(পণ্ডক নেই) (নো স্পয়লার)
ইউটোপিয়ার স্বপ্ন যে কত সহজে দুর্বিষহ দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে, তা ভাসা ভাসা জানতাম স্ট্যালিন আর মাও এর ইতিহাস থেকে। কিন্তু ঐ খবরের কাগজে চৌদ্দ মিলিয়ন বা পনের মিলিয়ন মৃত্যু, পড়লে স্রেফ একটা পরিসংখ্যান জানা বৈ কিছু হয় না। সাহিত্যের শক্তি এখানেই। এই লক্ষকোটি সংখ্যার দুয়েকটা সংখ্যাকে আমাদের চোখের সামনে রক্ত মাংসের মানুষ রূপে তুলে ধরে সে। সংখ্যাগুলো তখন স্রেফ পরিসংখ্যান না থেকে, হয়ে ওঠে আমাদেরই কারো বাবা, মা, বোন, প্রতিবেশী...
আর সাহিত্যের সবচে বড় শক্তি হলো, শুধু এসব 'গণহত্যার' বলিই নয়, তার সংঘটনকারীরাও হয়ে ওঠে আমাদেরই বাবা, মা, বোন, প্রতিবেশী। লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একজন আটপৌরে স্কুল শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে নারকীয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সর্দার। আর কীভাবে এ ধরনের সিস্টেম দশকের পর দশক টিকেও যেতে পারে।
প্রথম লিউ চিশিনের থ্রিবডি প্রবলেম পড়তে গিয়ে এমন সত্যের মুখোমুখি হই আমি। সংস্কৃতিক বিপ্লবের (কালচারাল রেভলিউশন) এর নামে, স্কুলের কিশোরীরা যেখানে আইডিওলজির বিষপান করে, নিরীহ শিক্ষক, লেখক, বা স্রেফ ছাপোষা কেরানীকেও 'কাউন্টার রেভোলিউশনারি', 'রিভিশনিস্ট' ইত্যাকার খেতাব দিয়ে জনসম্মুখে তুমুল সমবেত জয়োদ্ধনির মধ্যে চাবকে মারছে। দুর্দান্ত এক কল্পবিজ্ঞান শোনাতে শোনাতে, সেই মৃত্যু, সেই উন্মাদনা, হাহাকার, ঘৃণা, সবকিছুর এক স্থায়ী চিত্র এঁকে ফেলেন লিউ। পড়তে পড়তে শুধু মাওকেই চেনা হয় না। চেনা হয় আর দশটা মানুষকেও। আমার আশেপাশেই তো এমন অনেক মানুষ দেখি, স্রেফ নিজের বিপক্ষ মতবাদের কারো উপর প্রযুক্ত হচ্ছে দেখে, যেকোনো অন্যায়ও অনেকে চুপচাপ মেনে নেয়। একজন মাও এসে এদের মাথায় ছাতা ধরলে এরাও কি পারবে না দুয়েকটা গণহত্যার জন্ম দিতে?
চাইল্ড ফোর্টিফোর আমাদের দেখায় স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়ার চিত্র। ইউটোপিয়ার স্বপ্নের দাম কীভাবে সাধারণ আটপৌরে মানুষ সেখানে চুকিয়ে গেছে বছরের পর বছর। এবারও, সেসব নারকীয় কাণ্ডের ভিক্টিমের চেয়ে সংঘটনকারীরাই আমাকে বিমোহিত করে। প্রতিটি মানুষ স্বজ্ঞানে জেনেবুঝে কী দুর্বিষহ অত্যাচারের যন্ত্র হিসাবে কাজ করে চলেছে। স্রেফ আইডিওলজিক্যাল বিষপান করে নিজের বাবা-মা-ভাইকেও গুলাগে পাঠাচ্ছে তার এক হৃদয়গ্রাহী চিত্র তুলে ধরেছে লেখক, রব টম স্মিথ। গল্পের নায়ক লিও দেমিদভ জীবন শুরু করে, দুর্ভিক্ষের ভুক্তভোগী হিসাবে, বড় হয়ে জাতীয় বীর হয় নৎসিদের হটানোর যুদ্ধে। আর তারপর আইডিয়লজিক্যাল 'বিষপান' করে হয়ে ওঠে সাচ্চা কমিউনিস্ট। MGB নামক থট পুলিশ দলের উচ্চপদের অফিসার সে। তারপর ঘটনাক্রমে এক সময় সে নিজেই হয়ে ওঠে থটপুলিশিং এর শিকার। আমরা দেখি, এই পুলিশিংযন্ত্রের প্রতিটি কলকব্জা (মানুষ) নিজেদের কৃতকর্মের যুক্তিহীনতা, বর্বরতা, সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়েও, অনেকটা