কথা হলো কারা এই বাঙালি মুসলমান? ছফা তাঁর ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে এই প্রশ্নের উত্তর করেছেন - যাঁরা বাঙালী এবং একই সঙ্গে মুসলমান- তাঁরাই বাঙালী মুসলমান। এঁদের ছাড়াও সুদূর অতীত থেকেই এই বাংলাদেশের অধিবাসী অনেক মুসলমান ছিলেন- যাঁরা ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যানুসারে ঠিক বাঙালী ছিলেন না। আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধাগুলো তাঁদের হাতে ছিলো বলেই বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে সংস্কৃতিগত ভেদরেখা সমূহ অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই প্রভুত্বশীল অংশের রুচি,জীবনদৃষ্টি, মনন এবং চিন্তন পদ্ধতি অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালী মুসলমানদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। বাঙালী মুসলমানদের যে ক্ষুদ্রতম অংশ কোনো ফাঁক-ফোকর গলে যখন সামাজিক প্রভুত্ব এবং প্রতাপের অধিকারী হতেন, তখনই বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক চুকে যেতো এবং উঁচু শ্রেণীর অভ্যাস, রুচি, জীবনদৃষ্টির এমনকি ভ্রমাত্মক প্রবণতা সমূহও কর্ষণে ঘর্ষণে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্গীভূত করে নিতেন।১
এই প্রবন্ধ নিয়ে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতামত জানতে চেয়েছিলেন আহমদ ছফা। রাজ্জাক সাহেব উত্তরে বলেছেন, ‘আপনের লেখাটাও পড়েছি। উনিশ’শ তিরিশ সালের দিকে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের বর্তমান ‘হিন্দু মুসলমান সমস্যা’র পর এতো প্রভোক্যাটিভ রচনা আমি বাংলা ভাষায় আর পড়ি নাই।’ ২ … প্রবন্ধটি আর প্রকাশ পাবার পর সৃষ্ট হুজ্জত নিয়ে কিছু কথা জানা যায় ‘যদ্যপি আমার গুরু’ তে … খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর রোমের পেট্রিসিয়ানদের নতুন এক বিভাজন-রেখার সৃষ্টি করেছিল। এই ধরণের একতা প্রায় অলঙ্ঘনীয় বিভাজন-রেখা বেঙ্গলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ক্রিয়াশীল রয়েছে। স্যারের এই কথার মধ্যে আমি একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পেয়ে যাই। আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। সেই সময়ে জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট। আবুল ফজল ছিলেন জিয়া সাহেবের শিক্ষা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এবং আমরা তাঁকে মান্য করতাম। একদিন সকালবেলা দেখতে পেলাম আবুল ফজল সাহেব মাথায় টুপি দিয়ে অপর এক উপদেষ্টা এম এ জি তাওয়াবের সঙ্গে রমনা ময়দানের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি সালাম দিয়ে ফজল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জানালেন, তাওয়াব সাহেবের সঙ্গে সিরাতের মজলিসে যাবেন। আমি ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। আবুল ফজল সাহেব নাস্তিকতা প্রচার করতেন। ক্ষমতার কাছাকাছি এসে দেখছি তিনিও নবীভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই ঘটনাটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে। রাজ্জাক সাহেব রোমের প্লিবিয়ান খ্রিস্টানদের মনন মানসিকতার বিষয়ে যে ইঙ্গিত করেছিলেন, আমার মনে হল, সেই দোলাচল মনোবৃত্তিটা বাঙালি মুসলমানের মনেও কাজ করে যাচ্ছে। মুসলিম রচিত পুঁথিসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বাঙালি মুসলমানের চৈতন্যের একটি দিক আমি উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। লেখাটি মাসিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই একটা তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আমি বাঙালি মুসলমানদের বেশিরভাগকেই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বংশধর বলে মস্ত অপরাধ করেছি, এ অভিযোগ করে নানা পত্রপত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপা হতে থাকে। আমাদের দেশে এক শীর্ষস্থানীয় কবি ছদ্মনামে তিনটি প্রবন্ধ আমাকে গালাগাল করে লেখেন। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে পুরো ছয় মাস ধরে গালমন্দ করে নিবন্ধ লিখতে থাকেন। ওই নিবন্ধগুলো পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে সর্বত্র বিলি করতে আরম্ভ করেন। শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পর সমবেত মুসল্লিদের মধ্যে তাঁর পুস্তিকাটি বিনামূল্যে বিতরণ করে জনমতকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। আজাদ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও তাঁর পুস্তিকাটি বিতরণ করেছিলেন।৩ …
লেখাটার ছাপানোর পর অনেক লোক ছফাকে সমর্থন করেছেন। আবার বিরোধী শিবিরের লোকজনও কম ছিল না। ছফাগিরিতে প্রবন্ধটি নিয়ে বিস্তারিত লেখা উদ্দেশ্য হচ্ছে আহমদ ছফা ঠিক কি কারণে পুঁথি সাহিত্যের বিষয়ের কথা বলে মুসলমান সমাজের পালস্ ঠিক করে বুঝে নিতে চেয়েছেন তার আন্দাজ করা। প্রবন্ধটিতে ফিরে যাই।… মূলতঃ বাঙালী মুসলমানেরা ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি জনগোষ্ঠী।এই অঞ্চলে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার পরে সেই যে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রবর্তিত হলো, এঁদের হতে হয়েছিল তার অসহায় শিকার। যদিও তাঁরা ছিলেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তথাপি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রশ্নে তাঁদের কোনো মতামত বা বক্তব্য ছিলো না। একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার মৃত্তিকার সাক্ষাৎ সন্তানদের এই সামাজিক অনুশাসন মেনে নিতে হয়েছিল। যেমন কল্পনা করা হয়, অতো সহজে এই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হতে পারেনি। বাংলার আদিম কৌম সমাজের মানুষেরা সর্বপ্রকারে যে ওই বিদেশী উন্নততরো শক্তিকে বাধা দিয়েছিলেন- ছড়াতে, খেলার বোলে অজস্র প্রমাণ ছড়ানো রয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষদের বাগে আনতে অহংপুষ্ঠ আর্য শক্তিকেও যে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর বিশ্ব বিশ্রুত ‘ভারতের ধর্মসমূহ’ গ্রন্থে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। আর্য বা ব্রাহ্মণ্য শক্তি যে সকল জনগোষ্ঠীকে পদদলিত করে এদেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁদেরকে একেবারে চিরতরে জন্ম-জন্মান্তরের দাস বলে চিহ্নিত করেছেন। আর যে সকল শক্তি ওই আর্য শক্তিকে পরাস্ত করে ভারতে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের সকলকেই মর্যাদার আসন দিতে কোনো প্রকারের দ্বিধা বা কুণ্ঠা বোধ করেননি। শক, হুন, মোগল, পাঠান, ইংরেজ যাঁরাই এসেছেন এদেশে তাঁদের সহায়তা করতে পেছপা হননি। কিন্তু নিজেরা বাহুবলে যাঁদের পরাজিত করেছিলেন, তাঁরাও যে মানুষ একথা স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা খুব অল্পই অনুভব করেছেন। তবু ভারতবর্ষে এমনকি বাংলাদেশেও যে, কোনো কোনো নীচু শ্রেণীর লোক নানা বৃত্তি এবং পেশাকে অবলম্বন করে ধীরে ধীরে ওপরের শ্রেণীতে উঠে আসতে পেরেছেন তা অন্যত্র আলোচনার বিষয়।৪ …
যাঁদেরকে এভাবে পদদলিত করা হয়েছিল, পরাজয়ের শোধ নিতে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেয়। কিন্তু আর্যদের জ্বালায় সুখ আদৌ আসলো না। মুসলমান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সাথে ধর্মান্তরিত এসব বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্মের আশ্রয় লাভ করেন। এতে তাঁদের সামাজিক প্রভুত্ব লাভের কিছুটা দিশা হলেও জাগতিক সব কষ্টের সুরাহা মিলেনি। হিন্দুদের বর্ণাশ্রম এই উপমাহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস বলে রায় দিয়েছেন আহমদ ছফা। … বাঙালী মুসলমানদের অধিকাংশই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের লোক। তাঁদের মানসিকতার মধ্যে আদিম সমাজের চিন্তন পদ্ধতির লক্ষণ সমূহ সুপ্রকট। বার বার ধর্ম পরিবর্তন করার পরেও বাইরের দিক ছাড়া তাঁদের বিশ্বাস এবং মানসিকতার মৌলবস্তুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দিনের পর দিন গিয়েছে , নতুন ভাবাদর্শে এদেশে তরঙ্গ তুলেছে, নতুন রাজশক্তি এদেশে নতুন শাসনপদ্ধতি চালু করেছে, কিন্তু তাঁরা মনের দিক দিয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতোই বারবার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালী মুসলমান এবং মুসলমান রাজত্বের সময়ে তাঁদেরই মানসে যে একটি বলবন্ত সামাজিক আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিলো তাঁদেরই রচিত পুঁথিসাহিত্য সমূহের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। কাব্য সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার অনুসারে হয়তো এসকল পুঁথির বিশেষ মূল্য নাই। কিন্তু বাঙালী মুসলমান সমাজের নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় এসবের মূল্য যে অপরিসীম সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।৫ … প্রতিটা জাতির মধ্যের সুপ্ত সামাজিক আবেগ প্রকাশ পায় যখন কোন সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক মুক্তির সুযোগ ঘটে। আর সাহিত্য সেক্ষেত্রে মূল মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়ে। তবে ঠিকমতো জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সাথে যুক্ত হতে না পারলে ভালো কিছু সেখান থেকে আশা করা যায় না। মুসলমানদের পুঁথি সাহিত্য মহৎ পরিণতির দিকে যেতে পারেনি। … প্রতিবন্ধকতা সমূহ সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই বিরাজমান ছিলো। সমাজ সংগঠন ভেঙ্গে ফেলে নব রূপায়ন তাঁরা ঘটাতে পারেননি। কারণ মুসলিম শাসকেরাও স্থানীয় জনগণের মধ্যে থেকে এ নেতৃশ্রেণী সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বাঙালী মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব একেবারে ছিলো বা বললেই চলে। অন্যদিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি এবং আচারগত দূরত্বের দরুণ শাসকশ্রেণীর অভ্যাস, মনন রপ্ত করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাঙালী মুসলমান।৬ …
আহমদ ছফার প্রবন্ধটিতে কিছু কথার পুনরুক্তি হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। প্রথমবার পাঠে মনে হতে পারে ঠিকমতো সম্পাদনার অভাবে এটা হয়েছে। কিন্তু কয়েক বার পড়লে বুঝতে পারা যায় ব্যাপারটা তিনি ইচ্ছে করে করেছেন। সত্যভাষ্যকে দশ জায়গায় বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন ছফা। সত্যের খাতিরেই। জাতীয় সমাজের চেহারা বুঝে নিতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মানসগঠন বুঝে নেয়া তাঁর জন্য জরুরী হয়ে পড়েছিল। এখানে ছফার অন্য একটি প্রবন্ধ নিয়ে কথা বলবো। ‘বঙ্গভূমি আন্দোলন, রাষ্ট্রধর্ম, মুক্তিযুদ্ধঃ বাংলাদেশের হিন্দু ইত্যাকার প্রসঙ্গ’। ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ নিয়ে লেখা আরো কিছুটা এগোবে। পরের কিস্তিতে।পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ন্যাশনালিস্ট থট এন্ড দা কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ডঃ আ ডেরিভেটিভ ডিসকোর্স’ বইয়ের বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে আলোচনা পরের কোন কিস্তিতে বিশদে আনার চেষ্টা করবো। সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’, ছফার প্রবন্ধ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ নিয়ে কথাবার্তা আসবে সামনের কিস্তিগুলোতে।
একটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের মনোবেদনা বুঝে নিতে ছফা প্রবন্ধটি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা কত ছিল? প্রায় এক কোটির উপরে। জেনারেল ইয়াহিয়া ধারণা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই হিন্দুগুলোকে মেরে কেটে ভাগিয়ে ভারত পাঠিয়ে দিতে পারলে শান্তি নেমে আসবে। এসব হিন্দুর সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দিতে পারলে গরীব পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। যুদ্ধ করার বাসনা তাদের তখন মিটে যাবে। এ কারণেই একাত্তরের যুদ্ধের প্রথম টার্গেট ঠিক করা ছিল হিন্দুরা। ইয়াহিয়ার থিয়োরি যুদ্ধে কাজ করেনি। ফলে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হলো। এদিকে স্বাধীনতার পরে দেশের হিন্দুরা একটা ডিমোরালাইজেশোনের মধ্যে গিয়ে পড়লো। তারা বাংলাদেশে বাস করা নিরাপদ মনে করতে অক্ষম হলো। ছফার প্রবন্ধের শুরু এই জায়গা থেকে। … দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উনিশশো সাতচল্লিশে একবার ভারত উপমাহাদেশকে ভাগ করা হয়েছিল। মোটামুটি ব্যবস্থাটা ছিলো এরকম। হিন্দুরা ভারত চলে যাবে এবং মুসলমানেরা পাকিস্তান চলে আসবে। বাস্তবে তা কার্যকরও হয়েছিলো। ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির পর যে পরিমাণ মানুষ এক দেশ থেকে থেকে আরেক দেশে চলে গিয়েছিলো তার পরিমাণ এতো বিপুল ছিলো যে ইতিহাসে তার কোনো তুলনা মেলে না। অনেক হিন্দু ভারতে এলো, অনেক মুসলমান পাকিস্তানে এলো। তারপরেও যাওয়া-আসার পালা সাঙ্গ হলো না। কোটি কোটি মুসলমান ভারতে এবং প্রায় কোটি খানেক হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যেতে বাধ্য হলেন। ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করে মুসলমানদের সেখানে থাকার আইনগত স্বীকৃতি দিলো।৭ … ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হলো, হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হলেন। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ একরকম বাধ্য হয়েই এই অবস্থাটা মেনে নিলেন।৮ … পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল কারণ ছিল ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি অস্বীকৃতি। হিন্দুরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে। … এই যুদ্ধের কাছ থেকে তাঁদের প্রত্যাশার পরিমাণ ছিলো অনেক বেশি। তাঁদের জানমালের ওপর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে একক সম্প্রদায় হিসেবে অন্য কারো সঙ্গে তার তুলনা চলতে পারেনা। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ক্র্যাক ডাউনের প্রাথমিক পর্যায়ে বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িঘর মহল্লা এবং গ্রামে আগুন লাগিয়ে হিন্দু নর-নারীদের অবলীলায় খুন করে যাচ্ছিলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাথমিক যে রোষ তা হিন্দু সম্প্রদায়কেই সর্বাপেক্ষা অধিক সহ্য করতে হয়েছে।