ছফাগিরি। কিস্তি তিন।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: সোম, ৩০/১১/২০০৯ - ১:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছফাগিরি। কিস্তি এক।
ছফাগিরি। কিস্তি দুই।

আমি ছফাগিরির কিস্তি দুইয়ে লিখেছিলাম, উনিশশো একানব্বই সালের সেই ট্রমা থেকে আমি এখনো বেরিয়ে আসতে পারি নি। ধর্ম কিভাবে মানুষে মানুষে আকাশ-পাতাল ফারাক তৈরি করে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আর সাম্প্রদায়িক মনোভাব জন্মানোর ইতিহাস বুঝে নিতে আমি পড়া শুরু করি নানানজনের লেখা। ছাপার অক্ষরে যা থাকে তার মাঝে কতো মিথ্যা থাকে, আস্তে আস্তে আমার কাছে পরিষ্কার হয়। এরও অনেকদিন বাদে আমার হাতে আহমদ ছফার লেখা আসে। ছফার লেখা সাথে সাথে ছফাকে নিয়ে প্রায় সব লেখা যোগাড় করে পড়তে থাকি। ছফার জীবনধারণ, কথাবার্তা, লেখালেখি এই সবের মধ্যে আমি বুঝে নেই- এই লোক যথেষ্ট কামেল । কারণ এঁর কথাবার্তায় পুরানো বুলির চর্বিত চর্বণ নাই। আনকোরা প্যাঁচছাড়া লেখা। আর সত্যভাষণ। এবং সাথে সাথে দুর্বিনীত সাহস।

আগের কিস্তিতে ছফার আঙ্গিকে বঙ্কিমের রাষ্ট্রবেত্তা চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেছি। শতবর্ষের ফেরারিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- ছফা এই প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন-

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেভাবে মুসলমান বিজেতাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাঁদের পররাজ্য লোভী তস্কর, প্রজাপীড়ক, পর ধর্মবিদ্বেষী এবং লুন্ঠনকারী বলে অভিযুক্ত করেছেন, তেমনটি অন্য কোন লেখক করেননি। তথাপি তিনি বিজেতাদের সামরিক শ্রেষ্ঠতার প্রশংসা করেছেন। সুলতান মাহমুদ যে একজন দক্ষ সেনাপতি এবং বিচক্ষণ রণপন্ডিত ছিলেন মেনে নিতে কোন রকম কুন্ঠাবোধ করেননি। আক্রমণকারী মুসলমান রাজাদের সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ভারতীয় হিন্দু রাজন্যবর্গ অপেক্ষাকৃত হীনবল ছিলেন এবং তাঁদের সামরিক সংগঠন দুর্বল ছিল, ওগুলো বঙ্কিম অম্লানবদলে কবুল করে নিয়েছেন।

বঙ্কিমের ব্যক্তিমানসের সাথে তাঁর শিল্পীমানসের দ্বন্দ্ব ছফার চোখ এড়ায়নি-

চাকুরি জীবনে বঙ্কিমের লাঞ্ছনা, পারিবারিক দুর্যোগ, একমাত্র কন্যার অকাল মৃত্যু বঙ্কিমের ব্যক্তিগত জীবনকে হতাশার এমন এক চূড়ান্ত পর্যাতে ঠেলে দিয়েছিলো; একমাত্র ধর্মের মধ্যেই সান্ত্বনা সন্ধান করতে হয়েছিলো। তরুণ বয়সের সাধনা বলে বঙ্কিম চিন্তা করার যে অপূর্ব ক্ষমতা আয়ত্ব করেছিলেন, সেই জিনিশটিকে উল্টোদিকে প্রবাহিত করতে বাধ্য হলেন, বঙ্কিমের জীবনচরিত পাঠক তাঁর বিরুদ্ধে কঠিন অভিযোগ উত্থাপন করার পরও দুঃখবোধ না করে পারবেন না। আহ্! কি আশ্চর্য মানুষ। কি করতে পারতেন , আর কি করলেন।

বঙ্কিমকে নিয়ে ছফার প্রবন্ধটির হালকা নির্যাস আমার লেখা থেকে কিছুটা পাবেন। মূল লেখাটা পড়লে ছফার চিন্তার পুরো মোকাবিলা সম্ভব।

এবার আসি দ্বিতীয় প্রবন্ধে। বাঙালী(১৯৭৭ সালে প্রকাশিত এই লেখায় বাঙালি বানান করা হয়েছে ঈ-কার করে।ছফার লেখা থেকে করা কোটে ঈ-কার বানানটা অনুসরণ করা হলো) মুসলমানের মন।‘শহীদে কারবালা’ পুঁথির কথা দিয়ে লেখা আরম্ভ করেছেন আহমদ ছফা। সাথে বিবেচনা করেছেন অন্যান্য পুঁথি আর সেগুলোর ভাষ্য নিয়ে। যদ্যপি আমার গুরুতে বঙ্কিমের লেখার সাথে পুঁথির তুলনা করেছেন প্রফেসর রাজ্জাক-

পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটা মূল্যবান বই লিখেছিলেন। নামটা জানি কী। তিনি দেখাইছেন, যে সময়ে বঙ্কিমের উপন্যাসগুলো প্রকাশ পাইবার লাগছিল, একই সময়ে বটতলার মুসলমানি পুঁথিগুলাও মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা অইয়া বাইর অইতে আছিল। বঙ্কিমের উপন্যাস দুইশ আড়াইশর বেশি ছাপা অইত না। কারণ আধুনিক সাহিত্য পড়ার পাঠক আছিল খুব সীমিত। কিন্তু বইটা পড়লে দেখতে পাইবেন মুসলমানি পুঁথি ছাপা অইতেছিল হাজারে হাজারে। বঙ্কিমের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পুঁথির বিষয়বস্তুর তুলনা করলে ডিফারেন্সটা সহজে বুঝতে পারবেন।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সেই বইয়ের নাম ‘ন্যাশনালিস্ট থট এন্ড দা কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ডঃ আ ডেরিভেটিভ ডিসকোর্স’। বইটির অধ্যায় তিন লেখা হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে। এক জায়গা থেকে কিছুটা অনুবাদ করে দিচ্ছি-

সংস্কৃতির সম্পূর্ণ ধারক, মতবাদের তত্ত্বীয় দিক কি বাস্তবজীবনের বুনিয়াদ সব দিক মিলিয়ে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বঙ্কিমের মনে যে দৃঢ়বিশ্বাস দানা বেঁধেছিল সেটা আধুনিক এয়ুরোপের খাঁটি বস্তুতান্ত্রিক আদর্শের চেয়ে বেশি এথ্‌নিক ছিল। সময়স্রোতের জঞ্জাল সরিয়ে সংশোধিত, বিকশিত আদর্শবাদী হিন্দুত্বের কথা বলতে চেয়েছেন তিনি। … বঙ্কিম তাঁর শেষের দিকের লেখাগুলোতে আধুনিক ভারতের জাতীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। আধ্যাত্মিকতার দখলদারি মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতার সাথে একটা যুক্তিযুক্ত তত্ত্বের উপর যা খাড়া ছিল।ভারতের সংখ্যাগুরুদেরকে একটা একক জাতীয় সংস্কৃতির তলে একত্রীভূত করতে এই তত্ত্বের আদর্শ কাজ করছিল। আর এই জিনিসের আবিষ্কার করতে গিয়ে বঙ্কিমের চেতনাপ্রবাহে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার মুখোশ পরে আর চাপা থাকেনি। বঙ্কিম ইসলামের ক্ষমতা ও মহিমার দিকে পশ্চাদ্ধাবনকে ঠিকমতো বুঝে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই ধর্মকে তিনি ভেবে নিলেন আধ্যাত্মিক কি এথ্‌নিক গুণশুন্য।তাঁর আদর্শের বিপরীত ঠাউরে এই ধর্মকে ধরে নিলেন অযৌক্তিক, গোঁড়ামিপূর্ণ, সর্পিল, ভোগবিলাসী আর অনৈতিক।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এই লেখা থেকে আরো কিছু অংশের অনুবাদ পরের কিস্তিতে দিবো। সংখ্যাগুরু সমাজের বিশ্লেষণকারী হিসেবে লেখালেখির সাথে সাথে আহমদ ছফা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়েও লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধ ‘বঙ্গভূমি আন্দোলন, রাষ্ট্রধর্ম, মুক্তিযুদ্ধঃ বাংলাদেশের হিন্দু ইত্যাকার প্রসঙ্গ’ পড়লে কিছুটা আন্দাজ হবে।পরের কিস্তিতে এই প্রবন্ধের উল্লেখ থাকবে। ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ নিয়ে আলোচনা পরের কিস্তিতেও এগোবে।

আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানের স্বরূপ সন্ধানে সেই কালের লেখকদের বিচার করতে চেয়েছেন। ফলে পুঁথিলেখকদের মনোজগৎ বুঝে নেয়া তাঁর জন্য জরুরী হয়ে ওঠে। ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ধারার প্রভাব তাঁদের লেখায় এসে গেছে অগোচরে। সেইসব লেখকদের পঠনব্যাপ্তি ছিল খুবই সীমিত। ইসলামের নামে এক পাঁচমিশালী ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা লিখে গেছেন। পুঁথিলেখকদের অনেকেরই আরবী ফার্সী জ্ঞান ছিল না, ইসলাম শাস্ত্রে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাঁদের লেখায় ঐতিহাসিক তথ্যের যেমন ঘাটতি ছিল, তেমনি সমাজব্যবস্থার প্রচলিত দিক ও উঠে আসেনি। ছফার মুখে শুনি-

