অনুবাদ কারখানা ||| ৩ |||

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: শনি, ২৬/১২/২০০৯ - ৩:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেমেল ও জিপা - আইজ্যাক বাসেভিস সিঙ্গার

গল্পটা আমার মা আমাকে বলেছে। আমি প্রায় হুবহু আপনাদের বলার চেষ্টা করব।

তবিয়াস নামে এক লোক ছিলেন। অবস্থাসম্পন্ন। তার বউ লিয়া। আর ছিল এক মেয়ে। নাম জিপা। ভুদাই একটা মেয়ে। পুরা এলাকায় এরকম মেয়ে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। জিপা বড় হলে ঘটকেরা তার জন্য পাত্রের সন্ধানে নামে। কিন্তু পাত্রেরা তার ভুদাইচরিত দেখে পালায়। জিপা’র অনূঢ়া হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়।

তার বাবা-মা রাব্বির উপদেশ নেবার জন্য যায়। রাব্বি বলেন- ‘স্বর্গে ঠিকঠাক অয় কার লগে কার জোড়া লাগবো। জিপা একটা বেকুব মাইয়া। হের লাইগা মহাভুদাই কোন পোলা নিশ্চয়ই আছে। এই জোড়া বানানো হইয়া গ্যাছে। অহন তোমরা খোঁজ লাগাও মহাবেকুব কোন পোলারে পাওনের। দুইডারে বিয়া দাও। দেখবা দুই বোকা শান্তিতে থাকবো।’

উপদেশে বাবা-মা খুশি হয়। তারা এক ঘটকের কাছে যায়। অনুরোধ করে লুবিন অঞ্চলের সবচে বোকা লোকের খোঁজ লাগানোর জন্য। এরকম সুপাত্রের খবর দিতে পারলে ঘটকালির ফি দ্বিগুণ দেয়া হবে বলেও জানানো হয়। শেয়াল্ম এলাকায় ব্যাপক বোকা লোকের বাস। খোঁজ নিতে ঘটক সেই এলাকার দিকে যাত্রা করে।

সেখানে পৌঁছে এক বাড়ির সামনে দেখে এক দামড়া বেটা কাঁদে। পুছ করে- ‘আব্বা, কী হয়েছে?’
সে কয় – ‘আম্মায় এক থালা ব্লিনঠেস বানাইছে শাভুঠের জন্য। ক্রিম কিনতে বাইরে যাওনের আগে বারবার আমারে কইয়া গ্যাছে – “লেমেল, শাভুঠের আগে কুনু ব্লিনঠেস খাইবা না, খবরদার।” আমি ও কথা দিছি। খামু না। কিন্তু আম্মা বাইরনের লগে লগে খাওনের লাইগা মাথা খারাপ অইয়া গেল। একটা খাইলাম। পরে আরেকটা। হেরপর আরো একটা। এই কইরা কইরা পুরা প্লেট শ্যাষ। এমন কইরা খাইতেছিলাম একটা বিলাই যে আমার দিকে হাঁ কইরা চাইয়া ছিল খেয়াল করি নাইকা। আম্মা আইলে হেই ব্যাটা সব কইয়া দিবো। তখন আম্মায় আমারে দুনিয়ার সব গালি পাড়া ধরবো। ভুদাই। গাধা। হাবারাম। মাথামুটা।বেকুব। উল্লুক। রামগাধা।’

ঘটক ভাবল। বাহ্, পাইছি। জিপা’র একেবারে মানিকজোড়।

ঘটক শব্দ করে বলে- ‘আরে আমি মেকুরের ভাষা জানি। বলে দিলে তোমার মাকে কিছু বলবে না।আমি মেকুরদের রাজা। আমার কথা অমান্য করবে না।’
শুনে লেমেল খুশিতে নাচা ধরে। ঘটক বাবাজি বিড়ালের কাছে গিয়ে মুখে যা আসে বলে গেল –‘ প্যাঁচে ম্যাচে ক্যাচে ল্যাচে।’
তারপর লেমেলকে জিজ্ঞেস করে –‘ আচ্ছা, তোমার কি বউ দরকার ?’
‘হ !’
‘তোমার জন্য একটা মেয়ে ঠিক করা আছে। জিপা নাম। ওর মতো কাউকে তুমি পাবে না।’
‘মাইয়াডার কী গাল লাল টুকটুক্ক্যা? চুল বেণী করে? এরম মাইয়া আমার ভালু লাগে।’
‘তুমি যা যা চাও সব সেই মেয়ের মধ্যে আছে।’

লেমেল আবার খুশিতে নাচা ধরে। হাততালি দেয়। তখনি তার মা ক্রিম নিয়ে ঘরে ঢোকে। ছেলেকে নাচতে দেখে জিজ্ঞেস করে – ‘কি হইছে? এমুন কইরা নাচতেছস্ ক্যান?’
লেমেল কয়- ‘ আমি হব ব্লিনঠেস খাইয়া ফেলছি। ভয় পাইছিলাম বিলাই তুমারে সব কইয়া দিব কিনা। এই লোকডা বিলাইরে কিছু কইতে না করছে।’
মা হাঁদার হাঁদা বলে চিৎকার করে ওঠে –‘এই বেকুবের লাইগ্যা মাইয়া পাই কেমতে?’
লেমেল খুশি হয়ে উত্তর করে –‘আম্মা, মাইয়া ঠিক করা হইয়া গ্যাছে। হের নাম জিপা। লাল টুকটুক্ক্যা গাল। চুল ও বেণী করে।’

তারপর জিপা আর লেমেলের বাগদান হয়ে যায়। তারা লিখতে জানে না। সই করার জায়গায় লেমেল দেয় তিনটা ফোঁটা। জিপা দিলো তিনটা ড্যাস। লেমেল যৌতুক পায় দুইশ গুল্ডেন। লেমেল টাকার নোট চেনে না। জিপার বাবা পাঁচ গুল্ডেনের নোট সাদা খামে আর দশ গুল্ডেনের নোট নীল খামে ভরে দেন। লেমেল একটা রূপার ঘড়ি ও পায়। কিন্তু ঘড়িতে কিভাবে সময় দেখতে হয় জানে না। সময় কত জানতে হলে রাস্তার কারো কাছ থেকে জেনে নেয়। সাথে সাথে বলে ফেলে- ‘চশমাটা ফালায়া আসছি। ঘড়ির কাঁটা দেখতাছি না, ভাই।’ মা তাকে এই অজুহাত দেখাতে শিখিয়েছে।

বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলে জিপা বেশি বেশি কান্নাকাটি করে। মা বলে –‘ কী হইছে? কাঁন্দস্ ক্যান?’
উত্তর দেয় –‘ এরম অচেনা লুককে বিয়া করতে লজ্জা করে।’
‘আমিও অচেনা লুকরে বিয়া করছি। বিয়ার পরে জামাই-বউয়ের মইধ্যে কিছু লুকাছাপা থাহে না।’
‘ধুরু। কি যে কও। আব্বা অচিন হইবো ক্যান? আমি না বিয়া করতেছি একডা অচেনা ব্যাটারে।’
মা বলে- ‘জিপা, তুমি একডা মহাবেকুব। তুমার জামাই একডা রামবুকা। খোদা চাইলে তুমরা দুই গাধা ভালাই থাকবা।’
পরে নানা কথার বাহানা শেষে জিপা বিয়ের আসরে যায়।