নিরুপায়ের মতই কাজগুলো সংগঠন করে যেতে থাকে। মিলিয়ন মানুষকে গুলাগে পাঠাতে এমন করিৎকর্মা ব্যবস্থা তো লাগবেই। বলা হয় স্ট্যালিনের আমলে, এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যার কেউ না কেউ, রাষ্ট্রের অত্যাচারের শিকার হয়নি। তারপরও সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল তবিয়তে ছিলো কীভাবে? চাইল্ড ফোর্টিফোর এক দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চগল্প বলতে বলতে শুনিয়ে যায় সেই গল্পটিও। সেখানে এক সিরিয়াল কিলার, শত শত শিশুকে হত্যা করেও অনায়াসে ঘুরে বেড়ায় এই ডগমার কারণে যে- যে দেশে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে এমন বিকৃতি হতেই পারে না! সকল বিকৃতি আসলে পুঁজিবাদ কুফল। তাই সাম্যবাদী রাশিয়ায়, থট ক্রাইম থামানোর পুলিশ থাকলেও, খুনের তদন্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো খুনের পর, লোকাল মিলিশিয়া স্রেফ সেটাকে ধামা চাপা দেয়, কারণ তা প্রচার করলেই, সেই মিলিশিয়ার কর্মীরা রাষ্ট্রের দুর্নাম রটাচ্ছে, বা সাম্যবাদের পবিত্রতা হরণ করার জন্য এমন রটনা করছে বলে ধরা হবে।
এমন এক দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতেই, গল্পের প্রধান চরিত্র সময়ের বক্রপথে ভুক্তভোগী থেকে খলনায়ক থেকে নায়ক হয়ে ওঠে। চাইল্ড ফোর্টিফোরও তাই স্রেফ একটা থ্রিলার হয়ে না থেকে হয়ে ওঠে জীবনেরই গল্প। কর্তৃত্ববাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ভালবাসলেও সাহিত্যকে কেন প্রবল সন্দেহে অবদমন করে তার এক জলজ্যান্ত দলিল এই বই।
আর ব্যক্তিগতভাবে আমার এ ধরনের গল্প ভালো লাগে। আমি বলি 'মাট্রিক্স' টাইপ গল্প। দ্য ম্যাট্রিক্স চলচিত্রে যেমন, কোনো দর্শক অতশত না ভেবে স্রেফ দুর্দান্ত ফাইট দেখার জন্যও দেখতে পারে। আবার গভীর দার্শনিক চিন্তার খোরাকও হতে পারে ছবিটি। চাইল্ড ফোর্টিফোরও ঠিক তেমনই এক থ্রিলার।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা - অতন্দ্র প্রহরী
মন্তব্য
অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম - ধীরূজ
অনেকদিন আগের আমাকে যে স্মরণ করতে পারলেন, তা জেনে আপ্লুত হলাম।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
খাইতে ভালো অার যশোর থেকে ঢাকায় পড়তে অাসার গল্প যে কতজনকে শুনিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। লিখেন না কেন অার? - ধীরূজ
অনেক দিন পরে দেখলাম লিখতে। গল্পের কাহিনী পড়ে পাক সার জমিন সাদ বাদের থ্রিলার সংস্করণ মনে হচ্ছে।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
ভাল তুলনা দিয়েছিস!
তবে এই রিভিউ প্রকাশ করার পর থেকে মনে হচ্ছে, এমন সব রাজনীতিপূর্ণ রিভিউ পেলে সেই বই আমি পড়তাম না। তার মানে পন্ডক না দিয়েও পন্ড করে ছাড়লাম বইটা।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কত ভালো বই দুনিয়ায়, আপসুস সুমায় সংক্ষেপ
..................................................................
#Banshibir.
