এক্সট্রিমিস্ট সিনেমার গোত্র বুঝতে গেলে আগে কিছু সিনেমার নাম নেয়া দরকার। একটু পেছন থেকে আসি। গদারের ‘উয়িকএন্ড’, বুনুয়েলের ‘ত্রিস্তানা’, পাসোলিনির ‘সালো অথবা ১২০ দিনের সডোম’ আর পোলানস্কির’ ‘বিটার মুন’।
আমার দেখা এই গোত্রের প্রথম সিনেমা ‘ক্রিমিনাল লাভারস’। দেখেছিলাম জহির রায়হান ফিল্ম সোসাইটিতে। দেখে বেশ বিরক্তিকর লেগেছিল। তখন ও জানতাম না এটা এই গোত্রের সবচে নরম সিনেমা। সিনেমায় হরর জিনিষটা আমার পছন্দের না। কেন আমি জীবনের বাজে দিকগুলো এভাবে দেখবো? দু-চারটা বাতিকগ্রস্তের জন্য পুরা পৃথিবী তো আর পুঁতিগন্ধের হতে পারে না।এর পর দেখলাম 'আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ',স্ট্যানলি কুবরিকের। অসহ্য রকমের অভিজ্ঞতা। পার্ভাটদের জন্ম দেয়ার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা দায়ী- প্রমাণ করতে চান কুবরিক। চরমপন্থী এসব সিনেমার মূল উপজীব্য ভায়োলেন্স। বিশেষতঃ সেক্স ভায়োলেন্স। আমার মনে হতো এসব ছবি বানানো এক ধরণের পার্ভাট কাজ। আমি এদের মানসিক গঠন পড়তে আগ্রহী হলাম। পৃথিবীর এন্তার ছবি-বানিয়ে কেন এই দিকে ঝুঁকেছেন ? সাম্প্রতিক রসু খাঁ নামের সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে নানান পত্রিকায় প্রথম পাতার ব্যাপক কাভার করা দেখে বোঝা যায় পাবলিকের এসবে আগ্রহ অনেক। ছোটবেলায় শারমীন রীমা হত্যাকান্ডের তুমুল কাভারেজের কথা মনে পড়ছে। ‘বাংলার বাণী’ দীর্ঘকাল এই ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করে টিকে ছিল। জাতীয় আন্তর্জাতিক সব খবর আসতো সেখানে পরের পাতাগুলোয়। নগরীতে জ্যাক দা রিপারের আগমন নিয়ে সুমন রহমান সামুতে বেশ এক প্রস্থ লিখেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সব কিছুকে থিয়োরাইজ করার ব্যাপারটাকে আমার ভালো লাগে না। সব মানুষের মাথায় সোকলড ক্রমিক খুনের ভূতের সওয়ার থিকথিক করছে এটা ভয়ানক সরলীকরণ। নগরীতে ভালোবাসার আগমন ঘটলে আমার হেলে পড়ি, এমন রোমহর্ষক খুন নিয়ে আমরা খানিক উত্তেজনা বোধ তো করবোই। পেপার সেখানে কনজ্যুমার উপাদান। আমরা পড়বো। বিক্রিবাট্টা বাড়াতে ওরা ফুলাবে ফাঁপাবে।
কিছু কিছু লোকের কথা শুনলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে বসে। তাদের হাজার ভালো গুণ থাকলে ও আমার কিছু যায় আসে না। রবিন নামে আমার স্কুল জীবনের বন্ধুর সাথে আমার কি কারণে যেন লেগেছিল।সেই থেকে তার যাবতীয় সব কিছু আমার খারাপ লাগে।এমনকি এখনো। আমাদের চট্টগ্রাম কলেজে কোএড ছিল। আমি মেয়েদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করতাম। রবিনকে দেখতাম বেশ সহজ - মেয়েদের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে কি মিশতে। মাথায় আসলো এভাবে যে মেয়েদের পিছনে ঘুরে তাকে কি বলা যায়? লুইচ্চা রবিন জাতীয় সস্তা নাম ফুটাতে চাইছিলাম না। খুঁজছিলাম ‘ভয়ড অভ এক্সক্রিমেন্ট’ টাইপ ইংরেজি কোন শব্দ যা শুনলে সবাই যেন সাথে সাথে না বুঝে। ডিকশনারিতে প্রথম থেকে আরম্ভ করলাম। সি পর্যন্ত এসে মনে হলো পিছনের দিকে থাকবে। সারা দিনরাত অভিধান নিয়ে আছি বাবা বললেন- ইংরেজির উয়দ্দি ফিয়েসডি গরর নাকি? শেষে পেলাম – ডি তে। ড্যাংলার। কথা শেষ করি। আমাদের চরিত্রের এসব অচেতন দিকগুলো নিয়ে ভাবলে বোঝা যায় একটু একটু আমরা সবাই এক্সট্রিমিস্ট আছি। অচেতনের এই বোধকে নিয়ে রমরমা বাজার করা তাই বিচিত্র নয়।
এখন সংক্ষেপে একটু দেখি ‘ক্রিমিনাল লাভারস’ নিয়ে ওজোর কথাবার্তা।
ফেইরি টেল
ক্রাইম স্টোরি আর ফেইরি টেল মিশিয়ে আমি সিনেমাটা বানাই।একদিকে বাস্তবতা থাকবে আবার অলীক পরাবাস্তব জীবন ও থাকবে। প্রত্যেকটার ডার্ক দিকগুলো দেখানোর চেষ্টা করেছি।ফলে সেখানে আসছে খুন, আত্মহত্যা, নিপীড়ন।আমাদের মধ্যে যেসব মানসিক দ্বন্দ্ব আমি খানিক দেখাতে চেয়েছি।বলা যায় ব্যক্তিবিশেষের একান্ত কোন ফেইরি টেল।
মেয়েদের নৃশংসতা
মেয়েরা ছেলেদের চে কম নৃশংস নয়। আমি ছবিতে সেটা দেখাই।মেয়েদের ক্ষেত্রে এসব দেখা দিলে আরো ভয়ানক হয়। আমার ছোটদৈর্ঘ্যের ‘সি দা সি’ তে মারাত্মভাবে বিষয়টা এসেছে।
মন
কেউ যখন অপরাধ করে দেখানো হয় তার নির্মমতা আর রহস্যময় আচরণে সব ফুটে ওঠে- এমনকি তার মানসিক গঠন।এই সিনেমায় যেমন আরব ছেলেটাকে খুন করানোর পিছনে তার মাথায় নানান ফ্যান্টাসি কাজ করেছিল।সে ছেলেটার প্রতি ডিজায়ার বোধ করার চেয়ে ডিজায়ারটাকে খুন করতে চেয়েছিল।
বয়ঃসন্ধি
এখানে দেখানো হয়েছে খুন তারা করছে মজা নেয়ার জন্য।যেন একটা খেলা।মেয়েটা বলে-‘দেখো আমরা সায়ীদকে মারবো।আমি ওখানে ওকে তাতাবো।তুমি এসে ওকে ছুরি মারবে। আমরা লাশ বনে নিয়ে গিয়ে কবর দিয়ে দিব’।অলীক কি আর বাস্তব কি তারা বোঝার চেষ্টা করছে না।নানান কিছু যেমন সমকাম, অবদমিত কামনা, অসুস্থ রোমান্টিকতা সব দুটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে।মেয়েটার কাছে বেঁচে থাকার কি মরে যাওয়ার কোন মানে নাই । তাও ছেলেটা কিছুটা মাটির উপর দাঁড়িয়ে। খুন করা যে অপরাধ সে কান্ডজ্ঞান তার আছে।ফলে শাস্তি পাবার বিষয়টা সে স্বীকার করে নিচ্ছে।
আমি মোটামুটি যে কয়জন এক্সট্রিমিস্ট পরিচালকের জীবনী কি সাক্ষাৎকার ঘেঁটেছি দেখতে পেলাম তাঁরা নিজেদের মধ্যের নানান প্রশ্ন লোকজনের দিকে ছুঁড়ে দেন। উত্তর দেয়া এড়িয়ে যান। প্রায় সবাই নানান ট্রমার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। লার্স ভন ট্রায়েরের কিছু সাক্ষাৎকার পড়ে আমার মনে হয়েছে উনি পুরাই কনফিউজড।অবশ্য পৃথিবীর অনেক তালগোল পাকানো মাথা থেকে নানান কিছুর সৃষ্টি হয়েছে। সুরিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম, মন্তাজ –সব আসলে ভার্চুয়াল বনাম রিয়ালিটির মারপ্যাঁচ।জানি না- কনফিউজান কি ডিটারমিনেজমের পূর্বাভাষ?
মন্তব্য
আপনার পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম। Ozon আমার খুব পছন্দের একজন পরিচালক।
অনেক ধন্যবাদ ফরাসি সিনেমার এই দিকটি নিয়ে লেখার জন্য।
ওজোর সিনেমা মানেই অসম্ভব অভিজ্ঞতা। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো।
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ শুভাশীষ। ফরাসিদের ওপর লেখা চেয়েছিলাম। পেয়ে গেলাম। এখন কাল পড়া হবে তারিয়ে তারিয়ে। আমি জানি আমার অনেক কৌতূহলের নিবৃত্তি এর মাধ্যমে ঘটবে। অন্য অনেকের বেলাতেও এ কথা খাটবে। ওজোঁ-র 'সুইমিং পুল' দ্বিতীয়বার দেখা হলো আজই। অনেক কাজ ফেলেও দেখতেই হলো, উঠতে পারলাম না।
এই লেখাতে উপাত্ত কম। 'সুইমিং পুল' আমার ও কয়েকবার দেখা হয়েছে। সম্প্রতি দেখলাম ওজোর 'পাঁচ গুন দুই' আর 'আট নারী'।
একটা নাম বলেন। টেস্টার হিসাবে নামায় দেখি।
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
ওজো দিয়ে শুরু করা যায়। 'ক্রিমিনাল লাভারস' অথবা 'সিটকম'।
পিটার গ্রীনএওয়ের ' দা কুক দা থিফ হিজ ওয়াইফ এন্ড হার লাভার' ও দেখা যায়।
টেস্টার হিসাবে ...........................
পড়ছি, লিখতে থাকুন
------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
নুভেল ভাগ এর সাথে কিছুটা পরিচয় থাকলেও ফরাসি এস্ট্রিমিটি-র সাথে একেবারেই পরিচিত নই। কারও সিনেমা দেখা হয় নি। কিছুটা পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
বর্তমান এক্সট্রিমিটি-র পরিচালকদের কিছুটা কনফিউজড ই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কুবরিকের ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ নিয়ে আরেকটু লেখা থাকবে বলে আশা করেছিলাম। কারণ এটা আমার ফেভারিট কুবরিক সিনেমাগুলোর একটি। কুবরিক কিন্তু একেবারেই কনফিউজড ছিলেন না, এক্সট্রিমিটি-র পসারের দিকেও তার লক্ষ্য ছিল না। বরং আমি ক্লকওয়ার্ড অরেঞ্জ দেখেছি এইভাবে:
কুবরিক মনোবিজ্ঞান নয় বরং সমাজবিজ্ঞানে আগ্রহী ছিলেন। প্রথম দিকে অ্যালেক্স এর আলট্রাভালোন্স নগ্নভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু পরে যখন সামাজিক অথরিটির হাতে পরে এই চরিত্রটিই একটা ক্লকওয়ার্ক ইঁদুরে পরিণত হয় তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, সমাজের নিকৃষ্টতম ব্যক্তিটির চেয়েও উক্ত সমাজের কর্তৃপক্ষ নিকৃষ্টতর। অথরিটি তাদের প্রয়োজনেই সমাজের সবচাইতে ভায়োলেন্ট ব্যক্তিটিকে পোষে, তার চেয়ে বহু গুণে বেশি ভায়োলেন্ট বলেই এই পোষার কাজটা সম্ভব হয়। বিংশ শতকের সমাজবিজ্ঞানে জ্ঞান-ক্ষমতা নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে তার জন্য সবচেয়ে ভাল ফিল্ড অভ স্টাডি ছিল হাসপাতাল এবং কারাগার। মিলিয়ে দেখুন- কুবরিক ঠিক এই দুটো ফিল্ডই ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জে নিয়ে এসেছেন। সব মিলিয়ে ক্লকওয়ার্ক এর যে শৈল্পিক মান ও আবেদন ছিল তা আজকের কোন ভায়োলেন্স প্রদর্শনীতে পাই নি।
এমনিতে আমি ভায়োলেন্স ও হররের ভক্ত না, তবে এগুলোর মাধ্যমে যদি মহত্তর কোন থিম সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় তবে ভাল লাগে। যেমন ক্রোনেনবার্গ এর বডি হরর, কুবরিকের শাইনিং এবং একজরসিস্ট ধাঁচের হররগুলো ভাল লেগেছে। এবার ফরাসি এক্সট্রিমিটি শুরু করার পালা। আধুনিক মার্কিন সাইকো বা হরর খুব বাজে লাগে, যদিও অল্প বয়সে কয়েকটা দেখে ভিরমি খেয়েছিলাম।
আপনার সিনেমা বিষয়ক লেখাগুলো আমি বিশেষভাবে পড়ি। লেখা ছাড়বেন না যেন...
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
কুবরিকের আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ নিয়ে পরের কিস্তিতে আরো ডিটেইল্সে লিখার চিন্তা আছে। আপনার মন্তব্যে এই ধরণের লেখায় সাহস পাই। সিনেমা নিয়ে যে ধরণের আলোচনা সচরাচর হয় আমি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। এক একটা ভালো সিনেমা দেখার সাথে সাথে আমরা মিলাই এর সাথে নিজেদেরকে, আমাদের আশেপাশের পরিবেশকে। আমি দেখাতে চাই সিনেমাগুলো কিভাবে আমার জীবনে ঢুকে পড়েছে। সিনেমার নান্দনিক দিক কিংবা এর প্রভাব আমার লেখায় আসে না। তথ্য জানাই অনেকটা আলুথালু ভাবে। আপনি সিনেমা নিয়ে লেখেন তা বুঝতে পেরেছি। আমার লেখার এই ঘরানা নিয়ে আপনার কাছে সরাসরি মন্তব্য চাইছি- ভালো মন্দ দুটাই। তবে সিনেমা নিয়ে আরো কিছুদিন আমি একই পথে লিখে যাব।
অনেক অনেক ধন্যবাদ বিস্তারিত লেখার জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন