ছফাগিরি। কিস্তি নয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: শনি, ০৩/০৪/২০১০ - ৫:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কারা যেন এই পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার লুট করে
সমস্ত মণি-কাঞ্চন কাঁচা-আলোর ঢলাঢল লাবণী স্রোতে
গুলিয়ে মেরেছে। আলোর স্পন্দমান কণিকার
নিপুণ ঝঙ্কার বাতাসের শরীরে থরথর প্রেমের
প্রথম স্পর্শের মত কাঁপছে।

নিজের ভেতর টের পাচ্ছি আমার মস্তক
হাওয়া ঠেলে উর্ধ্বদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরের
মত ওঠছে, আর ভোরের আলোক এলানো
কেশগুচ্ছে খেলা করছে। আপন মহত্ত্বের
ঔজ্জ্বল্যে তুষার ঢাকা ধবল গিরিশৃঙ্গের
মত ঝলমল করছি আমি। …

ছফা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- আমার লেখা এখন অনুবাদের পর্যায়ে চলে গেছে। ছফার এই কবিতাটির শেষ স্তবকে ব্যক্তিগত এলিট ভাব দেখলে অনেকে মুখ মেরে উঠতে পারে। পুরা সাত্ত্বিক হওয়া তার সইবে না- ছফা নিজেই স্বীকার করেছেন এই কথা। তাঁর মধ্যে রক্তপাত হয়, প্রবাহ সৃষ্টি হয়, বিদ্যুৎ তৈরি হয়। অপরকে বিদ্যুতায়িত করার ব্যাপার তখন আর অগোচরে থাকে না। চট্টগ্রামের পটিয়া অঞ্চলের লেখক আহমদ ছফা একসময় আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সাথে একা লড়েছেন। বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের বিক্রিবাট্টা বন্ধ করার জন্য আন্দোলনে শরিক হয়ে অন্যদের জড়ো করেছিলেন। দেশের প্রকাশনা শিল্প আর লেখকদের বাঁচাতে, কলকাতাকেন্দ্রিক আধিপত্য হটাতে, ছফার অঞ্চলপ্রেম এখন বাহুল্য মনে হয় না। তিনি লেখক শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। আবার ছেড়ে চলেও এসেছেন। গোষ্ঠীবান্ধব আচরণ ছফার পক্ষে চালিয়ে যাওয়া মুশকিল ছিল।

ছফা তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে যান যেকোন ফ্রেম থেকে। একটা গোষ্ঠী বা দলের মধ্যে তাঁকে আটকে রাখা সম্ভব ছিল না। নিজের বিশ্লেষণী ক্ষমতার উপর তাঁর বাড়াবাড়ি বিশ্বাস ছিল। তিনি ‘অলাতচক্র’, ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসের রচয়িতা। মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে (হুমায়ূন আহমেদের পরিবার) বাড়িছাড়া করতে গেলে ছফা গায়ে পেট্রোল ধরিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেন। আবার একই ছফা লড়েন কবি ফররুখ আহমদের হয়ে। এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন।

ফররুখ আহমেদ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী কবি, এতে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না। কিন্তু তাঁর চেতনা সময় এবং সমাজের সঙ্গে বিকশিত হতে পারেনি। সেটাই হল মুশকিল। শুধু ফররুখ নন, অনেক বড় বড় কবি শিল্পী এই অহমটাকে একটা আদর্শ মনে করেছেন। যেমন এজরা পাউণ্ডের মত কবি, ন্যূট হ্যামসুনের মত লেখক, হিটলারের সমর্থক হয়ে গেলেন। ফররুখ অত্যন্ত সৎ এবং আত্নসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি পাকিস্তানকে সমর্থন করে গেছেন। কিন্তু নিজে ফায়দা নেননি। তাঁর বিশ্বাসটা নিজের বিশ্বাস ছিল, শাসকগোষ্ঠীর ইসলামের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। জীবনে তিনি কোনদিন পাকিস্তানে যাননি। আইয়ুব খান যখন তাঁর জন্য খেতাব পাঠালেন, গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। পরে সেই খেতাব মুনীর চৌধুরীকে দেয়া হয়। এইরকম একজন মানুষও তো অনাদর-অবহেলায় মারা গেলেন, মনে করলে খুব কষ্ট পাই। আমি যখন শুনলাম, ফররুখের একটা মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, এই তথাকথিত মুসলমান যাঁরা ফররুখকে নিয়ে নাচানাচি করেছে তখন তাদের সকলের ঘরে ঘরে গেছি। কেউ কিছু করল না দেখে কাগজে একটি নিবন্ধ লিখে আমাকেই প্রতিবাদ করতে হয়। আমার এই লেখার কারণেই তৎকালীন মুজিব সরকারকে ফররুখকে চাকরির বকেয়া মাইনে এবং চাকরি ফেরত দিতে হয়। … একটা জনগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদের দাবিতে জেগে উঠেছে, তিনি সেটাকে সমর্থন করতে পারলেন না। আবার পাকিস্তানী ঘাতকদের সঙ্গেও একমত পোষণ করতে পারলেন না। তার ফলে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতাবোধ, যার প্রকৃতি অত্যন্ত নির্মম।

ফররুখ আহমদের সাথে ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের নীলগঞ্জ (ময়মনসিংহ) হাইস্কুলের শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাসেমপুরী্র প্রতিতুলনা করা যায়। ইরতাজউদ্দিনের চোখ সেই সময়ে খুললেও ফররুখ আহমেদের বিশ্বাস টলে না দেখে আশ্চর্য লাগে। বিশ্বাসের অহমে কিছুতেই আঁচ না লাগানো এক ধরণের এলিট ধারণা। অবশ্য ফররুখ আহমেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই ভাব ছফার নজর এড়ায় নি। তাও তাঁর পক্ষে কলম ধরার অন্যান্য অনুষঙ্গ ছিল। যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে নানান ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। অনেকেই তখন ভেক পালটে দেশপ্রেমী হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে শামিল। সবার সব দোষ একা ফররুখ আহমেদ ভোগ করবেন- ছফার এটা ভাল লাগেনি।

আহমদ ছফা দীর্ঘ কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’, ‘শঙ্খ নদী’, ‘বস্তি উজার’, ‘কবিতার দোকান’ আকারে বেশ দীর্ঘ। গ্যোতের ফাউস্টের অনুবাদের কথাও এক্ষেত্রে এসে যায়। ‘কবিতার দোকান’-এ ছফা লিখেছেন-

আমি রন্ধন শাস্ত্রে
অত্যন্ত বুজর্গ এবং কামেল মানুষ। আমাকে কেউ
কেউ যখন ঠাট্টার ছলেও হজরত সম্ভাষণ করে,
আমার রাগ দুঃখ কোনটাই হয় না। কারণ আমি মনে করি একজন
হজরত হওয়ার যোগ্যতা আমার আছে।
সমস্ত উপাদান পরিমিত আকারে ব্যবহার করার ক্ষমতা
আমার অসাধারণ। আমার রান্নার গুণে নিতান্ত
তুচ্ছ জিনিশও নতুন একটি শিল্পসত্ত্বার গরিমায়
উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
রন্ধনশিল্পের এমন কতিপয় অলৌকিক কৌশল
আমি রপ্ত করে ফেলেছি, যাই-ই রান্না করিনে কেন
অমৃতে পরিণত হয়।

আহমদ ছফা তাঁর লেখালেখির সময় সমসাময়িক লেখক-কবিদের ভণ্ডামি দেখে চুপ থাকেন নি। প্রবন্ধে, উপন্যাসে, কবিতায় নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। গোত্রপ্রীতির বিরুদ্ধে লড়তে সহযোদ্ধা পাননি দেখে নিজেকে নিয়েই কথার শুরুয়াত। এই অহম কিছু কিছু লেখা বা বাতচিতে প্রকাশ পেলেও নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করেন নি। নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিক উঁচুতলার লোক হিসেবে ধরে নিয়ে অন্যদের বাতিল করে দেয়ার মানসিকতা বেশ উন্নাসিক। এই বদগুণ না থাকা সত্ত্বেও ছফার ভুলপাঠ অনেকেই হরহামেশা করেন।

