১
কত ভাষায় কত অসাধারণ সব লেখা আছে পৃথিবীতে। সেসব পড়েই তো একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। তাহলে নতুন কিছু আর লিখব কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর কি হয়? এ প্রশ্নের উত্তর কী হয়?
লেখালিখি শুরু করা যায় কৌতূহলবসত। দেখি তো পারি কী না? দেখি তো লিখতে কেমন লাগে? বা, লোকে কী বলে পড়ে? কিন্তু লেখালিখি চালিয়ে যাবার জন্য উপরের প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান জরুরী।
বিশেষ করে জীবনের অর্থহীনতা প্রতীয়মান হবার পর উত্তরটি খোঁজা হয়ে পড়ে রীতিমত ফিউটাইল পারসুইট। নানা রকম আদর্শবাদী কারণ, যেমন লিখে দেশোদ্ধার, ইতিহাসের কালপঞ্জি কিংবা সময়ের সাক্ষ্য রচনা। এসবই ‘কিচ্ছু যায় আসে না” বলে এক কথায় খারিজ করা যায়। তার উপর ওসব তো পত্রিকার পাতায় লেখা হচ্ছে অহরহ, প্রবন্ধ বা খবর আকারে। ওতে আমার হাত না দিলেও চলবে।
তাহলে? অমরত্ব প্রত্যাশা? সেটাও অর্থহীন। ভক্তপাঠককুলের পুজার্ঘ্য লাভ? অর্থহীন, অর্থহীন! নিজের ভাবনারাশি গুছিয়ে নিতে? হুমম... এবার হয়তো একটা উপযুক্ত কারণের কাছাকাছি পৌছানো যাচ্ছে। যেমন সম্রট মার্কাস অরেলিয়াস লিখেছিল তার মেডিটেশন্স। জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত এই লেখাগুলো ছিলো তার একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনারাশির একটা সংকলন। এক রকম আত্মনির্দেশিকা যা আজ স্টয়িক দর্শনের অন্যতম প্রভুখন্ড হিসাবে বিবেচিত।
তবে মানব ভাবনাকে পুরোপুরি ধারণ করা লিখিত মাধ্যমের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ লেখা এক রৈখিক। আর ভাবনা? ভাবনা বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক, শাখাপ্রশাখাপূর্ণ। ভাবনার কোনো সময়ক্রম হয়না, ভাবনা হতে পারে সচেতন বা অবচেতন। সেই সতেচন ও অবচেতন আবার সম্পূর্ণ বিপরীত কিছুও ভাবতে পারে একই সাথে। কিছু ভাবনা হয় বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, বুদবুদের মত চেতনার মাঝে ভেসে উঠে নিঃশব্দে মিলিয়ে যায়। আবার কিছু ভাবনা বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে গ্রাস করে ফেলে সমগ্র চেতনা। লেখায় ভাবনাকে ধরা! সেও কি সম্ভব? লেখা যা পারে তা হলো ভাবনার এই অসংখ্য শাখাপ্রশাকার কোনো একটাকে কিছুটা অসম্পূর্ণরূপে কাগজে ধরতে। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলবে ‘লিনিয়ার অ্যাপ্রক্সিমেশন’। তাতে কাজ চলে বৈকি, তবে সেটাই সব নয়।
লেখালিখি যেটা করে তা হলো, লেখকের মাথায় বন্দুক ধরে (এখানে কলম) ভাবনার এই অসংখ্য শাখা প্রশাখা থেকে কোনো একটাকে বেছে নিতে বাধ্য করে। তারপর সেই লিখিত বাক্যের শেষ থেকে আবার অসংখ্য ভবনার ডালপালা জন্মায়, আর লেখককে বেছে নিতে হয় তাদের কোনো একটি। এভাবেই অসংখ্য সম্ভাবনার শুধুমাত্র একটি ভূমিষ্ঠ হয় লেখনীতে। কোনো কিছু না হবার বদলে এই যে ভবনার একটা শাখার অন্তত কিছু অংশ মূর্তরূপ পেল, সেই মন্দের ভালই হলো লেখালিখি। তাছাড়া এরকম বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে কোনো ভাবনার শাখা প্রশাখা ধরে যত গভীরে যাওয়া সম্ভব হয়, লেখনীর সাহায্য ছাড়া তত দূর হয়ত পৌছানোও সম্ভব নয়।
তার মানে দুয়েকটা ভাবনার রজ্জু ধরে কিছুটা গভীরে প্রবেশের সহায়তা করা ছাড়া, পুরো ভাবনারাশিকে ধারণ করার বা গুছিয়ে ফেলার ক্ষমতা লেখালিখির নেই। পাঠকদের মধ্যে বিজ্ঞান ও গণিত মনস্কদের জন্য এখানে উল্লেখ করি যে ভাষার এই সীমাবদ্ধতা গাণিতিকভাবে প্রমাণিত। কার্ট গোডেল, এলান টুরিং প্রমুখ গাণিতিকভাবে দেখিয়ে গেছেন যে এমন অনেক সত্যি কথা আছে, যার সত্যতার প্রমাণ ভাষায় লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে সে এক অন্য গল্প যা নিয়ে লিখবো হয়ত অন্য কোনো দিন।
মূল ভাবনায় ফিরি। দেখা যাচ্ছে, ভাবনাকে আংশিক গোছানোর উদ্দেশ্যে আত্মনির্দেশিকা লেখার কিছুটা ন্যায্যতা পাওয়া গেল। তাহলে এ ঘরাণার ছাড়া আর অন্য কিছু লিখব কেন? অন্যরা কেন অন্যান্য ঘরানার লেখা লিখবে তার হেডোনিস্টিক জাস্টিফিকেশন আমি দিতে পারি। কারণ ওরা লিখলে আমি তা পড়ে মজা পাবো। তাই অন্যকে লিখতে উৎসাহ দিয়ে আমার লাভ আছে। তাই বলে আমি কেন কষ্ট করে লিখে অন্যদের মজা দিতে যাবো? আমার লেখা পড়ে তারা আনন্দ পেল নাকি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তাতে আমার কি আসে যায়? তাতে মানবজাতির বা বিশ্বজগতের কী আসে যায়? কিচ্ছুটি নয়। তাহলে তো আবারও এই লেখার একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদে ফিরে গেলাম।
২
অবশ্য প্রশ্নটা লেখালিখিকে উপজীব্য করে উত্থাপন করলে, মূল অনুসংগটা অধরা রয়ে যায়। কেননা এখানে মূল প্রশ্নটা হচ্ছে গল্প কেন বলব? কবিতা বা গান কেন গাইবো, মনের যে ভাবটি কোনো জাগতিক লাভের আশায় প্রকাশ্য নয় সেটা কেন প্রকাশ করব? লেখালিখি তো এই সেদিনের আবিষ্কার। এই এখনও যে সমাজে মানুষ লিখতে জানে না তারাও গল্প রচে চলেছে। চলেছে কবিতা বা গান বেঁধে। জীবনের অর্থহীনতার সন্ধান পায়নি বলেই কী বোকার মত ওঁরা করছে এসব? ভাবছে লিখে মানুষের খুব উপকার করবে? বা করবে অমরত্ব লাভ? নাকি প্রণোদনাটা অন্য কোথাও?
