বহিরঙ্গ ||| ৩ |||

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: বুধ, ২৩/১২/২০০৯ - ১০:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭)সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭)

বহিরঙ্গ ||| ১ |||
বহিরঙ্গ ||| ২ |||

সমর সেনের সাথে আমার পরিচয় ‘বাবু বৃত্তান্ত’ দিয়ে। পড়ে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর প্রিসাইজড্ আর মজারু কথাবার্তায় ঠাসা বইটা। তপনমোহন রায়চৌধুরীর ‘স্মৃতিরঙ্গ’ এই গোত্রের অন্য একটা বই। আর অকপট স্বীকারোক্তির জন্য ভাল লাগে খুশবন্ত সিংয়ের ‘ট্রুথ, লাভ এণ্ড এ লিটল ম্যালিস’। নিজেকে নিয়ে ঠিসারা করার ব্যাপারে সমর সেন বেশ কামেল। ১৯৭৮ সালের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লেখা … এ-বছরের এপ্রিল থেকে শরীর খারাপ হওয়াতে প্রায়-গৃহবন্দী ছিলাম বেশ কিছুদিন। অলস মস্তিষ্ক লেখার কারখানা। ‘বাবু বৃত্তান্ত’ তখন শুরু করি। … আমার কাছে যে সংস্করণটি আছে সেটা ১৯৮৮ সালের। পৃষ্ঠাসংখ্যা একশ পঁয়ষট্টি। এখানে আত্নজীবনী সাতান্ন পৃষ্ঠাতেই শেষ। বইয়ের অবশিষ্টাংশে রয়েছে সমরসেনের কিছু প্রবন্ধ আর কবিতা। আজিজে পরে বেশ মোটা তাজা একটা ‘বাবু বৃত্তান্ত’ দেখেছিলাম। কেনা হয় নি।

সমর সেন কবি। অনুবাদক।বিখ্যাত ‘ফ্রণ্টিয়ার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আর একটা পরিচয় আছে। তিনি শ্রী দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি। মৈমনসিংহ গীতিকা আর বৃহৎবঙ্গ।দীনেশ সেনকে চেনানোর জন্য এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে দীনেশ সেনের তুলনা করেছেন আহমদ ছফা তাঁর একটি প্রবন্ধে … দীনেশ এবং বঙ্কিমের মধ্যে বয়সের বিরাট ফারাক। বঙ্কিম যখন প্রৌঢ়, মৃত্যুর দিন গুণছেন, দীনেশ তখনও তরুণ। দীনেশচন্দ্র ছিলেন পূর্ব বঙ্গীয় বৈদ্য সম্প্রদায়ের লোক। সারা জীবন চেষ্টা করেও ঘটি উচ্চারণ পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেননি। তাঁকে নিয়ে অনেকেই ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ করতেন। যদিও দুজনের মধ্যে বেশি দেখা সাক্ষাৎ ঘটেনি, তথাপি এই পূর্ব বঙ্গীয় বৈদ্য বঙ্কিমের রাগ, উষ্মা এবং বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তার কারণ অবশ্যই আছে। বঙ্কিমবাবু কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল এই রাজাদের ধর্মের প্রয়োজনে হত্যা করা হয়েছিলো বলে দাবী করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর দু খণ্ডে সমাপ্ত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এই বঙ্কিমবাবুর ধর্মের আসল স্বরূপটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এক কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই এইসব রাজাদের হত্যা করেছেন। দীনেশ সেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেই জিনিষটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এই রাজারা সকলেই আঞ্চলিক স্বাধীন নৃপতি। শ্রীকৃষ্ণের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে অবশ্যই তাঁদের অপরাধী বলতে হবে। তাঁদের আপন স্বজনদের কাছে ছিলেন স্বাধীনতার শহীদ। দীনেশচন্দ্র সেন এই বিষয়টা যুক্তি প্রমাণ সহকারে প্রতিপন্ন করেছিলেন। দীনেশবাবুর আরো একটা অপরাধ ছিলো, সেটাও কম গুরুতর নয়। বঙ্কিমবাবু বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য মেনে নিয়েও সংস্কৃতের কাঠামোর মধ্যে সীমিত রাখতে চাইতেন। আর বাংলা সাহিত্যকে সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবর্তী করার একটা মনোগত অভিপ্রায় বঙ্কিমের ছিলো। সংস্কৃতের অনুবর্তী মানে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পরিমণ্ডলকেই বোঝানো হচ্ছে। অন্যদিকে দীনেশবাবু লোক সাহিত্য চর্চা এবং সংগ্রহ করে সারস্বত সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের আরেকটা উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল ঐতিহ্যের রুদ্ধদুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন সারস্বত সাহিত্যের সমান্তরালে একেবারে সাধারণ মানুষেরা যে সাহিত্য রচনা করেছেন, তার নন্দনতাত্ত্বিক মান কিছুতেই তুচ্ছ বা ফেলনা নয়।