৯ … ছফা আবেগতাড়িত না হয়ে নির্লিপ্ত চোখে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘একাত্তরঃ মহাসিন্ধুর কল্লোল’ প্রবন্ধটি উল্লেখ করার মতো। তাঁর ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ বইটির কথাও বলতে হবে যেটির প্রথম প্রকাশকাল ছিল ২৮ জুলাই ১৯৭১; প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। সাথে নিতে হবে উপন্যাস ‘অলাতচক্র’। একাত্তরের যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ কোন ভবিষ্যতের দিকে দৌড়াবে- এই উপন্যাসের চরিত্র দানিয়েল ভেবে নেয় … বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উনিশশো আটচল্লিশ থেকেই সংগ্রাম করে এসেছে। আসন্ন ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধটিই কি বাঙালি জাতির বিগত বাইশ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের একমাত্র ফলাফল। এই যুদ্ধে হয়তো ভারত জয়লাভ করবে এবং ভারতের সহায়তায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবো। আমাদের জাতীয় সংগ্রামের এই পরিণতি। এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? কি জানি, ইতিহাস কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? আমাদের বাবারা পাকিস্তান তৈরি করতে চেয়েছিলেন, আর আমরা পাকিস্তান ভাঙ্গছি। এই যুদ্ধ সংঘাত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমদের জাতীয় ইতিহাস কোন ভবিষ্যতের পানে পাড়ি দিচ্ছে? কে জানে!১০ …
যাই হোক জাতীয় ইতিহাস কোন দিকে মোড় নিয়েছে তা আমরা দেখেছি। যুদ্ধের পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতার ভেক ধরলেও পরে ধর্মের আবরণে গা ঢাকে। একাত্তরের পর যেসব হিন্দু ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁদের কিছু অংশ দেশে ফিরে দেখে তাঁদের সবকিছু বেহাত হয়ে গেছে। তাও কোন মতে তাঁরা থেকে যেতে শুরু করলেন। ধরে নিলেন কাঠামো যখন পরিবর্তিত হয়েছে অধিকার তাঁরা আস্তে আস্তে ফিরে পাবেন। সেটা আর হয় নি। ইতিহাসের পাতা একটু তাড়াতাড়ি উল্টে যাই। … মওদুদ আহমদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আজ এই দিনে পবিত্র ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে এমন একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করলাম, ভবিষ্যৎ বংশধরেরা এই মহৎ কর্মের জন্য আমাদের কথা কৃতার্থ অন্তরে স্মরণ করবে।’১১ … এই ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবে কিছু আন্দোলন হয়েছে। মিটিং-মিছিল চলেছে। এইটুকুই। বাংলাদেশের মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবার পেছনে এই ধর্মীয় মোড়ক বিশাল প্রভাব ফেলেছে বলে আমি মনে করি। ঠিক কোন কারণে বাংলাদেশের সেক্যুলারিজমকে (ধরি সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ধর্ম-স্বাধীনতা’) বাদ দিয়ে ধর্মের লেবাসে নিজেকে ঢেকে ফেলার দরকার হলো- এই ইতিহাস জানা খুব জরুরি।
সূত্র
১। আহমদ ছফার প্রবন্ধ – (ষ্টুডেণ্ট ওয়েজ , জানুয়ারী ২০০০) [পৃষ্ঠা ৬৩]
২। যদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা (মাওলা ব্রাদার্স , মে ২০০০) [পৃষ্ঠা ৫৬]
৩। [পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬]
৪। আহমদ ছফার প্রবন্ধ – (ষ্টুডেণ্ট ওয়েজ , জানুয়ারী ২০০০) [পৃষ্ঠা ৬৩-৬৪]
৫। [পৃষ্ঠা ৬৪] ৬। [পৃষ্ঠা ৬৫]
৭। রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক প্রবন্ধ- আহমদ ছফা ( জাগৃতি প্রকাশনী, জুন ২০০০)
[পৃষ্ঠা ৯৯]
৮। [পৃষ্ঠা ৯৯] ৯। [পৃষ্ঠা ১০০]
১০। অলাতচক্র- আহমদ ছফা ( শ্রীপ্রকাশ, জুন ২০০০) [পৃষ্ঠা ১৩৩]
১১। রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক প্রবন্ধ- আহমদ ছফা (জাগৃতি প্রকাশনী, জুন ২০০০)
[পৃষ্ঠা ১০৪]
মন্তব্য
আগের কিস্তিগুলোর লিংকঃ
ছফাগিরি। কিস্তি এক।
ছফাগিরি। কিস্তি দুই।
ছফাগিরি। কিস্তি তিন।
ভালো হচ্ছে লেখাটা। চলতে থাকুক.....
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ঠিকাছে
ছফা কখনো পড়িনি; তবে এ সিরিজের মতো আরো দু'এক জায়গায় ছফা সম্পর্কে পড়েছি। আপনার লেখার সার্থকতা এখানেই যে ছফাপাঠে আগ্রহ জাগিয়েছেন।
ছফাগিরি চলতে থাকুক
আপনি মনে হয় এই প্রথম আমার লেখায় কমেন্ট করলেন। প্রথম কিস্তিতে যদ্যপি আমার গুরুর পিডিয়েফের লিঙ্ক আছে। পড়ে নিতে পারেন।
ছফাকে এতো সহজে বুঝিয়ে দেবার জন্য আপনার উদ্যোগ প্রশংসার দাবী রাখে। আরো নিয়মিত ছফাগিরি লিখুন।
চলুক
একটা বিজ্ঞপ্তি
কাহারো হস্তে মাসিক চিন্তার ছফা সংখ্যাখানা থাকিলে কষ্ট করিয়া স্ক্যান করিয়া নিম্নোক্ত ই-ঠিকানায় পাঠাইলে মহোদয়ের নিকট চির বাধিত থাকিব।
subasishdas@hotmail.com
আহমদ ছফার কোনো লেখাই পড়তে পাইনি। আপনার লেখার মাধ্যমে জানতে বুঝতে চেষ্টা করছি। কাজেই বুঝতে পারছেন আশা করি যে, আমার প্রত্যাশা কতখানি!
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বুঝলাম।
ছফা। গুরু। সে এক বিশাল মানব। বিশাল ভাল্ডার। ধন্যবাদ তাঁকে উপস্থাপনের জন্য।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
লেখা ভাল হচ্ছে, চলুক।
মনে হয় প্রথম কিস্তিতে যদ্যপি আমার গুরুর লিংটি ছিল। পড়লাম। কেন যেন আপনার মত মুগ্ধ হতে পারলাম না। অবশ্য বইটা ছফাকে বিচারের জন্য পড়া ঠিক নয়।
ভারতের মুসলমানরা নীচু জাতের হিন্দু ছিল, কথাটা কি করে যেন ছফার প্রবন্ধ পড়ার আগেই মনে হতো। ওনার মত এত গভীর ভাবে ভাবিনি কখনো।
শরৎবাবুর প্রবন্ধটার লিংক দিতে পারলে ভাল হতো।
পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
শরৎচন্দ্রের ‘বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা’ আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। অনলাইনে ও পাই নি।
আরো কিছু কথা আছে। মন্তব্যে পরে লিখে জানাবো।
‘বাঙালী মুসলমানের মন’ পড়েছি দেশের বাইরে আসার অনেক পর, নিজের মুসলমানিত্ব নিয়ে সচেতন হবার পর। অসম্ভব অন্তরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখা । আপনার লেখায় ছফার উদ্ধৃতি পড়ে সে কথাই আবার মনে হল।
(সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েই বলছি) আমার প্রায়ই মনে হয় বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর আকাল চলছে । চারিদিকেই শ্লোগান । ছফার মতো এরকম নির্লিপ্ত একাডেমিক মানুষ কোথায় ?
আপনার লেখার "একাডেমিক টোন" ভাল লাগলো। যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি করেন?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ও হ্যাঁ আমি .........
অনেকদিন পর আপনার ছফাগিরি পড়তেই ক'দিন নিয়মিত সচলে ঢুকছি।
লেখা ভাল লাগছে ---- তবে যেহেতু এটা ছফা-পাঠ বা ছফা-সমালোচনা --- একটু বিতর্ক জমে উঠলে ভাল হত --- যেমনটা প্রথম পর্বে হয়েওছিল। আরো ভিন্নমত আসবে আশাকরি।
এই জাতির মনস্তত্ত্ব বুঝতে বাঙালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব বোঝাটা জরুরী--- ছফা সে জায়গাতে ভাল একটা আলোড়ন তুলেছেন --- এজাতীয় বিশ্লেষণ আরো হওয়া প্রয়োজন।
যাহোক, চলুক ছফাগিরি, সাথে আছি।
কেউ কিছু কয় না। বিতর্ক তো অনেক দূরের ব্যাপার। ক্যামনে কী।
আসলে ছফা নামটার সাথে সবাই-কম বেশি পরিচিত, তবে আপনার মত করে সবাই হয়তো তাকে পড়ে নি। আপনার প্রথম কিস্তি পড়ে আমি গুগলে সার্চ দিয়ে বিডিনিইজ২৪ কিছু পেলাম। লেখা চালিয়ে যাবেন । আশা করি আপনার মাধ্যমে কিছু জানতে পারবো।
স্বপ্নদ্রোহ
আপনি যদি দেশে থাকেন আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে উনার বই কিনে ফেলেন। আগে ছফাকে ছফার ভাষায় পড়ে নেন। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আপনার নাম কি দিশা? আরো একজন দিশা___ এসেছেন। আবার পাণ্ডবদার দিশা ও আছেন। খুব দিশাহারা লাগছে।
খুব খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। অনেক পর্ব পর্যন্ত আগাক এই আশা রাখছি আপনার কাছে। ছফাকে সবার কাছে নিয়ে সহজবোধ্য করে নিয়ে আসার জন্য আপনাকে অভিবাদন।
আপনার পুরো সিরিজটা পড়তে হবে, এটা পড়ে বেশ ভালো লাগলো ... পরের পর্বটার জন্য খুব আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছি... যেহেতু আমি ছফা পড়িনি তেমন (দু'টা উপন্যাস পড়েছি মনে হয়, অনেস্টলি, পড়ে ভালো লাগেনি, হয়তো আমিই নিন্মমানের পাঠক )
যাই হোক, দেখা যাক ছফার চিন্তার সাথে একমত হওয়া যায় কিনা
প্রফেসর রাজ্জাকের ব্যাপারে আপনার বক্তব্যটুকু খুব একটা ক্লিয়ার হলোনা ...আরেকটু বিস্তারিত বলা যায় কি?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
কোন দুইটা?