অনেকে বলবে, শুধু গল্প পড়ে নয় গল্প লিখেও আনন্দ আছে। আছে সৃষ্টি সুখের উল্লাস। তাহলে লিখে ট্রাঙ্ক ভরা পান্ডুলিপি নিয়ে কবরে গেলেই হয়। সেই লেখা ঘষামাজা করা, বা প্রকাশ করার কষ্ট কেন? এর একটা মানবীয় উত্তর আছে। কারণ লেখা অতি সাম্প্রতিক আবিষ্কার হলেও গল্প বলার শুরু মানবতার শুরু থেকেই। আর লেখনী মাধ্যম ছাড়া শ্রোতাবিহীন গল্প কবিতা বাঁধা অর্থহীনতার উপর পাগলামি। সে পাগলামি এড়াতে যেকোনো গল্প শ্রোতার সম্মুখেই বলতে হয়। তার সে প্রক্রিয়াটা লেখালিখির ক্ষেত্রে এসে অনুদিত হয়েছে, কোনো অডিয়েন্স মাথায় রেখে লেখায়। তা সে যে ঘরানার লেখাই হোক।
তার মানে কিছু লিখতে গেলে আমাকে মাথায় রাখতে হবে যে সেই লেখা কেউ না কেউ পড়বে। যে লেখা কখনও কেউ পড়বে না, তা ওই অসংখ্য ভাবনার বুদবুদের মতো যা চেতনার মাঝে ক্ষণিকের উপস্তিতি জানান দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে। অক্কামমের ক্ষুর খাটিয়ে আমরা বলতে পারি, তেমন লেখার অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে মাথা ঘামানো বাহুল্য। কারণ লেখক তা লিখে ধ্বংস করে দিয়েছে, নাকি লেখেইনি, এ নিয়ে কোনো উপসংহারে আসা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে যে লেখা অন্য কেউ পড়বে, বা পড়ার একটা সুদূর সম্ভাবনা আছে তেমন লেখা আমি কেন লিখব? এটাই আমাদের বিবেচ্য প্রশ্ন।
একজন বক্তার কথা ভাবা যাক। যার জীবন বিশ্বজগতের আর সবকিছুর মতই অর্থহীন। এবং ভাবা যাক একই রকম অর্থহীন একজন শ্রোতার কথা। এদের মধ্যে যে গল্পের আদান প্রদান হলো সেই ঘটনাও কি তাহলে অর্থহীন? হ্যাঁ। এই দুজনের বাইরের অন্য যেকারো কাছে সেটা অর্থহীনই। তবে এ দুজনের জন্য তা নয়। কারণ এই গল্প আদান প্রদাণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে একটা সংযোগ সৃষ্টি হল যা আগে ছিলো না। সে সংযোগ পৃথিবীর আর কারো কিছু না আসলে গেলেও এ দুজনের আসে যায়। কেননা অপর মানুষের সাথে সংযোগ সৃষ্টি মানবতার অন্যতম আদি (প্রাইমাল) তাগিদ। কেন এই আদি তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে ইভোলিউশনারি বায়োলজিতে ঢুকতে হবে। যা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। শুধু এটুকু বলা যায়, যে এই অপার অর্থহীনতার মাঝেও মানুষ যখন অন্য কারো সাথে সংযোগ সৃষ্টি করতে পারে সেই সংযোগ তাকে বিশ্বজগতের অর্থহীনতা বহন করার শক্তি যোগায়। যেহেতু বেঁচে থাকার তাগিদটাও একটা আদি তাগিদ। তাই জীবন যাপনের সময় অর্থহীন বাস্তবতার ভার কিছুটা লাঘব হয় যে কর্মে সেটা মানুষ করবে আপন স্বার্থেই।
তাহলে কী দাঁড়ালো, লিখতে শুরু করে মানুষ কৌতূহল বসত। আর সেটা চালিয়ে যায় অগত্যা। এটা মেনে নিলে অনেক অতিমানবীয় ঘটনাও আর অবোধ্য থাকে না। যেমন আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ কেন মৃত্য শয্যায় যন্ত্রণা কাতর হয়েও রচে চলেছেন,
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তা'রে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তা'রে চিরসমুজ্জল।
… "
আসলে এ সময় তাঁর নিজ হাতে লেখার শক্তি ছিল না। কবিতাটি তিনি ডিকটেশন আকারে অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। এ ছাড়া তাঁর উপায় ছিলো না।
জীবনের নানা রকম বাধা-বিপত্তি, কষ্ট-বঞ্চনার মাঝেও যারা লেখে আমরা বলি, দেখ কী তাদের কর্মনিষ্ঠা! কিন্তু আসল কথাটি হলো, যত বড় সমস্যাই আসুক না কেন, কিছু না লেখাটা লেখকের জন্য আরো বড় যন্ত্রণার। তাই সে লিখে চলেছে অগত্যা।
মন্তব্য
পাঁচতারা পোস্ট!
লিখে আমি অসম্ভব আনন্দ পেয়েছি। ২০১১ এর দিকে সচলে লেখা আরম্ভ করার আগে আমি কখনো লিখিনাই, এমনকি ইস্কুলের দেয়াল পত্রিকাতেও না। হঠাৎ লিখে দেখি দারুণ লাগছে। ছুটলে কথা থামায় কে, আজকে ঠেকায় আমায় কে। প্রথম দিকে মাসে দুই মাসে একটা করেও লিখতাম এত ভালো লাগে, বিশেষত গল্প আরম্ভ করার পর থেকে। আমি কেবল নিজের আনন্দে লিখলে মনে হয় আগের মতই বেশী লিখতাম, কিন্তু পাঠকের ভালো লাগবে কিনা সেইটা চিন্তা করে যা মনে চায় তাই নামিয়ে দেয়া হয় না। সচলের মানের লেখার জন্য আমাকে বেশ খাটতে হয়, তাই লেখা কমে আসে। কিন্তু লাগে চমৎকার।
একদম। শুরু করলে থামানো কঠিন। বড় বয়াম থেকে মুড়ি খাওয়ার মত। শুরু আছে শেষ নাই।
একবার ২০১৫/১৬ এর দিকে এক নতুন লেখক একটা ইতিহাসভিত্তিক মজার লেখা দিলেন। সেইখানে আরেক সহসচল মন্তব্য করলেন "বেশ চমৎকার, লেখা পড়লে মনে হয় সত্যপীরের মত"। এই জিনিসটা আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে উপভোগ করি। আমার পুরানো পাঠক আমার নাম ছাড়া এক অনুচ্ছেদ পড়েই ধরে ফেলার কথা এইটা কার লেখা। পচুর ঘষামাজা করে আঁটঘাট বেঁধে লেখার সময় যদি মনে হয় দ্যুৎ এত যন্ত্রণা কিসের জন্য, তখন এইসব ছোটখাট জিনিস আরো লিখতে আগ্রহ দেয়।
..................................................................
#Banshibir.
আমার মনে হয় এখানে একটা সুইট স্পট এর মত ব্যাপার আছে। শুধুই পাঠকের কথা ভেবে লিখলে লেখা হয়ে যেতে পারে বাজারি, বা ফরমায়েসি। ছাঁচে ঢালা রেসিপি মেনে লেখার মত। আবার পাঠককে একেবারে মাথা থেকে দূর করে লিখতে গেলে সে লেখা “দানা বাঁধবে” না। একজন লেখককে তাই এক রকম টাইটরোপ ব্যালান্স করে হাঁটতে হয়। হয়তো এই বাড়তি সমস্যা, যার কোনো সোজাসাপ্টা সমাধান নেই,
সেটাই লেখালিখিকে আরো বেশি উপভোগ্য করে তোলে।
শুরুর দিকে এমন হয়েছে যে সপ্তাহে একাধিক লিখেছি তাও মাসের পর মাস। লিখে কী হবে? ইত্যাদি কথা নিয়ে মাথাই ঘামাইনি। আপনি অবশ্য বছরে দুয়েকটা করে লেখা চালিয়েই গেছেন। কিন্তু পরিচিত অনেককেই দেখেছি, (আমি সহ) লেখা একদম থামিয়ে দিতে। লেখার কোনো তাগিদ যে মনে কাজ করে না, বা সেই আনন্দটা যে মিস করি না এমন নয়। কিন্তু নানান ঘটনায় এক রকম মোহভঙ্গই ঘটেছে এক সময়। মূলত “কী হবে এসব ছাইপাশ লিখে” এমন ভাবনা থেকেই বিপত্তি।
কারণ শুরুর নিতান্ত আনন্দের জন্য লেখা ফেইজ পার করে এক রকম সমাজ রাজনৈতিক রেস্পন্সিবিলিটি ভর করল মনে। ইণ্টারনেটে কে ভুল বলছে তার ভুল শুধরে দুপাতা লেখা। দেশরাজনীতি নিয়ে কমেন্টারি করা। এবং মনে করা যে আমার এই মতামতে বুঝি ম্যালা কাজ হচ্ছে। অতঃপর এটা উপলব্ধি করা যে আসলে এসব লিখে কোনো লাভ নেই। সত্যি বলতে এ ধরনের দায়িত্ববোধ থেকে লেখাগুলোর লেখনপ্রক্রিয়া উপভোগ্যও নয়।
