পায়ে শিকল মেরে রাখে রাতদিন। রাতে কখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনে হয় পায়ের উপর কোন পাহাড় আটকে আছে। ব্যথায় নীল হয়ে যাই। নড়তে পারি না, নাড়াতে পারি না কিছু। দমবন্ধ হয়ে আসে। নিজের চিৎকার হজম করে ফেলি। এখানে অনর্থক চিৎকার করলে প্রচুর মারে। আমি প্রথম প্রথম খুব মার খেতাম। এখন চালাক হয়ে গেছি। শিখে গেছি কিভাবে চিৎকার গিলতে হয়। আমি সারাদিন আমার ঘরে থাকি। একা একা। মাঝে মাঝে ওরা বের করে। গোসল করানোর জন্য। আমার একদম ভালো লাগে না গোসল। কিন্তু ওরা টেনে নিয়ে যায়। পায়ে শিকল বাঁধা নিয়ে গুটি গুটি হেঁটে যাই। এক দুই জনের
গায়ে নতুন জামা দেখা যায়। ওদের বাবা-মা এখনো বোধহয় দেখা করতে আসে। এক জায়গায় কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে পাইপ দিয়ে পানি মেরে মেরে গোসল করানো হয়। আমার কখনো কখনো দমবন্ধ হয়ে আসে।এখন শীতকাল। জায়গাটাতে হু হু করা ঠান্ডা বাতাস। ঘরের দিকে যেতে যেতে শীতে মরতে থাকি।
আমার বিছানায় আমি ঝিম মেরে থাকি। পাশ ফিরলে পায়ের শিকল শোর করে। গরগর একটা শব্দ আসে পাশের ঘর থেকে। সেখানে থাকে রুম্মান। বয়েস বেশি না। ওর চোখ সবসময় টকটকে লাল দেখি। আর রাজ্যের খিস্তি মুখে লেগে থাকে। নতুন নতুন অনেক গাল ওর মুখে শোনা যায়। আমাকে নানান গাল দিয়ে সম্বোধন করে। আজ যাওয়ার পথে আমায় ডাকলো খাউজানি চোদা।
নীলুর বাপ থাকে আমার সামনের কামরায়। উনি এখানের সবচে পুরানো লোক। কখনো কোন কথা বলেন না। সুইপার রহমান আমার রুম পরিষ্কার করতে আসলে আমার সাথে কথা পাড়ে। কাল বললো- আপনে তো মামা আর পাগল নাই। আপনেরে এইহানে রাইখ্যা দেওনের মতলব বুঝলাম না। বাড়ি পাঠাইয়া দিবার পারে আপনেরে। আমি শুনে হাসি। আমি এই জায়গার বাসিন্দাদের সব খবর পাই রহমানের কাছ থেকে। নীলুর বাপের কথা ও জেনেছি ওর মুখেই। তার গ্রামে একবার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। বউ আর দুই যমজ বাচ্চাকে পানি টান দিয়ে নিয়ে গেছিল নীলুর বাপের সামনে থেকে। তারপর থেকে এই রোগ। বলে না কোন কথা। শুনে ও না বোধহয়। নড়াচড়া করে না একদম। যেখানে যেভাবে থাকে সেখানেই পেশাব পায়খানা করে ফেলে। রহমান খুব খিস্তি করে নীলুর বাপকে। ডাকে হাগুমুতুবাবা।
আমার আজকাল এখানে থাকতে আর খারাপ লাগে না। কিভাবে কিভাবে যেন সময় কেটে যায়। আগে বাজে দুর্গন্ধে থাকতে কষ্ট হতো। এখন কেটে গেছে। শুধু থেকে গেছে পায়ের ব্যথাটা। রহমান বলে আমি ভালো হয়ে গেছি। কিন্তু এরকমই তো ছিলাম সারাটা জীবন। আমার মধ্যের আমির সাথে সারাজীবন কথা বলে গেছি। নির্জনে। মা মারা যান আমার বয়েস যখন তিন। বাবার একমাত্র সন্তান আমি। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা বিয়ে করতে পারতো, তবে করে নি। বাবা আমার সাথে মিশতো। আবার মিশতো না। আমাকে ভালবাসত কি? আমি কি বাবার ছেলের মতো হতে পেরেছিলাম? একদম না। বাবার কাছে থেকে যতোটা দূরে পারা যায় আমি থাকতে চাইতাম। আমি চাইতেই পারি। বাবা বড় ব্যবসায়ী। নানান জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে চাই্তো, পরিচয় করিয়ে দিতে চাইতো। আমি এড়িয়ে যেতাম। বেশি জোর করলে আমি ও আমার মতো জোর খাটাতাম। স্কুলে কাউকে আমার ভালো লাগতো না। সবাই আমার পিছনে লাগতো। লুলু লুমি নামে ভ্যাংচাতো। আমার শার্টে একবার নানান অকথা কুকথা লিখে ভরিয়ে দিলো। বাবা শার্ট দেখে গাড়িতেই আমাকে চড় মারলো। কয়েকদিন বাদে আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।বাসায় তিনজন স্যার রাখা হলো। বাবার বন্ধু একজন মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়া শুরু করলাম। হরেক কিসিমের পরীক্ষার পর ও উনি কোন কুলকিনারা করতে পারলেন না। বাবা ও মাঝে মাঝে যেত আমার সাথে। বাবার সাথে কোন কথা হয়নি সেই কতকাল।
বাসার স্যারদের মধ্যে একজন আমার বুকে হাত রাখতেন। হাতে মুখে আদর করতেন।পরে একদিন আমার সাথে ওইসব করলেন। আমি ব্যথায় কেঁদে উঠেছিলাম। চুমু খেয়ে বলেছিলেন- বাবু এরপর আর ব্যথা লাগবে না। দিনের পর দিন এসব চলছিল। পরে আমার ও ভালো লাগতো। কাউকে বলিও নি। আমি প্রাইভেটে এইচএসসি দিয়ে পাস করলাম। বাবা আমাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালো না। বাসায় স্যারদের আসা বন্ধ হয়ে গেলো। আমার সময় কাটতো না।বাবার বই কেনার বাতিক ছিল। কারণে অকারণে নানান বই কিনে বাসা ভরিয়ে ফেলেছিলো। খুব একটা যে পড়তো তা কিন্তু নয়। আমি সময় কাটাতে বই পড়া ধরলাম। দিন রাত পড়তাম। বাবা দেখতো, কিছু বলতো না। একদিন কি যেন হলো। হঠাৎ। বইয়ের পাতার কাল অক্ষর আমি আর দেখতে পারছিলাম না। পাতার পর পাতা অসহ্য সাদায় আমি কেমন জানি হয়ে গেলাম। আমার চোখ থেকে পৃথিবীর সব কালো অক্ষর যেন আকাশে উড়ে গেল। আমি বই ছেঁড়া শুরু করলাম। বইয়ের পর বই, বইয়ের পর বই। বাবা বাসায় ফিরে সব দেখে চুপচাপ বসে ছিলো।আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না কেন এসব করেছি।
পরদিন সকালে দেখি বাবা ড্রয়িংরুমে বসে আছে। আমাকে বললো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে। আমি তৈরি হয়ে বাবার সাথে বেরোলাম। গাড়ি চলতে চলতে চলতে আমাকে নিয়ে হাজির করলো এখানে। সে এক দীর্ঘ দীর্ঘতম জার্নি বাই কার।
(ক্রমশঃ)
মন্তব্য
পরের কিস্তি পড়তে চাই, জলদি...
দারুণ! অপেক্ষায় থাকলাম।
...............................
অন্ধকারে অন্ধ নদী
ছুটে চলে নিরবধি
মন্তব্য করতে ইচ্ছে করছে। কি অসাধারন সাবলিলতায় লেখা। কিন্তু, কি অসহ্য।
বুকভেংগে কেবল একটা শব্দই বেরোচ্ছে- 'আহারে বেচারা...'
মন্তব্যের জন্য থ্যাংকস।
আপনার গল্প উত্তরোত্তর ভালো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আপনার ভাষা আর আঙ্গিক ভীষণ সাবলীল , নির্মেদ, দৃঢ়। লেখা দিয়ে সচলায়তনকে সমৃদ্ধ করতে থাকুন।
তাই!
চমতকার লেখা
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম, তারপরে মন্তব্য। তবে এ পর্যন্ত ভালই লাগল।
স্বপ্নদ্রোহ
ভালো লাগছে
.........................................
I think what I think because that's how I am. You think what you think because that's how you are.
...........................
Every Picture Tells a Story
থ্যাংকস
আপনার ছোট বাক্য গঠনের প্যাটার্ণটা দারুণ। বাক্য যথেষ্ট শক্তি ধরে। পোকা- আমি উঠে...- সসেমিরা তিনটা গল্পের প্যাটার্ন পর্যালোচনায় তাই মনে হচ্ছে। পরিণতি আর নামকরণ নিয়ে আরেকটু ভাবতে পারেন ...।
ভালো কথা, সসেমিরা নামটা কোন এলিয়েনদের নাম থেকে নেয়া কি ?? 'কুয়াশা' সিরিজের কোন একটা বইতে এই নাম ছিলো...
______________________________________________________
মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক
আপনার বিশ্লেষণ ভাল।
ভালো লাগছে।
অপেক্ষায় রইলাম পরের অংশের
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
চলুক
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
খুব খারাপ লাগলো বেচারার জন্য । এই গল্পটা আগের দুইটার চেয়ে বেশি ভালো লাগলো। পরের পর্ব দেন যত তাড়াতাড়ি পারেন।
গল্প তা ছোটই হোক আর বড়ই হোক সেটা কি এক কিস্তিতে দেয়া যায়? সাবেক আমলে পত্রিকায় দেয়া ধারাবাহিক উপন্যাস পড়লে আর আজকের সময়ের হাজার কিস্তির সিরিয়াল দেখলে লেখকের উপর সুবিচার করা যায় না। কারণ, বিরতির জন্য পাঠক লেখার গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই ভুলে যান। কিছু ছোট ছোট খামতি হয়তো পাঠকের চোখে পড়ে যেগুলো দেখে তিনি ভাবেন পরের পর্বে সেগুলো শোধরানো হয়ে যাবে - তাই কিছু বলেন না। কিন্তু সেগুলো আর শোধরানো হয় না, পাঠকও ভুলে যান, মাঝখান থেকে গল্প আর লেখকের কিছু ক্ষতি রয়ে যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গল্পটা লেখার পর ভেবেছিলাম আর একটা কিস্তিতে শেষ করবো। কিন্তু লেখা আর এগোচ্ছে না। গল্পটা এখানেই শেষ। (ক্রমশঃ) হবে না। আর বড়গল্পের জায়গায় ছোটগল্প কি অণুগল্প হবে।
আমার প্রবলেম হচ্ছে এই গল্প আর টানা যাচ্ছে না। সরি।
এটা হলে কিন্তু অন্যায় হয়ে গেল ভ্রাতা! অনেক পাঠকই কিন্তু (আমিসহ) এটার পরের পর্বের অপেক্ষায় আছেন। অনেকেই ভেবে রেখেছেন পুরোটা পড়ে একবারে মন্তব্য করবেন বলে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দাদা,
আসলেই অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু টানতে পারছি না। সসেমিরা ২ লিখতে গিয়ে ম্লান মনোটোনাস...... লিখে ফেললাম। আজ কালের মধ্যে আমি মন্তব্যে জানাতাম। আপনার মন্তব্য পড়ে মনে হলো ,যাক এখনি লিখে জানাই।
সে এক দীর্ঘ দীর্ঘতম জার্নি বাই কার।
এরপর কোন বাক্য আর আসে না। পরে দেখলাম এখানে তো ভালোই থামে। আর বাড়ানোর দরকার কী।
ভালো থাকবেন।
সময় নিন। কিন্তু শেষ করুন গল্পটা। একটি সুন্দর গল্পের পরিণতি এমন হুট করে শেষ হিসেবে মেনে নেওয়া কষ্টকর।
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
অই মিয়া... ফাইজলামি পাইসেন?? লেখাটা এমন একটা জায়গায় আইনা শেষ কইরা দিবেন মানে?! আপনার এই ডিসিশন আমরা মানি না- মানবো না। দ্বিতীয় কিস্তির অপেক্ষা করতে রাজী আছি, কিন্তু এইখানে শেষ হইতে দিমুনা। সাফ দাবী...
এ জাতি বড় সাহিত্যপ্রেমী বস... ভালো কিছুকে উৎসাহিত করা যেমন জানি... ভালো কিছুকে বাধার সম্মুক্ষীণ হতে দেখলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতেও কুন্ঠাবোধ করি না।
মনজুর এলাহী
এই কথা চলতো না। পরের অংশ চাই-ই চাই..................
শুভাশীষদা,
ধানাই ফানাই বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দ্যান তো। কোন কথা হইলো এটা। লেখেন জলদি।
গল্পের পরের অংশ চাই-ই চাই।
নতুন মন্তব্য করুন