৫ | লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: রবি, ০৯/০৫/২০১০ - ১২:১৩অপরাহ্ন)
মাস দেড়েক আগে অলাতচক্র (নতুন ভার্সান) আবার পড়লাম। এই উপন্যাসটার প্রতিটা অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাবে। ফ্যাক্ট আর ফিকশনের এমন নিবিড় বুনোট বাংলা সাহিত্যে আর কোথায় দেখেছি মনে পড়েনা। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিটি ফ্যাকশনের কথা এখানে উঠে এসেছে। আজ এতগুলো বছর পরও সেই ফ্যাকশনগুলো একটু অন্যরূপে কিন্তু প্রবলভাবে বিরাজমান। চেতনার তীব্রতা হয়তো সেই রকম নেই, কিন্তু চরিত্র একই প্রকার আছে - behavior পাল্টেছে কিন্তু attitude পাল্টায়নি। বস্তুতঃ এই অঞ্চলের বাঙালীদের জাতীয় চরিত্রকে বোঝার জন্য, ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোতে তাদের আচরণ বোঝার জন্য, ঘটনার বিস্তার ঘটলে তাদের ভাবনার বিবর্তনটা বোঝার জন্য অলাতচক্রকে একটা coup d'oeil বলা যায়।
আমি অলাতচক্রের ১৯৮৪ ভার্সান আর ১৯৯৩ ভার্সান দুটোই পড়েছি। '৯৩-এ এসে শুধু নামগুলোই পাল্টেনি আরো অনেককিছুই পাল্টেছে - এমনকি শেষটা পর্যন্ত। আমার কাছে '৯৩ ভার্সানটা অনেক বেশি factual মনে হয়েছে, ইতিহাস বেশি উচ্চকিত হয়েছে। '৮৪-তে "রূপক দানিয়েল" বা "রূপক তরুর" নিজস্ব অন্তর্গত দ্বন্দ্ব-ভাঙা-গড়া অনেক বেশি স্পষ্ট ছিল। তবে দুই ভার্সান দুটো ভিন্ন উপন্যাসের মর্যাদা পাবার মত না। এইখানে ৮/৯ বছরে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব ভাবনার পরিবর্তনটাও লক্ষণীয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ফিকশনটি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিলো তা হলো এই অলাতচক্র। শরণার্থী শিবিরের তথা কলকাতার সেই নয়মাসের এতো জীবন্ত বর্ণনা আমি আর কোথাওই পাইনি(অবশ্য অনেক পরে জেনেছি যে এটা আসলে তার আত্মজীবনী!)। আহমদ ছফার যে প্রবল দার্ঢ্য আর আত্মসম্মানবোধ আমাদের মুগ্ধ করে, তার ক্রমান্বয়ে যে ক্ষয়ে যাওয়ার রূপরেখা, শরণার্থী জীবনে নিজেকে ক্রমাগত তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ হতে দেখা, স্রেফ গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য চরম সাম্প্রদায়িক একজনের অধীনে কাজ করা, নেতাদের নৈতিক স্খলন(সোনাগাজির উল্লেখও এসেছে!) এক্কেবারে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এই উপন্যাসে।
আহমদ ছফার মুক্তিযুদ্ধ দর্শন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের দর্শন অনেকাংশেই অভিনব। বড্ড নির্মোহ থাকতে পেরেছেন তিনি অনেকাংশেই। তবুও কিছু কিছু ব্যাপারে মনে হয়েছে আরো খোলামেলা হতে পারতেন। যতদুর জানি তিনি সেসময় সক্রিয় বামে ছিলেন। সেসময়ের রহস্যময় বামেরা, দুই কুকুরের লড়াই খ্যাত তত্ত্বগুলো, নকশাল আন্দোলন, মুজিব বাহিনী এগুলো আরো বেশি করে আসতে পারতো। কিন্তু যদি তরু/তায়েবার জন্য তার মনস্তাত্বিক বিপন্নতাকে মাথায় রাখি তাহলে বলবো এতকিছুর পরেও এতটা নির্মোহ থাকা কেবলমাত্র আহমদ ছফার পক্ষেই সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে কখনোই মোটাদাগের সাদাকালো বিভাজন বলে মনে হয়নি। অনেক ধূসর এলাকা আছে এর। মাত্র ৩০/৪০ বছরে হয়তো তার অনেক কিছুই আমরা জানতে পারবোনা। হয়তো আরো ৩০/৪০ বছর লাগবে পুরোপুরি জানতে। দুঃখ শুধু একটাই, যাদের এই দলিলগুলো সংরক্ষণ করার কথা, তারা আজ তা ইচ্ছামতো পাল্টাচ্ছেন, একেকজনের মতামত একেকরকম। আহমদ ছফার মতো শরণার্থী জীবন নিয়ে এরকম অকপট কথা কয়জন বলে যেতে পেরেছেন? আরো অনেক অনেক কবি-সাহিত্যিক ছিলেন তখন কলকাতায়, তাদের কারো লেখায়ই তো আম এই তীব্র মর্মযাতনা, আত্মসম্মানহীনতায় কুঁকড়ে যাওয়ার ছাপ পাই না। আল-মাহমুদ(কবি হিসেবে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন এতে কোনো দ্বিমত নেই।) একটা কবিতা এরকম, তিনি কলকাতায় আছেন, বুদ্ধদেব বসুর একটি আড্ডায় সবাই জড়ো হয়েছেন, পানাহার করছেন সবাই, তার কেন জানি ভালো লাগছেনা। এর চেয়ে বেশি তীব্র কোনো অনুভূতি আমি আর পাইনি আর কোনো কবিতায়!! আবদুল মান্নান সৈয়দ তো আরো এককাঠি বাড়া! গোটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই তার কোনো কবিতা নেই!!! আর অন্য লেখকের যেগুলো রয়েছে, তীব্র আবেগের মোটা খোলসটুকু সরালে সারবস্তু খুব কম লেখাতেই পাওয়া যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের ভুগোল ইতিহাস আমরা সবাইই জানি; সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসের কতটুকু জানি? কতটুকু জানি আদিবাসীদের ভূমিকা? কতটুকু জানি সমাজবাস্তবতা? বিভিন্ন প্রেক্ষাপট(সাম্প্রদায়িকতা/সূফিজম/জামাতপন্থী/মুসলিম লীগ পন্থী/ আওয়ামী লীগের মধ্যবিত্তকেন্দ্রিকতা/ভাসানীর প্রান্তিকতা, চীনপন্থা!/বামদল গুলোর ভূমিকা/বিহারী মনস্তত্ত্ব/সেনাবাহিনী/গণবাহিনী) নিয়ে বিশ্লেষণ ঠিক কতটুকু হয়েছে বলার মতো?
একটা মুক্তিযুদ্ধ মানে স্রেফ মানচিত্রের বদল নয়, বরং একটা আদর্শের বদল, নতুন চিন্তাচেতনার উন্মেষ। সামাজিক/আর্থরাজনৈতিক অনেককিছুই তখন পালটে যেতে পারে, পালটায় মূল্যবোধের ক্রমও। জানিনা আর কোনো সাহিত্যিক আহমদ ছফার মতো এতো ভালো করে তা বুঝেছিলেন কিনা। শুধুমাত্র এইই একটি উপন্যাসেই স্রেফ নয়মাসে একজন দানিয়েল এর মানসিক বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা জেনে যাই যে হ্যাঁ, আমাদের এখন পরিবর্ত্নন হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন।
পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ যদি একান্ত নিজস্বতায় নির্বাণ এর আখ্যান হয় তবে অলাতচক্র হলো সর্বস্বতায় নিজের একান্ত দুঃখকে ছড়িয়ে দেওয়ার দলিল।
(বিশাআআআল মন্তব্যে অগোছালো চিন্তা-প্রলাপের বিপুল সমাহারে আমি নিজেই অতিশয় লজ্জিত। আসলে প্রিয় লেখকের প্রিয় উপন্যাসের কথা অনেকদিন পর আবার মনে করিয়ে দিলে এমনটাই হয়। আশা করি নিজগুণে ক্ষমাঘেন্না কইর্যা নেবেন। )
________________________________
বিধিবদ্ধ পঙ্কিলতা।
জীবন বাবু,তাঁর কবিতা।
তৃপ্তিদায়ী আত্মশ্লাঘা।
এবং এ রাতজাগা।
************************************
১২ | লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: রবি, ০৯/০৫/২০১০ - ৬:১৫অপরাহ্ন)
লেখা আরো বড় ছিল। পুরাটা কপি পেস্ট করে প্রিভিয়্যু দিলে দেখি কিছু আসে না। তারপর এনালগ সিস্টেমে কিছু কিছু এডিট মার্লাম। যতোটুকু দিলাম তার চেয়ে একটা বাক্য বেশি দিলে প্রিভিয়্যু গায়েব হয়ে যায়।
------------------------------------------------------------------- অভ্র আমার ওংকার
১.