দুনিয়ার পাঠক এক হও!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ভালো লাগলো লেখাটা। পড়বো বইটা আশা করি।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
বইটা যে কেমন রোলার কোস্টার রাইডের মত তা আমার এই রিভিউতে আসেনি। অবশ্যই পড়ে ফেলেন। তবে দুই দিন নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা!!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
এই গ্রন্থালোচনাটি একেবারে ঠিকঠাক হয়েছে। এটা পড়লে পাঠক বইটা পড়তে উৎসাহিত হবেন।
১। নানা প্রকার সত্যমিথ্যা বয়ান, ধামাচাপা দেয়া, অতিরঞ্জন, পরস্পর দোষারোপের আড়ালে কী করে যেন চলতি সময়ে স্তালিন/মাওদের কীর্তি যথাযথ আলোচনায় আসে না। তাই তাদেরকে যথাসময়ে চিহ্নিত করা যায় না।
২। বর্তমান সময়েও কী করে যেন বিগত দিনের স্তালিন/মাওদের অ্যাপোলজিস্টরা প্রবলভাবে সমাজে থেকে যায়। তাই বিগত দিনের আলোচনাতে তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে 'আসলে ঘটনা এমন না', 'এখানে অনেক অতিরঞ্জন আছে', 'এগুলো বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচার', 'তাত্ত্বিক দিক দিয়ে উনার মতবাদকে নাকচ করতে না পেরে এখন উনার বদনাম করা হচ্ছে' ইত্যাদি ইত্যাদি।
৩। স্তালিন/মাওরা একক ব্যক্তি নয়। তাদের চারপাশে থাকা ক্ষমতাবৃত্তের সবাই এসব কীর্তির অংশীদার, এর সুবিধাভোগী। সেসব দুরাচার সুবিধাভোগীদের নাম, কীর্তি আলোচনায় আসে না। বিশেষত যেসব তাত্ত্বিক গুরু এই মহামেধ যজ্ঞের ধারণা যোগায়, যুক্তি যোগায় তাদের কীর্তি আলোচিত হয় না।
৪। যে পাঠ কেবল ইতিহাসের আলোচনা করে কিন্তু বিচার, শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে না সেই পাঠ আবেগে খোঁচা দেয় মাত্র, ন্যায়বিচার দাবির পথ খোলে না। সভ্য মানুষ হিসাবে আমাদের উচিত, যত পুরনো অন্যায় হোক, তার বিচার, শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করা। ফরগেট-ফরগিভ-রিকনসিলিয়েট ব্যবস্থাটি আজ ও আগামীকালে আরও ভয়াবহ অন্যায়ের পথ খুলে দেয়।
৫। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আর গত একশ' বছরে অকম্যুনিস্টদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যাগুলো কী কায়দায় যেন আর আলোচনায় আসে না। তাই ইন্দোনেশিয়া (সুহার্তো), ইরান (রেজা শাহ্ পাহলভী), ইরাক (সাদ্দাম হোসেন), চিলে (অগুস্তো পিনোচেট) বা আফ্রিকার অনেক দেশের গণহত্যাগুলোর কথা এখনকার খুব বেশি জন আর জানেন না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ পাণ্ডবদা। এত যত্নে করা আপনার মন্তব্য পেয়ে এই গ্রন্ধালোচনা সার্থক হলো মনে করছি।
খুব সাধারণ আটপৌরে মানুষ কীভাবে অসাধারণ মানবিক কিংবা বিভৎস অমানুষ হয়ে উঠতে পারে, এই ব্যাপারটা আমাকে ভাবায় খুব। বরাবরই মনে করি এসব ঘটনার নিগূড় অনুধাবনে তাত্ত্বিক আলোচনা, কিংবা পরিসংখ্যান এর চেয়ে সাহিত্যই সব চেয়ে ভাল হাতিয়ার। গ্রেগর সামসা, বা রাস্ক্লনিকভ এর মত কাল্পনিক চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ আমাদের সে সত্যের সম্মুখীন করে তার দেখা বিজ্ঞানে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। স্ত্যালিন মাও এর সৃষ্ট ক্ষত জনমনে জিইয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। নইলে প্রকৃতিগত কারণেই আমাদের গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে কোনো স্ট্রং ম্যানের আনুগ্যত গ্রহণ করার যে প্রবণতা, তার বিরূদ্ধে লড়াই এ জেতা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর সাহিত্যকে, এমনকি এই চাইল্ড ফোর্টি ফোর এর মত জনপ্রিয় থ্রিলার সাহিত্যকেও, এ কাজে সফল হতে দেখা স্বস্তির।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি তারা খানিকটা দেখে এসেছি আদর্শের নামে মানুষ কেমন অমোঘ নিয়তির মত অমানুষ হয়ে যায়। সেইটে যখন সারা দেশ জুড়ে বা অনেক দেশের একটা সমন্বয় জুড়ে চলে সে যে কি নারকীয়, কি বীভৎস হতে পারে তা পুরোটা কল্পনাতেও আসে না।
গ্রন্থালোচনা ভাল লেগেছে। উপরে ষষ্ঠ পাণ্ডব যেমন বলেছেন - ঠিকঠাক!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন