২৮ বর্গমিটারের একটা ঘর। সেটাই আমার অ্যাপার্টমেন্ট। একজন মানুষের বেঁচে থাকতে যা কিছু লাগে সব আয়োজন এর মাঝেই। একটা দেয়াল কাঁচের। সেটাই জানালা। পর্দা সরিয়ে দিলে, কনকনে শীতে কুঁকড়ে যাওয়া গাছগুলোকে ঝড়ো বাতাসের সাথে যুঝতে দেখা যায়। কিছু ছাত্রহোস্টেলের শ্যাওলা ধরা ছাদ চোখে পড়ে। তার মাঝে মাঝে বয়লারের ধোঁয়া বের হবার চিমনি। বৃষ্টির পানি জমে আছে এখানে সেখানে। এরকম একটা অ্যাপার্টমেন্টেই কি মারা গেছিলেন হুমায়ুন আজাদ? সবুজে ঘেরা রাড়িখাল ছেড়ে হাজার মাইল দূরে...
অভিজিৎ দা মারা গেছেন। খুন করা হয়েছে তাকে। মাত্র সেদিন দেখা হলো মেলায়। ছবি তুললাম। অটোগ্রাফ নিলাম। “শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বইটার জটিল বাক্যগুলোকে কীভাবে বন্যা আপা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছেন সে সব ঠাট্টা হলো। আর আজ অভি দা স্মৃতি হয়ে গেলেন। তাকে যারা সামনে থেকে দেখেনি তারা বুঝবেও না কী অপরিসীম ভালোবাসা ছিলো তার মানুষের প্রতি। সেই ভালোবাসার টানেই রাতের পর রাত জেগে পড়াশুনা-লেখালিখি, ঘাতকের হুমকি মাথায় নিয়েও ছুটে আসা প্রাণের মেলায়। তিনি কি জানতেন যে এই জনপদ তার প্রাণ হারিয়েছে? নাহলে এতশত মানুষ আর নিরাপত্তাকর্মীর মাঝেও কী অবলীলায় কিছু শ্বাপদ এসে হত্যা করলো তাকে! কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ হুংকার দিয়ে থামতেও বলেনি ঘাতকদের। এই কথাটাই মাথায় ঘুরছে বার বার করে। এর চেয়েও অধঃপতন কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব এবং অবশ্যম্ভাবী। যখন এমন প্রতিটি হত্যার পরে নীরবতা ভেঙ্গে এই মানুষগুলো আনন্দ মিছিল করবে। পাকিস্থানে যেমন করে। আর তো মাত্র কদিন…। নিজের জীবন দিয়ে আমাদের কাঙালিত্ব দেখিয়ে গেলেন অভিজিৎ রায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ঐ ফুটপাথে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মাঝেই নিজেকে দেখতে পেলাম যেন। অভি দা রা যখন প্রাণপনে সরাচ্ছে পৃথিবীর জঞ্জাল। তখন তো আমি ঠিক এভাবেই সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে ‘লাইক’ দিয়ে গেছি। কখনো বা তাও না। কত বছর ধরে আমার কীবোর্ড থেমে আছে নিরন্তর আলসেমীতে। আঁধার সরানোর সকল বোঝা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে আমি তো বেশ আছি। আমার জনপদ ক্রমেই প্রাণহীন হয়ে যাবার জন্য আমিও কি দায়ী নই?
মন্তব্য
................................
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
যা কিছু সহজসাধ্য, যা কিছু অনায়াসলভ্য, অন্তত যেটুকু হলে দৈনিক তেল-নুন-পেঁয়াজের জীবন যাপন করা যায় সহজে, তাইতে ব্যস্ত হয়ে গিয়ে, কিংবা ব্যস্ততার ভান করতে করতে যুদ্ধের পুরোটা ভার তুলে দিয়েছিলাম সম্মুখসেনানীর কাঁধে। সাইডলাইনে দাঁড়ানো ছাড়া আর কি!
