেখিনি। তার একটা আঙ্গুল ধরে যখন প্রথমবারের মত স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকলাম, তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল জানি না, শুধু মনে আছে আশেপাশের সবার সাথে তাদের বাবামা’কে দেখে অভিমানে গাল ফুলিয়ে ছিলাম পুরোটা সময় আর পরীক্ষা শেষে আঙ্কেলের চোখ ফাঁকি দিয়ে একা একা বাসায় চলে এসেছিলাম।

কলোনির স্কুলে কেজিতে ভর্তি হওয়ার জন্য পাস-ফেল কিছুর দরকার নেই, শুধু পরীক্ষা দিলেই হল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ব্যাপারটা আমি জানতে পারি তারো অনেক বছর পর আমার বোনের ভর্তি পরীক্ষার সময়। ওই বিরূপ পরিবেশে বাবামা’র সহযোগীতা ছাড়াই পরীক্ষা দিয়ে কতজনকে পেছনে ফেলে স্কুলে ভর্তি হতে পেরে যে গোপন গর্ব আমার মধ্যে কাজ করত, তা সেদিনই শেষ হয়ে গেল।

কেজি ক্লাসের কিছু কিছু ঘটনা মনে আছে। ক্লাস করার সময় দেখতাম বেঞ্চে কারো কারো পাশে তাদের মা বসে আছে, ম্যাডাম ক্লাসে কি লিখতে দিল তা দেখিয়ে দিচ্ছে। আমার মা’ও মাঝে মাঝে আসত। যেদিন আসত, সেদিন আমার খুশি দেখে কে। ক্লাসে কিছু লিখতে দিলে লেখা শেষ করে আগে বারান্দায় ছুটতাম। বারান্দায় মা আর অন্যান্য আন্টিরা দাঁড়িয়ে থাকত। মা’কে দিয়ে কারেকশন করিয়ে তারপর ম্যাডামকে দেখাতাম। কেজি ক্লাসের মজাটা এখানেই, স্যার ম্যাডামরা কোন কিছুতেই কিছু বলে না। কারন বাচ্চাদের কাছে যে অস্ত্র আছে- কান্না, সেটা সামাল দেয়ার দেয়ার ক্ষমতা বাবামা ছাড়া আর কারো নেই।

একদম পিচ্চিকাল থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমাকে পড়িয়েছে আমার মা। নিয়মিত শাস্তির দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকত আয়নায় ঝোলান হ্যাঙ্গারগুলো। হ্যাঙ্গারের মার খেয়েছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। ক্লাস এইট পর্যন্ত চলেছে হাত আর বেলনের মার। তারপর থেকে আর মারে না, অপরাধ করলে চলে মানসিক শাস্তি। মা আমার সাথে কথা বন্ধ করে দেয়। আমিও কিছুসময় ভাব ধরে থাকি, তোমার সাথে কথা না বলে আমার দিব্যি চলছে। আর মনে মনে বলি, আল্লার রহমত- রান্না বন্ধ করে নাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকেই হার মানতে হয়। কি করব, আমার নিত্য দিনের সব দাবিদাওয়া তো মা’র কাছেই করতে হয়। এখনো বাসায় সে সময়কার ভাঙ্গা হ্যাঙ্গারগুলো আছে।

কেজি ক্লাসে ফিরে যাই। তখন আমাদের স্কুলে ফ্রি খাতা দিত, স্কুলের লোগো দেয়া। সেই খাতাগুলোর একটাও এখন সংগ্রহে নেই। ক্যালেন্ডার দিত। আর বইতো ফ্রি ছিলই। ক্লাসে চলত সমবয়সীদের সাথে দুস্টামি, হাজার হোক আমি পিচ্চি মানুষ, ম্যাডাম গায়ে হাত তুলবেন না। ম্যাডামও মাঝে মাঝে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে(বেঞ্চে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখা) বারান্দায় চলে যেত আন্টিদের সাথে গল্প করতে। তখন তো আরো মজা। মাথা উঠিয়ে কাগজের ঢিল বানিয়ে ছুঁড়তাম বন্ধুদের মাথায়, তারপর আবার বেঞ্চে মাথা দিয়ে ঘুম।

কেজি ক্লাসের আর কোন ঘটনা মনে পড়ছেনা। ক্লাস ওয়ান কেজির মতই কেটেছিল, তবে মনে আছে ক্লাস ওয়ানে দুটি ঘটনা ঘটেছিল। একটি হল- হেডস্যার অভিভাবকদের স্কুলে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করল, এতে আড্ডাবাজ আন্টিরা মনে খুব কষ্ট পেল। মা কখনই আড্ডাবাজ ছিল না। আমার চাপে পড়ে আর যেতে হবে না বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দ্বিতীয়টি ছিল- কোন এক ড্রইং পরীক্ষায় আমি প্রশ্ন না দেখেই ছবি এঁকে দিয়ে এসেছি। পরে দেখি প্রশ্নে অন্য জিনিষ। আমি কি করব, সামনের সিটে বসা বন্ধুকে দেখেছি কম্পাস দিয়ে বৃত্ত এঁকে পুরোটা এক রঙ করছে। আমি ভাবলাম বৃত্ত এসেছে, তাই আমিও বৃত্ত এঁকে চলে আসলাম। পরে বাসায় মা বলার পর দেখি প্রশ্নে লেখা ফুটবল। সেদিন মনে আছে মা আমার পেন্সিল বক্স ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, হ্যাঙ্গার পিঠে পড়েছিল কয়েকবার, আর বাবা ঠেকাতে এসে ঝাড়ি খেল। বাবা আমার পড়াশুনার ধারে কাছ দিয়েও কখনো যেত না, তাই পড়াশুনার জন্য মা শাস্তি দিতে এলে বাবাই ঠেকাতো সবসময়।
(চলবে)


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

ওঁয়া ওঁয়া

====================================
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
=====================================

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

স্পার্টাকাস এর ছবি

কান্নার কি হইল?

----------------------------------------
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

তিথীডোর এর ছবি

নিয়মিত ধোলাই খেতেন দেখা যাচ্ছে! দেঁতো হাসি
আমার মা অফিসের চাপে সময় পেতেন না, ছুটির দিনগুলোতে পুরো হপ্তার পাওনা উসুল হতো... মন খারাপ

লেখা চলুক...

====================================
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
=====================================

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ওডিন এর ছবি

কেজি ক্লাসের মজাটা এখানেই, স্যার ম্যাডামরা কোন কিছুতেই কিছু বলে না। কারন বাচ্চাদের কাছে যে অস্ত্র আছে- কান্না, সেটা সামাল দেয়ার দেয়ার ক্ষমতা বাবামা ছাড়া আর কারো নেই।

সঠিক অবজারভেশন।

আমি প্লেগ্রুপে ক্লাশ করেছিলাম মোট দেড়দিন, বাড়ির পাশের এক টিউটোরিয়ালে, দ্বিতীয় দিন ব্রেকের সময় একা একা চলে আসি- দেড়দিনেই বুঝে গেছিলাম স্কুল আমাকে কিছুই শেখাতে পারবে না। পরের দশটা বছরে ধারণাটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছিলো। দেঁতো হাসি

______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

সাবিহ ওমর এর ছবি

ওহ হ্যাঙ্গার একটা বিভীষিকা! অবশ্য ওটার বাড়ি বাবার হাতেই বেশি খেয়েছি। আম্মা মারলে হাত দিয়েই...

আহা কতদিন মার খাইনা খাইছে

রানা মেহের এর ছবি

আচ্ছা মায়েরা তাদের চরম মন খারাপের সময়ও রান্না বন্ধ করেনা কেন?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তাসনীম এর ছবি

চলুক স্কুলবেলা, শৈশবের গন্ধ সবসময় মধুর হয়।

++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখা ভাল্লাগলো।

নার্সারি থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আমি ব্যাপক ধোলাই খেয়েছি। মন খারাপ

-----------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ফারুক হাসান এর ছবি

পোস্ট অতীব উপাদেয় হয়েছে। হাসি

আশুগঞ্জ সার কারখানায় গিয়েছিলাম ২০০৪ সালে সম্ভবত। একমাসের ট্রেনিংয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্ট সেখানে পাঠিয়েছিল। আমাদের গ্রুপে ছিলাম আটজন। খুব মজায় সময় কেটেছিল। আমাদের থাকতে দিয়েছিল গেস্ট হাউজে, সার কারখানার কলোনীর পাশেই। ওখানকার লোকজন খুবই অতিথিবৎসল, কলোনীর অনেক বাসাতেই দাওয়াত খেয়েছি আমরা।

স্পার্টাকাস এর ছবি

বুয়েট আর আইইউটি'র মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট তাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে জিয়া সার কারখানায় যায় প্রতি বছর।

-------------------------------------
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

মর্ম এর ছবি

স্কুলের পর কলেজেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পড়লেও খুব কাছের এক বন্ধু চলে গিয়েছিলো জিয়া ফার্টিলাইজারে। ওর সুবাদেই দুয়েকবার যাওয়া হয়েছে ওখানে।

কেনো জানিনা কলেজটাকে বেশ জেলখানা জেলখানা লেগেছিলো! অবশ্য কলেজ সম্পর্কে বন্ধুটির ধারণাদান এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলো হয়তো।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

স্পার্টাকাস এর ছবি

চারদিকে ঘেরাও বলে কি জেলখানা মনে হয়েছে? আফসুস!
নিয়ম যত থাকবে, নিয়ম ভাঙ্গার মজাও তত বাড়বে দেঁতো হাসি

----------------------------------------
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

ব্লগ_পাঠক [অতিথি] এর ছবি

বন্ধু স্পারটাকাস খুবই ভাল লেগেছে তোমার লেখা টা, স্কুল কলেজ জীবনের কথা মনে পরে গেল.........

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমিও একবার গিয়েছিলাম, ৮০ সালে, তবলীগের চিল্লায়। সেখানকার মসজিদে কয়েকরাত ছিলাম। সেসময় মনে হয় স্কুল তৈরী হয়নি। চারদিকে থৈ থৈ বন্যার পানি। সেখান থেকে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন মসজিদে নৌকায় আসার সময় তব্লীগের আমীরের সাথে মনমালিন্য হওয়াতে নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছিলাম পানিতে, এরপর সাঁতার কাটা অবস্থায় অন্য নৌকা এসে আমাদের বিশ জনের দলটিকে পাড়ে নিয়ে আসে। সে অবস্থায় ভেজা আর এক কাপড়ে আশুগঞ্জ সাইলোর মসজিদে আমাদের জায়গা হয়েছিলো, সে এক মজার অভিজ্ঞতা।

...........................
Every Picture Tells a Story

স্পার্টাকাস এর ছবি

চরম কাহিনীতো, দ্রুত লেখা ছাড়ুন।

---------------------------------
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।