হিন্দুদের দেব-দেবী এবং কাব্যোক্ত নায়ক-নায়িকাদের প্রতি মনে মনে একটি বিদ্বেষের দূরস্মৃতিও সক্রিয় ছিলো। কেননা এই দেব-দেবীর পূজারীদের অত্যাচার এবং ঘৃণা থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় তাঁদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে বৌদ্ধ ধর্ম এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই মুসলমান পুঁথিলেখকেরা তাঁদের রচনায় যখনই সুযোগ পেয়েছেন, এই দেব-দেবীর প্রতি তাচ্ছিল্য এবং ঘৃণা প্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজের দেব-দেবী, নায়ক-নায়িকার প্রভাব থেকে তাঁদের মন মুক্ত হতে পারেনি। তাই তাঁরা সচেতনভাবে এই দেব-দেবীদের প্রতিস্পর্ধী নায়ক এবং চরিত্র যখন খাড়া করেছেন, এই সৃষ্ট চরিত্র সমূহের মধ্যেই দেব-দেবী নতুনভাবে প্রাণ পেয়েছে। হযরত মুহম্মদ, হযরত আলী, আমীর হামজা, মুহম্মদ হানিফা, বিবি ফাতেমা, জৈগুন বিবি এই চরিত্রসমূহ বিশ্বাসে এবং আচরণে, স্বভাবে চরিত্রে যতো দূর আরব দেশীয়, তার চাইতে বেশি এদেশীয়।তাঁদের মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা এবং হৃদয়াবেগ কাব্যলেখক চাপিয়ে দিয়েছেন তা একান্তভাবেই বঙ্গদেশে প্রচলিত দেব-দেবীর অনুরূপ। বাইরের দিক থেকে দেখলে হয়তো অতোটা মনে হবে না। কিন্তু গভীর দৃষ্টিক্ষেপ করলে তা ধরা না পড়ে যায় না। বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা সাহিত্যের দুই মুখ্য উপাদান। বিশ্বাস অভিজ্ঞতার নবরূপায়নে সাহায্য করে। আলোকিত বিশ্বাস আলোকিত রূপায়ন ঘটায় এবং অন্ধবিশ্বাস অন্ধরূপায়ন। মুসলমান পুঁথিলেখকদের বিশ্বাসের যে শক্তি তা অনেকটা অন্ধবিশ্বাস, ইসলামী জীবনবোধসমৃদ্ধ বিমূর্ত কোনো ধারণা তাঁদের অনেকের ছিলো না। তাই তাঁদের শিল্পকর্ম অতোটা অকেলাসিত। প্রতি পদে কল্পনা হোঁচট খেয়েছে বলে তাঁদের রচনার শক্তি নেই।আলাওল দৌলত উজীর প্রমুখ মুসলমান কবি উৎকৃষ্ট কাব্যরচনা করতে পেরেছেন। তার কারণ তাঁদের কতিপয় সুযোগ ছিলো।

অনগ্রসর জনসমাজ ইসলামের নামে যেসব কথা শুনতে চাইতো পুঁথিলেখকরা সেই অনুসারে লিখতেন। ছফা বিশদ করেছেন এভাবে-

বাঙালী মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্যে উদ্ভট রসের অতি বেশি ছড়াছড়ি। হিন্দু মহাকাব্য এবং পুরাণসমূহের বীর-বীরাঙ্গনাদের চরিত্রের অপভ্রংশ মুসলিম কবিদের সৃষ্ট বীরদের মধ্যে নতুন করে জীবনলাভ করেছে। তাই পুঁথিসাহিত্যে অগ্রসরমানতার চাইতে প্রতিক্রিয়ার জের অধিক। মনের হীনমন্যতাবোধ থেকেই এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি।এর পেছনে একগুচ্ছ ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান। মুসলমান পুঁথিলেখকরা সচেতনভাবে এক সামাজিক আদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে আরেকটি সামাজিক আদর্শ, একটি শিল্পাদর্শের বদলে আরেকটি শিল্পাদর্শ নির্মাণের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নতুন শিল্পাদর্শটির চেহারা কি রকম হবে, জীবনের কোন মূল্যচেতনার বাহন হবে, অতীতের কতোদূর গ্রহণ করবে, কতোদূর বর্জন করবে, সে সম্বন্ধে তাঁদের মনে কোন পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিলো না। তাই তাঁরা অনেক সময়ে বহিরঙ্গের দিক দিয়ে নতুন সৃষ্টি করলেও, আসলে তা ছিলো গলিত অতীতেরই রকমফের। উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, পরিচ্ছন্ন চিন্তার বদলে ভাবাবেগই তাঁদের শিল্পদৃষ্টিকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে রেখেছে।এক সময়ে এই মুসলমানের পূর্ব পুরুষেরা যে উঁচু বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, এই অপমানজনক দূরস্মৃতি বাইবেলের ‘অরিজিনাল সীন’ বা আদি পাপের ধারণার মতো তাঁদের মনে নিরন্তর জাগরূক থেকেছে। মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্যের প্রতিক্রিয়াশীলতা আসলে সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতারই সাহিত্যিক রূপায়ন। সে বিষয়টির স্মরণে রাখার প্রয়োজন আছে। মুসলিম শাসনের অবসানের পর এই সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরো গভীর এবং অন্তর্মুখী রূপ পরিগ্রহ করে। এই প্রতিক্রিয়ার জের বাঙালী মুসলমান সমাজে এতো সুদূরপ্রসারী হয়েছে যে উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী গদ্য লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সুবিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থটিতে ও ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথির ব্রাহ্মণ আজরকে একই চেহারার, একই পোষাকে, একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সময়ের পালাবদলের পালা ব্যাপারটি এই অত্যন্ত শক্তিধর লেখকের মনে সামান্যতম আঁচড়ও কাটতে পারেনি।

প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম কিভাবে হয় ছফা তার ইতিহাস বুঝে নিতে চেয়েছেন। ছফা কী কখনো ভেবেছিলেন তাঁর গায়েও প্রতিক্রিয়াশীলতার তকমা সাঁটবে কেউ কেউ। যদ্যপি আমার গুরু বইয়ের শুরুতে ছফা লেখেছিলেন-“ যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায় / তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়”। মাঝে মাঝে বোধহয় ইশারাই কাফি।

পুঁথিলেখকরা যেভাবে অজানা বিষয়ের দিকে অন্ধভাবে ধাবিত হয়েছিল। হিন্দু লেখকদের কিন্তু তা করতে হয় নি। সামাজিক অভিজ্ঞতাকে তাঁরা লেখায় ঠিকমতো আনতে পেরেছিলেন। আত্মপ্রত্যয়ের সাথেই। ইসলামের আসল স্বরূপ, তার দার্শনিক অবলোকন পুঁথিওয়ালারা করেছে লোকশ্রুতি কি দূরকল্পনা থেকে … নবদীক্ষিত মুসলমানদের বেশীর ভাগই ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাই আর্য সংস্কৃতিরও যে বিশ্বদৃষ্টি এবং জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে একটা প্রসারিত বোধ ছিলো, বর্ণাশ্রম ধর্মের কড়াকড়ির দরুণ ইসলাম কিংবা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে সে সম্বন্ধেও তাঁদের মনে কোনো ধারণা জন্মাতে পারেনি। পাশাপাশি ইসলামও যে একটা উন্নততরো দীপ্ত ধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সাধন করেছিলো, বাঙালী মুসলমানের মনে তার কোনো গভীরাশ্রয়ী প্রভাবও পড়েনি বললেই চলে। … এয়ুরোপীয় রেনেসাঁয় মুসলমানদের যে অবদান তার ছোঁয়া ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর একবারেই লাগেনি। ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যার ছিঁটেফোটা বাঙাল মুলুকে লাগে নি বলে ছফা রায় দিয়েছেন … নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পরে স্থানীয় মুসলমানরা ইংরেজ আমলের দিশী খ্রিষ্টানদের মতো একটা উন্মত্ত গর্ববোধ ছাড়া ইসলামী কিংবা আর্য সংস্কৃতির কিছুই লাভ করতে পারেননি।… আরবী, ফার্সি কি উর্দুর প্রতি টান ছিল পুঁথিপত্রের লেখকদের। কিন্তু এই ভাষাগুলোকে পূর্ণরূপে রপ্ত করার মতো আর্থিক এবং সামাজিক বুনিয়াদ তাঁদের ছিলো না। ফলে বাংলা ভাষার সাথে এসব ভাষা মিশিয়ে মিশেল এক ধরণের কাব্য রচনায় তাঁরা মাতলেন … সুযোগ পেলে তাঁরা আরবীতে লিখতেন, নইলে ফার্সীতে, নিদেন পক্ষে উর্দুতে। কিন্তু যখন দেখা গেলো এর একটাও সামাজিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয় তখন বাধ্য হয়েই বাংলা লিখতে এসেছে। কেউ কেউ সন্দ্বীপের আবদুল হাকিমের সেই ‘ যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী/ সেজন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ পংক্তিগুলো আউরে বলে থাকেন যে নিজেদের ভাষার প্রতি পুঁথিলেখকদের অপরিসীম দরদ ছিলো। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আবদুল হাকিমের এই উক্তির মধ্যে একটা প্রচন্ড ক্ষোভ এবং মর্মবেদনা লক্ষ্য করা যায়। নিশ্চয়ই সে সময়ে এমন লোক ছিলেন যাঁরা সত্যি সত্যি বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতেন। আবদুল হাকিম নিজে সে শ্রেণীভুক্ত নন, তাই সে উঁচু ভাষাতে তাঁর অধিকারও নেই। তাই তিনি তাঁর একমাত্র আদি এবং অকৃত্রিম ভাষাতেই লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।১০

সরদার ফজলুল করিম একটি বই লিখেছিলেন প্রফেসর রাজ্জাককে নিয়ে।‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজঃ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর আলাপচারিতা’। সেখানে বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে ইংরেজদের ঘাড়ে পুরা দোষ চাপিয়ে মুক্তি খোঁজার ব্যাপারটা রাজ্জাক সাহেব খানিকটা ব্যাখ্যা করেছেন। … ১৮৫৭ –এর পরে ইংরেজরা মুসলমানদের প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে তাদের সমস্ত ক্ষেত্র থেকে বাদ দিয়ে দিল আর সে কারণেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ল, একথা ঠিক নয়। শিক্ষিত মুসলমানরা বৃটিশ সরকার ও শাসনের সঙ্গে নন কো-অপারেশন করেছিল, একথাও ঠিক নয়।১১ … ১৮১৪ সালে কোলকাতার উকিলদের যে তালিকা আমরা দেখি তাতে দেখা যায় ১৬ জন উকিলের মধ্যে ১৪ জন মুসলমান। ১৮৬৫ সালেও ৫০% উকিল মুসলমান, কিন্তু তারপর থেকে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া শুরু হলো। এর প্রধান কারণ , ইংরেজি শিক্ষার দিকে এই শিক্ষিত মুসলমানরা একেবারেই ঝুঁকলো না।১২

মুসলমান সমাজের যে অধঃপতন শুরু হয়েছিল তার প্রকৃত কারণ কী সেই দিকে ছফা তাকালেন গভীরভাবে। পলাশীর যুদ্ধের পর বাঙালি মুসলমানদের নেতৃশ্রেণী কোন সঠিক পথে এগোতে পারেনি। কিন্তু উত্তর ভারতে ঘটেছে তার উল্টো ঘটনা। প্রথমদিকে নেতৃশুন্য থাকলেও পরে স্যার সৈয়দ আহমেদের নেতৃত্বে সেখানকার মুসলমানেরা একটা দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছায়। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নাই। … প্রায়শঃ হালের একগুঁয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা বলে থাকেন, বৃটিশ শাসনের আমলে বাংলার মুসলমান সমাজ অধঃপতনের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটা পুরো সত্য তো নয়ই, সিকি পরিমাণ সত্যও এর মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ। সত্য বটে, মুসলিম শাসনের অবসানের পর শাসক নেতৃশ্রেণীটির দুর্দশার অন্ত ছিল না। কিন্তু তাদের সঙ্গে সাধারণ বাঙালী মুসলমান জনগণের একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোন যোগসূত্র ছিলো কি? নবাবী আমলেও এ দেশীয় ফার্সী জানা যে সকল কর্মচারী নিয়োগ করা হতো, তাঁদের মধ্যে স্থানীয় হিন্দু কতোজন ছিলেন এবং কতোজন ছিলেন স্থানীয় মুসলমান, এ সকল বিষয় বিচার করে দেখেন না বলেই অতি সহজে অপবাদের বোঝাটি ইংরেজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাঁরা দায়িত্বমুক্ত মনে করেন। উত্তর ভারতে মুসলিম শাসক নেতৃশ্রণী একইভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন, অধিকন্তু তাঁদের অনেকেই সিপাহী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপরেও তাঁরা কি করে এগিয়ে আসতে পারলেন এবং তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হলো স্যার সৈয়দ আহমদের মতো একজন মানুষ? বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে তেমন একজন মানুষ জন্মালেন না কেনো? এই সকল বিষয়ের সদুত্তর সন্ধান করলেই বাঙালী মুসলমানের যে মৌলিক সমস্যা তার মূলে যাওয়া যাবে।১৩

কিন্তু কেন? কেন সেই সময়কার বাঙালি মুসলমানরা এক পা এগিয়ে আসতে গিয়ে তিন পা পিছিয়ে যেত? ছফা আমাদেরকে সেগুলো প্রশ্নের আকারে দেন। আর কিয়দাংশে উত্তর ও করেন।

সূত্র

১। আহমদ ছফার প্রবন্ধ – (ষ্টুডেণ্ট ওয়েজ , জানুয়ারী ২০০০) [পৃষ্ঠা ৪১]
২। [পৃষ্ঠা ৪২]
৩। যদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা (মাওলা ব্রাদার্স , মে ২০০০) [পৃষ্ঠা ৫৯]
৪। Nationalist Thought and The Colonial World, Partha Chatterjee (London, ZED Books Ltd., 1986 ) [Page 77]
৫। [Page 77]
৬। আহমদ ছফার প্রবন্ধ – (ষ্টুডেণ্ট ওয়েজ , জানুয়ারী ২০০০) [পৃষ্ঠা ৫৬]
৭। [পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮] ৮। [পৃষ্ঠা ৫৮] ৯।[পৃষ্ঠা ৫৯] ১০। [পৃষ্ঠা ৬১]
১১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজঃ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর আলাপচারিতা –
সরদার ফজলুল করিম (সাহিত্য প্রকাশ, জুন ২০০০) [পৃষ্ঠা ১৮]
১২। [পৃষ্ঠা ১৯]
১৩। আহমদ ছফার প্রবন্ধ – (ষ্টুডেণ্ট ওয়েজ , জানুয়ারী ২০০০) [পৃষ্ঠা ৬১]


মন্তব্য

আবেদ এর ছবি

লেখা খুবই ভালো হচ্ছে। আপনার লেখার মাধ্যমে ছফাগিরিকে অনেক দূর পর্যন্ত আপনাকে টানতে হবে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দেখি কতোদূর পর্যন্ত লেখা যায়।

হাসিব এর ছবি

লিখতে থাকুন । বেশ ভালো একটা এ্যাকাডেমিক ধাঁচের সিরিজ পাচ্ছি । পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম ।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

হাসিব ভাইয়ের সাথে একমত ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসিব ভাই,

থ্যাংকস।

মানিক ভাই,

একটা হেল্প দরকার। মাসিক চিন্তার ছফাকে নিয়ে সংখ্যাটা দরকার। স্ক্যান করে পাঠানোর কোন উপায় কি আছে?

মন্তব্যের জন্য থ্যাংকস।

স্বাধীন এর ছবি

চলুক.........

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার ছফাগিরি উপভোগ করছি।

স্বপ্নদ্রোহ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ধন্যবাদ .........

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

পড়ছি। ভালো লাগছে। সে সঙ্গে জানতে পারছি অনেক নতুন কিছু। ধন্যবাদ।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনার ভালো লাগছে শুনে খুশি হলাম।

রাহিন হায়দার এর ছবি

আলোচনায় শামিল হবার সামর্থ না থাকলেও পড়ছি আপনার চমৎকার লেখাগুলো। চলুক চলুক

________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ছফাসমগ্র কিনে পড়া ধরেন। আলোচনায় আসতে পারবেন ইজিলি।

ফরিদুর এর ছবি

আপনার লেখা নিরাশ করছে না, নানা কিছু জানছি। ছফার উপর আপনার দখল আছে। লিখে যেতে থাকেন ছফাকে নিয়ে, একদম থামবেন না। আমি, আমরা আপনার লেখার জন্য সচলায়তনে ঢুঁ মারছি প্রতিদিন। আরো লেখা নামানোর জন্য আগেভাগে ধন্যবাদ দিয়ে রাখছি।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কন কি! অন্যদের লেখাও পড়ুন।

মামুন হক এর ছবি

খুব মন দিয়ে পড়ছি হাসি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ভালো কথা। চোখ টিপি

বর্ষা এর ছবি

ছফাকে নিয়ে এতো কম আলোচনা হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে জোস হচ্ছে। সেই সাথে আপনার এনালাইসিস। আবার প্রিয়তে নিলাম। বইগুলো বড্ড মিস করছি।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি


আমি মনে করতাম বাংলাদেশের নয়া জেনারেশন ছফার লেখার সাথে পরিচিত। সচলে ছফাগিরি ছাপানোর পর মন্তব্যের বহর দেখে বুঝলাম , ছফা কেউ পড়েই নাই। এটা অনেক ডিসটার্বিং একটা বিষয়। লোকজন বাংলা ভাষায় লিখে লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলছে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর ইনটিগ্রিটিওয়ালা লেখকের লেখা পড়ছে না- এটা মানা কষ্টকর।

বর্ষা এর ছবি

ঠিক বলেছেন। আমার মনে আছে আমি ছফার বই প্রথম পড়েছি ; 'গাভীবৃন্তান্ত'---বুয়েটের ২য় বর্ষের পি এল এ। আমার মনে আছে বইটি শেষ করে অনেকক্ষণ
বসেছিলাম। মনে হইছিলো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পর আরেক জন মনে হয় বাংলা শিত্যে এলেন যে মনোস্তাত্তিক বিশ্লেষণের সাথে কোনো গল্পের প্লটের গাঁথুনি তৈরি করতে পারেন। আর বইএর ঘটনাগুলো এতো নির্মম ভাবে সত্যি ছিলো----আমার খুব হাসি পেয়েছিলো চরিত্র গুলোর সাথে পরিচিত আংকেল আন্টির মিল পেয়েছিলাম।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

নৈষাদ এর ছবি

শুভাশীষ ভাই, চমৎকার সিরিজ চলছে। পাঠকের বিস্তারিত মন্তব্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে সিরিজটাকে।

তবে... বাংলা ভাষায় লিখতে হলে আহমদ ছফার লেখা পড়তে হবে, এটা মানাও ব্যাক্তিগত ভাবে আমার জন্য কষ্টকর।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ছফা পড়ছে না -তাই খেদোক্তি।

সবুজ বাঘ এর ছবি

খুবই দারুণ। নিজেরে একা মনে কইরেন না, লগে আছি।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনি লগে আছেন দেইখা ভালা লাগলো। মন্তব্যে অংশ নেন। একা একা সবাইরে জবাব দেওন তো টাফ। আর সব বইও লগে নাই।

শেহাব [অতিথি] এর ছবি

বস চালান...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হ। চালাইতেছি।

রণদীপম বসু এর ছবি

এই তৃতীয় পর্বে এসে আপনার লেখাটা জমতে শুরু করেছে। এগুতে থাক....

গত বইমেলাতে খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পনি-এর প্রকাশনায় প্রথম সমগ্র আহমদ ছফা রচনাবলী (৮ খণ্ডে সমগ্র) চোখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে নিয়ে এসেছিলাম নিবিড় পাঠ করার নিভৃত ইচ্ছা নিয়ে। আগে ছুটকা-ছাটকা দুয়েকটা ছফা পড়েছিলাম অবশ্য। সেটা কোন বিবেচনায়ই যথেষ্ট নয়। তাই গোটা সমগ্র নিয়ে লেগে পড়বো পড়বো করেও এখনো বইয়ের কড়কড়ে গন্ধ তেমনি রয়ে গেছে। বুকসেলফ আলো করে রাখা খণ্ডগুলো এখন চোখ টাটাচ্ছে অদ্ভুতভাবে। মনে হচ্ছে এবার শুরু করে দিতে হবে অন্য সব বাদ দিয়ে। সে পর্যন্ত কোন মন্তব্য করার সাহস পাচ্ছি না। তবে কৌতুহলী পাঠক হিসেবে আপনাকে অনুসরণ করে যাচ্ছি এবং ধুন্ধুমার মন্তব্যগুলোর চমৎকারিত্বও উপভোগ করছি, এটা এই পর্বে এসে জানান দিয়ে রাখলাম।

খুব সংবেদনশীল বিষয়-চর্চা হাতে তুলে নিয়েছেন। আশা করছি প্রয়োজনীয় মনোনিবেশ ও সতর্কতায় ঘাটতি হবে না। আর লেখাকে জোর করে ছেটে দিয়ে ছোট করারও দরকার নেই। বরং এসব লেখার দীর্ঘতায়ই রস জমে ভালো। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেভাবে আগায় আগাতে থাক। চলুক না, দেখা যাক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় !

অনেক ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

রণদা,

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি এর ছবি

বস,

আপনার লেখা দুর্দান্ত ভালো হচ্ছে। নিয়মিত ছফাগিরি নিয়ে লেখা নামান।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বসলাম।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ছফা পড়তে পড়তে আমরা একটা ঝাঁপসা (কিংবা নিজের মতো পরিষ্কার) ধারণা হয়েছিল যে বর্তমান বাংলাদেশের চিন্তাস্রোতকে একমাত্র ছফাই স্কেচ করতে করতে পেরেছেন সরাসরিভাবে (গ্রহণীয় হোক কিংবা বর্জনীয়)

কিন্তু ধারণাটাকে কোনোদিন সমীকরণ করা হয়নি
আপনার এই সিরিজি আমার ধারণা সেই সমীকরণটাই করছে

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লীলেন ভাই,

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ঠিক বলছেন, ছফাই পারে ঠিকঠাক স্কেচ করতে।

ছফার মতো বড় মাপের কাউকে ধরার জন্য আমি তথ্যসূত্র দিতে পারি, এর বেশী কিছু না। তাঁর চিন্তাধারাকে সমীকরণে ফেলার যোগ্যতা আমার নেই।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মোরশেদ শফিউল হাসানের একটা বই পড়লাম সম্প্রতি- "ছফা ভাই- আমার দেখা আমার চেনা"...। সেই বর্ণনা এবং আপনার সিরিজের থেকে সে সময়ের পটে একজন মৌলিক মানুষের রুপ বেরিয়ে আসছে।

... চলুক।

_________________________________________

সেরিওজা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

শফিউল সাহেবের বইটা পড়ছিলাম। চলে।

আমি এখানে উছিলা ছাড়া আর কিছু না। পারলে টাকা জমিয়ে ছফাসমগ্র কিনে পড়েন। ছফাকে বুঝতে চাইলে তাঁর নিজের জবানে পড়তে হবে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এই সিরিজটা অনেক মনোযোগ দাবী করে।
আপনার কল্যানে ছফা পুনঃপাঠের সুযোগ হলো।
কৃতজ্ঞতা। চলুক।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ধন্যবাদ, মোরশেদ ভাই।

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

পড়ছি, ভালো লাগছে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ধন্যবাদ, মোস্তাফিজ ভাই।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম কিভাবে হয় ছফা তার ইতিহাস বুঝে নিতে চেয়েছেন। ছফা কী কখনো ভেবেছিলেন তাঁর গায়েও প্রতিক্রিয়াশীলতার তকমা সাঁটবে কেউ কেউ। যদ্যপি আমার গুরু বইয়ের শুরুতে ছফা লেখেছিলেন-“ যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায় / তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়”। মাঝে মাঝে বোধহয় ইশারাই কাফি।