প্রফেসর রাজ্জাক কিস্তি এক থেকে চার প্রতিটাতে এসেছেন। সব কিস্তি পড়লে কিছুটা ধারণা পাবেন আশা রাখি।
আর সচলে কম ঢোকেন নাকি? ব্যস্ততা?
চমৎকার লাগলো এই পর্বটাও!
মামুন ভাই,
থ্যাংকস
ছফা পাঠের একটা অনন্য শিক্ষা মনে হয় নির্মোহ স্বগোত্র-সমালোচনা। যেমন ধরুন, ছফা নিজে বাঙালী মুসলমান হয়েই কিন্তু বাঙালী-মুসলমানের মন-বিশ্লেষণ করেছেন। এই স্বগোত্র-সমালোচনার আজ বড় অভাব আমাদের সমাজে। আমি যদি সেকুলার মধ্যবিত্ত কিম্বা ধর্মধারী মধ্যবিত্ত হই, তাহলে আমার শ্রেণীর মানস-চরিত্র আমারই বেশি জানার কথা। তার দোষ-গুন নিয়ে সমালোচনার দায় তাই আমারই সবচে বেশি। আর সমালোচনা দিয়ে যদি কোন কিছুকে প্রভাবিত করা যায়, সেটার সম্ভাবনা নিজ গোত্রেই বেশি, অন্যকোথাও নয়।
আপনার মন্তব্যের জবাব দিতে একটু দেরি হলো। নিচের মন্তব্য প্রতিমন্তব্যগুলো দেখতে পারেন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অসাধারণ লাগছে এই সিরিজ; চালিয়ে যান ভাইয়া। লগে আছি।
"পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল কারণ ছিল ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি অস্বীকৃতি। হিন্দুরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে। …"
এ কথা কী করে বলতে পারলেন ছফা? সকলেরই জানার কথা, সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রবল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং সে সংগ্রামই পরে রূপ নেয় স্বাধীনতাযুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধে। এই বৈষম্য যে কত বেশি ছিল তা নিয়েও অনেক লেখা হয়েছে। আমিও বিদেশী সাংবাদিকের লেখা উদ্ধৃত করে লিখেছিলাম আমার প্রথম আলো-র নিয়মিত লেখাটিতে। শুভশীষ, তুমি সেটি পড়ে থাকবে। হিন্দুমুসলিম নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিক আন্দোলনে জড়িয়েছিল এ অঞ্চলকে বৈষম্যমুক্ত করতে, পরে যা রূপ নেয় স্বাধীনতাযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে যোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যও ছিল তাই।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শুধু এ আকাঙ্ক্ষায় স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছে বলা সত্যের অপলাপ এবং বিভ্রান্তিকর। অআরও অআছে।
"পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ক্র্যাক ডাউনের প্রাথমিক পর্যায়ে বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িঘর মহল্লা এবং গ্রামে আগুন লাগিয়ে হিন্দু নর-নারীদের অবলীলায় খুন করে যাচ্ছিলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাথমিক যে রোষ তা হিন্দু সম্প্রদায়কেই সর্বাপেক্ষা অধিক সহ্য করতে হয়েছে।"৯ …
বলা হলো, "প্রাথমিক পর্যায়ে বেছে বেছে হিন্দুদের......প্রাথমিক যে রোষ তা হিন্দু সম্প্রদায়কেই..."
এখানে 'প্রাথমিক' বলাটা ভুল, বড়ো রকমের ভুল। দখলদারির সারা সময়টা জুড়ে তারা হিন্দুনিধনে তৎপর থেকেছে, তাঁদের বাড়িঘর ধ্বংস করেছে, নারী, শিশু কাউকে রেহাই দেয়নি। এসব নিয়ে অনেক বই আছে, দলিলাদি আছে, যা আমার কথার সাক্ষ্য দেবে। আমিও এসব প্রত্যক্ষ করেছি।
"এই যুদ্ধে হয়তো ভারত জয়লাভ করবে এবং ভারতের সহায়তায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবো। আমাদের জাতীয় সংগ্রামের এই পরিণতি। এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? কি জানি, ইতিহাস কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? আমাদের বাবারা পাকিস্তান তৈরি করতে চেয়েছিলেন, আর আমরা পাকিস্তান ভাঙ্গছি। এই যুদ্ধ সংঘাত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাস কোন ভবিষ্যতের পানে পাড়ি দিচ্ছে? কে জানে!"১০ … ভারত আমাদের সহায়তা করেছে এজন্য এত হা-পিত্যেশ কেন? বলা হচ্ছে, "এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম?" কেন, কোনো দেশ কি তার মুক্তির সংগ্রামে অন্য দেশের সহায়তা নেয় না? "আমরা পাকিস্তান ভাঙ্গছি" বলে হাহাকার কেন? ভারতের প্রতি ছফা সাহেবের এত বিরূপতা কেন?