বিয়ের পর কিছুদিন পার হয়। লেমেলের শ্বশুর তাকে বলে –‘দেখ,লেমেল। তুমার আব্বায় ব্যবসা করত। আমিও ব্যবসায়ী। আমি চাই তুমিও ব্যবসা বুইঝা লও। তুমারে যে যৌতুক দিলাম সেটা দিয়া কুনু ব্যবসার চিন্তা কর।’
লেমেল জিজ্ঞেস করে ব্যবসায়ী মানে কী। শ্বশুর বলে- ‘কম দামে কিন্যা বেশি দামে যে বেচে হে ব্যবসায়ী।এটাত্ কিছু লাভ হয়। তুমি যৌতুকের টাকাডা লইয়া লুবিনে যাও। দরদাম কইরা কিনা ফ্যালাও। হেরপর এখানে নিয়া আইসা বেশি দামে বেচ।’
লেমেল শ্বশুরের কথা শুনে লুবিন যাত্রা করে। রাস্তায় খাবার হিসেবে জিপা কিছু বাধাকপির পাতা মুড়িয়ে মুরগির মাংস দেয়। গাড়িতে লেমেলের বেজায় খিদে লাগে। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখে মুরগির মাংস কাঁচা। জিপার মা তাকে বলেছিল কিছু মুরগির মাংস দিতে। রান্নার কথা বলে না দেয়াতে কাঁচা মাংসই দিয়ে দিছে।
যাত্রাপথে লেমেল একটা খাবার দোকানে থামে। রাজ্যের খিদে তার পেটে। ওয়েটার কি খাবে জিজ্ঞেস করে। লেমেল বলে-‘যা যা খাবার আছে দিতে থাক। আমার পেট না ভরা পর্যন্ত দিয়া যাবা।’

দোকানের লোক তাই করে। প্রথম দিল এক গ্লাস মদ। পরে আরেক গ্লাস। বাছুরের পায়া-ভুড়ি দিয়ে বানানো একটা এপেটাইজার দেয়া হলো। প্রচুর পাউরুটি আর সালাদ দিয়ে সেটা সাবাড় করে লেমেল। তারপর দেয়া হলো নুডলসের স্যুপের একটা বড় বাটি । এক বাটি শেষ করে আরেক বাটি চায়। এরপর দেয়া হলো ওট, বাধাকপি, আলু, গাজর মেশানো গোস্ত। বেশ অনেক খানি। সব খাওয়ার পর ও তার ক্ষুধা কমে না। আখরোট, আপেল, নাশপাতি আর কিশমিশ দিয়ে বানানো একটা শরবত গেলাও শেষ ।কিন্তু খিদে তাও শেষ হয় না। চায়ের সাথে কিছু কেক সার্ভ করল দোকানের লোকজন। চা খেল। কেক ও। কিন্তু ক্ষুধার নিবৃত্তি? দোকানের মালিক এসে বললেন- ‘আশা করি এবার আপনার পেট ভরেছে।’
লেমেল বলল-‘না অহনো পুরা ভরে নাইকা।’
দোকানের মালিক একটা বিস্কুট এনে বলল-‘এটা খেয়ে দেখেন।’
কুকিটা খাওয়ার পর লেমেল বুঝতে পারল তার খিদে আর নেই। সে বলে ওঠে –‘আরে বিস্কুটটা আগে দিলেই তো এত খাওনের দরকার অইতো না।’

ভুদাই কাস্টমারকে চিনে নিতে কষ্ট হয় না ঠগ দোকানদারের। সে বলে- ‘এখন দেরি হয়ে গেছে। পরের বার আসলে শুধু এই বিস্কিটের অর্ডার দিয়েন। তখন আর কিছু খাওয়া লাগবে না। এখন তাড়াতাড়ি বিল মিটায়ে ফোটেন।’ লেমেল পকেট থেকে টাকা বের করতে গেলে সাদা আর নীল খামগুলো বের হয়।
‘একটা খামে আছে পাঁচ গুল্ডেনের নোট। অন্যটাত্ দশ গুল্ডেনের। কুনটাত্ কী আছে ভুইল্যা গেছি।’ বাটপার দোকানের মালিক খাম খুলে একটা পাঁচ আর একটা দশ গুল্ডেনের নোট নিল। ভাংতি দেয়ার সময় ও লেমেলকে ঠকায়।

তারপর লুবিনে গিয়ে দোকানের পর দোকান খুঁজতে লাগে যেখানে দরদাম পাওয়া যাবে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না। রাতে বিছানায় শুয়ে সে ভাবতে থাকে জাদুকরি বিস্কুটের কথা। ওটা খেলে সাথে সাথে পেট ভরে যায়। এই বিস্কুট বানানোর রেসিপি জানলে তার টাকার অভাব হবে না। শেয়াল্মের লোকজনের কাছে পয়সাকড়ি কম। সারাদিন সবাই খিদায় কাতরায়। এই বিস্কুট পেলে সবাই লুফে নেবে। এই বিস্কুট খাবার পর গত বিশ ঘণ্টা তার কিছু খেতে ইচ্ছা করে নি।

পরের দিন সে বাড়ির দিকে যাত্রা করে। পথে সেই দোকানে আবার থামে। গিয়ে সেই বিস্কুট দিতে বলে। দোকানদার উত্তর করে –‘কিছুক্ষণ আগে আমার শেষ কুকিটা বিক্রি করে ফেলছি। তবে আমি আপনার কাছে রেসেপি বিক্রি করতে পারি। শেয়াল্মে এই কুকি বেচে আপনি অনেক টাকা লাভ করতে পারবেন। দেখবেন রথশ্লিড থেকে বড়লোক হয়ে গেছেন।’
‘দাম কত অইবো?’
দোকানদার অনেক দাম হাঁকল। ভবিষ্যতে অনেক টাকা লাভের আশায় লেমেল রেসিপিটা কিনে ফেলে চড়া দামে। দোকানের মালিক দেখল লেমেল লেখাপড়া কিছু জানে না, টাকার নোট পর্যন্ত চেনে না। একটা রেসিপি সে কাগজে লিখে দিলঃ
তিন কোয়ার্টস হাঁসের দুধ, পাঁচ পাউণ্ড লোহার গুঁড়ার ময়দা, বরফ দিয়ে বানানো দুই পাউণ্ড পনির, পাথরের টুকরা থেকে চেঁচে নেয়া এক পাউণ্ড চর্বি, লাল কোন কাকের আধা পাউণ্ড পাখনা, তামা পিষে এক কোয়ার্টার রস নাও। সব নিয়ে একটা মোমের বাটিতে ছুঁড়ে ফেল। আলু গাছের কাঠ দিয়ে আগুণ জ্বালিয়ে তিন দিন তিন রাত রাঁধতে থাক। তারপর একটা মণ্ড তৈরি কর। বাটারের ছুরি দিয়ে বিস্কুটগুলো কাট। তারপর বরফ দিয়ে বানানো কোন ওভেনে বেক কর যতক্ষণ না লাল, বাদামি, হলুদ না হয়। তারপর একটা গর্ত কর। পুরা জিনিস সেখানে ঢাল। সেখানে একটা সাইনবোর্ড টানাও – বুকাচুদারে বাজার করতে পাঠালে দোকানদারেরা বেজায় খুশি হয়।

লেমেল আবার ইচ্ছামত খেল। রেসিপি আর খাবারের দাম দেয়ার পর দেখা গেল তার কাছে কেবল ঘরে ফেরার মতো ভাড়ার টাকা আছে। কিন্তু দরদাম পেয়ে সে খুশি হলো বেজায়।

বাসায় ফিরে সে জিপাকে জানাল সেই জাদুর কুকির কথা। খুশিতে জিপা হাততালি দিয়ে নাচতে শুরু করে। কিন্তু খুশির জোয়ার বেশিক্ষণ টিকে না। লেমেলের শ্বশুর বাসায় ফিরে রেসিপি পড়লেন। রেগে চিৎকার করে উঠলেন –‘লেমেল, তুমারে হেরা ঠকাইছে।’
শুনে জিপা কাঁদা ধরে। সাথে জিপার মা।
কিছুক্ষণ পরে লেমেল বলে -‘আমি লিখতে পড়তে পারি না। এজন্য লুকে আমারে ঠকায়।পড়তে বা লিখতে জানলে আর কিছু অইবো না।’
শ্বশুর বললেন-‘হ, বাবা। ব্যবসা করতে অইলে লিখতে পড়তে জানতে হইবো।’
গ্রামে কোন মাস্টার নাই। পড়তে শেখার জন্য লুবিন যেতে হবে। শ্বশুর তার যাওয়ার খরচা আর টীচারের বেতন দিলেন। লুবিনে গিয়ে লেমেল লেয়ারস্টো রাস্তায় ঘুরতে লাগে। একটা চশমার দোকানে দেখে অনেক চশমা সাজানো।। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে সে দেখে এক ক্রেতা চোখে চশমা লাগিয়ে বইয়ের দিকে তাকায়। দোকানদার জিজ্ঞেস করে-‘এখন কী পড়তে পাচ্ছেন?’ লোকটা হ্যাঁ বলে।

লেমেল বুঝে নেয়। ও, তাইলে এই ব্যাপার। চোখে চশমা লাগালেই পড়তে পারা যায়। তাহলে আর মাস্টার খোঁজার দরকার কি। পড়ালেখা শিখার দরকার আর নাই। জিপার কাছে যাওয়ার জন্য সে অস্থির হয়ে ওঠে।
দোকানে ঢুকে বলল-‘এক জোড়া চশমা দ্যান যাতি পড়বার পারি।’
দোকানদার জিজ্ঞেস করে কি পাওয়ারের চশমা। সে বলে-‘আমি জানি না। আমারে দ্যান। আমি পইরা দেখি।’
দোকানদার এক জোড়া চশমা তার চোখে লাগিয়ে বই খুলে। লেমেল বইয়ের দিকে তাকায়। বলে-‘কিছু পড়বার পারি না।’
‘আচ্ছা। আরো শক্তিশালী চশমা দিচ্ছি।’
‘ধুরু। না।’
দোকানদার নানা পাওয়ারের চশমা তার চোখে লাগায়। কিন্তু যেই কে সেই। দোকানদার শেষে বলে–‘আমার সন্দেহ হচ্ছে। আপনি আদৌ পড়তে পারেন কিনা।’
‘পড়বার পারলে কি চশমা নিবার লাগি দুকানে আসি।’
‘ভাই। আপনার যেতে হবে কোন শিক্ষকের কাছে। চশমা দিলে পড়তে পারবেন, এই ধারণা কেমনে করলেন।’
শুনে লেমেলের মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভেবেছিল চশমা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। জিপা’কে ছাড়া তার একদম ভাল লাগে না। এর মধ্যেই জিপার জন্য তার মন খারাপ লাগা শুরু হয়ে গেছে। পরে সে মাস্টারের খোঁজে আবার বেরোয়। একজনকে পেয়ে ও যায়। কদ্দিন লাগবে শিখতে জিজ্ঞেস করার পর উনি জানান-‘এক বছর লাগবে। কমসে কম ছয় মাস তো বটেই।’
লেমেল খুব কষ্ট পায় শুনে। সে মাস্টারকে বলে-‘আপনে কি আমার লাইগা একখান চিঠি লেইখা দিবার পারবেন। আমার জিপা’রে চিঠি দিমু।’
‘পারব। বলো কী লিখতে হবে।’
লেমেল বলা ধরেঃ

প্রিয় জিপা,
আমি লুবিনে। ভাবছিলাম চৌখে গগলস্ দিলেই পড়বার পারুম। কিন্তু দোকানদারে কইলো এটাত্ কাম হবে না। টীচার কইলো লেখা পড়া শিখতো চাইলে ছয় মাস কি এক বছর লাইগা যাইবো। এই পুরা সময় কাটাইতে হইবো লুবিনে। আমার জান, তুমারে ছাইড়া থাকনের কথা ভাবতে গেলেই আমার মন পুড়তাছে। আমি কেন এত ভালবাসি তুমারে? ছয়মাস তুমারে ছাড়া থাকন লাগলে আমি কয়েকশ বার মইরা যামু। আমি ভাবতেছি বাসায় ফিরা আসুম। তোমার আব্বায় যদি রাজি থাকে। আমার এমুন কুনু কাম দরকার যেটাত্ পড়া লেখার দরকার নাইকা।
তুমার
লেমেল

জিপা চিঠি পেয়ে বাবাকে বলে পড়ে দিতে। সব শুনে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাবাকে বলে একটা চিঠি লিখে দিতেঃ

আমার লেমেল,
আমারে তুমি একদিন না দেখলে মইরা যাবা, আর আমি তুমারে এক মিনিট না দেখলে পাগল হইয়া যামু। চইলা আসো সোনা আমার। আমার লেখক মানুষের দরকার নাইকা। আমার দরকার একডা ভালা জামাই। বাসা থাকবো পোলামাইয়ায় ভরা। ছয়ডা পোলা।ছয়ডা মাইয়া। আব্বায় তুমার লাইগা কুনু কাম ঠিক কইরা দিবো। এক মুহূর্ত দেরি করবা না। সোজা বাসায় চইলা আসো। তুমি মইরা গেলে আর আমি পাগল হইয়া গেলে ক্যামনে কী।
তুমার জান
জিপা

জিপা’র চিঠি মাস্টারমশায় লেমেলকে পড়ে শোনালে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সে দিনই বাড়ির দিকে রওনা হয়। গাড়িতে ওঠার আগে সে একটা দোকানে ঢোকে জিপা’র জন্য কোন উপহার কেনার জন্য। দোকানদারকে সে সব জানায় তার সাথে কী কী হয়েছে। কেমন করে এক দোকানদার তাকে কুকির রেসিপি নিয়ে বলদ বানিয়েছে। চশমা দিলেই কিন্তু পড়া যায় না। সব।

এই দোকানদার আরেক বাটপার। সে বলল-‘তুমি লেমেল। তোমার বউ জিপা। আহা, এই রকম অনেক লেমেল অনেক জিপা থাকলে কি মজাই না হত। আমার একটা সিরাপ আছে। এটা খেলে তুমি দুটা তিনটা চারটা লেমেল হয়ে যেতে পারবে। ভাবো তো একবার, দশটা লেমেল আর দশটা জিপা থাকলে কি হবে? এক লেমেল এক জিপা সারাদিন বাসায় থাকবে। অন্য এক জোড়া যাবে বাজারে। আরেক জোড়া হাঁটবে। চতুর্থ জোড়া ক্রিম মেখে কেবল ব্লিনঠেস খাবে। পাঁচ নাম্বার যুগল লুবিনে গিয়ে পড়ালেখা শিখে ফেলবে।’
‘ক্যামনে এইডা সম্ভব?’
‘রসটা একটু খাও। তুমি নিজেই দেখতে পাবে।’

দোকানদার এক গ্লাস সাধারণ পানি এনে লেমেলকে সেখান থেকে এক ফোঁটা খেতে দেয়। তারপর লেমেলকে একটা রুমে নিয়ে ঢোকে। সেখানে দুটা আয়না মুখোমুখি একটু বাঁকা করে রাখা ছিল। লেমেল আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে অজস্র সংখ্যায়। সে হেঁটে গেলে
এতো এতো লেমেল একসাথে হেঁটে যায়।

দোকানদার বলল-‘কি, তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম?’
লেমেল অবাক হয়ে বলল- ‘আমার অহনো বিশ্বাস হইবার চায় না। এই সিরাপের দাম কত?’
দোকানদার বলে – ‘অনেক দাম। কিন্তু আমি তোমাকে সস্তায় দেবো।গাড়ি ভাড়ার টাকা রেখে বাকি সব টাকা আমাকে দিয়ে দাও। তোমার জন্য জবরদস্ত একটা দরদাম হবে।’

লেমেল সাথে সাথে টাকা দিয়ে ফেলে। দোকানদার তাকে এক বড় বোতল পানি ভরে এনে গছায়। বলে- ‘তুমি আর জিপা প্রত্যেক দিন এক ফোঁটা করে খাবে। বছর খানেক এই বোতলে তোমাদের চলে যাবে। শেষ হয়ে গেলে লুবিনে এসো, আমি আবার বিনামূল্যে ভরে দেব। দাঁড়াও, আমি তোমাকে লিখিত গ্যারাণ্টি দিচ্ছি।’

দোকানদার একটা কাগজ নিয়ে এল। সেখানে লিখে – ‘ঈশ্বর ভুদাইদের খুব পিরীত করে। দিনকে দিন ভুদাইয়ের সংখ্যা তাই বেড়ে চলছে।’

লেমেল বাসায় ফিরে। শ্বশুর পানির বোতল দেখেন। কাগজটা পড়ে নেন। বুঝতে পারেন লেমেল আবার ধরা খেয়ে এসেছে।

কিন্তু লেমেল জিপাকে দেখে সব দুঃখ ভুলে যায়। চুমু খেয়ে জিপাকে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে-‘আমার অনেক জিপা’র দরকার নাইকা। হাজার বছর বাঁইচা থাকলেও একখান জিপা আমার লাইগা কাফি।’
‘আমারো অতো বেশি লেমেল লাগবো না। দশ লক্ষ বছর বাঁইচা থাকলেও একখান লেমেলে আমার চলবো।’

হ। দুজনেই মহাভুদাই। লেমেল। জিপা। কিন্তু তারা দুজন দুজনকে অনেক অনেক ভালবাসে। লেমেল একটা ঘোড়া কেনে। একটা গাড়ি ও কেনে। হয়ে যায় গাড়োয়ান। এর জন্য আর লেখাপড়ার প্রয়োজন হয় না। শেয়াল্মের রাস্তায় সে গাড়ি চালায়। তার সময়ানুবর্তিতা, বন্ধুবৎসল ব্যবহার আর ঘোড়াগুলোর প্রতি মায়া দেখে লোকজন তাকে খুব ভালবাসে। লেমেল আর জিপা’র ছয় ছেলে আর ছয় মেয়ে। ছেলেরা মাকে খুব যত্ন করে। মেয়েরা বাবাকে। তারা ও যথারীতি বোকাসোকা। প্রাপ্তবয়স্ক হয়। শেয়াল্মে তাদের মতো কিছু বোকাকে বিয়েও করে। লেমেল জিপা বুড়োতে থাকে। পৌত্র, প্রপৌত্র, প্র-প্রপৌত্রদের এক বিশাল ব্যাটেলিয়ান নিয়ে সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করে।

(সেকেণ্ড ড্রাফট)
___________________________________________________________

গল্পটা নেয়া হয়েছে আইজ্যাক বাসেভিস সিঙ্গারের ‘স্টোরিজ ফর চিল্ড্রেন’ গল্পগ্রন্থ থেকে। গল্পটি ইদিশ থেকে অনুবাদ করেছেন জোসেফ সিঙ্গার। মুখবন্ধে বাসেভিস সিঙ্গার লিখেছেন-‘ছোটদের জন্য কিছু লিখতে পারি এটা আমি নিজেও জানতাম না। একটা ভুল ধারনা ছিল অনেক দিন। যারা ছোটদের জন্য লিখে তারা প্রকৃত সাহিত্যিক নন, বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পীরা আসল চিত্রশিল্পী নন। অবশ্য এটা ঠিক গ্রিম ভাইদের বইয়ের জার্মান অনুবাদ এবং হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এণ্ডারসনের গল্পের অনুবাদ পড়ে আমি খুব মুগ্ধ হতাম। কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের ইদিশ অনুবাদ পড়ে আমার যে আনন্দ হয়েছিল এখনো পর্যন্ত ভুলি নি। কিন্তু আমার ভাবাগোনায় বাচ্চাদের নিয়ে গল্প লেখার কথা কখনো আসে নি।লেখকেরা নিজেদের যেটুকু চিনেন, সম্পাদকেরা তারচে বেশি ভাল চেনেন। সম্পাদক এলিজাবেথ জোর গলায় বলেছেন আমি ছোটদের জন্য লিখতে পারি। তাঁর এই দৃঢ় বিশ্বাস আমি ভাঙ্গতে পারি নি।.........’