হার্ডি যেমন বলেছিল তার এ ম্যাথমেটিশিয়ান্স এপলজিতে, শ্রেষ্ঠ গণিত হচ্ছে তাই, যা কোণো প্র্যাক্টিক্যাল এপ্লিকেশন এর কথা মাথায় রেখে চর্চা করা হয় না। এটা হয়ত লেখালিখির ক্ষেত্রেও খাটে। শ্রেষ্ঠ লেখা তাই যার পিছনে কোনো গূড় উদ্দেশ্য নেই। সমাজ পরিবর্তনের দায় নেই। কাউকে শিক্ষা দেওয়ার ভার নেই। নেই কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের মোহ। সব যদি অর্জিত হয়, তা নিতান্তই বাইপ্রোডাক্ট।
এসব “প্রাক্টিক্যাল দায়িত্ববোধ” ঝেড়ে ফেলতে পারলে লেখালিখি না করার কোনো কারণ থাকে না। তা পৃথিবী সাগর তলে ডুবে যাক, বা ধর্মান্মোদনায় উচ্ছনে যাক। লেখালিখি করা যায় নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
জর্জ অরওয়েল তাঁর কালজয়ী মাস্টারপিস ১৯৮৪ লেখার ঠিক আগে একটি ক্ষুদ্রায়তন প্রবন্ধ লেখেন। শিরোনামঃ ‘হোয়াই আই রাইট’। সঙ্গত কারণেই তার ঐতিহাদিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুত্ব অনেক। তাই ওটার ভিত্তিতে একটি লেখা তৈরি করছিলাম। কিন্তু আপনি এত ভালোভাবে এবং প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন যে, আর বলাটা বাহুল্য।
জর্জ অরওয়েল ‘হোয়াই আই রাইট’ প্রবন্ধে লেখালেখির চারটি নেপথ্য-কারণ তুলে ধরেছেন। এখানে শুধু সেই মেগামাইন্ড এর লেখা-ভাবনা অতি-সংক্ষেপে (এবং অক্ষম, অযোগ্য) ভাবানুবাদে তুলে ধরছি।
১) নিতান্তই অহমের পরিবিস্তারঃ একটি পরিপূর্ণ জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে লেখালেখি করা।
২) সৌন্দর্যের সূচীতীব্র আকাঙ্খাঃ জীবন ও প্রতিবেশের বাহ্যিক-আভ্যন্তরীণ এবং শব্দবিন্যাসের সৌন্দর্যের সুলুক-সন্ধানএর জন্যে লিখে যাওয়া।
৩) ইতিহাসের প্রণোদনাঃ নিজে যে সময়ের সাক্ষী হয়ে আছেন, ভাবীকালের জন্যে তার রেখাচিত্র লেখার প্রাকারে রেখে যাওয়া।
৪) ‘রাজনৈতিক’ উদ্দেশ্যঃ এখানে রাজনীতি শব্দখানার যত বেশি বিস্তৃত মানে ধরা যাবে তত ভালো। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের যেমন সমাজে বা জীবনে বেঁচে থাকা উচিত সেই আদর্শ মানের দিকে (নিয়ে) যাবার একটা ইশারা দেখানো।
চমৎকার একটি লেখার জন্যে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
মূল লেখাঃ https://www.orwellfoundation.com/the-orwell-foundation/orwell/essays-and-other-works/why-i-write/
স্বরূপ-সন্ধানী
---------------------------------
অন্ধকারে সবচেয়ে সে শরণ ভালো,
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