পরিশেষে বলি, "ঠিক কোন কারণে বাংলাদেশের সেক্যুলারিজমকে (ধরি সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ধর্ম-স্বাধীনতা’) বাদ দিয়ে ধর্মের লেবাসে নিজেকে ঢেকে ফেলার দরকার হলো- এই ইতিহাস জানা খুব জরুরি।" ---শুভাশীষ, তোমার এই কথা খুব জরুরি। খুবই জরুরি।
স্বাধিকার আন্দোলনের অনেক কারণের মধ্যে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি অস্বীকৃতি একটা অগ্রগণ্য কারণ ছিল। তবে একমাত্র বা মুখ্য এটা বলা যাবে না। ছফা এই প্রবন্ধে হিন্দুদের স্বাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে হয়তো এই কথা পেড়েছেন। ছফার এই বিষয়ে আরো অনেক লেখা আছে। পরের কিস্তিগুলোতে কথাগুলো আসবে।
প্রাথমিকভাবে কথাটার ওপর ছফা জোর দিয়েছেন। ইয়াহিয়ার প্ল্যান অনুসারে শুরুতে বাংলাদেশের হিন্দুরা এই রোষের কবলে পড়ে। তবে এটা ঠিক, যুদ্ধের সারাটা সময় ধরে হিন্দুদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলেছিল। পাকিস্তানিরা মনে করতো- এই হিন্দুগুলোই যতো নষ্টের মূল। পরে অবশ্য হিন্দু মুসলমান বাছবিচার করে নি হানাদার বাহিনী। বাংলাদেশের সব মানুষকেই তারা পিষে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
ছফার ভারত বিদ্বেষকে আমি একটু অন্যভাবে দেখি। এটা বলা যেতে পারে পশ্চিমবাংলার বাংলা সাহিত্যে দাদাগিরির প্রতি বিদ্বেষ। একটু বড় আঙ্গিকে ভারতের দাদাগিরির প্রতি বিদ্বেষ। কারো ওপর দাদাগিরি ফলালে বেশীক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। ছফার মতো ইনটিগ্রিটি সম্পন্ন লোকের কাছে সেটা একদম অসহ্য। দাদাগিরির একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। আনন্দবাজার পত্রিকা একবার বাংলা একাডেমীকে 'আনন্দ পুরষ্কার'- য়ে ভূষিত ঘোষণা করে। এক ধরণের মারাত্মক ঔদ্ধত্য। যাই হোক বাংলা একাডেমী অপারগতা প্রদর্শন করে। যদ্দূর মনে পড়ে সেই বছর আনন্দ পুরষ্কার জোটে তসলিমা নাসরীনের।
উদ্ধৃতি
ভারত আমাদের সহায়তা করেছে এজন্য এত হা-পিত্যেশ কেন? বলা হচ্ছে, "এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম?" কেন, কোনো দেশ কি তার মুক্তির সংগ্রামে অন্য দেশের সহায়তা নেয় না? "আমরা পাকিস্তান ভাঙ্গছি" বলে হাহাকার কেন?
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই প্রশ্নগুলোর জন্য। 'অলাতচক্র' উপন্যাসে কিছু উত্তর মিলতে পারে। আর পরের কিস্তিগুলোতে এসব প্রসঙ্গ আরো বিশদে আসবে।
একটু অন্য প্রসঙ্গ , এই পোস্টটা পড়তে পারেন, মন্তব্য সহ।
ভালো থাকবেন।
আপনার ছফাদর্শন ভালো লাগলো। আলোচনা-সমালোচনা পড়ে ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝলাম তা হল, ছফার গুরুর মুসলিম লীগ প্রীতি,ছফার সাম্প্রদায়িকতা(?), প্রতিক্রিয়াশীলতা(!!) নিয়ে অনেকেই বিব্রত। আমাদের একটা মৌলিক সমস্যা হলো টাইম ফ্রেমের বিভিন্নতায় নিজের মতকে পূর্ণাঙ্গ ধরে নিয়ে সবকিছুর বিবেচনা করা। ছফার সাহস ছিলো, তাই তিনি অবহেলায় তা উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন।
দ্বিজাতিতত্ত্বের পটভূমিকে ৪৭ এর আরো অনেক আগে থেকে বিবেচনা করতে পারলে ভালো হয়। বাঙালি মুসলিমদের অবাঙালি মুসলিমরা কখনোই গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। তাদের পুরো স্বার্থই ছিলো উত্তর ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে(দেখুন http://www.defencejournal.com/2002/dec/demons.htm)। ভারতভাগের জন্য যে কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী মানসিকতাই প্রধান প্রভাবক ছিলো তা ছফা স্পষ্টাকারে দ্যাখিয়ে দ্যান বঙ্কিমকে নিয়ে রচিত প্রবন্ধে। অধুনা কট্টর বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংএর আত্মজীবনীও তার প্রতিদ্ধনি করে। দ্বিজাতিতত্ত্ব সঠিক ছিলোনা তা অবশ্যই মানছি, কিন্তু সময়ের দাবীতে তার আর কোনো বিকল্প ছিলো কি? জিন্নাহ কিন্তু প্রথমে কংগ্রেসেই ছিলেন, মানসিকতায় মেলেনি। এমনকি সুভাষচন্দ্র বসুও তার পথ আলাদা করে নেন কংগ্রেস থেকে। যেহেতু বাঙালিদের ৪৭এর বিভাগের সময় কেউ গোনার মধ্যেই রাখেনি,[বেঙ্গল প্যাক্টকেতো স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।] ফলাফলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তারাই একমাত্র জাতিগোষ্ঠি যাদের নিজস্ব একটি দেশ আছে।