এই মৃত্যু আমাকে অপরাধী করেছে। আর এই অপরাধবোধটা নেবার মতো শক্তি আমার নাই। নিজের তুচ্ছ সামর্থ্য নিয়েই যেটুকু পারি করে যাবো।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
কিছু অযৌক্তিক অপরাধবোধ আছে যা অযৌক্তিক জেনেও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। যতটা যা কথা বলছি, নিজের উপর আরোপ করে বলছি। আদতে এখনো বাকরুদ্ধ হয়ে আছি। যেহেতু আমাদের নিশ্চুপ শোক অন্যের উল্লাসের কারণ হবে তাই কথা বলছি।
স্বয়ম
যে লড়াই অভিদার দেখাদেখি চালিয়ে নিতে চাইতাম, সে লড়াই থেকে নিজের অজান্তেই একটু একটু করে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছি। কিন্তু পিছু হটা যোদ্ধাদের না দেখার ভান করে অভিদা একাই লড়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত। তাঁর রক্তের দাগ পিছুহটা কিংবা দ্রুতি কমিয়ে ফেলা সকল যোদ্ধার গায়েও লেগে আছে।
বিষণ্নতা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।
_________________
[খোমাখাতা]
“পাষাণ সমান পরে আছে, প্রান পেয়ে সে উঠবে ওরে”
একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে অভিদা যেন আমাদের কাছে শুধুই ইতিহাস না হয়ে যায় ।
------------------
রাধাকান্ত
......
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
চোখ ভিজে এল!
যারা তাকে হত্যা করেছে, তারা কখনই জানবে না, বুঝবে না, তারা কি করেছে! অভিজিৎদার বিশ্বাস ছিল, এমনকি কেউ যদি তাকে খুনও করতে আসে, তাকে তিনি যুক্তি দিয়ে শান্ত করতে পারবেন; যুক্তির প্রতি কি অগাধ আস্থা ছিল! আর একটি যুক্তিভিত্তিক বাংলাদেশ গড়াই ছিল তাঁর স্বপ্ন!
অভিজিৎদা কোন বিদ্বেষমূলক লেখা লেখেননি কোনদিন। তবে শুধু লেখার কারণে, এমনকি হউক বিদ্বেষমূলক, কাউকে হত্যা করা হলে, অভিজিৎদার কলম চলত অবিরাম! কোন বিশ্বাসের প্রতিই টান ছিল না অভিজিৎদার, কিন্তু বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতিই তার ভালবাসা ছিল সীমাহিন!
অন্ধকূপ
সত্যিই! সবচেয়ে কষ্টের কথা কি জানেন? এই লজ্জা, কাঙালিত্ব উপলব্ধি করার মত বোধটুকুও নেই অধিকাংশ মানুষের মধ্যে।
এই কদিনে আরো একবার মানুষ(?) চেনা হল।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
এ বড় কষ্টের দিন, বৈরি সময়।
দেবদ্যুতি
তখন মন্তব্য করিনাই, করার মতো অবস্থাও ছিলো না।
অভিদার সাথে সামনাসামনিই কথা হতো, ফেসবুকে বা মেসেঞ্জারে খুব বেশী না, দাদার সাথে প্যান প্যান করে উনার সময় নষ্ট করতে ইচ্ছা হতোনা।
কী অসাধারন একটা মানুষ ছিলেন দাদা, কখনও রেগে যেতেন না, যুক্তি খণ্ডন করে দেওয়া তার একেক্টা উত্তর দেখে অদ্ভুত লাগতো, মনে আছে একদিন আমরা বলছিলাম যে দাদা কিভাবে এতো মাথা ঠাণ্ডা করে কথা বলেন? এর রহস্য কি?
অভিদার খবর পাই উনি মারা যাবার পর পরই, ভাইবারে ইনান ভাইয়ার কাছে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নাই, আম্মুর সিরিয়ালের নিকুচি করে চ্যানেল ঘুরিয়ে স্ক্রলে খবরটা দেখে মাটিতে বসে গিয়েছিলাম, ধাক্কাটা নিতে কষ্ট হচ্ছিলো খুব!
সাইড লাইনে লাইক দিতে দিতেই অভিদাকে কতোটা ভালোবেসেছিলাম তা ভাবা যায়না।
খুনীরা ধরা পড়বে, বিচার হবে, এই আশা করতেও ভয় লাগে এখন, আর ভাল্লাগেনা।
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
নতুন মন্তব্য করুন