[গোলাম আজমের ফাঁসি না হওয়ায়, আমি, আমরা সবাই ক্ষুব্ধ। এমন অবস্থায় এই হালকা চালের লেখাটা প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে নিলাম।]
আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন এমন একজন লেখক যার রাইটার্স ব্লক কেটে গেছে। টুক-টাক লেখালিখি করেছেন যারা কখনো, তারা সবাই রাইটারস ব্লকের সাথে পরিচিত। যারা লেখালিখি করেন নি কিন্তু পড়েছেন, তারাও অমত হবেন না যে প্রিয় কোনো লেখক ব্লক খেয়ে গেলে কী অপুরনীয় ক্ষতি টাই না হয়ে যায়। যাক গিয়ে এসব গুরুচন্দ্রিকা রেখে আমরা যাই মূল সাক্ষাৎকার পর্বে।
উপস্থাপক- সবার প্রথমে সবচেয়ে ক্লিসে প্রশ্নটা করি। কেমন লাগছে?
লেখক- হঠাৎ করে মনে হচ্ছে বেঁচে উঠলাম। ইন ফ্যাক্ট, এই যে দুদিন আগেই মাথা কুটে মরলেও কিছু লিখতে পারতাম না, তখন কীভাবে বেঁচে ছিলাম সেটাই দুর্বোধ্য লাগছে।
উপস্থাপক- কখন বুঝলেন যে ব্লকটা কেটে গেছে?
লেখক- সেদিন সকালেও যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখনও সব কিছুই আগের মতই ছিলো। মানে, সাদাকালো, মন-মরা এবং একঘেয়ে রকমের বোরিং। মুখে সেভিং ফোম লগিয়ে রেজরে এক টান দিয়েছি অমনি গেল কেঁটে। কিছুটা ব্লিডিংও শুরু হলো। আর তখনই দেখি, আরেহ! রক্ততো আর সাদা-কালো লাগছে না। রীতিমত টকটকে লাল! তখনই বুঝলাম লেখন জটটা কেটে গেছে। ঘরের আর সব জিনিসের রঙও দেখতে শুরু করলাম। এ যে আপনি পরে আছেন সবুজ জামা। কদিন আগে হলেই বলতে পারতাম না, বুঝলেন? হা হা হা।
উপস্থাপক- স্বীকার করতেই হয়, ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আপনি কি অন্যসব জট বেধে যাওয়া লেখকদেরও একই উপায় প্রস্তাব করেন? মানে সেভ করতে গিয়ে গালের কাছে একটুখানি কেটে ফেলা?
লেখক- এহ! এই তো ভুল বুঝলেন। আপনি জিজ্ঞেস করলেন কখন বুঝলাম যে জট কেটে গেছে তাই সেই দিন ক্ষণের বর্ণনা দিলাম।তাই বলে যে সেভ করে করে জট কাটিয়ে ফেলেছি তাতো নয়।
উপস্থাপক- তাহলে বলবেন কি কীভাবে কাটলো?