অনুবাদ কারখানা ||| ২ |||


মন্তব্য

ঐশী এর ছবি

সিঙ্গারের গল্পের মধ্যে একটা আলাদা জগৎ আছে। এই রকম একটা জগতে হাহাকার, কষ্ট, বেদনা, কিছু কিছু সুখ অন্য মাত্রায় প্রকাশ পায়। পড়তে পড়তে একটা অন্যরকম অনুভুতি মনের মধ্যে টোকা মারে। আপনার কারখানায় সিঙ্গার ধরা পড়েছেন দেখে প্রীত।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

সিঙ্গারের গল্প অনুবাদ করায় বেশ খবরাছে। মাথা গুলায়।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

ভালো লাগল অনুবাদ। প্রাণবন্ত।
একটা প্রশ্ন ছিল, অনুবাদ কি অনুমতি নিয়ে করা?
----------------------------------------
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
----------------------------------------
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

ওহ্! দুঃখিত। তার লেখা তো আগেই পাবলিক ডোমেইনে চলে গেছে।
----------------------------------------
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
----------------------------------------
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অতিথি লেখক [অতিথি] এর ছবি

অনুবাদ খুবই ভালৈছে। এক কথায় চমৎকার। আর ও অনুবাদ করে দেন সিঙ্গার সা'বের গল্প।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দেখা যাক।

অতিথি লেখক [অতিথি] এর ছবি

সিনেমাটা দেখে আসলাম মাত্র। অসম্ভব ভাল। আপনার লেখা পড়ে অনেক খুঁটিনাটি জানতে পারলাম। খুব ভাল একটা রিভিউ লিখছেন। আপনাকে শুভেচ্ছা।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনি বোধহয় ভুল নাম্বারে ডায়াল করছেন। এটার নাম্বার দুই নয় চার ছয় পাঁচ ...... চোখ টিপি

অরণ্য বংশী [অতিথি] এর ছবি

চমৎকার অনুবাদ! ভালো লেগেছে হাসি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কথা হল, অনুবাদটা আমার নিজের খুব একটা ভাল লাগে নি। সঙ্গত কারণে আমি এই লেখার সিরিজকে কারখানা নাম দিয়েছি। সেকেণ্ড ড্রাফট্‌ কথাটাও লিখে দিয়েছি।

ফাইনাল ড্রাফট্‌ হলে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে আপ করব।

আপনাকে শুভেচ্ছা।

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

রুশ সাহিত্যে সরল বাক্যে খটমট শব্দের সংমিশ্রণে যে আধো-রম্য পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, অনুবাদে তার প্রায় পুরোটাই ধরা পড়েছে চমৎকার ভাবে। সপ্রতিভ অনুবাদ।

কোথায় শুদ্ধ আর কোথায় রম্য ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে তা একটু দেখে নিয়েন চুড়ান্ত খসড়ার সময়। সববয়সীর জন্য লেখা হলে "বুকাচুদারে" জাতীয় শব্দ পরিহার করাই ভালো। হঠাৎ খটকা লাগে এতে।

কিছু সচলিকৃত বাক্যের চমৎকার ব্যবহার হয়েছে। তাই ভাবছি- "এরম মাইয়া আমার ভালু লাগে" এর বদলে "এরম মাইয়া আমি ভালু পাই" লিখলে কেমন হবে!

-----------
"সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে"

-----------
চর্যাপদ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্য ভালু পাইলাম। চোখ টিপি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চমৎকার গল্পানুবাদ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

গৌতম এর ছবি

সহজ ও সাবলীল অনুবাদ। সবকিছু ছাপিয়ে ভালোবাসাটুকু উজ্জ্বল।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হ ............

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ভালো গল্প... চলুক

অনুবাদের প্যাটার্ন কি বদলালেন নাকি ?? নাকি গল্পটাই এরকম ??

_________________________________________

সেরিওজা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হালকা এক্সপেরিমেণ্ট আছে। তবে গল্পটাও এরকম অনুবাদ করতে বাধ্য করছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।