জীবনে আমি কূটনীতিক হব সেটা আমি কোনদিন চিন্তাও করিনি।কারণ পাকিস্তান আমলে আমার মতন একজন চাকমার মুসলিমদের জন্য সৃষ্ট পাকিস্তানে কূটনীতিক হওয়া চিন্তা করা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয় ।আমি ১৯৫৯ সালে ঢা.বি হতে এম এ পরিক্ষা দিই এবং যথারীতি পাশও করি ।১৯৬০সালে ই পি সি এস(ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) পরিক্ষা দিই এবং তাতে নির্বাচিত হই। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিদের মধ্যে আমিই প্রথম প্রতিযোগিতা মূলক পরিক্ষা দিয়ে চাকরি পাই। এরপর ভবিষ্যতে পররাষ্ট্র মণত্রনালয়ে চাকরি করব ,রাষ্ট্রদূত হব তা আর ভাবিনি।
২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রধান্মন্ত্রির মুখ্য সচিব জানান যে সরকার আমাকে কাজে লাগাতে ইচ্ছুক। আমি তাকে বলি যে আমি ইতোপূর্বে সরকারের অতিরিক্ত সচিব ছিলাম; আমার সঙ্গে যারা অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন তারা অনেকেই এখন সচিব। কাজেই আমাকে যেকোন মন্ত্রনালয়ের সচিব বা রাষ্ট্রদূত করা যেতে পারে। আমি আরো বলি যে আমার ২টি মেয়ের এখনও বিয়ে হয়নি কাজেই রাষ্ট্রদূত করে আশে পাশের কোন দেশে নিয়োগ দিলে আমি খুবই খুশি হব। তারপর একদিন মুখ্য সচিব জানান যে প্রধান্মন্ত্রি আমাকে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর একদিন প্রধান্মন্ত্রির সচিবালয়ে CV জমা দিতে গেলে জানতে পারি আমাকে ভূটানে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১৯৯৮ সালের ৮ জুলাই আমি পররাষ্ট্র মণত্রনালয়ে যোগদান করি এবং ১৫ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডু হয়ে ভূটানের ড্রুক এয়ার যোগে ভূটানের একমাত্র বিমানবন্দর পারো তে পৌছি। সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী এবং আমার ছোট মেয়ে। ভূটান সরকারের পক্ষ হতে চীফ অব প্রটোকল কেসাং ওয়াংদি এবং পররাষ্ট্র মণত্রনালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা আমাদের অভ্যর্থনা জানান। আর ও উপস্থিত ছিল ড্রুক এয়ারের পারোর স্টেশন মানেজার নিধুক দরজি, তার স্ত্রী এবং কন্যা। উল্লেখ্য নিধুক আগে ঢাকায় ড্রুক এয়ারের স্টেশন মানেজার ছিলেন এবং আমার বাসায় ভাড়াটিয়া ছিলেন। বিমান বন্দরেই চীফ অব প্রটকল আমাকে জানান যে আমাকে ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় মহামান্য রাজা জিগ্মে সিঙ্গে ওয়াংচুক’র কাছে পরিচয়পত্র বা Credentials পেশ করতে হবে ।
ঐদিন রাতে আমাদের পারো তে থাকার পরিকল্পনা ছিল। তাই চীফ অব প্রটোকল রাজধানী থিম্পু চলে যান। পরদিন সকালে কাউন্সিলর আলী আকবর আসেন; নিধুক দরজি ও হাজির। এরপর আমরা সবাই একসঙ্গে হোটেল থেকে বিদায় নিয়ে পারোর কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখে রাজধানি থিম্পুর উদ্দেশে যাত্রা আরম্ভ করি। পারো হতে থিম্পুর দুরত্ব প্রায় ৭০ কিমি। রাস্তাটি কেবল উচু-নীচু নয় অত্যন্ত আকা বাকা। ফলে যখন আমরা রাষ্ট্রদূতের বাসায় পৌঁছি তখন মাথা ধরে গেছে। সেদিন দুপুরে এবং রাতে আমরা কাউন্সিলর আলী আকবর’র বাসায় খাওয়া-দাওয়া করি। থিম্পুতে রাষ্ট্রদূতের বাসা এবং চান্সেরি একদম পাশাপাশি জায়গায়।বাসাটি ভূটান সরকার রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের জন্য বরাদ্দ করে;ইতপূর্বে এতে ভূটানের অর্থমন্ত্রি বাস করতেন। বরাদ্দকৃত সাড়ে ৪ একর জমির উপর নির্মিত ভবনের চারদিকে অনেক খালি জায়গা আছে। তাছাড়া ১৭টি আপেল গাছ সহ অন্যান্য অনেক ফলবান বৃক্ষও রয়েছে। খালি জায়গার কিছু অংশে আমার পূর্বের রাষ্ট্রদূতগণ চাষ করে গেছেন;আমিও কিছু অংশে চাষ করেছি।
দূতাবাসের পাশেই আমাদের চেন্সেরি ভবনটি একটি তিন তলা ভাড়া বাসায়। একতলা ও দোতলায় অফিস এবং তিন তলায় থাকেন কাউন্সিলর।পাশেই একই মালিকের আরো একটি বড় ভবনে দূতাবাসের বাকী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা থাকেন।
১৬ সেপ্টেম্বর আমি থিম্পু পৌঁছালেও আমার আনুষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব গ্রহনের তারিখ ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ আমি যেদিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করি সেদিনই মহামান্য রাজার কাছে Credentials পেশ করি। আমার Credential পেশ করার সময় আমর স্ত্রী, ছোট মেয়েও উপস্থিত ছিল। Credential পেশ করার জন্য রাজ দরবারে যাওয়ার সময় রাজ দরবারের গেট হতে আমাদের ঢোল ও বাদ্যজন্ত্র বাজিয়ে এবং নাচ-গান করে দরবার হলের সদর দরজা অব্দি নেওয়া হয়। তারপর সেখান হতে দরবার হল এবং রাজার কাছে Credentials পেশ। এরপর রাজা আমাকে audience দেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিলেও Credentials পেশ করার আগে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ানো যায় না।কাউন্সিলর আলী আকবর জানান যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত নেওয়ার কমপক্ষে ১৫-২০দিন পর রাষ্ট্রদূতকে পরিচয়পত্র পেশ করতে বলা হয়;সেই হিসেবে ভূটান সরকার আমকে খাতির করেছে। পরবর্তীতে জানতে পারি যে ভূটান একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশ থেকে একজন বৌদ্ধ রাষ্ট্রদূত পেয়ে ভূটান সরকার এবং রাজা খুবই খুশি হন।একারনেই পরিচয়পত্র তাড়াতাড়ি পেশ করতে বলা হয়েছিল
মহা্মান্য রাজার কাছে পরিচয় পত্র পেশ করার পর প্রায় ঘন্টা খানেক কথা-বার্তা হয়। রাজা আমার বিভিন্ন পারিবারিক বিষয় জানতে চান। আলোচনার সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যাক্তিত্ব ,দেশপ্রেম এবং আন্তরিকতার কথা বলেন।রাজা এরপর আমার কোন প্রশ্ন আছে নাকি জানতে চান। আমি ভূটানে যাওয়ার আগে দেশটি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলাম। তখন জানতে পারি ভূটানের নদী গুলো থেকে প্রায় ৩০০০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুত উতপাদন সম্ভব। তাই রাজাকে আমি প্রস্তাব করেছিলাম যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল যৌথ উদ্দ্যগে ভূটানে বিদ্যুত প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।রাজা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন এবং বললেন সেটা খুবই সম্ভব এবং ভূটান এতে রাজি। তিনি আরো বলেন যে পৃথিবীতে ভূটানে সবচেয়ে কম খরচে বিদ্যুত উৎপাদন করা যায়। এর কয়েক দিন পর আমি আমাদের পররাষ্ট্র , জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে লিখি।কিন্তু কোন সাড়া পাইনি।
পরবর্তীতে ঢাকা আসলে আমি বিষয়টি নিয়ে প্রধান্মন্ত্রির মুখ্য সচিব’র সাথে আলোচনা করি। এরপরে মুখ্য সচিব’র নেত্ৃত্বে ৪ সদস্যর একটি প্রতিনিধি দল ভূটান সফর করে। ভূটানের বানিজ্য মন্ত্রী জানান যে তাদের সরব বৃহৎ বিদ্যুত প্রকল্পের নির্মান কাজ ভারতের সহযোগিতায় চলছে এবং ২০০৪ সালে তা শেষ হবে এবং ১০২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে এবং সব বিদ্যুত ভারতে রপ্তানি হবে। কাজেই ভারতের সম্মতি ব্যাতিত সেই প্রকল্পের বিদ্যুত বাংলাদেশে রপ্তানি করা যাবে না; করতে হলে নতুন প্রকল্প নিতে হবে।
মন্তব্য
চলুক
লেখাটা পড়তে বেশ ভালো লাগছিল। এর পর কি হলো জানার ইচ্ছে আছে। তাছাড়া আপনার ভুটান জীবনের কথাও শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
টুইটার
খুব ভালো লেগেছে। আরও লিখুন দয়া করে।
সচলে সুস্বাগতম। অনেক অনেক লেখা আশা করছি আপনার থেকে।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
অধীর আগ্রহে পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
স্বাগতম।
আপনার অভিজ্ঞতার কথা আরো শুনতে চাই, নিয়মিত...
সচলে স্বাগতম।
গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে আপনি বাংলাদেশের অনেক কিছুই দেখেছেন , আশাকরি সেই দেখার অভিজ্ঞতাগুলো সচল পাঠকদের সাথে শেয়ার করবেন।
সহমত।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
চলুক।
ভালো লাগলো লেখাটা। সচলে স্বাগতম। এই লেখাটা আরেকটু বড় হলে ভালো লাগতো। অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে দিন আমাদের জন্য।
কূটনৈতিক মিশনের কার্যকলাপ নিয়ে লেখা খুব কম আছে। রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক, সমস্যার ধরন, ইত্যাদি বিবেচনায় কূটনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ে আলোকপাতের অনুরোধ রইলো।
শরদিন্দু দা আরো বিস্তারিত লেখা চাই আপনার কাছ থেকে। সেই সাথে ভূটানের সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানতে চাই। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
সচলে স্বাগতম। কূটনৈতিক বিষয়ে আপনার অনেক লেখা কামনা করছি।
সচলে আপনাকে স্বাগতম!
এর পর কি হলো জানতে চাই। পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
______________________________________________________
সামনে যদি যাবি ওরে, থাক-না পিছন পিছে পড়ে।
লেখক কে অভিনন্দন ।
লিখা চলুক স্বাভাবিক গতিতে।
সচলে স্বাগতম!
পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
আরো বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। আপনি আপনার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করুন আমাদের সাথে!
...................................................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
সচলে স্বাগতম।
পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম..
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
সচলায়তনে স্বাগতম ।
লেখাটা চমৎকার এগুচ্ছিল। পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
সচলে স্বাগত। ভুটান নিয়ে আমার নিরন্তর আগ্রহের খোরাক যোগাবে আপনার লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ সকল কে লেখাটি পড়ার জন্য। জেনে ভাল লাগল যে লেখাটি আপনাদের ভাল লেগেছে। বেশ উৎসাহিত বোধ করছি ।২য় পর্ব টি আশা করি শীঘ্রই প্রকাশ করতে পারব।
আগেও বিভিন্ন লেখার দাবী জানিয়েছিলাম। এখনো জানাচ্ছি। এই পর্ব জোরসে চলুক...
অনেক ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম।
বেশ তো ভাল লাগছিল পড়তে, কিন্তু পরের পর্বগুলা আর পেলাম না।
নতুন মন্তব্য করুন