ওপরের তৃতীয় লাইনের বানানটা হবে "ঐতিহাসিক"।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মানিক বন্দপাধ্যায়েরও ‘কেন লিখি’ নামের লেখাটা এক সময় ভাবিয়েছিল খুব। সাম্প্রতি পড়েছিলাম রিলকের লেটার টু আ ইয়ং পোয়েট। এই কেন লিখি থিমেরই। বা ইকোর কনফেশন্স অফ আ ইয়ং নভেলিস্ট। দেখা যাচ্ছে সব লেখকই এক পর্যায়ে এসে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
তবে আমার এই লেখার সুত্রপাত ‘কেন লিখি?’ থেকে না। কারণ, আমি লিখিনা প্রায় বছর দশেক। অনুসন্ধানটা ছিল ‘কেন লিখি না?’ থেকে। মূলত ‘লিখে কি আসে যায়’। এমন একটা ভাবনা থেকেই লেখা বন্ধ করেছিলাম। যদিও লেখার প্রক্রিয়াটা এখনও উপভোগ করি পুরো দমে। ফলে কেউ যদি সবকিছুকে অর্থহীন মেনেও নেয়, তারপরও লেখলিখির কোনো মোটিভেশন তার থাকতে পারে কি না সেই অনুসন্ধানই আমার এই লেখার উপজীব্য। এবং এবারের মত আমার উপসংহার ইতিবাচক।
ফেসবুকে এক বন্ধু শেয়ার করায় অরওয়েল এর লেখাটা আবার খুঁটিয়ে পড়লাম। তারপর দেখি আপনার এই কমেন্ট। অরওয়েল উল্লিখিত চারটা কারণের বাইরেও মানুষ যে স্রেফ ‘আমার কথা শোনো” এই গল্প শোনানোর বা সম্পর্ক সৃষ্টির আদি তাগিদে লেখালিখি করে সেটা আসেনি। এটা স্রেফ শিশুর এটেনশন সিকিং আচরণের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। হয়ত এর শিকড় একই, কিন্তু পরিণত মানুষের সম্পর্কসৃষ্টির তাগিদটাও পরিণত। তার দাবিও বেশী। সেটা তার গল্প বলার প্রবণতাকে প্রণোদনা যোগায়। আর লেখক কিছুটা লোভী হওয়ায়, চায় স্থানকালের গন্ডি পেরিয়ে এক সাথে হাজারো মানুষের সাথে সেই সম্পর্ক স্থাপন করতে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
খুব সাদামাটা ভাবে মূল কথা হলো – মানুষ প্রথমত লেখে নিজের জন্য। নিজের মধ্য যে সকল ভাবনা খেলা করে সেসকল বর্ণমালায় দেখতে চায় সে নিজেই যেন তার নিজের ভাবনা সে পাঠ করতে পারে সুশৃঙ্খলভাবে। আর যখনই লেখা হয়ে যায় তখনই ইছে জাগে লেখাটি পাঠ করুক অন্যরা।
ধন্যবাদ আপনার ভাবনাটি শেয়ার করার জন্য।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
লেখাতো বলাই।
তোমাকে বলা।
তবে সেই তুমি সামনে বসে থাকে না।
সে থাকে মনের মধ্যে বসে।
তার সাথে কথা বলার থাকে যেইজনের
সেইজনই লেখে।
ভেতরের আমি- সেও আসলে সেই তুমি।
মনের যে জন।
লেখা মানে তার সাথে
কথাই বলা।
লেখাটা একটা মাধ্যম
একটা সেতু
যার ওপর দিয়ে আমি হেঁটে যাই
আমার মনের তোমার কাছে।
আমি লিখি লোভে। বলা তো যায় না, কেউ হয়তো পড়বে!
খুব সুন্দর একটি পোস্ট স্পর্শ। ভালো লাগলো।
---মোখলেস হোসেন।
নতুন মন্তব্য করুন