দীনেশচন্দ্র সেন বাংলার সাথে সাথে ইংরাজিতে অনেক লেখা ছেপেছেন। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচুর ইংরাজি লেখা আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ও। ইংরেজ কলোনির কারণে এই প্রবণতা ছিল বলে মনে হয়। তবে পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে লেখালেখি অনুবাদের আকাল শুরু হয়। বাংলায় দক্ষ হলেও ইংরাজিতে দুর্বল হওয়ায় লেখার অনুবাদ হয়নি। বিশ্ব সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অনেক ক্লাসিকের সন্ধান পায়নি কেবল অনুবাদের অভাবে। বাবু বৃত্তান্তে ফিরি। সমর সেন দাদুর কথা পেড়েছেন অনেক জায়গায়। … আমাদের আলাপ আলোচনা সরস ছিল। বি.এ.-তে ভালো করলে বিলেত পাঠাবার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দেওয়াতে বললেন যে অর্ধেক খরচ দেবেন, বাকিটা বিয়ে করে যোগাড় করতে। বললাম- “দাদু, পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলাত যাব না।” উত্তরে অট্টহাসি হেসেছিলেন। … ঠাকুমাকে দেখলে ঠাকুর্দা কোঁচার খুঁটে মুখ ঢাকতেন, বাক্যালাপ বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুর্দা থাকতেন খোশ মেজাজে, আফিম সেবনের গুণে। ডায়বিটিস্ ছিল, কিন্তু ডাক্তারি নিষেধের তোয়াক্কা করতেন না, মিষ্টি খেতেন প্রচুর, মায় কাঁচা চিনি পর্যন্ত। ঠাকুর্দা নাকি ২২ বছর স্নান করেননি। সর্দিগর্মিতে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন শুনে বাগানবাড়ির পুকুরে এসে একবার সাঁতার কাটেন, পুকুরটির সঙ্গে অবশ্য ইয়াংসে নদীর তুলনা হয় না। ১৯৩৯-এ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়াতে বিধানচন্দ্র রায়কে খবর দেওয়া হ’ল। তিনি প্রথমেই তাঁর ‘ফি’র উল্লেখ করাতে বাড়ির লোক বিরক্ত হয়ে নীলরতন সরকারকে ডাকেন। নীলরতনবাবু অনেকক্ষণ পরীক্ষা করে বললেন, কিছু করার নেই। ‘ফি’ দিতে গেলে নেন নি- দীনেশচন্দ্রের নাম তাঁর অজানা ছিলনা।

সমর সেনের জন্ম ১৯১৬ সনে। শৈশব কেটেছে বাগবাজারের বিশ্বকোষ লেনের একান্নবর্তী পরিবারে। বাবা অরুণচন্দ্র সেন ছিলেন স্কটিস চার্চ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। মা পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে। নভেম্বর ১৯২৮-এ মায়ের মৃত্যু। আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে সমর সেনের প্রকাশভঙ্গি অনেক নির্লিপ্ত।… মা’র তখন নাভিশ্বাস, কথাবার্তা বন্ধ, এক-একবার চোখ মেলে ছেলেমেয়েদের দেখছিলেন। কিছুক্ষণ পরে আমাদের ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হ’ল। বিছানায় শুয়ে প্রার্থনা করলাম- ‘ভগবান, তুমি থাকলে মা বেঁচে যাবেন।’ ভোরবেলায় মা মারা গেলেন। ভগবান নিয়ে অতঃপর মাথা ঘামাইনি। জীবনে একবার নেড়া হলাম। … মার মৃত্যুর সময় সমর সেনেরা ছিলেন নয় জন, ছয় ভাই আর তিন বোন। বিচিত্র স্বভাবের এতোগুলো ছেলেমেয়ে যে যার মতো মানুষ হতে লাগলেন। অদ্ভুত সব লোকজনের আশ্রয় হত বিশ্বকোষ লেনের বাড়িতে। কবি হেমচন্দ্র বাগচী। মেয়েপাগল উইলিয়াম এলেন নামের এক আমেরিকান। শরীরচর্চায় বিশ্বাসী ব্রহ্মবিহারী সরকার। স্কটিশ চার্চে ভর্তি হতে না পেরে সমর সেন বারো বছর বয়েসে কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি হন। ক্লাস ফোরে। স্কুল পালিয়ে গঙ্গাতীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টিমার, নৌকা দেখে পরে বাড়ি ফিরতেন। … মা’র মৃত্যুকালে যে বোন তিন মাসের সে যখন তিন বছরের (আমার ঠিক পরের বোন তার দেখাশোনা করতো) তখন একদিন দেখলাম বাবা বেশ সেজে-গুজে সন্ধ্যেবেলায় বেরচ্ছেন। পরিহাসচ্ছলে জিজ্ঞেস করলাম- বরের মতো দেখাচ্ছে, বিয়ে করতে যাচ্ছো না কি? পরদিন এলেন নতুন বধূ, বয়সে অনেক কম, সুন্দরী বিধবা। … সেই দ্বিতীয় পক্ষে আরো সাত ভাই বোন হয়।

এরপর বাসা পরিবর্তন। বিশ্বকোষ লেনের বাসা ছেড়ে নন্দলাল লেনের বাসায় ওঠা হয়। সমর সেন বাগবাজারের বর্ণনা করেছেন। … নানা কারণে বাগবাজারের খ্যাতি ছিল। শিবমন্দিরে গাঁজার আড্ডা, অনেক ব্যায়াম সমিতি, বোস বাড়ির বিরাট মাঠে বারোয়ারী দুর্গা পুজো, প্রদর্শনী মেলা ও ব্যায়ামবীরদের কসরৎ; পাড়ায় পাড়ায় সিদ্ধির কুলপি, প্রসিদ্ধ মিষ্টান্নের দোকান; সন্ধ্যেবেলায় বিকটবেশে বহুরূপীদের আবির্ভাব; অমৃতবাজার পত্রিকা, কাছেই যামিনী রায়ের বাড়ি। সকালে গঙ্গাতীরে নানা বিচিত্র দৃশ্য- নিতম্বিনীদের মুক্তকেশ লঘুবেশ স্নান ও ঢলানি, স্নানের পর ভক্তিভরে উড়িয়া পুরোহিতের হাতে কপালে তিলক অঙ্কন। আবহাওয়া ভালো থাকলে আকাশ ভরে যেতো ঘুড়ি ও পায়রাতে। ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া রীতিমতো আর্ট ছিল। … ১৯৩২ সনে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। বাগবাজারের বাড়ি ভাড়া দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন ততোদিনে উঠেছেন বেহালার ডায়মণ্ডহারবার রোডের বাগান বাড়িতে। সমর সেন ১৯৩২ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বেহালায় থাকেন। লোকশিল্পের গবেষক অজিত মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, অশোক মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের বেহালার বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। এবং আরো অনেকে।… আমাদের বেহালার বাড়িতে রাধারমনবাবু ও বঙ্কিমবাবু খুব সম্ভব ১৯৩২ নাগাদ আসেন। বঙ্কিমবাবু ছিলেম অত্যন্ত মন্থরগতি, দীর্ঘ ভারিক্কি চেহারা, কথাবার্তা বলতেন ধীরে সুস্থে, আত্মপ্রত্যয় ছিল প্রখর। বাগানে খাটা পায়খানায় গেলে ঘণ্টা দেড়েকের আগে বেরোতেন না, সঙ্গে যে বই নিয়ে যেতেন পরে প্রায়ই পাওয়া যেত না। আমরা বলতাম বিপ্লব আপনার জন্য পিছিয়ে যাবে, ক্রান্তি মুহূর্তে হয় পায়খানায় কিংবা জর্দা পানের জন্য বসে থাকবেন।

সাহিত্যচর্চার খাতিরে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণুদে প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ প্রকাশ নিয়ে অনেক কথার বর্ণনা পাওয়া যায় সমর সেনের লেখায়। তাঁর কবিতা রচনার আয়ুষ্কাল মাত্র বারো বছর। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত। তিরিশ বছর বয়েসের পর সমর সেন টুকিটাকি এক-দুটো ছাড়া আর কবিতা লিখেন নি। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁদের সাথে আড্ডা চলতো জম্পেস। সমর সেনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা কম ছিল। ‘শেষের কবিতা’ তাঁর কাছে মনে হয়েছে চালিয়াতি। অন্যদিকে মানিক বাবুর নৈর্ব্যক্তিক ছোটগল্প ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। বাংলার সেকালের অতিবুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ইয়েটস্, এলিয়ট, পাউণ্ডের ভীষণ প্রভাব ছিল সেই কালে। সমর সেনের আশেপাশে ছিল খ্যাতিমান সব বাংলাভাষীদের ভিড়। চিত্রশিল্পী যামিনী রায়। নাট্যসম্রাট শিশির ভাদুরী। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। সমর সেন বাবার কথা বলেছেন তাঁর নিজস্ব ঘরানায়। … গোলাম মহম্মদ রোডের বাড়িতে রাজনীতি নিয়ে বাবার সঙ্গে ক্রমাগত বচসা-বিতর্ক হতো; হিটলার মুসোলিনির হাতে ইংরেজরা অপদস্থ হলে আমরা বিচলিত বোধ করতাম না, কিন্তু নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট আন্দোলনে আমাদের সমর্থন ছিল না। গান্ধীজীর সঙ্গে সুভাষ বোসের বিরোধে আমরা ছিলাম সুভাষবাবুর পক্ষে। কিন্তু সুভাষবাবু সাম্যবাদ ও ফ্যাসিজম্-এর একটা সমণ্বয়ের কথা তোলেন। অন্যদিকে নেহরু অক্লান্তভাবে হিটলার মুসোলিনির বিরোধিতা করেন- সে কারণে বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে নেহরুর প্রতিপত্তি ছিল। বাবা ফরোয়ার্ড ব্লকের অনুরাগী হন। মাঝে মাঝে আমাদের মতান্তর এমন স্তরে পৌঁছতো যে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকার কথা ভেবেছি। অবশ্য এটা নয় যে আমি সক্রিয় কর্মী ছিলাম। আমার গণ্ডই সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে, সে গণ্ডি কখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ১৯৪২-এ ছুটিতে কলকাতায় এসে রাত্রে বিমান আক্রমণের হুঁশিয়ারি বাজলে আমরা ছাদ থেকে নেমে যেতাম, বাবা নামতেন না; বোধহয় কলকাতার আকাশে জাপানী বোমারু বিমানের আগমন তিনি অপছন্দ করতেন না। যুদ্ধশেষে তিনি শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার দিকে ঝোঁকেন। চল্লিশের দশকে একটি উপন্যাস (‘মর্মান্তিকা’) লেখেন, যার গদ্য এখনো বিস্ময়কর লাগে।

ছুটিতে বেরিয়ে পড়তেন ভ্রমণে। বর্মা। পূর্ব বাংলা। এম.এ. পাশ করার আশুতোষ কলেজে দরখাস্ত ঠুকেন। কিন্তু হল না। অশ্লীল বাংলা কবিতা লেখেন- ইন্টারভ্যু বোর্ডের লোকেরা কিভাবে যেন জেনেছিল। শেষে কাঁথির প্রভাতকুমার কলেজে চাকরি হল। করলেন মাত্র দু মাস। পরে কিছুদিন দিল্লীতে স্থিতু হন। বিয়ে করেন। পিতা হন। … ১৯৪১-এর এপ্রিলের শেষে বিয়ে হলো রামবাবুর ছোটভাই পাঁচুবাবুর ছোট মেয়ে সুলেখার সঙ্গে। নিখিল সেনের ওখানে পাঁচুবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমাকে আসতে বলেছিলেন ১৩ নং দরিয়াগঞ্জে।স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্ভিকতার চিহ্নমাত্র দেখলাম না। পাঁচুবাবু সুপুরুষ, সৌম্য, স্নেহশীল ব্যক্তি, কখনো কারো বিষয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ করতে দেখিনি। তাঁর স্ত্রীকে দম্ভ করতে দেখিনি। আমার মতো জামাইকে বরদাস্ত করেছিলেন, সেটা সামান্য কথা নয়।১০ … বিয়ের দু-একদিন পর থেকে পুরনো জীবনযাত্রায় ফিরে যাই। যৌবনের শুরুতে দু-একবার হোঁচট খেয়ে রোমাণ্টিক হাবভাব ছিল না। তাছাড়া ২২ শে জুন রুশ-জার্মান লড়াই আরম্ভ হওয়াতে সংসারের কথা মনে থাকতো না; বিপদ-আপদ হ’লে শ্বশুরবাড়ি তো হাতের ডগায়। ১৯৪২-৪৬র মধ্যে দুটি কন্যা হয়।১১

বাংলার বিক্ষুব্ধ সেই চল্লিশ দশকে সমর সেন অতিবাহিত করেন দিল্লীতে। অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে চাকুরি করেন ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত। দিল্লীতে দাঙ্গা লাগার কথা কিছুটা উল্লেখ করেছেন সমর সেন। ১৯৪৯ সনের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার ‘স্টেটস্‌ম্যান’ পত্রিকায় দরখাস্ত করেন। নভেম্বরে সম্পাদনা বিভাগে যোগ দেন। সাত বছর সেখানে চাকরি করেন। সমর সেনের লেখার গুণে আত্মকাহিনী স্থান কাল রাজনীতি সব কিছুকে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়েছে। … অন্তত আমাদের জীবনে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রখর ছিল তিরিশ ও চল্লিশের বছরগুলিতে,যখন দেশ-বিদেশের চেহারা বদলে যায়। পঞ্চাশের দশকে চীনের অভ্যুদয়, কোরিয়ার যুদ্ধ, চীনের দ্রুত প্রগতি, ইজিপ্ট সংকট, দেশে মাঝে মাঝে রক্তাক্ত সংঘর্ষ। সংসদীয় পথ পাকা হয়। ১৯৫৬-এ স্তালিনে-র কেচ্ছা শুরু হ’ল। ব্যাপারটা অত্যন্ত কদর্য ঠেকেছিল, কৈশোর ও যৌবনের অনেক বদ্ধমূল ধারণা ও আদর্শে এমন আঘাত আগে লাগে নি।১২

এরপর ১৯৫৬ সালে প্রগতি প্রকাশালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দিতে সপরিবারে মস্কো চলে যান। কামাক্ষীপ্রসাদ, ননী ভৌমিক, ফল্গু কর, শুভময় ঘোষ- এঁরা আশেপাশেই থাকতেন। অনুবাদে সেখানে একটা নিয়ম চালু ছিল। চিরায়ত রুশ সাহিত্যের অনুবাদ কর্মে ভাষার খাতিরেও কোন রকম অদল-বদল করা যাবে না। অনুবাদ হাস্যকর হলে হোক। এই কারণেই বোধ হয় কিছু কিছু রুশ বইয়ের বাংলা অনুবাদ পড়তে আমার বেশ পেঁজো লাগতো। বাংলাদেশের দ্বিজেন শর্মা প্রগতিতে চাকুরি করেছিলেন বিশ বছর। রাশিয়ার স্মৃতিচারণ নিয়ে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’। একজন ক্রিয়েটিভ লোক এত বছর ধরে অনুবাদের কাজ করলে তাঁর লেখক সত্তার মারাত্মক ক্ষতি হয়।

মস্কোর জীবনযাত্রার কথা এসেছে ‘বাবুবৃত্তান্ত’য়ে। স্বভাবত প্রিসাইজলি। একদিকে স্পুটনিক অন্যদিকে মোটা থার্মোমিটার পাঁচ মিনিট মুখু পুরে রাখা। তুষার ঝড়। ২৫ নম্বর ট্রামে যাতায়াত। বর্ণবিদ্বেষমুক্ত রাশিয়া। গ্যাগারিনের প্রত্যাবর্তনের জন্য সমস্ত রাশিয়াবাসীর অধীর প্রতীক্ষা। মার্কস-এঙ্গেলস্-লেনিন পাঠ্যপুস্তকে থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ানদের অরাজনৈতিক মনোভাব। ১৯৬১ সনে রাশিয়া ছেড়ে স্বদেশে চলে আসেন সমর সেন।

কলকাতায় ফিরে একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দেন। পরে সাপ্তাহিক ‘নাও’ পত্রিকার সম্পাদকের পদে যোগ দেন। প্রথম সংখ্যা বেরোয় ১৯৬৪ সনের অক্টোবরে। শুরুর দিকে ‘নাও’ ছিল সিপিএম সমর্থক। নীরদ চৌধুরী নিয়মিত লিখতেন। এই পর্বে দেখা মিলে সম্পাদক সমর সেনের অভিজ্ঞতা। জানতে পারি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের আখ্যান। … সাপ্তাহিক চালনায় বেশ কিছু কৌশল রপ্ত করা দরকার। নানান ধরণের লেখক, অনেকে স্পর্শকাতর, সমালোচনায় অসহিষ্ণু। গোষ্ঠি টিকিয়ে রাখতে সম্পাদককে অল্পবিস্তর মিথ্যার সাহায্য নিতে হয়, মাঝে মাঝে ন্যাকা সাজতে হয়। এ-সব গুণ রপ্ত করেছিলাম ‘পত্রিকার স্বার্থে’।১৩ … ‘নাও’ থেকে বিতাড়িত হবার পর নতুন পত্রিকা ‘ফ্রণ্টিয়ার’ শুরু করার তোড়জোর করতে থাকেন।নীরোদ চৌধুরী সমর সেনের সম্পাদনা করা নতুন পত্রিকায় কিছু লেখেন নি। … ‘ফ্রণ্টিয়ার’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সনের ১৪-ই এপ্রিল, বাংলা নববর্ষে।প্রথমে ভেবেছিলাম টাকার অভাবে হয়তো আটকে যাবে, কিন্তু প্রথম থেকে কাটতি আশাতীত হওয়াতে ব্যাপারটা দাঁড়ালো মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো।১৪ … দশ বছর কেটে গেছে, এখন প্রায়ই মনে হয়, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছি- ভারতীয় মোষ তাড়ানো অবশ্য কোন পত্রিকার সাধ্যের বাইরে। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্যক্তিরা অনেক যখন বলেন ‘ফ্রণ্টিয়ার’-এর জন্য ‘আপনাকে শ্রদ্ধা করি’ তখন মনে হয় শ্রদ্ধায় চিঁড়ে ভেজে না।১৫ … ‘ফ্রণ্টিয়ার’ নকশাল-ঘেঁষা পত্রিকা বলে খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করে। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস বিভক্ত হবার পর পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখায় ইন্দিরা-ঘেঁষা উচ্ছ্বাস এখন পড়ে বিব্রত বোধ করি।১৬ … ষাট-সত্তর দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের মহাকাব্য মানুষের আস্থাকে জিইয়ে রাখে। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ নতুন বিপ্লবের আদর্শের সৃষ্টি করে। উৎপাদন ক্ষমতা হাতে এলেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ অব্যাহত হয় না, হাজার হাজার বছরের স্তূপীকৃত মানসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জঞ্জাল অপসারণ, মনের কাঠামো, অভ্যাস পরিবর্তনের সংগ্রাম না চালালে সংশোধনবাদ বারে বারে ফিরে আসে।১৭ … এমারজেন্সির সময় পুরনো লেখকগোষ্ঠির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়, তার প্রধান কারণ দেশের বিষয় খোলাখুলিভাবে লেখার উপায় ছিল না। কোনক্রমে একটা সম্পাদকীয় লিখতে পারলেই যথেষ্ট। ঝোঁক হতো এমন একটা কিছু ছাপাই যাতে পত্রিকা বন্ধ না হয়।১৮ … দিন কাটছিল, দিনগত পাপক্ষয়। ১৯৭৬-এর মার্চের শেষে অফিসে বসে আছি, ‘ফ্রণ্টিয়ার’-এর একটি ফর্মা ছাপা হয়েছে, আর একটি মেসিনে উঠেছে, হঠাৎ সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এসে ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে।১৯ … এপ্রিল-মে ‘ফ্রণ্টিয়ার’ বন্ধ রইলো (বন্ধ না থাকলে হয়তো ঋত্বিক ঘটকের কয়েকটি ছবি প্রথম দেখার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হতো না)। অন্য ছাপাখানায় যাওয়া সম্ভব নয়, কেননা কর্তৃপক্ষ কামান দাগাবেন ছাপাখানার উপর।২০

‘বাবু বৃত্তান্ত’ বহিতে সমর সেনের আত্মবয়ান শেষে রয়েছে প্রবন্ধ, উড়ো খৈ নামের প্রায়-প্রবন্ধ, পরিশিষ্ট এবং সর্বশেষে সংযোজন। লেখার সময়কাল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭; বহিরঙ্গের পরের কিস্তিতে গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাগুলোর আলোচনা করার আশা রাখি।

সমর সেন তাঁর ‘বাবু বৃত্তান্ত’ য়ের আত্মবয়ান শেষে একটু জাস্টিফিকেইশান করেছেন। … বাবু বৃত্তান্তে আমার ও বন্ধুবান্ধব্দের অনেক কথা ইচ্ছে করে লিখিনি। অনেকে বর্তমান। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা, দুই নাতনি- বড়োটি ইতিমধ্যে বেশ লায়েক হয়েছে- এরা আমার নির্ভীক আত্মকথায় পুলকিত হবে না, যেমন হবেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাবিশেষ বাদ দিলে দেশ ও দশের কী ক্ষতি? আমার বন্ধু ও বান্ধবী ভাগ্য- আঠারো বছর বয়স থেকে- সামান্য নয়,কিন্তু তাঁদের বিষয়ে লিখতে গেলে খেই পাবো না। কয়েকজনের প্রভাব আমার (একদা) সাহিত্যিক ও ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায় ব্যাপক কিন্তু এ-মুহূর্তে সেটা চেপে যাওয়া ভালো। মধ্যবিত্তের দৌড় সুবিদিত।২১ … আমেন।

সূত্র
১। বাবু বৃত্তান্ত – সমর সেন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৮) [প্রথম সংস্করণের ভূমিকা]
২। আহমদ ছফার প্রবন্ধ – (ষ্টুডেণ্ট ওয়েজ , জানুয়ারী ২০০০) [পৃষ্ঠা ২৯-৩০]
৩। বাবু বৃত্তান্ত – সমর সেন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৮) [পৃষ্ঠা ৯]
৪। [পৃষ্ঠা ১১] ৫। [পৃষ্ঠা ১২] ৬। [পৃষ্ঠা ১৭] ৭। [পৃষ্ঠা ১৭-১৮]
৮। [পৃষ্ঠা ২০] ৯। [পৃষ্ঠা ২৮-২৯] ১০। [পৃষ্ঠা ৩৮] ১১। [পৃষ্ঠা ৩৯]
১২। [পৃষ্ঠা ৪৫] ১৩। [পৃষ্ঠা ৫৯] ১৪। [পৃষ্ঠা ৬০] ১৫। [পৃষ্ঠা ৬১]
১৬। [পৃষ্ঠা ৬১] ১৭। [পৃষ্ঠা ৬১] ১৮। [পৃষ্ঠা ৬৩] ১৯। [পৃষ্ঠা ৬৩]
২০। [পৃষ্ঠা ৬৩] ২১। [পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫]

বহি
বাবু বৃত্তান্ত – সমর সেন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৮)

ছবির উৎস
বাবু বৃত্তান্ত – সমর সেন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৮)


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

ঠিসারা, সারস্বত, পেঁজো

এই শব্দগুলোর মানে কি ?

আমরা বলতাম বিপ্লব আপনার জন্য পিছিয়ে যাবে, ক্রান্তি মুহূর্তে হয় পায়খানায় কিংবা জর্দা পানের জন্য বসে থাকবেন।

হাসি

হিটলার মুসোলিনির হাতে ইংরেজরা অপদস্থ হলে আমরা বিচলিত বোধ করতাম না, কিন্তু নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট আন্দোলনে আমাদের সমর্থন ছিল না। গান্ধীজীর সঙ্গে সুভাষ বোসের বিরোধে আমরা ছিলাম সুভাষবাবুর পক্ষে। কিন্তু সুভাষবাবু সাম্যবাদ ও ফ্যাসিজম্-এর একটা সমণ্বয়ের কথা তোলেন। অন্যদিকে নেহরু অক্লান্তভাবে হিটলার মুসোলিনির বিরোধিতা করেন- সে কারণে বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে নেহরুর প্রতিপত্তি ছিল।

সুভাষ বোসের সমর্থকেরা নাতসী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা জানতো কিনা সেটা জানার ইচ্ছে অনেক দিনের । আমার ধারনা অন্তত জার্মানির ভারতীয়রা (মানে ততকালের ভারতীয়) জানতেন । এসব সত্ত্বেও সুভাষ বোস বাঙালির হিরো !

অশ্লীল বাংলা কবিতা লেখেন- ইন্টারভ্যু বোর্ডের লোকেরা কিভাবে যেন জেনেছিল।

ক'দিন পরে চাকুরির ক্ষেত্রে ব্লগে ফেইসবুকে কি লিখলাম সেটাও মনে হয় চাকুরিদাতারা নজরে নেবেন । পশ্চিমে এর নজির বেশুমার ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ঠিসারা চট্টগ্রামের শব্দ। অর্থ টিটকারি।

সারস্বত মানে জ্ঞানী আকা ইণ্টেলেকচুয়াল আকা আঁতেলেকচুয়াল। আকা হলো aka;

পেঁজো শব্দটা প্রগতি প্রকাশনের কোন এক বইতে পেয়েছিলাম। পাজি থেকে
অপভ্রংশ হয়েছে বোধ করি। চন্দ্রবিন্দুর ইতিহাস জানা নাই। পেজোমি। চোখ টিপি

মন্তব্যের জন্য থ্যাংকস।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সমর সেনকে চেনা যায় তাঁর কবিতা দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে ত্রিশের দুইজন কবির দার্শনিক প্রভাব থেকে কোনদিন বের পারবো কিনা জানিনা। এক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত দুই সমর সেন। বাবুবৃত্তান্ত চমৎকার একটা বই। তবে আমার মনে হয় আগে সমর সেন এর ধুমসে কিছু কবিতা পড়ে নিয়ে তারপর বাবুবৃত্তান্ত পড়ে তারপরে তাঁর কবিতাসমগ্রটা একবার ঘুরে এলে সমর সেনকে বোঝা যাবে। নাইলে ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা আর স্মৃতিচারণের আড়ালে তাঁর প্রকৃত পরিচয় যে কবিতায় সেটা হারাবে। সমর সেন কবিতা থেকে ঘোষনা দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন ৩২ বছর বয়সে। এরকম উদাহরণ আর নাই।



অজ্ঞাতবাস

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি মন্তব্য লিখতে লিখতে দেখি বদ্দার মন্তব্য চলে আসছে। লাইক মারলাম আপনার মন্তব্যে... মনের কথা কইছেন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

... রোম্যান্টিক ব্যধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়
যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে
বছর দশেক পরে যাবো কাশীধামে।।

এই ছিল তাঁর কাব্যজীবনের শেষ তিন লাইন।



অজ্ঞাতবাস

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বদ্দা,

আমি একটু স্বশিক্ষিত। চোখ টিপি তাই 'বাবু বৃত্তান্ত' আগে হাতে আসে। কোবতে পরে।

আপনার কথা লাইক্কর্লাম।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বহিরঙ্গ ৩ এ কিছু বাজে টাইপো এবং অজান্তে ভুল টাইপ করা হয়ে গেছে। ঠিক্কর্লাম মন্তব্যে। কোন মডু দয়া করে ঠিক্কর্লে খুশি হবো।

প্যারা ১ লাইন ৪
রায়চৌধুরীর > চট্টোপাধ্যায়ের

প্যারা ৬ লাইন ৪
ঠাকুর > দত্ত

প্যারা ৬ লাইন ১৮
গণ্ডই > গণ্ডি

প্যারা ৭ লাইন ১
এম.এ. পাশ করার আশুতোষ> এম.এ. পাশ করার পর আশুতোষ

প্যারা ১০ লাইন ১
বাবুবৃত্তান্ত > বাবু বৃত্তান্ত

প্যারা ১০ লাইন ২
মুখু > মুখে

প্যারা ১১ লাইন ৪
অভিজ্ঞতা> অভিজ্ঞতার

প্যারা ১১ লাইন ৪
গোষ্ঠি> গোষ্ঠী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

তপনমোহন রায়চৌধুরীর ‘স্মৃতিরঙ্গ’ এই গোত্রের অন্য একটা বই।

তপন রায়চৌধুরীর "রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা" পড়ে দেখতে পারেন। ভালো লাগবে মনে হয়।

সমর সেনকে কবিতাতেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু ৭৭ সালে যখন লিখেন "সম্প্রতি পুরনো কবিতার কিছু কিছু পঙক্তি মনে পড়ে বলে দুশ্চিন্তায় আছি। এ বয়সে কবিতার ব্যামো আবার ধরবে না তো?" তখন হতাশ হই। প্রতিষ্ঠার চূড়ান্তে গিয়ে ছেড়ে দিলেন কবিতা। জীবিকার দায়ে অনুবাদ করতে করতেই জীবন গেলো... অপচয় হলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কিডা?



অজ্ঞাতবাস

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

খাইছে। দত্ত হবে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি
ফকির লালন এর ছবি

ভালো লাগলো। বইটা পড়িনি, নাম শুনেছি, হাতে আসেনি, আপনার লেখা পড়ে পড়ার আবশ্যক তালিকায় রাখলাম। কতো ভালো জিনিস যে পড়া হয়নি, ভাবি, আর লজ্জা লাগে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

গুরু, বইমেলায় একটা বই বাইর করেন।

শেখ নজরুল এর ছবি

বাবুবৃত্তান্ত থেকে যেমন কোড করেছেন তেমনি কিছু কবিতার করলে আরো মজা পেতাম। ধন্যবাদ আপনাকে।

শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এই পর্বে সমর সেনের আত্মজীবনী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাই কবিতা কোট করি নি। যাই হোক। নিচে মোরশেদ ভাই সমর সেনের অনেক কবিতা টাইপ করে দিয়েছেন। পড়েন।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

নিঃশব্দতার ছন্দ

স্তব্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বিশাল অন্ধকারে শুধু একটি তারা কাঁপে,
হাওয়ায় কাঁপে শুধু একটি তারা।

কেন তুমি বাইরে যাও স্তব্ধরাত্রে
আমাকে একলা ফেলে?
কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন, নিঃশব্দ পাথরের মতো?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাঁপে;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায়?

মাঝে মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তোমার নিঃশব্দতার ছন্দ :
সহসা বুঝতে পারি—
দিনের পর কেন রাত আসে
আর তারারা কাঁপে আপন মনে,
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে সবুজ প্রাণ;
চপল, তীব্র, নিঃশব্দ প্রাণ—
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে কেন তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায়।


তুমি যেখানেই যাও

তুমি যেখানেই যাও,
কোনো চকিত মুহুর্তের নিঃশব্দতায়
হঠাৎ শুনতে পাবে
মৃত্যুর গম্ভীর, অবিরাম পদক্ষেপ |

আর, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে ?
তুমি যেখানেই যাও
আকাশের মহাশূণ্য হ'তে জুপিটারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
লেডার শুভ্র বুকে পড়বে |


একটি মেয়ে

আমাদের স্তিমিত চোখের সামনে
আজ তোমার আবির্ভাব হ'লো
স্বপ্নের মত চোখ, সুন্দর, শুভ্র বুক,
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভিক আভাস
আমাদের কলুসিত দেহে
আমাদের দুর্বল, ভীরু অন্তরে |
সে-উজ্জ্বল বাসনা যেন তীক্ষ্ণ প্রহার |



একটি বেকার প্রেমিক

চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি |

সকালে কলতলায়
ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,
খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি ;
মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভাবে কী যেন ভাবি---
হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি ;
আর শহরের রাস্তায় কখনো প্রাণপণে দেখি
ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক |
আর মদির মধ্য রাত্রে মাঝে মাঝে বলি
মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন |
কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূণ্য মরুভূমি |


নিরালা

বর্তমান মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা,
মাঝে মাঝে মনে হয়,
দুর্মুখ পৃথিবীকে পিছনে রেখে
তোমাকে নিয়ে কোথাও স'রে পড়ি |
নদীর উপরে যেখানে নীল আকাশ নামে
গভীর স্নেহে,
শেয়াল-সংকুল কোনো নির্জন গ্রামে
কুঁড়েঘর বাঁধি ;
গোরুর দুধ, পোষা মুরগির ডিম, খেতের ধান ;
রাত্রে কান পেতে শোনা বাঁশবনে মশার গান ;
সেখানে দুপুরে শ্যাওলায় সবুজ পুকুরে
গোরুর মতো করুণ চোখ
বাংলার বধূ নামে ;
নিরালা কাল আপন মনে
পুরোনো বিষণ্ণতা হাওয়ায় বোনে |



উর্বশী

তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো !
কিংবা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,
হে ক্লান্ত উর্বশী,
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে
উর্বর মেয়েরা আসে
কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধার ক্লান্তি,
কত দীর্ঘশ্বাস,
কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,
আর কতো দিন !


বিস্মৃতি

ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে |
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস |
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে |
হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হ'লো,
তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ ধতা এলো,
বৃষ্টির আগে শব্ দহীন গাছে যে-কোমল, সবুজ স্তব্দতা আসে |


বিরহ

রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায় |

তুমি এখনো এলে না |
সন্ধ্যা নেমে এলো : পশ্চিমের করুণ আকাশ,
গন্ধে ভরা হাওয়া,
আর পাতার মর্মর-ধ্বনি |


মেঘদূত

পাশের ঘরে
একটি মেয়ে ছেলে-ভুলানো ছড়া গাইছে,
সে ক্লান্ত সুর
ঝ'রে-যাওয়া পাতার মতো হাওয়ায় ভাসছে,
আর মাঝে মাঝে আগুন জ্বলছে
অন্ধকার আকাশের বনে |

বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা | বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্র জলে ঘরবাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু ও মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন
সদলবলে গাইবে দুর্ভিক্ষের স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস,
ফিরে যাবে তুমি বিবাহিত প্রেমিকের কাছে |
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও,
কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে ?



স্বর্গ হ'তে বিদায়

সমুদ্র শেষ হ'লো,
আজ দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো |
সমুদ্র শেষ হ'লো
গভীর বনে আর হরিণ নেই,
সবুজ পাখি গিয়েছে ম'রে,
আর পাহাড়ের ধূসর অন্ধকারে
দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো |
সমুদ্র শেষ হ'লো,
চাঁদের আলোয়
সময়ের শূণ্য মরুভূমি জ্বলে |

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মোরশেদ ভাই,

থ্যাংকস।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হায় হাসান মোরশেদ... কী করলেন এইটা? মাথায় সমর সেন ঢুকায়ে দিলেন এই সাত সকাল বেলায়... এখন সারাদিন তাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হবে... মন খারাপ
এমনিতেই গতরাত থেকে মাথায় যন্ত্রণা দিতেছে সঞ্জীবদা... মন খারাপ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

হাসান মোরশেদ যেগুলি দিলেন সেগুলি সব কয়টাই আছে। কিন্তু শেষ যেইটা দিয়া সমর সেন কবিতা লেখা ছাড়লেন সেইটা নাই। ঐটার শুরুটা ছিল :

আবার ফেরাও সহজ শহরে ...



অজ্ঞাতবাস

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

জন্মদিনে

১.
আবার ফেরাও সহজ শহরে
যেখানে দশটা-পাঁচটার পর
ক্লান্ত লোকেরা অন্তত নিঃশঙ্ক বাড়ি ফেরে ;
সূর্যাস্তের সিদুর পশ্চিমে,
ঘরে ঘরে গৃহিণীরা গা ধোয়,
আর গা-ঢাকা অন্ধকারে ঘরছাড়া বাবুরা
চকিতে বেপাড়ায় ঢোকে।............

পুরনো দিন ফেরে না কোনোদিন।
আকাশের দিকে তাকাই,
আগুনের গোলা যেখানে
আপনমনে জ্বলে;
ধুলো ওড়ে, নেড়া বট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
গতপত্র ক্লান্ত ভঙ্গিতে।
গাছের যৌবন তবু প্রতি বছরে ফেরে
আমরা ক্রমশ ডুবি স্বখাত সলিলে।

সহজ জীবনের পর মৃত্যু-
সে তো বটের উপরে চাঁদের আলো,
কিংবা শূন্য পাহাড়ে কুয়াশা।
ও ধ্রুপদী শান্তি আমাদের নয়;
অনিদ্রা থেকে দুঃস্বপ্নে আমামদের যাত্রায়

কাক ডাকে,
রোদেপোড়া উদ্বিগ্ন মুখের কালো শব্দ।
বাঙলায় বিহারে গড়মুক্তেশ্বরে
বিকলাঙ্গ লাশ কাঁধে
লোক চলে গোরস্থানে
কিম্বা পোড়াবার ঘাটে।

মৃত্যু হয়ত মিতালি আনে :
ভব্লীলা সাঙ্গ হলে সবাই সমান-
বিহারের হিন্দু আর নোয়াখালির মুসলমান
নোয়াখালির হিন্দু আর বিহারের মুসলমান।

২.
শুনি না আর সমুদ্রের গান
থেমেছে রক্তে ট্রামবাসের বেতাল স্পন্দন।
ভুলে গেছি সাঁওতাল পরগণার লাল মাটি
একদা দিগন্তে দেখা উদ্যত পাহাড়,
বাইজির আসরে শোনা বসন্তবাহার।
ভুলে গেছি বাগবাজারি রকে আড্ডার মৌতাত,
বালিগঞ্জের লপেটা চাল,
আর ডালহাউসির আর ক্লাইভ স্ট্রিটের হীরক প্রলাপ,
ডকে জাহাজের বিদেশি ডাক।
রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়।

যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে।
বছর দশেক পর যাব কাশীধামে।।

দময়ন্তী এর ছবি

আহা সমর সেন!

ফ্রন্টিয়ার এখনও নিয়মিত বেরোয়৷ ফ্রন্টিয়ারের ডিজিটাল আর্কাইভ আছে সংহতি ডট কমে৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দময়ন্তীদি,

সংহতি ডট কমের লিংক দিয়ে খুব ভাল করলেন। আমি খুঁজতেছিলাম।

ধন্যবাদ।

আলতাফ হোসেন এর ছবি

ধন্যবাদ শুভাশীষ, অংশগ্রহণকারীদেরও ধন্যবাদ।
কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেল। সমর সেন-এর একটি কবিতাও আমার কাছে নাই। এখন নমুনা রাখতে পারব।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।