এই "কেউ কেউ" দের ছফা বিরোধীতার মূলে আছে রাজনীতি যে রাজনীতি ছফার লাশ কবরস্থ করা নিয়ে করেছে ইতরামি ।

আপনার সিরিজ শেষ হলে আপনার লেখা আর সচলদের মন্তব্য- প্রতিমন্তব্যে যে বিষয়গুলি উঠে এসেছে সে ব্যাপারে আমার বক্তব্য প্রকাশ করবো পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবে । আমি নিয়মিত সিরিজে নজর রাখছি কিন্তু ব্যক্তিগত কারনে এখন বিশদে যাবার উপায় নেই ।

আপাতত স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার নকঁশাকার শিবনারায়ন দাশের দুই লাইন নিচে দিলামঃ

"আমি নিজে প্রগতিশীল বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেই ছাত্রজীবন থেকে । কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বা প্রগতিশীল মানুষ শুধু বক্তৃতার মঞ্চে বা টিভি স্ক্রিনে পেয়েছি । প্রতিদিনের জীবন চর্চায় আমি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মানুষ আমার জীবনে দু’জনকে পেয়েছিলামঃ এক ) আমার রাজনৈতিক গুরু শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত , দুই, আহমদ ছফা । "

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মানিক ভাই,

অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

ব্যক্তি ছফা লেখক ছফাকে বুঝে নেয়ার জন্য আস্তে আস্তে এগোনো ভালো। কিস্তিটা কতোদূর টানবো বুঝতে পারছি না। আপনি সময় করে মন্তব্য করে যাবেন এই আশা রাখছি। এবং বিশদে।

শিবনারায়ন দাশের কথাটা উল্লেখ করার জন্য ধন্যবাদ।

মাসিক চিন্তার ছফা সংখ্যাটা খুব দরকার। কিছু কি করা যায়?

সুমন সুপান্থ এর ছবি

সচলে আসতে পারি না অনেকদিন ! একটা লেখাও ঠিক মতো পড়া যাচ্ছে না। দৌড় না তো পুরো ম্যারাথনের উপরে আছি । তবু, তবু শুভাশীষ, আপনার এই সিরিজের সব ক'টি পর্বই পড়া হয়েছে ক য়ে ক বার করে !!!
সচলে তো বটেই, এমনিতেও এমন মনোযোগ দিয়ে কোন লেখা পড়া হয় নি বহু বহুদিন !

মানিক ভাইর কথা কোট করেই বলি, 'আপনার সিরিজ শেষ হলে আপনার লেখা আর সচলদের মন্তব্য- প্রতিমন্তব্যে যে বিষয়গুলি উঠে এসেছে সে ব্যাপারে আমার বক্তব্য প্রকাশ করবো পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবে '

তবু একটা গল্প মনে পড়লো । পাড়ার ক্রিকেটে এক বড় ভাই বেদম ছক্কা মারতো । ডিপ স্কয়ার লেগ কি, লং অফে ফিল্ডিং করার কালে যখন মাথার উপর দিয়ে বল বাইরে গেলো, শুধু আমি কেন প্রায় সবাই বলতাম , ছক্কা হইছে ঠিক, কিন্তু তোমার এই শট কিন্তু ঠিক হয় নাই ! মাঠ ছোট বলে বাইচ্চ্যা গেলা ।
কিন্তু মনে মনে জানতাম, এই মাঠ কেন ওয়ন্ডারার্স হলেও এটা ছক্কাই হতো। মুখে বলতাম না, ('আসলে মাথার উপর দিয়া গেছে তো ! " )

আহমদ ছফা মনে হয় আমাদের সেই বুজুর্গ ছক্কা পেঠানো লেখক, যার বলগুলো ক্রমশই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আমাদের !
তাকে মাটিতে নামিয়ে আনার হিম্মতওয়ালা ফিল্ডার যে আমরা এখনো হই নি ___ সেটা আমাদের মনেই থাকে না !

আপনাকে ধন্যবাদ ,শুভাশীষ ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনার মন্তব্যের প্রতি-মন্তব্য কি হতে পারে সেটা অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোন কিনারা হলো না। অনেক কয়বার পড়ছেন সেটা শুনেই মন ভরে গেল।

ছফাকে সহজ করে দাঁড় করানোর এলেম আমার নেই। আমি যা লিখছি সেটা আদতে ছফাগিরি না, বলা যায় ছফাগিরি বোঝার প্রচেষ্টা।

ভালো থাকবেন।

যুবায়ের  এর ছবি

ব্লগোমন্ডলে আহমদ ছফাকে আনার জন্য আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সিরিজ এক কথায় অসম্ভব রকমের ভালো। আপনি ধারাহবাহিকভাবে অনেক বিস্তারিত পরিসরে ছফাকে নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। সার্বিক বিবেচনায় ছফাপাঠ খুবই গুরুতর দরকার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।