ছোটকাকুর সাথে বাইরে বেরহলে অদ্ভুত সব জিনিস দেখি- ইউক্যালিপ্টাস বন, ব্রডগেস লাইন, জোড়া দিঘি আর জটাধারী বট। হয়তো কোনো একদিন বিকালে এসে বলবে, ‘চল তেপান্তরের মাঠ দেখে আসি’। আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলে, তুলে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে বলবে, ‘শোন, শক্ত করে ধরবি, আর সাবধান, পা যেন যায় না চাকার মধ্যে! সব চেয়ে ভালো হয় যদি পা দুটো অ্যারোপ্লেনের পাখার মত ছড়িয়ে রাখিস।’ ছোটো কাকুর সাইকেল আমাকে ছোটো রাস্তা, বড়ো রাস্তা আর বিলের ধার ঘেসে নিয়ে যেতে থাকে তেপান্তরের মাঠের দিকে। তখন সাইকেলটাকে একটা পক্ষিরাজ, নিজেকে ডালিম কুমার আর দুপাশে ছড়িয়ে রাখা পা দুটোকে পক্ষিরাজের ডানা মনে হয়। ডালিম কুমারের পা কেন পক্ষিরাজের ডানা হবে, সে কথা অবশ্য মাথায় আসে না আমার। তবে একসময় ডানায় ব্যাথা শুরু হলে আমি যখন তাদের একটু একটু করে গুটিয়ে নেই, তখনই একটা গ্রামের বাক ঘুরে পৌছে যাই তেপান্তরের মাঠে!
মাঠে বাঁধা ছোট্ট ছাউনি দেওয়া মাচায় দুজন চুপ করে বসে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর, সূর্য ঢলে পশ্চিমের আকাশটা লালচে হলে, যখন পাঁচটা বক সারবেঁধে এসে সূর্যটাকে স্যালুট দিয়ে যায়। আর ঝুলে থাকা পায়ের নিচে কতগুলো ধানের চারা এসে বিলিকাটতে থাকে, তখন কাকু জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, কেমন লাগে?’ সেসময় বুকের মধ্যে যে ঝড়, যে বৃষ্টি, যে বিজলি আর যে খরার মিশ্র অনুভুতি হয়, সেটার কোনো নাম দিতে পারিনা আমি। বলি, ‘মায়া লাগে’। কাকু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর মুচকি হেসে বলে, ‘মায়া লাগে কার জন্যরে বোকা?’...। কী জানি, হয়তো ওই কাকতাড়ুয়ায় বসা ফিঙে, নিড়ানি হাতে কৃষক, সেচের নালা, অথবা, ওই লালচে তুলা মেঘগুলোর জন্যই মায়া লাগে খুব। সেসব কথা বলা হয়না আমার। শুধু বুকপকেটে সেই মায়াটুকু নিয়ে বাড়ি ফিরি।
তারপর সেই মায়াটা আমাকে ছেড়ে যায় না আর। একবার মাঝদুপুরে টিপ-টিপ বৃষ্টি থেমে গেলে যখন নারকেল পাতারা চক চকে তলোয়ারের মতো তাদের ফলা ঘোরাতে থাকে। আর সবচেয়ে দূর থেকে ভেসে আসা আজানও থেমে যায়। কাকু এসে বলে, ‘চল একটা মজার জিনিস দেখে আসি’। সেবার কাদা পথ মাড়িয়ে আমাকে নকশি দেয়াল ঘেরা এক অদ্ভুত যায়গায় নিয়ে যায় সে। সেখানে সারি সারি মানুষ ঘুম-ঘুম চোখে বসে সুর করে বলা অজানা ভাষার কথা শোনে। আর বড়ো বড়ো নকশি করা কলামের উপর দাঁড়িয়ে থাকে গোলাকার ছাঁদ। চুপি চুপি কাকু বলে, ওটা গম্বুজ। সেই গম্বুজের নিচ থেকে সারি সারি পাখা ঝুলে শো-শো ঘড়-ঘড় শব্দে বাতাস করতে থাকে সবাইকে। সেখানে কারো কথা বলা মানা।
তারপর একসময় সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলে ছোটোদের যখন পিছনের দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর মানুষগুলো মুখের কাছে একটা আঙুল নিয়ে শুষস...স করে আমাদের চুপ করতে বলে। তখন বুকপকেটের সেই মায়াটা, কো-থেকে ওই নকশিদেয়াল ঘেরা যায়গায় উড়ে আসা একটা দোয়েলের পাখায় ভর করে। সেই অজানা ভাষার দুখি-দুখি সুরটা ভেসে আসতে থাকে। আর দোয়েলটা নকশি দেয়াল, গম্বুজ আর ঝুলন্ত পাখার মধ্যে ছটফট করতে করতে বাইরে যাওয়ার পথ খোঁজে। অবশ্য সেদিকে খেয়াল হয়না কারো। পাচিলের মতো দাঁড়ানো সারি-সারি মানুষ সেই অজানা সুরের সাথে সাথে কেমন যেন দুলতে থাকে। আর আমার চোখ, সেই পাচিল টপকে খুঁজতে থাকে সেই দোয়েলটাকে। কিন্তু সামনের সেই উচু উচু মানুষগুলো পার হয়ে তখন আর কিছুই দেখা যায়না। ফ্যানের ঘড়-ঘড় ছাপিয়ে দোয়েলের ছটফটানি কানে আসে শুধু।
তারপর একসময় হুঠ করে সেই সুরটা থেমে গেলে সবাই কেমন নিচু হয়। তখন সেই নকশিদেয়াল ঘেরা অদ্ভুত যায়গাটা একটা খুব বড়ো মাঠ হয়ে যায় যেন। সারি ধরা পাচিলগুলো ভেঙ্গে পড়ে, আর সেই রঙবেরঙের পিঠগুলো মিলে যেন একটা বিশাল কার্পেট হয়ে জড়িয়ে থাকে পুরো মাঠ। একলা দাঁড়িয়ে দোয়েল খুঁজতে থাকা নিজেকে তখন বড়ো বেশি একা লাগে।
তখন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই বুঝি, মেঝের মোজাইক পাথরগুলো সাদা পিঁপড়া কালো পিঁপড়া আর লাল পিঁপড়া হয়ে, গুর-গুর করে হাটতে থাকে পায়ের চার পাশে। গম্বুজের মধ্যে আটকা পড়া দোয়েলটা এদিক ওদিক পথ খোঁজে। আর তখন নকশি দেয়ালের জানালা দিয়ে দুটো কলাপাতা হাত নেড়ে, “এইযে! এদিকে...” বলে ডাকতে থাকে তাকে। কিন্তু নিচের ঘড়-ঘড় করা রাগী ফ্যানগুলো তাদের ঘূর্ণিব্লেড হাতে পাহারাদেয় সে পথ। বোকা দোয়েলটার জন্য কষ্ট লাগে খুব। একবার মনে হয়, সেই রঙবেরঙা মানুষের কার্পেট মাড়িয়ে এক দৌড়ে গিয়ে বন্ধ করে দিই সব ফ্যান। কিন্তু তা করা হয়না। তখন নিজেকেও যেন সেই দোয়েলটার মতোই বন্দি লাগে। পাশের ছেলেটা জামা ধরে টান দেয়। ইশারায় আমাকেও নিচু হতে বলে। সেসব খেয়াল হয়না আমার। একটা অজানা আশঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে থাকি দোয়েলটার দিকে। চোখ সরালেই যদি ওটা কাটা পড়ে ঘুর্ণিব্লেডে! অপলকে তাকিয়ে থাকি তাই। ছেলেটা আবারো টান দেয় জামায়।
একসময় দোয়েলের দুয়েকটা পালক খসে আসতে থাকে নিচের দিকে। সেই সুরটা আবারো শুরু হয়। কার্পেট মানুষগুলো আড়মোড়া দিয়ে উঠে পাচিল বানাতে থাকে। মোজাইকের পিঁপড়ারা লুকায় সেই সাদা-কালো-লাল পাথরের মধ্যে। আর জানালার কলা পাতা, শেষবারের মতো “এই যে...” ডেকে চুপ করে যায়। তখন বুকপকেটটা আবার ভারী হয়ে যায় যেন। সেই মায়াটা দোয়েলের পাখা ছেড়ে ফিরে আসে সেখানে। তারপর জামা ছিড়ে বুকের মধ্যে একটা খামচি দিয়ে দিলে, আমার মনে হয়, এমন কেউ কি নেই যে বাঁচিয়ে দেবে দোয়েলটাকে? পাচিলটা দাঁড়িয়ে যায়। আমি হাত বাড়াই বাতাসে ঝুলতে থাকা সেই পালকগুলোর দিকে। কিন্তু সেই রাগী ফ্যানগুলো ফু দিয়ে, তাদের তাড়িয়ে দেয় দূরে। উচু পাচিলের ওপারে। তখন আবারো, আমার খুব মায়া লাগে।
মন্তব্য
ওফ! কাজ সেরে উঁকি দিতে এসে ভোররাতে এমন প্রাপ্তি! ভীষণ ভালো লাগলো। এবার ঘুম এলে হয়!
আপনিতো দেখি কর্মবীর আবদুল কালাম কেও হার মানাবেন! ভোররাত পর্যন্ত কাজ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আর বলবেন না, টিমে আরেক বেটি ছিলো সে কসমেটিক সার্জেন প্রায়, কোনো ইনপুট না দিয়ে শুধু রিপোর্টের ফন্ট মার্জিন এই সব নিয়ে কমেন্ট পাঠিয়ে খালাস! অগত্যা ডেডলাইন সামলাতে রাত্রিজাগরণ। (ইহাকে কেহ নারীবিরোধী কমেন্ট ভাবিবেন না, কন্যাটি এমনিতে ভালো, কাল কোনো কারণে ছড়াইয়াছিলো)।
আমার বেশি ভালো লাগলো প্রথম তিনটে প্যারা। মায়াময় ছবি আর এমন সব বাক্যবন্ধ যে নেশা ধরে যায়!
ঠিক, শেষের দিকে কেমন তাল কেটে গেছে।
নাহ, আবার ট্রাই দিতে হবে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কী চমতকার একটা লেখা স্পর্শ
কী অদ্ভুত কথা
বসে আছি খটখটে দুপুরের পাশে
আপনার লেখাটা একটানে কোন একটা নির্জন ভোরে নিয়ে গেল
এরকম লেখা যেন থামেনা কখনো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আসলে দেখতে চাচ্ছিলাম একটা শিশুর কাছে দেশ/দেশপ্রেম কিভাবে ধরাদেয়।
আর দেখতে চাচ্ছিলাম একটা শিশুর কাছে প্রার্থনা কতোটা অর্থহীন/নিষ্ফলা হতে পারে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাহ্! খুব চমতকার লেখার হাত আপনার! ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ছোটবেলায়।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
মনের মাঝে হাজার শিশু লালন করি। আপনার মন্তব্যে তারা খুশি।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
চলুক
চরম!!!
আমি দুপুরেই পড়ছিলাম লেখাটা। মায়াময় লেখা। তবে সত্যি বলতে থিমটা বুঝলাম রাতে আরেকবার পড়ার পর। অসাধারণ। আচ্ছা লেখাটা কি তাড়াহুড়া করে লিখেছেন?
হুমম
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কী চমতকার লেখা! মনের ভিতর কেমন মনকেমনিয়া মায়ারঙ দিয়ে যায়।
গ্যালারি থেকে মাঝে মাঝে না, আপনি পুরাপুরি খেলায় নেমে পড়েন, আপনার লেখাপত্র সত্যি সত্যি আরো বেশী মানুষের কাছে যাওয়া দরকার। আমি সিরিয়াসলি বলছি।
শুভেচ্ছা রইলো।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
গাছে তুলে মই কেড়ে নেবার ফন্দি!!?
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ক্যাম্নে ল্যাখেন যে?
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
কাকার সাইকেলের পেছনে চড়ে রাজকুমার হয়ে আমারো যে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
তুমি আমাদের পার্টিতে আসার আগে এই লেখা লিখছ এই জন্যই কি একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলছ নাকি! মনে হচ্ছে লেখাটা শেষ হয় নাই!
নতুন মন্তব্য করুন