লেখক- সে এক বিরাট ইতিহাস। ঘরে ছিলো না কেরসিন... কিডিং, আসলে অনেক খাটাখাটনি, ব্যর্থ প্রয়াস ইনভেস্ট করতে হয়েছে ব্লক কাটাতে। তবে আমার মনে হয় মূলত, ব্লক ঘটার কারণগুলো উদ্ঘাটন করতে পারায় এটা সম্ভব হয়েছে।
উপস্থাপক- তাহলে সেই কারণগুলোই বলুন। আমি নিশ্চিত অনেক পাঠক-এবং লেখকই জানতে আগ্রহী এবং উপকৃত হবেন।
লেখক- কারণ আছে অনেকরকম, তার সবগুলোই যে সবসময় কাজ করে তা নয়। এক- বা একাধিকটা একসঙ্গে রীতিমত কোয়ান্টাম সুপারপজিশনে কাজ করে পারে। এবং সেগুলো একেকজনের একেক রকম হয়, আবার একই লেখকের একেক জট হয়তো একেক কারণে বেঁধে থাকে। তবে আমি বলি কি, দুয়েকবার হাতে জট না বাধলে প্রকৃত লেখক হয়ে ওঠা যায় না। সে যাক গিয়ে, আমি কিন্তু এখন বিশাল তালিকা করতে শুরু করবো। আপনি বা শ্রোতারা বিরক্ত হতে পারেন।
উপস্থাপক- না না, ওসব নিয়ে ভাববেন না। রেকর্ডার রেডি আছে। আর আমিও খুব কৌতূহল বোধ করছি। আপনি শুরু করুণ।
লেখক- হুমম, এই ব্লকটাই কিন্তু আমার প্রথম ব্লক ছিলো না। এর আগেও দু-তিনবার খেয়েছি। কখনো ছ-মাস, কখনো বছর দেড়েক! তবে এবারেরটাই সবচেয়ে দীর্ঘ, আড়াই বছর। ফলে রাইটারস ব্লকের উপর রীতিমত বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছি। আপনার সুবাদে সেই জ্ঞান জাহির করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। হা হা হা...
যেমন ধরুন একবার লিখতে লিখতে মনে হলো, আরেহ, আমি তো নতুন কোনো গল্প লিখছি না। স্রেফ লেখার একটা সুখপাঠ্য স্টাইল আবিস্কার করে ফেলেছি। এখন যা লিখি তা-ই পাঠকদের কাছে সুখপাঠ্য লাগে। তারা পড়ে ভালোলাগাটা জানায়। আর মাঝে মধ্যে এক্সপেরিমেন্টালি অন্য রকম লিখলেই বলে, নাহ্ প্রিয় লেখক, লেখাটা ঠিক আপনার মানের হলো না! কিন্তু ততদিনে নিজের কাছেই ওই স্টাইলটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। অতয়েব জট!
তারপর মনে করেন, কীভাবে যেন সমাজ পরিবর্তনের ভূত মাথায় চাপলো। মনে হলো, মহান লেখালিখি করতে হবে। যেসব পড়ে পাঠক বলবে, যাহ শালা, আজ থেকে ভালো হয়ে গেলাম। তারপর দেশ-দশের প্রভুত উন্নতি সাধিত হবে। ভুলে গেলাম যে, গল্পকারের মূল কাজ, অনুভূতি উৎপাদন। কল্পজগত সৃষ্টি। এর মধ্যে যদি কিছু ফিলসফি এসে যায়, সমাজে যদি কিছু তোলপাড় হয়, সেসব বাইপ্রোডাক্ট। বাইপ্রোডাক্টকে উদ্দেশ্য ভেবে গল্প লিখতে যাওয়া আর বালছেঁড়া একই কথা। ওতে না হয় শিল্প, না হয় বিপ্লব...
উপস্থাপক- তাই বলে কি লেখকের কোনো সামাজিক দায়িত্ব নেই? দুঃখিত ইন্টারাপ্ট করলাম।
লেখক- দেখুন "লেখক" বললে ব্যাপারটার ব্যপ্তি বেড়ে যায়। যিনি প্রাবন্ধিক তিনিও লেখক। যিনি নতুন রাজনৈত তত্ত্বলিখবেন, আত্মজীবনি, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি লিখবেন, তাদের সামাজিক দায়িত্ব কিছুটা আছে বৈকি! আমি বলছি গল্পকারের কথা। প্রাবন্ধিক কখনো হস্তজট খেয়েছে বলে শুনেছেন? কিছু একটা নিয়ে ক-পাতা পড়লে, কিছু চিন্তাভাবনা করলেই প্রবন্ধ নামিয়ে ফেলা যায়। ইচ্ছে, সময়, এসব থাকা দিয়ে কথা। কিন্তু গল্পকার একটা কল্পজগৎ সৃষ্টি করছেন। চরিত্রগুলো তৈরি করছেন, তাদের শ্বাস দিচ্ছেন, সুখ-দুঃখ দিচ্ছেন। গল্পকারের একটাই সামাজিক দায়িত্ব, তার সৃষ্ট জগৎটাতে কোনো পাঠক বেড়াতে এসে যেন না ভাবে, সময়টা নষ্ট হলো। তবে হ্যা, কিছু কুলাঙ্গার আছে, গল্পের মধ্যে সমাজে দংগা বাধানোর উপাদান ভরে দেয়, বৈষম্য সৃষ্টিকারী মতবাদে ব্রেইন ওয়াশ করে তার পাঠককে। এসব না করা গল্পকারের নর্ম। অপরদিকে, আমি গল্পের মধ্যে সচেতনভাবে শিক্ষামূলক কিছু ভরে দেবার চেষ্টাকে খারাপ উদ্দেশ্য হিসাবে দেখি না, কিন্তু ওতে অবধারিত ভাবেই গল্পের মানহানি হয়। গল্পরা মামলা করতে পারলে, ওসব লেখকের উকিলের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতেই বাকি জীবন কেটে যেত।
উপস্থাপক- আপনার মতটা মনে হয় বুঝতে পারছি। আচ্ছা আমরা এখন আগের আলোচনায় ফিরি।
লেখক- তো যা বলছিলাম, আরেকটা ভুল গল্পকার করে প্রায়ই। সে ভুলে যায়, যে তার প্রধান পাঠক সে নিজে। নিজের কাছে জুতসই লাগছে না, কিন্তু অনেক পাঠকেরই ভালো লাগবে ভেবে লিখলে, গল্পের আত্মা মরে যায়। আবার নিজের কাছে ভালো লাগছে, কিন্তু পাঠকদের হয়তো ভালো লাগবে না ভেবে না লিখলে, আত্মা মরে যায় গল্পকারের। তখন অবধারিতভাবেই আসে রাইটার্স ব্লক।
উপস্থাপক- তারমানে পাঠকের ভালো লাগা না লাগার কোনো গুরুত্ব লেখক দেবে না?
লেখক- এটা একটা ট্রিকি পয়েন্ট। আপনি যেভাবে প্রশ্নটা তুললেন, তাতে পাঠক-লেখক দু'ই অহেতুক আহত হবেন। আপনাকে বুঝতে হবে প্রত্যেক পঠকই একেকজন ভিন্ন মানুষ। তাদের চিন্তাধারা, চাহিদা, সাধ-আহলাদ, প্রেম, ঘৃণা, ভালোলাগা, সবই আলাদা আলাদা। একটা মানুষের নিজেকে চিনতেই জীবন কেটে যায়, আর অন্য একজন পাঠককে চেনার দাবি করাটা হবে খুবই বোকামি।তাই পাঠকের কী ভালো লাগে, সে কী চায়, এসব অনুমান করে যদি আপনি লিখতে যান, খুব সম্ভবত (ইন ফ্যাক্টি আমি বলব নিশ্চিত ভাবেই) আপনি ভুল অনুমান করবেন। তাই, যে পাঠককে আপনি সবচেয়ে বেশি চেনেন, মানে নিজেকে, তার রুচিমত কিছু লেখাটাই শ্রেয়। এতে গল্প কেঁচে যায় না। বাকি পাঠকদেরও ওতে লাভ। বস্তাপচা গল্প থেকে তাদের পরিত্রাণ মেলে। গল্পের পাঠকদের প্রতি এই যত্নটুকু নেবার জন্যই হাজার পাঠকের হাজার মত একসংগে মাথায় নিয়ে গুবলেট পাকানো পরিহার করা উচিত। একটু ভাবলেই অনেক লেখকের উদাহরণ পাবেন, যারা নিজের একধরনের পাঠকশ্রেণী তৈরি করেছেন, এবং স্রেফ সেই পাঠকদের রুচিমতই লিখে গেছেন জীবনভর। এবং পরে সেই পাঠকের কাছেই একঘেয়েমির বা গল্পশূন্যতার দায়ে গালি খেয়েছেন।... যাক গিয়ে এই আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। পরের প্রশ্ন করুণ।
উপস্থাপক- লেখনজটের কারণগুলো নিয়ে কিছু ধারণা পেলাম। কিন্তু এভাবে আটকে যাওয়া লেখকদের লিখতে শুরু করার ব্যাপারে কোনো টিপ্স?