অবশ্য আহমদ ছফা যে সর্বাংশে সঠিক তাও বলা যায়না। বৌদ্ধ ধর্ম থেকে মাস কনভার্সনের যে রূপরেখা তিনি দেখিয়েছেন অধুনা ঐতিহাসিকদের [ব্রাইটন, মোহর আলী] গবেষণায় তা অনেকাংশেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে(দেখুন- http://www.escholarship.org/editions/view?docId=ft067n99v9&chunk.id=ack)।
তবে বাঙালিদের চরিত্র বিশ্লেষণে তিনি অনন্য। তার 'আলি কেনান' যুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর মানসিকতার দালিলিক চরিত্র, 'গাভী বিত্তান্ত' বুদ্ধিজীবিদের অন্তঃসারশূন্য আত্মরতির নির্মম স্যাটায়ার, 'অলাতচক্রে' শরণার্থী শিবিরের সত্যিকারের দৃশ্য, 'তসলীমা নাসরীন'এর বিজেপিভোগ্যা হবার তীব্র প্রতিবাদ, গণকন্ঠের জ্বালাময়ী সব কলাম, কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যতোষামোদের তীব্র বিরোধী- এগুলোর মাঝেই টিকে থাকবেন তিনি।
তিনি নিজেকে বাঙালি মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতেন, এর কারণ কখনোই আমার কাছে সাম্প্রদায়িক বলে মনে হয়নি। শতশত বছরের শোষিত, বঞ্চিত এক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই হয়তো তার এই স্বেচ্ছা অভিধা।
সবশেষে একটা কথা বলি, আমরা যতই সেকুলারিজমের আবরণে নিজেদের ভুলে থাকার চেষ্টা করিনা কেন, এ জাতির রন্ধ্রে, রন্ধ্রে বিষাক্ত ক্লেদের মত যে ধর্মানুভুতি ঢুকে আছে সেটাই একেবারে খুলে খুলে সবাইকে দেখিয়েছেন আহমদ ছফা। সেকুলারিজমের এইতো ১ম ধাপ। একাজের জন্য তিনি যদি সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল হন তবে এরকম সাম্প্রদায়িক,প্রতিক্রিয়াশীলদেরই আমাদের বড্ড দরকার।
ধন্যবাদ।
উদ্ধৃতি
বৌদ্ধ ধর্ম থেকে মাস কনভার্সনের যে রূপরেখা তিনি দেখিয়েছেন অধুনা ঐতিহাসিকদের [ব্রাইটন, মোহর আলী] গবেষণায় তা অনেকাংশেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিষয়টা নিয়ে আমি কিছুটা পড়াশোনা করে তারপর প্রতিমন্তব্য করবো। আপনার লিংকগুলোর জন্য থ্যাংকস। ব্লগ একটা মিথস্ক্রিয়া। আপনার দীর্ঘ মন্তব্যে আমি অনেক জোর পেলাম।
আহমদ ছফা বাংলাদেশকে একটা সাবালক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর লেখালেখি, গালাগালি, দর্শন সবকিছুর পেছনে এটাই ছিল মূল কারণ।
এইটাই এক্কেবারে আসল ছফাগিরি।
ঠিক বলছেন।
তাই? ধরেন আমার মতো প্রান্তিকজন যাদের সৌভাগ্য হয়নি রাজ্জাক সাহেবের ব্যক্তিত্বের ঋজুতা দেখার তারা কি করে জানবে যে তিনি ডাইহার্ড মুসলিম লীগিয় বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিলেন?
পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙ্গালীদের অনেকেই ছিলেন যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশ আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ততা দিয়ে প্রমান করেছেন যে তারা তাদের মুসলিম লীগিয় বিশ্বাস থেকে সরে এসেছেন।
বাংলাদেশ আন্দোলনে রাজ্জাক সাহেবের ভূমিকা কি, জানতে চাইছিলাম।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
শুভাশীষ দা জানিনা আপনি এখন সচলে লেখেন কিনা? গত এক দেড় বছরে আমি আপনাকে সচলে দেখিনি। আপনি যে সময়ে সচলে লিখে গেছেন সেই সময়ে আমি সচলে আসিনি। তারপরও একটা প্রশ্ন রাখছি যদি আপনি কিংবা ছফা অনুরাগী কেউ উত্তর দেন সেই আশায়:
১।
এই যে সরে আসলেন বলে দাবি করছেন তার সাপেক্ষে কি কোন প্রমাণ আছে? আমি কোথাও পাইনি, দয়া করে কোন লেখায় তিনি তার বিশ্বাস থেকে সরে এসেছেন জানাবেন।
২।
সাপ্রাদায়িক বিপক্ষে দাঁড়াতে হলে দাঁড়ানো উচিত অসম্প্রদায়িক চেতনার। কিন্তু সেটা না করে উনি মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কেন নিজেকে খাড়া করেছন? একটা নিদিষ্ট ধর্মের পক্ষে কথা বলে মানুষকে আপনি কি করে অসম্প্রদায়িক বলে রায় দেন জানাবেন?
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন