ভাবতাম, মাছি মারা কেরানি হচ্ছে অফিসে তেমন একটা কাজ কর্ম পায় না, বসে বসে মাছি মারে, তেমন কেউ। আবার অনেক সময় ভাবতাম, খুব নগন্য কাজের জন্য যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তেমন কেউ বুঝি। মানে, অফিসে ব্যাপক মাছির উপদ্রব, রেগেমেগে বড় সাহেব একজন লোককেই নিয়োগ দিয়ে ফেললেন। তার কাজ হলো এইসব মাছি মারা। সে মাছি মারা কেরানি। তবে প্রকৃত মাছি মারা কেরানিকে চিনতে পারলে বুকে কাঁপন ধরে যায়। সে চাকরী করে ইংরেজ সাহেবের অধীনে। পান থেকে চুন খসলেই চাকরি নট। দায়িত্ব পেয়েছে হিসাবের জবেদা খাতা নকল করবার। অবিকল হওয়া চাই। কিন্তু খাতার এক পৃষ্ঠায় এক হতভাগা মাছি মরে লেপ্টে আছে। কেরানির সারাটা দিনই গেল হাওয়া থেকে মাছি মেরে অবিকল ওইভাবে চ্যাপ্টা করে তার নতুন খাতায় লাগাতে। এইখানে এসে থমকে যেতে হয়। নিজের মাঝেই এমন এক মাছি মারা কেরানিকে দেখতে পাই যেন। ইংরেজ বিদায় নিয়েছে সেই কবে। আজও আমাদের মাছি ধরা শেষ হয়নি।
তবে এই যে অবিকল ইংরেজ সাহেবের মত হলো না। এই নিয়ে কখনো সখনো, একেবারেই হঠাৎ করে যেন আমাদেরকে গর্ব করতেও দেখা যায়। আমরা বলি, বলোতো বাপু, ‘অভিমান’ এর ইংরেজি কী? অভিধান টবিধান ঘেটে পণ্ডিতরা ব্যর্থ হয়ে গেলে বলি, দেখলে তো সারাদুনিয়াটা দখল করে ফেললেও ইংরেজরা এই অভিমানের খোঁজ পায়নি। তবে ইংরেজের যে অভিমান হয় না, তা কিন্তু নয়। যতই জাতিভেদ চাপিয়ে দেই না কেন, মানুষের মনের মানচিত্র তো সেই অভিন্নই। তবে হ্যা, অভিমানের স্বরূপ বদলায় দেশে দেশে। সৈয়দ হককে কোট করি এখানে,
“অভিমানের ইংরেজিটা বলে দিলেই, আমি জানি, বাঙালি চেঁচিয়ে উঠবে- হলো না, হলো না। হলো যে না, সেটা আমিও জানি। বাঙালির অভিমান আর ইংরেজের অভিমান এক জিনিস নয়। এক জিনিস হতেও পারে না। আমরা বাবা-মার বকা খেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করি। ইংরেজ সেই অভিমানে সমুদ্র যাত্রায় বেরোয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌকরি নিয়ে, ভারতবর্ষে সামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। লর্ড ক্লাইভ! আমরা বিদ্যার অভিমান নিয়ে রোয়াকে বসে থাকি, জগতের দিকে তাকাই যেন মূর্খজনের মহা একটা মিছিল দেখছি। ওরা বিদ্যার অভিমানে বই লিখছে, বিজ্ঞানের উন্নতি করছে, জগতের হাল ধরছে। এক জিনিস হলো কী করে?”
এই কথাগুলোয় অন্তত দুই রকম অভিমানের খোঁজ পাই আমরা। প্রথমটা, মানে বাবা-মার বকা খেয়ে যে অভিমান, সেটাকে কেতাবি ঢং-এ বলা যায় “স্নেহহেতুক অনাদরজন্য-চিত্তক্ষোভ”। আর পরের অভিমান হলো বিদ্যাভিমান, পাণ্ডিত্যাভিমান ইত্যাদি। বিদ্যার বড়াই হালকা তিরস্কারের সুরে যে করে সে হলো বিদ্যাভিমানী। বড়াইটা থাকে তার নিজের ভিতরে। ওদিকে পাণ্ডিত্যাভিমান আরেক ডিগ্রি উপরের ব্যাপার। সৈয়দ হকের ভাষায়, “পাণ্ডিত্যাভিমানীর অভিমান বাইরে বেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে।” যেমনটা অনেক প্রবাসী উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে দেখি।
তবে এত কিছুর পরেও একটা খটকা যায় না। এই যে সৈয়দ হক লর্ড ক্লাইভের নামের পরে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিলেন। এই চিহ্নটা গলায় কাটা হয়ে হিংগে থাকে। নামের পরে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ওয়ালা বাঙালি খুঁজতে থাকি আমি। আর সেই প্রসঙ্গে মনে পড়ে হুমায়ুন আজাদ কে। তার বাঙালি নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন [১],
“উনিশশতকই হচ্ছে মহৎ বাঙালিদের শতাব্দী। এই মহতেরা কীভাবে জন্মালেন? এর একটা কারণ সম্ভবত ইংরেজদের সংস্পর্শ। ইংরেজের চরিত্রের যে-প্রচণ্ড শক্তি, তার কিছুটা সংক্রামিত হয়েছিলো বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও আরো কারো কারো চরিত্রে। খাঁটি বাঙালিরা মহৎ বাঙালি নয়, বাঙলার বিবর্তনে তাদের কোনো অবদান নেই। বিশশতকেও যাঁরা প্রধান হয়েছেন, তাঁরা খাঁটি বাঙালি নন, তাঁদের মধ্যেও ইউরোপীয় চরিত্রের মিশেল রয়েছে। সুভাষ বসু বাঙালি? মনে হয় জাপানি বা জর্মন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাঙালি? বাঙালি হ’লে তো দু’একটি ছিঁচকে বই লিখেই শিষ্যদের মুখে মুখে অমর মনীষী হয়ে যেতেন। তিনি যে-বিশাল বই লেখার দুঃসাহস দেখালেন, এতে তাঁকে জর্মন না মনে ক’রে উপায় নেই। এমন উচ্চাভিলাষ কি বাঙালির আছে! বাঙালি ক্ষুদ্র এবং চারপাশের সবকিছুকে ক্ষুদ্র ক’রে রাখতে চায়। এর প্রমাণ পাই বাঙালির প্রিয় প্রবাদে। ভূয়োদর্শী প্রবাদপ্রণেতা পরামর্শ দিয়েছেন, বেশি বড়ো হয়ো না ঝড়ে ভেঙে পড়বে, বেশি ছোটো হয়ো না ছাগলে খেয়ে ফেলবে। বাঙালি আকাশচুম্বী হবে না, তার দর্শন ছাগলের নাগালের ওপরে ওঠা। কিন্তু অধিকাংশই উঠতে পারে না। বাঙালি, তুমি কবে তোমার চরিত্রের মুক্তোগুলো খুইয়ে মানুষ হবে?”
আমাদের সময়ের প্রধান পুরুষেরা, মানে হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক এরা এইসব কেন লিখছেন? মাছি মারা কেরানির মত লেপটে থাকা মাছিটাকে অনুকরণ কতে চাইছেন কি তারা? নাকি অন্য কিছু? এসব পড়লে তাদের উপর মৃদু অভিমান হয় কি? নাকি হয় রাগ?
এ নিয়ে সৈয়দ হক বলেন, “অভিমান নয়, রাগ করা চাই। রাগ খুব সুন্দর গুণ। ভারত বর্ষের বৃটিশ সাম্রাজ্যের যুগে ইংরেজের রাগ এ নয়, যে রাগ আমাদের মানসকে সমতল থেকে ঠেলে অন্তরচাপে পর্বত করে তোলে, সেই রাগ।...”
“... এই ধরনের রাগ করতে পারে বলেই ইংরেজ, ইংরেজ- আমেরিকান, আমেরিকান। অভিমান তারা একেবারেই কি করে না? করে বৈকি।” তবে তাদের অভিমান আত্মঘাতি নয়। অভিমান হলে তারা নিজের ভিতরে গুটিয়ে থাকতে চায়। অভিধানে হুবহু শব্দ না পেলেও তারা বলে ‘লিভ মি অ্যালোন’। “আমাকে একটু একা থাকতে দাও! বোঝা গেল অভিমান হয়েছে। ভাষা তো বোঝার জন্যই।”
পড়ছি সৈয়দ শামসুল হকের 'কথা সামান্যই'। বইটা কী নিয়ে? বইটা ‘অভিধানের আমোদ’ নিয়ে। এই আমোদ ঠিক আমোদ-প্রোমদ নয়। বরং এই যে বাংলার নানান শব্দের কত বর্ণময় অর্থবহতা। তাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা কত জানা অজানা গল্প। তারই মজাটা নিংড়ে নেওয়াই হলো এই আমোদ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কে। ছেলেবেলায় সৈয়দ হককে এই অভিধানের আমোদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ছোটোছোটো অনেকগুলো লেখা। প্রতিটাই ঘুরছে একেকটা শব্দকে কেন্দ্র করে। আর সেই সংগে উঠে আসছে বাঙালি মানসচিত্রের নানা কথা। এই লেখাটায় তারই কিছু নমুনা দেবার চেষ্টা। বাংলাভাষার মনিমুক্তো নিয়ে ঘাটাঘাটি যার নেশা তার জন্য অবশ্য পাঠ্য একটা বই। আর যে স্রেফ চমৎকার আমোদে কিছুটা সময় কাটাতে চায় তার জন্যেও।
বই- কথা সামান্যই
লেখক- সৈয়দ শামসুল হক
প্রকাশক- সাহিত্য প্রকাশ
পৃষ্ঠা- ৩৯৬
মূদ্রীত মূল্য- পাঁচশ টাকা। (মেলা থেকে কিনেছি ৩৭৫ টাকায়)
সূত্র-
[১] বাঙালি- হুমায়ুন আজাদ
মন্তব্য
কেমন জানি অসংলগ্ন লাগল আলোচনাটা।
আবজাবালোচনা
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
নেই বইটি। কিনব কিনব করেও নেয়া হয় নি। এবার অবশ্য সৈয়দ শামসুল হক এর অনেকগুলো বই কেনা হয়েছে। সেগুলো শেষ করে, এটা সংগ্রহ করব
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আমি সৈয়দ হক খুব একটা পড়িনি। বছর খানেক আগে খেলারাম খেলে যা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই মেলায় এইটা কিনলাম।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আমিও ওনার নতুন পাঠক বলতে গেলে। পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ইয়ে ঠিক এমন্টাই হয়েছিল একবার আমার।অভিমান করেছি, এর ইংরেজী খুঁজে পাচ্ছিলাম না, পরে গুগল ট্রান্সলেটরে দিয়ে যা পেলাম, তাতে দেখি লোকজন এর মানে ঠিক বুঝেনা। আলোচনা চলুক।
অভিমান করে আবার কেউ "অভিমান করেছি" বলে নাকি?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
এইটা পড়ে আমি হাসতে হাসতে শেষ!
মোটেই আবাজাবালোচনা লাগে নাই!
ধন্যবাদ।
বইটা এমন সব চমৎকার লাইনে ভরপুর।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
দারুন লাগলো!! মাছি মারা কেরানীর উদ্ভবের মত আরো কত মজার মজার গল্প যে আছে এক একটা শব্দের পেছনে!
বই টা আজই অর্ডার দেবো রকমারিতে।
ধন্যবাদ স্পর্শ।
____________________________
দিয়ে ফেলুন! এইটা এমন এক বই, যার বিনেপয়সায় বিজ্ঞাপন করতেও ভালো লাগে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
হক রক্স।
আবার জিগ্স!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বইটা পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে । কিনে ফেলব
________________
তাহসিন রেজা
তার মানে লেখাটা সার্থক
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কত বই যে জমে যাচ্ছে পড়ার তালিকায়। কবে যে পড়ে শেষ করব কে জানে!
আলোচনা ভালো লাগল। এই বইটা পড়বই।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
আসলেই, না পড়া বই এর একটা পেজর্যাঙ্ক অ্যালগরিদম বের করতে হবে। এরপর র্যাঙ্কের উপরের গুলো পড়বো। নাইলে এই জীবনে নাপড়াবইএর বোঝা হালকা হবে না।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আমার কিন্তু গ্রন্থালোচনা ভাল্লাগছে। আগ্রহ জাগাইল পড়ার জন্য।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
থ্যাঙ্কিউ! আমি আসলে গ্রন্থালোচনা ঠিকঠাক লিখতে পারি না। আরো প্রাকটিস করতে হবে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
করেন প্র্যাক্টিস, অপেক্ষায় থাকলাম আপনার প্র্যাক্টিসের
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অভিমানের মত আরো অনেক বাংলা শব্দেরই ঠিকঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই যেন। যেমন 'আই মিস ইউ' বাস মিস,ফোনকল মিস এমন সবের সাথে একপাল্লায় দিব্বি হেসেখেলে বসে যায়। কথা হলো! ভেতরে কতটা পুড়লে বলা যায় 'মন পুড়ে বাবুল তুর জন্য' হেহেহে মজা করলাম। খুউব ভালো লাগলো পুস্তক আলোচনা। বইটা নিয়ে আরো আলোচনার অবকাশ আছে কিন্তু! সেরকমটা করলে আমার মত যাদের এই বইটা সহসাই পড়বার সম্ভাবনা নেই তাদের খুব অনেক ভালো লাগবে। যারা আরো একটু শুনতে চায় তাদের বিমুখ করা কী ঠিক হবে বলেন? তবে আপনার মনোভাব যদি এক্ষেত্রে ঠাকুর বাড়ির প্ল্যানচেটে আসা দীন নাথের মত হয়,
তবে আমাদের মুখচুন করা ছাড়া গতি নেই। নরীদচন্দ্র চৌধুরীর নামের পরে ? চিহ্ন বসতে দেখেছি যেন
পড়তে হবে-
facebook
নতুন মন্তব্য করুন