লেখক- যে প্রথম লিখতে শুরু করবে তার জন্য টিপ্স, আর যিনি জটাধারী লেখক তার জন্য টিপ্স আলাদা। প্রথমত, কেন আটকালেন সেটা উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করুণ। ব্লককে খারাপ জিনিস নয়, বরং মেটামরফসিসের একটা সুযোগ মনে করুণ। নতুনভাবে শুরু করার পর লেখা আগের মত জনপ্রিয় নাও হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি লিখছেন প্রাণের টানে। পপুলারিটির মোহে নয়।
দ্বিতীয়ত, গল্প বন্ধুদের বলে ফেলবেন না। বলে ফেলা গল্পের মত বোঝা আর হয় না। বয়ে নিয়ে বেড়াতেও ভালো লাগে না, লিখে বিদায় করতেও বোরিং লাগে।
তৃতীয়ত, নিজের জন্য লিখুন।
চতুর্থত, গল্পের গায়ে গল্প হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো গুরুদায়িত্ব চাপাবেন না।
পঞ্চমত, দোনোমনো করবেন না। কিছু একটা লিখতে গিয়ে যদি মনে হয়, এমনটা কি বাস্তবে হতে পারে? তাহলে সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন। আপনি লিখছেন আপনার কল্পজগৎ নিয়ে, সেখানে আপনি যেমন চান তেমনই ঘটবে। দোনোমনো করতে করতে সবচেয়ে গুছিয়ে লেখাটাও প্রাণরসহীন হয়। কনফিডেন্টলি লিখলে, অগোছালো লেখাটাও নাড়া দিতে ব্যর্থ হয় না। ভালো আঁকিয়েরা এটা বোঝে, তারা কনফিডেন্ট স্ট্রোকে ছবি আঁকে।
ষষ্ঠত, সমালোচকদের নিয়ে অতুলচন্দ্র গুপ্তের কথাটি মনে রাখবেন, "যে সমালোচক মনে করে যে সাহিত্য সৃষ্টির কাজে তার সহায়তা আছে, তার ভুলটা ঠিক সেই রকমের, যদি জ্যোর্তিবিদ পণ্ডিত মনে করত যে গ্রহের চলাফেরার রাস্তা আবিষ্কার করে তার গতির সহায়তা করা হচ্ছে।"
সব শেষে, লোকলজ্জা, ভয়, এসব থাকলে সৃষ্টিশীলতা অঙ্কুরিত হয় না। না হয় কিছু একটা করে বোকাই বনলেন। কারো ক্ষতি তো হলো না। প্রাণের সংজ্ঞা নিয়ে জীববিজ্ঞানীরা মাথা খুটে মরছেন। আমি বলি, যে জিনিস কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে না, তা-ই প্রাণহীন। তাই নানান রকম উপায় নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পিছপা হবেন না।... এগুলোই।
সাংবাদিক- ধন্যবাদ আপনাকে। এই সাক্ষাতকার দেবার বদলে নিশ্চয়ই নতুন কিছু লিখতে আপনার বেশি ভালো লাগতো। তারপরও এই সময়টুকু আমাদের দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানবেন।
লেখক- আপনাকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এইটা ভাল্লাগছিল...
লেখাটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে পাঠকদের বঞ্চিত করলেন।
এই যে, আপনি আর কয়েকজন পড়লেন। সেটাই বা কম কী?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাহ! তাও ভালো, লেখা শুরু করলে! নিয়ে বস্লুম, পরেরটার জন্য!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
নতুন মন্তব্য করুন