বারবার ঠাঁই
নাড়া হতে হতে শেষমেষ একটি চিলে
কোঠায় আমি ডেরা পেতেছিলাম। সেখানেও
দেখি কবিতার দোকানদারেরা দৌরাত্ম্য
শুরু করেছে। তাই অনুপায় হয়ে আমি
আমার কবিতার দোকান টলমল
মেঘের মুলুকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি।
এখন মনে হচ্ছে, এটাই উপযুক্ত
স্থান। প্রথম থেকে যদি বুঝতে
পারতাম, অনেক অকারণ হয়রানি থেকে
রেহাই পেয়ে যেতাম। এখন আমি অনেকটা
নিশ্চিত। আমার খদ্দেররা হাওয়াতে
সিঁড়ি লাগিয়ে মেঘ-মুলুকের ক্যান্টিনে
নির্বিবাদে চলে আসতে পারবে। নগরীর
দোকানদারদের বাগরা দেয়ার
সমস্ত পথ বন্ধ। বিশুদ্ধতার জগতে
তাদের গতিবিধি সম্পূর্ণ অচল। এখন
আমি করধৃত আমলকীর মত সমস্ত
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের দায়িত্বভার গ্রহণ করে
ফেলেছি। কার সাধ্য আমাকে ঠেকায়।
আমার সাধনায় ফুল ফুটেছে, ফল ফলছে।

কেন লিখি? সব লেখক তাঁদের জীবনের একটা পর্যায়ে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন। ছফা ও হয়েছেন। ছোটবেলায় বাবাকে বলতে শুনেছেন- আমার এই ছেলেটি আগের যুগে জন্মালে অবশ্যই পয়গম্বর হত। এটা শুনে তাঁর ভাল লাগত না। পয়গম্বর হওয়াটা কিভাবে এড়ানো যায় তার ফিকির খুঁজতেন। ছাত্রজীবনে কৃষক রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু টিকে থাকা সম্ভব হয় নি। জাঁদরেল পণ্ডিত হওয়ার বাসনায় নানারকম পড়াশুনা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের বেহাল দশা দেখে সেই আগ্রহে ও ভাটা পড়ে। ব্যবসা শুরু করেছিলেন। চালাতে পারেন নি। তবে লেখালেখির শুরুটা এক্সিডেন্টাল হলে ও এটা ধরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। লেখালেখি করা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। তাই শেষ বিচারে নিজেকে তিনি লেখক হিসেবেই দেখতে পান। না পয়গম্বর। না হজরত।

এখন একটা বিশ্বাস মনের ভেতর হীরার মত শক্ত হয়ে জন্মেছে। লেখকেরা মানব সমাজের, মানবজাতির অস্তিত্বের সারবান অংশটুকু ধারণ করেন। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক এঁরা সকলেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু লেখককে আমার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বিক্রমাদিত্যের আমলের কারিগর-বিজ্ঞানী এবং অন্যবিধ বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমাদের চিন্তা না-করলেও চলে। কিন্তু কালিদাসকে নিয়ে না-ভাবলে চৈতন্যের শুদ্ধতা আসবে না বলে মনে করি। আমি এমন আহামরি লেখক নই। তবু যখন কলম ধরি একটা ধারণা আমার আসে। মনে হয় আমি সমগ্র মানবসমাজের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আছি। আমার লেখার মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যক্তি চৈতন্যের নতুন উদ্ভাসন ঘটছে।

আবার ও বলছি আমি ছোট মানুষ। কোন স্পর্ধিত উচ্চারণ আমাকে শোভা পায় না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ছন্দ দিয়ে তিনি যন্ত্র চালাবেন। গ্যোটে বিশ্বাস করতেন সমস্ত প্রাণশক্তি পুঞ্জীভূত করে একটামাত্র প্রবল ফুৎকারে নতুন দেববীর্যে বলীয়ান মানুষ সৃষ্টি করবেন। আমি কিছু নই। তবু জানি এই সমস্ত অতিকায় মানুষ আমার মার মত নারীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। একটুখানি অতিকথা বললাম। কারণ ক্ষুদ্র সাফল্যের চাইতে মহৎ ব্যর্থতা অনেকবেশী কাঙ্ক্ষিত। কথাগুলো গুছিয়ে বলার সুযোগ হল না। যখন একা থাকি, নির্জন পথে একাকি হাঁটি, আমার বাবার কথাগুলো আমাকে হন্ট করে; আমার ছেলেটি আগের যুগে জন্মালে পয়গম্বর হত। শেলি তো বলেছেন, পোয়েটস আর দ্য আন-একনলেজ্‌ড লেজিস্‌লেটরস অব দ্য ওয়ার্ল্ড। আমি কতটুকু লেখক, কতটুকু কবি বা অন্যকিছু সেটাও জানি না। তবু আমাকে লিখতে হবে। লেখাটা আমার কাছে আনন্দের নয়, অত্যন্ত গুরুভার বেদনাময় কর্তব্য। এড়িয়ে যেতে চাই; পারি না। …

মানুষের মধ্যে হানাহানি, দলবাজি দেখে সব ছেড়ে পলায়নের ইচ্ছা ছফা কিছু কিছু জায়গায় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পালাতে পারেননি। মানুষের মাঝে যাঁর ঘরবসতি আকাশে পাখির রাজ্যে কি মর্ত্যে বৃক্ষের সান্নিধ্যে বেশিদিন কাটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের রাজ্যে ফিরে এসেছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। অন্যদের তরঙ্গিত করার চেষ্টা করেছেন। ফলাফল শূন্য দেখে হতাশ হয়েছেন। তবুও অমৃত উৎপাদনের ইচ্ছা গোপন রাখেন নি। ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ’ উপন্যাসের শেষ প্যারা দেখি।

মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা এবং হানাহানি দেখে আকাশের পাখির জগতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতিবৈরিতার প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং মানুষের কর্তব্য পালন করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কী? আমি বৃক্ষ নই, পাখি নই, মানুষ। ভাল হোক, মন্দ হোক, আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মত মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে। তথাপি আমার জীবন আমি একেবারে অর্থহীন মনে করিনে। আমার প্রাণে পুষ্পের আঘ্রাণ লেগেছে, জীবনের একেবারে মধ্যবিন্দুতে বৃক্ষজীবনের চলা অচলার ছন্দদোলা গভীরভাবে বেজেছে, বিহঙ্গজীবনের গতিমান স্পন্দন বারংবার আমার চিন্তা-চেতনা অসীমের অভিমুখে ধাবমান করেছে। এই পুষ্প, এই বৃক্ষ, এই তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, আমার কোন একাকীত্ব, কোন বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনে। সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে রয়েছি। আমি পুত্রটির কাছে বিশেষভাবে ঋণী। আমার পাখিপুত্রটি আমাকে যা শিখিয়েছে কোন মহৎ গ্রন্থ, কোন তত্ত্বকথা, কোন গুরুবাণী আমাকে সে শিক্ষা দিতে পারেনি।একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে। আমার পাখিপুত্র মুক্ত, আমি মুক্ত, আমাদের সম্পর্ক থেকে প্রত্যহ অমৃত উৎপন্ন হয়। এই আকাশের জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কি অমৃত সমুদ্রে অবগাহন নয়?

গ্যোতের ‘ফাউস্ট’ অনুবাদ ছফার একটা উল্লেখযোগ্য কাজ। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক ছফার এই কাজ নিয়ে গর্ব করতেন। যেকোন মজলিশে সুযোগ পেলেই মৌলবী আহমদ ছফাকে বলতেন ফাউস্টের অনুবাদ থেকে পড়ে শোনাতে। এই অনুবাদ করার পেছনে ছফার কথা বেশ সুপাঠ্য। ১৯৬৪ সনের ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালীন সময় ছফা কারফিউ ভেঙ্গে বন্ধু অরুণেন্দু বিকাশ দেবের নবাবপুরের নরেন্দ্রবসাক লেনের বাসায় যান। সেখানে কোন কিছু না ঘটলে ও হিন্দু পরিবারটি ভয়ে দিন গুজরান করছিল। পৌঁছানোর পরের দিন পাতকুয়ায় গোসল করতে যাওয়ার সময় পুরানো কিছু বইয়ের স্তুপে পেলেন জীর্ণ একটা বই। ফ্ল্যাপে লেখা ফাউস্ট। লেখকের নাম পর্যন্ত নেই।

ওইটুকু ইংরেজিজ্ঞান নিয়েও আমি যখন বইটির ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম; আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। একটা জায়গায় এসে, দু’টো লাইন পড়ে, আমার ভেতরটা এত খুশি হয়ে উঠল যে, তখন আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিলঃ ‘অল থিয়োরি ইজ ডাল, বাট দ্য গোল্ডেন ট্রি অফ লাইফ ইজ এভারগ্রীন।’ এই লাইনগুলো পড়ার পর আমি কিছুক্ষণ ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে একটা মানসিক বিমর্ষতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমি চিন্তা করছিলাম, শুধুমাত্র নিজের ধর্মের নয় বলে পূর্বশত্রুতা ছাড়া কি করে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে। মানুষের বেঁচে থাকার কোনও উদ্দেশ্য আছে, যা আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এই লাইন দু’টো পাঠ করার পর আমার মনে একটা ভাবান্তর এসে গেল। তখন ফাল্গু্ন শেষ, চৈত্রমাস শুরু হয়েছে। গাছে গাছে নতুন পাতা জন্মাচ্ছে। পাতাগুলোকে আমার মনে হচ্ছিল এক ধরণের সাইনবোর্ড, যাতে রয়েছে- গোল্ডেন ট্রি অব লাইফ ইজ এভারগ্রীন।

আমি গোসল করার কথা ভুলে গেলাম। ব্রেকফাস্ট করার কথা ভুলে গেলাম। সোনার মাছির মতন কি একটা আমার কানে ঝংকার দিয়ে বলে যাচ্ছিল, সবকিছুর পরেও জীবন অমূল্য জিনিস। …

সূত্র

১। আহমদ ছফা রচনাবলি- সপ্তম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৫২৪]
২। আহমদ ছফা রচনাবলি- তৃতীয় খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৩৫৪-৩৫৫]
৩। আহমদ ছফা রচনাবলি- তৃতীয় খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৪৭২]
৪। আহমদ ছফা রচনাবলি- তৃতীয় খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৪৭৭]
৫। আহমদ ছফা রচনাবলি- সপ্তম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৪৮০]
৬। আহমদ ছফা রচনাবলি- দ্বিতীয় খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৮৪]
৭। আহমদ ছফা রচনাবলি- সপ্তম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ৪৫৬]

ছফাগিরি। কিস্তি আট।


মন্তব্য

সহজীয়া এর ছবি

অসাধারণ! ছফাকে আপনি ধারণ করতে পেরেছেন। অলাতচক্র নিয়ে আলাদা প্রবন্ধের দাবী জানিয়ে রাখলাম।
____________________________________
বিধিবদ্ধ পঙ্কিলতা।
জীবন বাবু,তাঁর কবিতা।
তৃপ্তিদায়ী আত্মশ্লাঘা।
এবং এ রাতজাগা।
************************************

আসাদ [অতিথি] এর ছবি

"আমি বৃক্ষ নই, পাখি নই, মানুষ। ভাল হোক, মন্দ হোক, আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মত মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে। "-- "পাতাগুলোকে আমার মনে হচ্ছিল এক ধরণের সাইনবোর্ড, যাতে রয়েছে- গোল্ডেন ট্রি অব লাইফ ইজ এভারগ্রীন" --- হিউম্যানিস্ট ছফা, জীবনবাদী ছফার একটা চমৎকার চিত্রায়ন হয়েছে এই পর্বে।

লেখক ছফা অন্য একজন লেখকের সত্বাকে কতটা আন্তরিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন, তার পরিচয় পাওয়া গেল। তবে, "আমি কেন লিখি?" -- এ প্রশ্নের জবাবে ছফা কোন সমাধানে পৌঁছালেন, পরিষ্কার হল না।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কেন লিখি? - প্রবন্ধটি আকারে বেশ ছোট।

তবে ছফা কেন লেখালেখি করেন এই প্রশ্নের উত্তর অনেক প্রবন্ধে কি সাক্ষাৎকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শব্দের পর শব্দ বসিয়ে চিন্তাহীন শব্দসংগম করে করে অর্থহীন লেখার যে চর্চা এপার বাংলা ওপার বাংলায় অব্যাহত আছে ছফার তার বিরুদ্ধ স্রোতের মানুষ।

স্পর্শ এর ছবি

এ পর্বটা আরো বড় হতে পারত কিন্তু। পড়তে পড়তে একেবারে ডুবে গেছি যখন তখনই দেখি শেষ! পরের পর্বগুলো বড় করার আবদার জানিয়ে গেলাম।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

মামুন হক এর ছবি

নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিক উঁচুতলার লোক হিসেবে ধরে নিয়ে অন্যদের বাতিল করে দেয়ার মানসিকতা বেশ উন্নাসিক।

--এই রোগটা এখন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে গেছে চারদিকে...
লেখায় পাঁচ তারা, তবে স্পর্শের সাথে একমত, আরও বড় হতে পারত।

রিভা  এর ছবি

ছফাগিরির জন্যে ধন্যবাদ......লেখাটা ভাল লাগলো......

বাউলিয়ানা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ শুভাশীষ'দা।

ছফাগিরির জন্য অপেক্ষায় থাকি।

ফারাবী [অতিথি] এর ছবি

রীতিমত গবেষণা করে লেখা, পড়ে ভাল লাগল। আপনার ছফাকে নিয়ে প্রথম লেখাটা পড়েই আমার মনে হয়েছিল এখন থেকেই ছফার লেখা পাঠ শুরু না করলেই নয়। এবারের বই মেলায় সে কথা মনে রেখেই একখানা বইও কেনা হয়েছে ওনার। ক'দিন বাদেই পড়া শুরু করব আশা করা যায় হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

অপেক্ষা করছিলাম
পড়লাম

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১. এই পর্বেও ছফার উদ্ধৃতি আর লেখকের বিশ্লেষণ কিছু কিছু জায়গায় আলাদা করা একটু কঠিন হয়ে গেছে। এতে পাঠক একটু বিভ্রান্তিতে পরেন।

২. ছফার বোদ্ধা পাঠকদের কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন শুভাশীষ এই সিরিজিটা লিখছেন কেন? আমি তাদের একটু ধৈর্য্য ধরতে বলছি।

ছফার লেখক সত্ত্বা, তাঁর মানব সত্ত্বা, তাঁর সৃষ্টি -এর পরিচয় তুলে ধরা, সেগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা, সর্বোপরি ছফা পাঠ কেন জরুরী সেটা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তুলে ধরার কাজটি খুব সহজ নয়। এই দুরূহ কাজটি করার সাহস শুভাশীষ দেখিয়েছেন। তিনি সফল কি ব্যর্থ সে বিচার আরো অনেক পরের ব্যাপার।

৩. "অলাতচক্র" উপন্যাসটি সম্ভবতঃ ১৯৮৪/১৯৮৫ সালের ঈদসংখ্যা "নিপুণ"-এ প্রকাশিত হয় (মোস্তফা জাব্বার সম্পাদিত)। আমার স্মৃতি প্রতারণা করে না থাকলে সেই উপন্যাসের শুরুতে "অলাহুত চক্রের মাঝে...." দিয়ে শুরু এমন দুই লাইনের একটা কবিতা ছিল। নায়িকার নাম "তায়েবা" ছিলনা। উপন্যাস ৪ঠা ডিসেম্বর নয় ১৬ই ডিসেম্বরের ঘটনা দিয়ে শেষ হয়। শেষ লাইন সম্ভবতঃ এমন ছিল, "দেখি কলকাতার বাড়িগুলোর ছাদে অশোকচক্র পতাকা উড়ছে। বুঝলাম ঢাকা ফল্‌ করেছে"।

ছফার উপন্যাসসমগ্রতে প্রকাশিত "অলাতচক্র"তে এসব নেই। উপন্যাসের ভেতরেও বেশ পরিবর্তন করা হয়েছে। উপন্যাসটির প্রথম ভার্সানটি আমি হারিয়ে ফেলেছি। কারো কাছে থাকলে দয়া করে জানাবেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

১। উদ্ধৃতি ইটালিকসে আলাদা প্যারায় দিচ্ছি। এক দুইটা লাইন তাও আমার ব্যাখ্যায় চলে আসে। পড়লে আমি বুঝতে পারছি। আপনার কোন স্পেসিফিক জায়গায় অসুবিধা হলে জানায়েন।

২। আমি একটা কারণে ছফাগিরি শুরু করেছিলাম। আমাদের সময়ের নায়কের কথা অন্যদের জানাতে।

৩। 'অলাতচক্র'-র প্রথম ভার্সানটা কারো হাতে থাকলে জানাবেন।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

শ্রদ্ধেয় বাউলশিল্পী,

মাত্র প্রথম পাতা শেষ করলেন বস্‌।

ঠিক আছে। ধৈর্য ধরে আছি। আসেন আসেন প্লিজ।

-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।