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশ- বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি অধ্যায় আহমদ ছফা ধরে রেখেছেন তিনটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে। 'ওঙ্কার', 'অলাতচক্র' আর 'একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন'। এই তিনটি উপন্যাস ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধে যতোটা দেশাভ্যন্তরে সশরীর যুদ্ধে হয়েছে, তার কোন অংশেই কম হয়নি সীমান্তের ওপারে। দাবাটা খেলা হয়েছে মূলত কোলকাতাতেই আর সেই চিত্রটাই একেঁছেন আহমদ ছফা তার অলাতচক্র উপন্যাসে। আহমদ ছফা এখানে দানিয়েল হয়ে যান। আর তায়েবা হয়ে যান বাংলাদেশ।
আহমদ ছফার দেখার দৃষ্টি মারাত্মক। তার উপর যুদ্ধের অনেক পরে যখন এই উপন্যাস পরিমার্জন করেন, তখন দেখা চেহারাগুলোর স্পষ্ট রূপই তিনি তুলে আনতে পেরেছেন এই উপন্যাসে।
৭১-এ দেখা চরিত্রগুলোকে ছফা বিচার করেছেন ৭৫ পরবর্তীকালে দাড়িয়েঁ। আবার তা পরিমার্জন করেছেন ৯০ পরবর্তীকালে। অলাতচক্রকে পড়তে গিয়ে এই তিনটা সময়কাল তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বেশির ভাগকেও এই তিন সময়কালেই নানান রূপে পাল্টে যেতে দেখেছি। ছফা এই মানুষগুলোকে কোন সময়ের চোখে দেখেছেন? কোন চোখে দেখেছেন তায়েবারূপী বাংলাদেশকে? ৭১-এ কিন্তু ছফা 'জাগ্রত বাংলাদেশ' লিখেছিলেন।
এই উপন্যাসের সঙ্গে ছফার "বেহাত বিপ্লব" তত্ত্ব অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত। তায়েবার মৃত্যুর মাধ্যমে স্বপ্নের বাংলাদেশের মৃত্যুই তিনি দেখেন আসলে। যেই বাংলাদেশকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ওঙ্কারে।
অলাতচক্রর চরিত্রগুলো একেবারেই আমাদের ইতিহাসের চরিত্র। চেনা জানা। এই মানুষগুলোকে ছফা দেখেছেন বিশ্লেষণ করেছেন নিজস্ব চিন্তা দ্বারা। স্বভাবতই এই চিন্তার সঙ্গে কারো কারো দ্বিমত থাকবে। ছফার শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যেমন একে সরাসরিই অপছন্দ করেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও এই কারণেই বলেন "অনেক সম্ভাবনা নিয়েও অলাতচক্র কোনো উপন্যাসের খসড়ার একটি অংশ বলেই গণ্য হয়, বড়মাপের একটি শিল্পকর্মের মর্যাদা পায় না।" আবার রশীদ করীম একেই অনেক শক্তিশালী সাহিত্যকর্ম মনে করেছেন।
মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু একাত্তরের বাংলাদেশকে এরচেয়ে শক্তিশালী চোখে আর কাউকে দেখতে দেখি নাই। এজন্যই অলাতচক্র আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
২.
এরকম একটি উপন্যাস নিয়ে এত বড় একটি লেখা তৈরি করার জন্য আপনাকে অবশ্যই অভিনন্দন। দারুণ একটি কাজ করেছেন।
৩.
আমি ছফাগিরির আগের পর্বগুলো পড়িনি। পড়া হয়নি সময়াভাবে। তাই সেগুলো নিয়ে বলতে পারছি না। কিন্তু এই পর্বটা পড়ে মনে হলো আপনি সলিমুল্লাহ খান দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত। অনেক জায়গাতেই সলিমুল্লাহ খান সরাসরি হাজির হয়েছেন আপনার কলমে। বার বার মনে হয়েছে এই লেখাটা হয়তো আগে পড়েছি আমি কোথাও।
আমার অনুরোধ থাকবে ছফাগিরি লেখার সময় সলিমুল্লাহ খানকে এড়িয়ে যেতে। আপনার চিন্তাটাই পড়তে আগ্রহী বেশি আমি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
উপন্যাসের সাথে এত মিশে গিয়েছিলাম যে তায়েবার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব, আফসোস হচ্ছিল, তায়েবাকে যদি বাঁচানো যেত! আহমদ ছফার উপন্যাসগুলির মধ্যে 'অলাতচক্র' আর 'পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ' আমার সবচেয়ে পছন্দের। খুব নির্মোহ, সৎ, সোজাসাপ্টা আবার একইসাথে কখনো কখনো তির্যক, প্রথমবারের মত ছফার উপন্যাসপাঠ - একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আর 'গাভী বৃত্তান্ত' তো চরম ! উপন্যাসটা যখন পড়েছিলাম, তখন আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম - তাই বক্তব্য অনুভবও করছিলাম খুব ভালোই।
লেখা ভালো লেগেছে। উদ্ধৃতি একটু বেশি এসেছে মনে হয়েছে - মানে আমার কাছে বেশি লেগেছে। তবে এই উপন্যাস যারা এখনো পড়েননি তাদের জন্য হয়তো এটাই ঠিক আছে।
দুর্ভাগ্য ছফা ভাই'র সাথে কোনদিন আমার সাক্ষাত হয়নি। কিন্তু তার সব লেখাই গিলে খেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। একদিন আজকের কাগজে এসেছিলেন, তখন আমি পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক। তার বিশাল কেলানো দাতের হাঁসির কথা কেবল মনে পড়ে। আমার সহকর্মী বন্ধু-বড়ভাই জহিরুল আহসান টিপু (সদ্য প্রয়াত ভোরের কাগজের বার্তা সম্পাদক)পরিচয় করিয়ে দিয়েছলেন।
বাংলাদেশে দলবাজ বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক কিংবা সাহিত্যিকের ভীড়ে ছফাভাইরা বেঁচে থাকবেন সবাইকে ছাড়িয়ে সময় থেকে সময়ান্তরে।
ছফাভাইকে আমি কেবল সাহিত্যিক হিসেবে ভাবি না, তিনি ছিলেন আমাদের প্রজন্মের দিগ্দর্শন। বাংলাদেশের সর্বত্র যে দলবাজ গোষ্ঠী গুড়ে উঠেছে- প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে কবিতা পরিষদ কিংবা রাইটার্স ক্লাব পর্যন্ত; ছফা ভাই জীবিত থাকলে তাদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে দু'গালে চড় কষে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে 'সোজা তাকাতে হয়'।
অশেষ ধন্যবাদ লেখককে,
দলবাজি না করে কিংবা কোন কিছুর তলে আশ্রয় না নিলে দেশের ফাউল লেখকেরা টিকতেন না। এদেরকে চড় কষানোর মাপের লোক কোথাও নেই। সাহস দেখিয়ে কেউ যদি চড় ও কষায় এরা দলবাজি আদৌ ছাড়তেন কিনা সন্দেহ।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------ অভ্র আমার ওংকার
লেখাটার একটা লাইন সম্পাদনা কর্তে গিয়ে হাপিশ হয়ে গেছে। মন্তব্যে লেখাটা দিয়ে দিলাম।
--
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা সাহিত্যের মধ্যে আহমদ ছফার ‘অলাতচক্র’ উল্লেখযোগ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একরকম বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে কোলকাতায় ঢুকে পড়ে। ছফা সেই অনুষঙ্গে তাঁর উপন্যাসের কাহিনি টেনেছেন। তায়েবা যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অবস্থার রূপক। প্রাণ বাঁচাতে তাকে কোলকাতা শহরে আসতে হয়েছে। যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে তায়েবার (তরুর) মৃত্যু ঘটে কিন্তু...
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা সাহিত্যের মধ্যে আহমদ ছফার ‘অলাতচক্র’ উল্লেখযোগ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একরকম বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে কোলকাতায় ঢুকে পড়ে। ছফা সেই অনুষঙ্গে তাঁর উপন্যাসের কাহিনি টেনেছেন। তায়েবা যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অবস্থার রূপক। প্রাণ বাঁচাতে তাকে কোলকাতা শহরে আসতে হয়েছে। যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে তায়েবার (তরুর) মৃত্যু ঘটে কিন্তু রাষ্ট্র বাংলাদেশের আবির্ভাব হয়। গাণিতিক এই ফ্যালাসি উপন্যাসকে অন্য মাত্রা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা মহৎ সাহিত্যের যাবতীয় গুণাগুণ এই উপন্যাসের মধ্যে আছে।
‘অলাতচক্র’ উপন্যাস প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে সাপ্তাহিক নিপুণের ঈদসংখ্যায়। পরে পরিমার্জিত আকারে প্রকাশ পায় মুক্তধারা থেকে। ১৯৯৩ সালে। নিপুণে প্রকাশ করার সময় উপন্যাসের চরিত্রগুলো ছিল তরু, হেলেন ইত্যাদি নামে। এই নামগুলো উল্লেখ করার কারণে অনেকে ছফার কাছে অভিযোগ পেশ করেন। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে ছাপার সময় নামগুলো পাল্টে দেন। তরুর নাম পাল্টিয়ে লেখা হয় তায়েবা এবং আহমদের জায়গায় দানিয়েল। আহমদ ছফা রচনাবলির অষ্টম খণ্ডের পরিশিষ্টে তরুকে নিয়ে লেখা ছফার অনুভূতি জানা যায়।
… তরুর এই গল্পটা আমাকে চব্বিশ তারিখের মধ্যে শেষ করতে হবে। যে বাসর আমার রচিত হয়নি এই গল্পটির মধ্যেই সে বাসর আমি পাতব। মানুষের আত্মা বলতে কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা আমার কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবু দোষ কি বিশ্বাস করতে, মানুষের আত্মা আছে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করছি তরুর আত্মা আমাকে সাহায্য করে, যাতে জীবনবৃত্ত আমি মেলে ধরতে পারি।
এক সময় তো তাকে সব দিয়ে ভালবেসেছি। সে ভালবাসার বেদনাঘন গহন কাহিনীটি আমি প্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছি। আমি প্রার্থনা করব সূক্ষ্ম চেতনারূপী তরুর আত্মার সকাশে আমার অনুভবে সত্য যেন প্রকাশমান হয়, যতই নিষ্ঠুর হোক আমার বিশ্বাসে স্থির নিশ্চিত এবং অটল থাকতে পারি।… ১
আহমদ ছফার ডায়েরি অনুসারে জানা যায় এপ্রিলের মাঝামাঝি কোন একটা সময়ে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কোলকাতা চলে যান। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ইচ্ছা থাকলেও পরে তাঁকে বোঝান হয় যুদ্ধ করার অনেক লোক আছে। কিন্তু লেখালেখির যুদ্ধের জন্য কিছু লোক দরকার। আহমদ ছফা না হয় সেই কাজ করুক। কোলকাতায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি সংগঠন শুরু করেছিলেন। সেখানে সভাপতি ছিলেন ডক্টর অজয় রায় এবং সাধারণ সম্পাদক আহমদ ছফা। কোলকাতায় থাকাকালীন সময়ে প্রবীণ সিপিএম নেতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সান্নিধ্যে আসেন।
ম্যারি ডানহ্যামকে ছফা একটা চিঠিতে লিখেন-
… আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে বন্দুক, ট্যাংক, কামান নিয়ে ঘুমন্ত ঢাকা মহানগরীর ওপর হামলা করে বসল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রতিরোধকামী গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে মিলে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পাড়ি দিলাম। প্রথমে আগরতলা, তারপর কোলকাতা। আমি কোথাও বিশেষ সুবিধে করতে পারলাম না। আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা তাদের দলের লোক ছাড়া অন্য কাউকে ফ্রন্টে যেতে দিচ্ছিল না। আমি মুখ আলগা স্বভাবের লোক। কখন কী বলে ফেলি তার কোন স্থিরতা ছিল না। আমাকে নিয়ে বন্ধু-বান্ধবেরা মুশকিলে পড়ে গেলেন। ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা প্রবাসী বাঙালিদের ভেতর থেকে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের খুঁজে খুঁজে বের করতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছিল। এক কথায় যদি কারও ওপর তাদের নেকনজর পড়ে আমরা ধরে নিতাম, তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে লাশটা পাওয়া যাবে কি না। আমি যেভাবে চলাফেরা করতাম এবং বেপরোয়া কথাবার্তা বলতাম, অনায়াসে আমাকে পাকিস্তানি স্পাই হিসেবে চিহ্নিত করা যেত। সেই সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সে যাত্রায় জানে বেঁচে গেলাম। তখন কাকাবাবু ছিলেন একেবারে থুত্থুরে বুড়ো। শ্বেতীরোগে সারা শরীর ছেয়ে গিয়েছিলো। চলাফেরা করতে পারতেন না। কিন্তু তখনও তিনি ছিলেন সিপিএমের অফিসিয়াল প্রেসিডেন্ট। তাঁর কাছে জ্যোতিবসু, আবদুল্লাহ রসুল, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার উনারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমি পরিচিতও হয়েছিলাম। মুজফফর সাহেব মাসে মাসে আমাকে চলাফেরা করার জন্য কিছু টাকা দিতেন। পরে জেনেছি, আমি একা নই, আরও অনেকে এ টাকায় ভাগ বসাত। আমার ধারণা আমি কাকাবাবুর স্নেহদৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। তিনি সকলকেই আপনি বলে সম্বোধন করতেন। একবার আমাকে বলেছিলেন, কাজী নজরুলের পর একমাত্র আমাকেই তিনি তুমি বলে ডাকছেন। সেবার আমার খুব অসুখ হয়েছিলো। বাঁচব এমন ধারণা আমার ছিলো না। মৃত্যুর পূর্বে শরীরের সর্বশেষ প্রাণশক্তিটুকু দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিবেগ যেন ত্বরান্বিত করা যায়, এ নিয়ে একটা বই লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাগ্যক্রমে মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তবাবুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। তিনি কথা দিলেন, আমি যেটুকু লিখব সঙ্গে সঙ্গে প্রুফ করে দেবেন। আমি জ্বরের ঘোরের মধ্যে একটানা লিখে যেতাম। লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বন্ধুদের ডিকটেশন দিতাম। তারা শুনে শুনে লিখে নিতেন। অল্পদিনের মধ্যে বইটি প্রকাশিত হয়ে গেল। ওটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম লেখা। কিন্তু আমার বইটি আশানুরূপ প্রচার পাচ্ছিল না। এই ব্যাপারটি আমি একদিন কাকাবাবুর কাছে খুলে বলেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি আগামীকাল এসে আমাকে গোটা লেখাটি পড়ে শোনাবে। পরের দিন গিয়ে আস্ত লেখাটি পড়ে শোনালাম। তিনি দুদিন পর যেতে বললেন। দুদিন পর যখন গেলাম তিনি মুখে মুখে আমার বইটার ওপর একটা আলোচনা ডিকটেট করে বললেন, যাও, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকায় দিয়ে এস। ওই পত্রিকার মালিক ছিলেন অরুণ রায়। লালবাজার থেকে কাগজটি বের হতো। কাকাবাবুর আলোচনাটি বের হওয়ার পর আমার বইয়ের কাটতি বেড়ে যায়।... ২
বইটির নাম ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বাংলাদেশের প্রথম বই। প্রকাশ করেছিল চিত্তবাবুর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তধারা’।
মুজতবা আলীর একটা কথা আছে। মানুষের মধ্যে যখন দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণতা আসে, তখন সে যেকোনো জিনিসকে ঠিকঠাক পারস্পেক্টিভে দেখে। ছফার মধ্যে এই গুণ ছিল। রাষ্ট্র ভারতের কোলকাতা শহর বাংলাদেশের অজস্র উদ্বাস্তুদের যুদ্ধকালীন সময়ে আশ্রয় দেয়। কিন্তু নগরে আগত আগন্তুকদের প্রতি অচেতন শ্লেষ আহমদ ছফার নজর এড়ায় না।
… লোকটা এপর্যন্ত দু’ দু’বার ‘জয়বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। কোলকাতা শহরে লোকদের মুখে ইদানীং জয়বাংলা শব্দটি শুনে আমার অস্তিত্বটা কেমন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যান্ডেল। এক সপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা-ছাতা, কতো জিনিস বাজারে বাজারে ছেড়েছে কোলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাঁকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিছুদিন আগে যে চোখওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো, কোলকাতার মানুষ মমতাবশত তারো নামকরণ করেছিলো জয়বাংলা। …৩
বইটিতে উত্তম পুরুষের চরিত্রের নাম দানিয়েল। কিন্তু কেন দানিয়েল? সলিমুল্লাহ খান এর কিছুটা তালাশ করেছেন। দানিয়েল শব্দটি হিব্রু। ব্যাবিলনে নির্বাসিত ইহুদি জাতির একজন বুদ্ধিজীবী। কিতাবুল মোকাদ্দেস অনুসারে শব্দটির অর্থ ‘আল্লাহ আমার বিচারক’।
ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতেনাসার প্রকাশ নবুৎখদনিসর (Nebuchandnezzar) একদিন স্বপ্নে দেখলেন, একটা বিরাট মূর্তি। মূর্তিটা বিরাট, অতিশয় তেজোবিশিষ্ট আর তার চেহারা ভয়ঙ্কর। সেই মূর্তির মাথাটা খাঁটি সোনার, বুক ও হাত রূপার এবং পেট ও রান ব্রোঞ্জের তৈরি। তার পা লোহার এবং পায়ের পাতা কিছুটা লোহা ও কিছুটা মাটি দিয়ে তৈরি ছিল। বাদশাহ যখন তাকিয়ে ছিলেন, তখন দেখলেন একটা পাথর কেটে নেওয়া হল। কিন্তু তা মানুষের হাতে কাটা হয় নাই। সেই পাথরটা লোহা ও মাটি মেশানো দিয়ে তৈরি পায়ে আঘাত করে সেটা চুরমার করে ফেলল। তখন লোহা, মাটি, ব্রোঞ্জ, রুপা ও সোনা টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙ্গে পড়ল এবং গরমকালে খামারের মেঝেতে পড়ে থাকা তুষের মত হয়ে গেল। বাতাস তা এমন করে উড়িয়ে নিয়ে গেল যে তার আর কোন চিহ্নই রইল না। যে পাথরটা মূর্তিকে আঘাত করেছিলো, সেই বিরাট পাহাড় হয়ে গিয়ে সমস্ত দুনিয়া দখল করে ফেলল।
হজরত দানিয়েল আলায়হেস সালাম এই স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করলেন। তার আগে ব্যাবিলনের কোন গুণিন, ভূতের ওঝা, জাদুকর কিংবা গণক এর অর্থ উদ্ধার করতে পারেন নাই। দানিয়েল বললেনঃ হে মহারাজ, আপনি বাদশাহদের বাদশাহ। বেহেশতের আল্লাহ আপনাকে রাজ্য, ক্ষমতা,শক্তি ও সম্মান দান করেছেন। আপনার হাতে তিনি মানুষ, পশু আর পাখিদের দিয়েছেন। তারা যেখানেই বাস করুক না কেন, তিনি তাদের সকলকে আপনার অধীন করেছেন। আপনিই সেই সোনার মাথা।
আপনার রাজ্যের পর যে রাজ্য উঠবে, সেটা আপনার রাজ্যের মত মহান হবে না। তারপর তৃতীয় আর একটা রাজ্য উঠবে, সেটা সেই ব্রোঞ্জের পেট ও রান। আর গোটা দুনিয়া সেই রাজ্যের অধীন হবে। শেষে লোহার মত শক্ত চতুর্থ একটা রাজ্য উঠবে। লোহা যেমন সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে তেমনি সেই রাজ্য অন্য সব রাজ্যকে ভেঙ্গে চুরমার করবে। আপনি স্বপ্নে সে পায়ের পাতা ও পায়ের আঙ্গুলগুলোর কিছু অংশ মাটি ও কিছু অংশ লোহা দিয়ে তৈরি দেখিয়েছিলেন তা আসলে ভাগ করা রাজ্য। তবে আপনি যেমন মাটির সঙ্গে লোহা মেশানো দেখেছেন,তেমনি সেই রাজ্যেও লোহার মত কিছু শক্তি থাকবে। পায়ের পাতা ও আঙ্গুল যেমন মেশানো ছিল তেমনি সেই রাজ্যের কিছু অংশ হবে শক্তিশালী ও কিছু অংশ দুর্বল। লোহার সঙ্গে মাটি মেশানোর অর্থ রাজ্যের লোকরা হবে মেশানো এবং লোহা যেমন মাটির সঙ্গে মেশে না, তেমনি তারাও এক হয়ে থাকবে না। ঐ সব বাদশাহর সময় বেহেশতের আল্লাহ এমন একটা রাজ্য স্থাপন করবেন, যেটা কখনো ধ্বংস হবে না কিংবা অন্য লোকের হাতে যাবে না। সেই রাজ্য ঐ সব রাজ্য চুরমার করে শেষ করে দেবে, কিন্তু সেই রাজ্য চিরকাল থাকবে। এটা হল সেই পাহাড় থেকে কেটে নেওয়া পাথর যেটা মানুষের হাতে কাটা হয়নি। পাথরটা লোহা,ব্রোঞ্জ, মাটি,রুপা ও সোনাকে টুকরা টুকরা করে ভেঙ্গে ফেলেছিল।ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তা এইভাবে আল্লাহ তা’লা মহারাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন। (বাইবেল সোসাইটি ২০০০: ১২৫১)
দানিয়েল পয়গম্বরের স্বপ্নের সঙ্গে আহমদ ছফার দানিয়েল চরিত্রের অনেক খাতির দেখা যায়।... ৪
এই মিল করাটা অমূলক নয়। কোলকাতার পিজি হাসপাতালের ঊনত্রিশ নম্বর বেডের তায়েবাকে দেখতে যায় দানিয়েল। তায়েবার বয়স সাতাশ। তার পরিবারের মধ্যে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব। উপন্যাসের শুরু এখান থেকে। তায়েবা জানতে চায় দানিয়েলের খবর। তার অন্তরমহলের চিন্তা ছফার বয়ানে জানতে পারি।
কোলকাতা শহরে আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে দিন কাটাচ্ছি, বিশেষ করে মুসলমান ছেলেরা। আমাদের সঙ্গে মা, বোন বা পরিবারের কেউ আসেনি। সে কারণে শরণার্থী শিবিরে আমাদের ঠাঁই হয়নি। আমরাও শিবিরের মানুষদের প্রাণান্তকর কষ্ট দেখে মানে মানে শহরের দিকে ছিটকে পড়েছি এবং কোলকাতা শহরে গুলতানি মেরে সময় যাপন করছি। একজন আরেকজনকে ল্যাং মারছি। বাংলাদেশের ফর্সা কাপড়চোপড় পরা অধিকাংশ মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন বেকার জীবনযাপনের ক্লেদ কোলকাতার হাওয়া দূষিত করে তুলেছে। আমরা সে হাওয়াতে শ্বাস টানছি। সীমান্তে একটা যুদ্ধ হচ্ছে, দেশের ভেতরেও একটা যুদ্ধ চলছে। অবস্থানগত কারণে আমরা সে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? যুদ্ধে চলে গেলে ভালো হতো। দেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটুকু করতে পারতাম জানিনে। তবে বেঁচে থাকবার একটা উদ্দেশ্য চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। আমার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধকে ভয় করি বলে নয়। আমাদের দেশের যে সকল মানুষের হাতে যুদ্ধের দায়দায়িত্ব, তারা আমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবার উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেননি। আমি তিন তিনবার চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই মহাপুরুষদের দৃষ্টি আমার ওপর পড়েছে। অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছেন, আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন? আপনার মতো ক্রিয়েটিভ মানুষের কতো কিছু করবার আছে। যান কোলকাতায় যান। সেই থেকে কোলকাতায় আছি। হাঁটতে, বসতে, চলতে, ফিরতে মনে হয় শূন্যের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছি। ... ৫
দানিয়েলের এইসব অন্তুর্গত ভাবনা তায়েবাকে আর জানানো হয় না। কোলকাতায় ডেরা পাততে এসে অনেক তরুণ দিনের পর দিন খোলা রাস্তার ওপর রোদ বৃষ্টির মধ্যে দিন কাটিয়েছে। অন্যদিকে কিছু লোক ব্যাংক থেকে পয়সা কি সোনা হাতিয়ে দেদারসে পয়সা ওড়াচ্ছে। বার ও নাইটক্লাব বাংলাদেশীতে সয়লাব। ভারত সরকারের অতিথি হয়ে মহানন্দে এরা দিন কাটাচ্ছে। এদের সাথে থিয়েটার রোডের কর্তাব্যক্তিদের যোগাযোগ নেই বলা যাবে না। ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন সোনাগাছির রেডলাইট এলাকায়। পুলিশ পরে পরিচয় জানতে পেরে ছেড়ে দেয়।
যুদ্ধের অঙ্গন ছেড়ে আসা লোকজনের এই বিকৃতিগুলো বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল চারপাশে। শরাণার্থী শিবিরগুলোতে অবর্ণনীয় কষ্ট। ক্যাম্পে প্রতিদিন মারা যাচ্ছিল শিশু আর বৃদ্ধ। সৎকারের কোন ব্যবস্থা নেই। মৃতদেহ পাশে রেখে পরিবারের লোকজন মরিচ মেখে বাসী ভাত খাবার দৃশ্য পর্যন্ত দেখেছেন দানিয়েলের নরেশদা।
জাহিদুল হক রাশেদা খাতুন দম্পতির মধ্যে ডোরা ঢুকে পড়ে। বয়স্ক স্বামীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রাশেদা শশীভূষণ নামের একজনকে নিয়ে শান্তিনিকেতন চলে যান। বেশি দেরি না করে জাহিদুল ডোরাকে নিকে করে ফেলে। তায়েবা ছোটোবোন ডোরাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে আবার জাহিদুলকে বাবার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করত। ফলে এই কিম্ভূত অজাচারে তায়েবার অসুস্থ না হয়ে উপায় থাকে না। দানিয়েল আর কাউকে না পেয়ে তায়েবার অসুস্থতার জন্য প্রাথমিকভাবে জাহিদুল-ডোরাকেই দায়ী করে। দানিয়েল তার রাগ চেপে রাখে না। ডঃ মাইতির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলে।
আপনি অনেক আনকোরা তরুণের মধ্যে জীবনের মহত্তর সম্ভাবনা বিকশিত হয়ে উঠতে দেখেছেন, একথা যেমন সত্যি, তেমনি পাশাপাশি একথাও সত্য যে যুদ্ধের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠিত মহাপুরুষের খোলস ফেটে খান খান হয়ে পড়েছে এবং আমরা এতোকালের ব্যাঘ্র চর্মাবৃত ছাগলদের চেহারা আপন স্বরূপে দেখতে পাচ্ছি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমাদের দুর্দশার সীমা নেই। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে আমাদের তরুণ ছেলেরা হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন দেখতে পাচ্ছি। দেশের ভেতরের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখানে কোলকাতায় সাদা কাপড়চোপড় পরা ভদ্রলোকের মধ্যে স্খলন, পতন, যতো রকমেই নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, তার সবগুলোর প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। এখানে যত্রতত্র শুনতে পাচ্ছি, আধবুড়ো মানুষেরা যত্রতত্র বিয়ে করে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে এই ভদ্রলোকদের তুলনায় কম নিষ্ঠুর মনে হয় না।… ৬
যুদ্ধের সময়ে বাসনার এই অসংযম দানিয়েলকে আহত করে। ব্যক্তিবিশেষের অজাচার এক হিসেবে রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ভেবে নেয়। জয়সিংহ ব্যানার্জী আর তার যজমানের মেয়ের ক্ষেত্রে একই ঘটনা। মেয়েটার কোন অভিভাবক নেই। পোষার দায়িত্ব স্বভাবত জয়সিংহ ঘাড়ে নেন। কিন্তু আসল ঘটনা জানা যায় অন্য একজনের মুখে।
শালা বদমাইশ বাউন, মা আর বুন দুইডা ক্যাম্পে কাঁইদ্যা চোখ ফুলাইয়া ফেলাইছে। আর হারামজাদা মাইয়াডারে কইলকাতা টাউনে আইন্যা মজা করবার লাগছে। আর ওই মাগীডাও একটা খানকি।… ৭
রেজোয়ান নামক এক যুবকের আত্মহত্যার পেছনেও নর-নারীর সম্পর্ক। রেজোয়ানের বোন এক পাকিস্তানি মেজরকে বিয়ে করে ফেলেছে। এই শক কাটাতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে। একটা চিঠি রেখে যায়। দানিয়েলের বেশে আহমদ ছফা রেজোয়ানের মৃত্যুর জন্য যুদ্ধকে দায়ী করেন।
বড়ো আপা, যাকে আমি বিশ্বাস করতাম সবচাইতে বেশি, সে একজন পাকিস্তানি মেজরের স্ত্রী হিসেবে তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোচ্ছে, একথা আমি চিন্তা করতে পারিনে। দেশে থাকলে বড়োআপা এবং মেজরকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতাম। এখন আমি ভারতে। সুতরাং সে উপায় নেই। অথচ প্রতিশোধ স্পৃহায় আমার রক্ত এতো পাগল হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত নিজেকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই। … ৮
সিপিএম বাংলাদেশ ইস্যুতে কংগ্রেসের ভূমিকাতে ফাঁকফোকর নিয়ে বেশ চড়া টোনে থাকত। ইয়াহিয়া আর ইন্দিরার মধ্যে যোগসূত্র আনার জন্য রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতরে করা নাটকে এক সিপিএম কর্মীর অনুরোধে এক চরিত্রের কণ্ঠ দিয়ে বলানো হয় ‘এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার জনগণের যে জাগ্রত সহানুভূতি ইন্দিরাজী সেটাকেই নিজের এবং দলের আখের গুছাবার কাজে লাগাচ্ছেন। এতোকাল সিপিএম বলতো শাসক কংগ্রেস বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধাপ্পা দিচ্ছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠাবার কোনো কর্মপন্থা গ্রহণ করবে না। এখন সে কথা সবাই বলছে। এই তো সেদিন যুগান্তরের মতো কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকায় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সাংবাদিকও লিখতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা তুঙ্গে উঠেছে। আর ওদিকে শ্রীমতি ইউরোপ, আমেরিকায় ‘বাবু’ ধরে বেড়াচ্ছেন। … ৯
জয়বাংলার বাবু দানিয়েল থাকেন ছাত্রদের এক হোস্টেলে। অজন্তা ছাত্রাবাস। সেখানে অনেক ছাত্রদেরই আসল নিবাস পূর্ব বাংলা। অনেকের গায়ে টোকা দিলেই গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ এইসব এলাকার গন্ধ পাওয়া যায়। সাম্প্রদায়িকতায় টিকতে না পেরে বা গা বাঁচাতে এরা এপাড়ে চলে এসেছে।
কোলকাতা শহরে থাকে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে ঢেউ খেলছে পূর্ববাংলার দীঘল বাঁকের নদী, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, হাটঘাট, ক্ষেতফসল, গরুবাছুর। আমি গোসল করতে গেলেই নিজেরা বলাবলি করতো, কিভাবে একজনের বোনকে মুসলমান চেয়ারম্যানের ছেলে অপমান করেছে। অন্যজন বলতো পাশের গাঁয়ের মুসলমানেরা এক রাতের মধ্যে ক্ষেতের সব ফসল কেটে নিয়ে গেছে। ছোটোখাটো একটি ছেলে তো প্রায় প্রতিদিন উর্দু পড়াবার মৌলবীকে নিয়ে নতুন কৌতুক রচনা করতো। ভাবতাম আমাকে নেহায়েত কষ্ট দেয়ার জন্যই এরা এসব বলাবলি করছে। অথচ মনে মনে প্রতিবাদ করার ও কিছু নেই। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য। উঃ সংখ্যালঘু হওয়ার কি যন্ত্রণা! তাদের কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হতো সুলতান আহমেদ, আলাউদ্দিন খিলজী থেকে শুরু করে আওরেঙ্গজেব পর্যন্ত যতো হিন্দুদের ওপর হয়েছে তার জন্য যেনো আমিই অপরাধী। মাঝে মাঝে ভাবতাম, বার্মা কি আফগানিস্তান কোথাও চলে যাওয়া যায় না। এখন অবশ্য আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন এসেছে। যেখানেই পৃথিবীর দুর্বলের ওপর অত্যাচার হয়, মনে হয়, আমি নিজেও তার জন্য অল্প বিস্তর দায়ী। কেনো এসব অনুভূতি হয় বলতে পারবো না। এখন আমাকে সবাই সমাদর করে। আমি অসুস্থ মানুষ বলে কেউ কেউ আমাকে বালতিতে পানি ভরতি করে দিয়ে যায়। সম্যক পরিচয়ের অভাবই হচ্ছে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের মূল। … ১০
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাজে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। লিফলেট বিলি করে শেখ মনির প্রচারণার কথা ছফা উল্লেখ করেছেন।
লিফলেটটি আগরতলা থেকে বেরিয়েছে। সংক্ষেপে তার মর্মবস্তু এ রকম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে ধরা পড়বার আগে এক ঘরোয়া সভা ডেকেছিলেন। তাতে তিনি যদি পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন, কী কী করতে হবে সে সকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ওই সভায় একজন নাকি শেখ সাহেবের কাছে সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলো, বঙ্গবন্ধু, আপনার অবর্তমানে আমরা কার নেতৃত্ব মেনে চলবো? শেখ সাহেব আঙুল তুলে শেখ মনিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, তোমরা এর নেতৃত্ব মেনে চলবে। … ১১
আগরতলাতে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলের মধ্যে সম্মুখসমরের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিলো। প্রতিবাদে সেখানকার মানুষ মিছিল করে এই হানাহানি বন্ধের ব্যবস্থা নিয়েছিলো।
তায়েবার সাথে দানিয়েলের প্রীতির সম্পর্ক ছিল কিন্তু প্রেমে মোড় নেয়ার আগেই তায়েবা অসুখ বাঁধিয়ে বসে। সেই অসুখ সারার সম্ভাবনা ও নেই। তায়েবা এক কথায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে এইটুকু বলা যায়। তায়েবার অসুখ নিয়ে কথা পাড়তে গিয়ে ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে ভদ্রলোকের সাথে নানা কিছু নিয়ে আলোচনা হয় দানিয়েলের। যুদ্ধকালীন সময়ে কোলকাতার মানুষের সাহায্যের কথা দানিয়েল নির্দ্বিধায় স্বীকার করে।
বাঙালি এবং বাঙালিত্বের প্রতি পশ্চিম বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের একটা অতুলনীয় সহানুভূতি এবং জাগ্রত মমত্ববোধ আছে বলেই এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিরদাঁড়া উঁচু করে থাকতে পেরেছে। পশ্চিমবাংলার বদলে যদি গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় গ্রহণ করতে হতো, ভারত সরকার যতো সাহায্যই করুক না কেনো, আমাদের সংগ্রামের অবস্থা এখন যা তার চাইতে অনেক খারাপ হতো। পশ্চিম বাংলার মানুষের আবেগ, উত্তাপ এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণবন্ত এবং সজীব রেখেছে। …১২
দানিয়েল সেখানেই রাত গুজরান দেয়। একটা স্বপ্নও দেখে। তার আব্বা এসেছেন। তাঁর পরনে ধুতি। সুন্দর জামাকাপড় পরার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে আব্বা জানান- বেটা জানো না বুঝি, আজ তোমার বিয়ে। এতে অবাক হলে আব্বা জানান-এমন মাঝে মাঝে হয়। এই উপলক্ষ্যে চাপকান কি শাল চাইলে জানানো হয় সাদা ধুতি পড়েই বিয়ে করতে যেতে হবে। যাওয়ার জন্য কোনো ঘোড়ার গাড়ির এন্তেজাম নাই। বরং একটা খাটিয়া করে চারজন লোক দানিয়েলকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সুর করে বলা হচ্ছে- বলো মোমিন আল্লা বলো। খাটিয়া বহনকারী একজন বলে ওঠে- এই লাশ পাথরের মতো ভারী। আর বয়ে নিতে পারবো না। কাঁধ থেকে কাত করে দানিয়েলকে তারা রাস্তার ওপর ঢেলে দিলো।
উপন্যাসের কেন্দ্রে এসে এই স্বপ্ন কিছুটা সুলুক দেয়। বাসনা কামনা ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব নয়। অন্যের কামনা নিজের কামনা হয়ে প্রকাশ নেয়। বাবার বাসনা দানিয়েলের বাসনা হয়ে যায়। বাঙালি মুসলমান আসলে জানে না সে কী চায়। ফ্রয়েডের স্বপ্ন তত্ত্ব আর জাঁক লাঁকার সেমিনার দিয়ে সলিমুল্লাহ খান এর ব্যাখ্যা হাজির করেছেন ‘রাষ্ট্র ও বাসনাঃ আহমদ ছফার বিষাদ-সিন্ধু’ প্রবন্ধে।
দানিয়েলের আবাসে প্রতিদিন রীতিমতো কনফারেন্স বসে। আলোচনা ঘিরে থাকে শেখ মুজিব , তাজউদ্দিন , থিয়েটার রোডের লোকজনের কাজকারবার।
আপনার মাও সে তুং এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে কী করছেন, সে খবর রাখেন? পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশে খুন, জখম, হত্যা, ধর্ষণ সবকিছু অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। আর আপনার মাও সে তুং সে ইয়াহিয়ার জল্লাদ সৈন্যদের ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ ভর্তি করে বোমা,কামান, অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। ... ১৩… বাংলাদেশের সালাম এবার মুখ খুললো। মওলানা ভাসানী মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, যাতে চীন পাকিস্তানের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে কোনো রকম সহায়তা না করে। আরে থোন ফালাইয়া, আপনার মওলানা ভাসানীর টেলিগ্রাম দুইখান চৌ এন লাই আর মাও সে তুং যতন কইরা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে থুইয়া রাখছে। মওলানা এখন ইন্ডিয়া কেনো আইছে কইবার পারেন? তাবিজ দেয়ার মৌলবী, আপনেরা তারে বিপ্লবী লিডার বানাইছেন। কথাগুলো খুরশিদের। … ১৪
খুরশিদ নিজেকে আওয়ামী লীগের লোক বলে জাহির করে। হাই কমান্ডের লোকজন যদিও খুব একটা পাত্তা দেয় না। আসল জায়গায় ঢুকতে না পেরে দানিয়েলের ডেরায় আওয়ামী লীগ বিরোধীদের মুণ্ডুপাত করে। আড্ডায় মওলানার প্রসঙ্গ চাপা পড়ে শেখ মুজিব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
খুরশিদ বললো, থিয়েটার রোডের যে সকল মাস্তান আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে সব কিছু লুটপাট করে খাচ্ছে, এখানে বঙ্গবন্ধু হাজির থাকলে পেঁদিয়ে তাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। সালাম ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো, আরে রাখো তোমার বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিদের সঙ্গে শলাপরামার্শ করেই ধরা দিয়েছে। পৃথিবীর কোন বিপ্লবী নেতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তোমার ওই বঙ্গবন্ধুর মতো শত্রুর কাছে সগৌরবে আত্মসমর্পন করেছে তার কোনো নজির আছে কী? শেখ মুজিব সব সময় স্যুটকেস গুছিয়ে রাখতেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই জেলে চলে যেতেন, আর আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে বিজয়ী বীরের বেশে জেলখানা থেকে বেরিয়ে ক্রেডিটটুকু নিতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। শেখ পাকিস্তানের জেলে আর আমরা এখানে কোলকাতার পথে পথে ভেরেন্ডা ভেজে চলছি। এই অবস্থাটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তোমার ওই শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ। শেখের মতো এতো বড়ো জাতীয় বেঈমান আর দ্বিতীয়টি নেই। খুরশিদ হুংকার দিয়ে উঠলো, খবরদার সালাম, ছোটো মুখে বড়ো কথা বলবে না। অন্য লোকের নাম বললে কিছু মনে করতাম না। বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু বললে মুখের বত্রিশটি দাঁতের একটিও আস্ত রাখবো না। … ১৫
দানিয়েল একদিন যায় পশ্চিমবঙ্গে তার একমাত্র পরিচিত অর্চনার বাসায়। অর্চনা একসময় নকশাল আন্দোলন করত। কোলকাতার একটা কলেজে ফিলোসফির মাস্টারনি। লেখালেখির সূত্র ধরে তাদের পরিচয়। অর্চনাকে জানায় তায়েবার কথা। সেখানে দুজন ভদ্রলোকের সাথে দানিয়েলের দেখা হয়। সত্যব্রত আর অনিমেষ। সত্যব্রতবাবু পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে যুদ্ধের সমস্ত মাঠ ছেড়ে দিয়ে ভারতে পাড়ি জমানো দিয়ে কথা শুরু করেন। অনিমেষবাবু আশংকা প্রকাশ করতে থাকেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হবে। কংগ্রেসের এই সুযোগে জল ঘোলার কথা বলে সত্যব্রত। অর্চনা এর প্রতিবাদ করে। কংগ্রেসের ভুল না ধরে বরং বামপন্থী দলগুলোর আচরণ দেখা উচিত। বাংলাদেশের এই জাতীয় সংগ্রামে তাদের সমর্থন নেই। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান থেকে তারা সরে আসছে না। পাকিস্তানের সাথে চীনের বন্ধুত্ব- তাই পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া তারা অব্যাহত রেখেছে। প্যাঁচগোজের এই আলোচনা সরিয়ে অর্চনার বড়ভাই সুনীল সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। … দেখবে একদিন তোমাদের জয় হবেই। এ তোমাদের ন্যায়যুদ্ধ। জানো তো, যথা ধর্ম তথা জয়। ধর্ম তোমাদের পক্ষে। …১৬ কথা যুদ্ধ পাল্টে জাগতিকতার উর্ধ্বে চলে যায়। … মানুষের মনে এই যে ট্যানশন তার পেছনে দু’টি কারণ, একটি হলো লোভ, অন্যটি অনিশ্চয়তা। মনের ভেতর থেকে এই দু’বস্তুর অবসান ঘটাতে পারলে দেখবে জীবন অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে। … ১৭
তায়েবাকে হাসপাতালে দেখতে গেলে তায়েবার মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। জাহিদুল, ডোরা সেখানে হাজির ছিল। আশ্চর্য খোশগল্পের আবহাওয়া। দানিয়েল অবাক হয়। …
তায়েবা জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ডোরা তার জীবনের মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটিয়ে বসে আছে। আমাদের সকলের অস্তিত্ব চিকন সুতোয় ঝুলছে। এই ধরনের অবস্থায় নির্বিকার মুখ ঢেকে এঁরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের আলোচনা কি করে করতে পারেন। জীবন সম্ভবত এ রকমই। আঘাত যতো মারাত্মক হোক, দুঃখ যতো মর্মান্তিক হোক, এক সময় জীবন সব কিছু মেনে নেয়। দুনিয়াতে সব চাইতে আশ্চর্য মানুষের জীবন। … ১৮
‘অলাতচক্র’ উপন্যাস পড়লে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক গবেষণাগ্রন্থ পড়ার কষ্ট বেঁচে যায়। ছফা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সাথে ইতিহাসের কিছু সহিপাঠ গল্পচ্ছলে আমাদের বলে দেন। কোনো চরিত্রের মুখ থেকে বের হওয়া তথ্যের বিশ্লেষণ সময়মতো দানিয়েলের চিন্তাভাবনার মধ্যে প্রকাশ পায়।
… থিয়েটার রোডের লোকদের বিরুদ্ধে এসব নালিশ নতুন নয়। সবাই নালিশ করে। কিন্তু তাদের করবার ক্ষমতা কতোদূর তা নিয়ে কেউ বিশেষ চিন্তাভাবনা করে বলে মনে করে না। আমি মনে মনে তাজুদ্দিনের তারিফ করি। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমার বিশ্বাস সবদিক চিন্তা করে দেখার ক্ষমতা তাঁর আছে। কিন্তু তিনি কতোদূর কি করবেন। আওয়ামী লীগারদের মধ্যে অনেকগুলো উপদল। ভারত সরকার সবক’টা উপদলকে হাতে রাখার চেষ্টা করছে। আবার তাদের অনেকেই তাজুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। পাকিস্তানি এবং আমেরিকান গুপ্তচরেরা এখানে ওখানে ফাঁদ পেতে রেখেছে। তাদের খপ্পরে আওয়ামী লীগারদের একটা অংশ যে পড়ছে না, একথাও সত্যি নয়। … ১৯
আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে তাঁর করা উপপাদ্যের সরলপাঠ দানিয়েলের অন্তর্গত ভাবনার মধ্যে সহজে বলে দেন। একটা গোঁজামিলের আভাস দেন। এই গোঁজামিল কী জিনিস?
যে বাঙালি মুসলমানদের অকুণ্ঠ আত্মদানে পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিলো, সেই পাকিস্তানই তিরিশ বছর ধরে তাদের বুকের ওপর বসে তাদের ধর্ষণ করেছে। একটা জাতি এতোবড় একটা ভুল করতে পারে? কোথায় জানি একটা গড়বড়, একটা গোঁজামিল আছে। আমরা সকলে সেই গোঁজামিলটা ব্যক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে অদ্যাবধি বহন করে চলেছি। পাকিস্তানের গণপরিষদে তো পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাভাষার দাবিটি তো তারা সমর্থন করতে পারতেন। হলেনই বা মুসলিম লীগার। তবু তাঁরা কি এদেশের মানুষ ছিলেন না? তবু কেনো, বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের ছাত্র তরুণদের প্রাণ দিতে হলো? পূর্বপুরুষদের ভুল এবং ইতিহাসের তামাদি শোধ করার জন্য কি এই জাতিটির জন্ম হয়েছে?
উনিশশো আটচল্লিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এই জাতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আর চূড়ান্ত মুহূর্তটিতে আমাদের সবাইকে দেশ ও গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় ছিলো, সুযোগ ছিলো। কোলাহল আর চিৎকার করেই আমরা সেই সুযোগ এবং সময়ের অপব্যবহার করেছি। পাকিস্তানের কর্তাদের আমরা আমাদের বোকা বানাতে সুযোগ দিয়েছি। তারা সৈন্য এনে ক্যান্টনমেন্টগুলো ভরিয়ে ফেলেছে এবং সুযোগ বুঝে পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা আমাদের যুদ্ধটাকে কাঁধে বয়ে ভারতে চলে এসেছি। হয়তো যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। তারপর কি হবে? আমাদের যুদ্ধটা ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মন বলছে পাকিস্তান হারবে, হারতে বাধ্য। কিন্তু আমরা কি পাবো? ইতিহাসের যে গোঁজামিল, আমরা বংশপরম্পরায় রক্তধারার মধ্য দিয়ে বহন করে চলেছি তার কি কোনো সমাধান হবে? কে জানে কি আছে ভবিষ্যেতে। … ২০
আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখে রেডিওতে শোনা গেল ইয়াহিয়ার দম্ভোক্তি। এইসব শুনে দিনের অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে দানিয়েল যায় অর্চনার বাসায়। সেখানে অর্চনার প্যারিস ফেরত দাদা প্রমোদের সাথে দেখা হয়। সাতাশ আটাশ বছর আগেকার
৩০ | লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: শনি, ২৫/০২/২০১২ - ৮:২৩পূর্বাহ্ন)
পূর্ব-বাংলার স্মৃতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন। ভদ্রলোক নিজের ভাবাগোনা নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন।
মুক্তিযুদ্ধ যদি জয়যুক্ত হয় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানেন এটা একটা বিরাট ব্যাপার। বাংলার ইতিহাসে আমি যতদূর জানি, এই ভূখণ্ডে বিক্ষোভ বিদ্রোহের অন্ত নেই। কিন্তু বাঙালি আপন প্রতিভা বলে নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারে তাহলে একটা অভিনব ব্যাপার হবে। কোলকাতায় খোঁজখবর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তা থেকে স্থির কোনো ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন মুজিব একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সোহ্রাওয়ার্দীর চ্যালা ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি মহাত্মাজীর মন্ত্রশিষ্য। অহিংস অসহযোগ নীতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এই বিরাট গণসংগ্রাম রচনা করেছেন। দু’চারজন কমিউনিস্ট বন্ধুর কাছে জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি তাতে সংশয়টা আরো বেড়ে গেলো। মুজিব নাকি ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী। মুজিব লোকটা কেমন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কি সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আমার কাছে সবটা ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়া ছায়া মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষটার ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নইলে তাঁর ডাকে এতোগুলো মানুষ বেরিয়ে এলো কেমন করে। আমি টিভিতে মুজিবের অনেকগুলো জনসভার ছবি দেখেছি। দেখার সময় শরীরের পশম সোজা হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম মারমুখী মানুষের ঢল আমি কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। … বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সামান্য অধিকার আছে, তা দিয়েই বলতে পারি ভারতবর্ষের বহু জাতি এবং বহু ভাষার একটা মহাদেশ। উনিশশো সাতচল্লিশে ধর্মের প্রশ্নটি যখন মুখ্য হয়ে অন্য সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়েছিলো। আরো একটা কথা, নানা অনগ্রসর পশ্চাৎপদ জাতি এবং অঞ্চলের জনগণ তাদের প্রকৃত দাবি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই আপার সমাধান হিসেবে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্র দু’টির জন্ম হয়েছিলো। পরিস্থিতি যে রকম দেখা যাচ্ছে , পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র জন্ম দিতে যাচ্ছে। একথা যদি বলি আশা করি অন্যায় হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। …২১
ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কারণে ভারত রাষ্ট্রের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দেয়ার তত্ত্বটি ছফা অনেক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। ভারতে কিছু আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা আছে। তবে সেটা আমলে দেয়ার মতো আকার ধারণ করে নাই।
উইল ডুরান্টের ‘সিজার এন্ড খ্রিস্ট’ বইতে রোমান সাম্রাজ্যের পতন নিয়ে লেখা ছিল- A great civilization is not conquered from without until it has destroyed itself within. The essential causes of Rome’s decline lay in her people, her morals, her class struggle, her failing trade, her bureaucratic despotism, her stifling taxes, her consuming wars.
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ থেকে সহায়তা করেছে। তবে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি আমাদের অমিত সাহস দিয়ে। রক্ত দিয়ে। আর অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গিয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে আমাদের দুর্দশা আরো তীব্র হতো। ডুরান্টের তত্ত্বমতে ভেঙে চুরমার হয়ে আবার নতুন করে হয়তো সব শুরু হত। তবে শোষিত হবার ইতিহাস আমাদের কম প্রাচীন নয়। এসবের মধ্যে আমাদের দীর্ঘকাল অতিবাহিত করতে হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে ঊনচল্লিশ বছর ধরে আমরা বিশ্ব মানচিত্রে শিরদাঁড়া সোজা করে টিকে আছি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। তবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির জন্য। যুদ্ধ দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব হওয়ার সাথে এর সম্পর্ক কম।
অলাতচক্র উপন্যাসে ছফার কৃতিত্ব সত্যনিষ্ঠ থাকার। এমনকি নিজের আওড়ানো কথার ওপর নিজেই পরে কঠোর হন। উপন্যাসে জয়েসীয় স্ট্রিম অব কনসাসনেস থাকলেও ছফার সহজ পাঠকবান্ধব গদ্যশৈলীর জন্য কোন জায়গায় আটকে যেতে হয় না। জাহিদুল ডোরাকে নিয়ে দানিয়েলের মধ্যের অস্বস্তি অনেক জায়গায় এসে গেছে। দানিয়েলের করা অনুসিদ্ধান্ত এক জায়গায় টলে যায়।
ডোরা জাহিদুলকে বিয়ে করেছে। তাতে এমন অন্যায়টা কি হয়েছে? এরকম অনেক তো ঘটে। হেনা ভাই একটা বিধবা মেয়েকে এ সময়ে বিয়ে করে অপরাধ কি করেছে? মহিলা এবং হেনা ভাই পরস্পরকে পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছে। আমি একধারসে সকলকে অপরাধী মনে করি কেন? পৃথিবীর সকলে ঘোরতর পাপে লিপ্ত, আর আমি একা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এ কেমন করে হয়। … ২২
উপন্যাসের অধ্যায় বারোতে রয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ছফার বিশ্লেষণ। ব্যাখ্যায় না গিয়ে কিছু সারকথা জড়ো করলে একসাথে অনেক তথ্য জানা যায়।
… নাদুসনুদুস নেতারা স্নো-পাউডার চর্চিত মুখমণ্ডল এবং স্নিগ্ধ তেলঢালা শরীর নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পেছন পেছন হাজির হয়ে জনসভায় বক্তৃতার ঢঙে হাত উঠিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর নকল করে বলতে থাকেন, ভাইসব, তোমরা বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। তোমরাই বাংলা জননীকে মুক্ত করবে। সেই দামাল ছেলেরা তখন তাঁদের অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে শালা বাঞ্চোত বলে গালাগাল করে। … ২৩ … তাজুদ্দিন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে। নিজদের স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা বিশেষ নেই। সব সময় ভারত যা বলছে, সায় দিতে যাচ্ছে, যা চাপিয়ে দিচ্ছে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের বিপক্ষে কেউ কিছু বলতে সাহস না করলেও আওয়ামী লীগের একাংশ আমেরিকার মাধ্যমে গোপনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের যুক্তি একটাই ভারত কখনো বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবে না, সুতরাং ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় আসাই হবে সবচেয়ে ভালো কাজ। … ২৪… পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে ভারতকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করবে। যদি একটা যুদ্ধ সত্যি সত্যি লাগে, পাকিস্তানের মিত্র চীন কিংবা আমেরিকা যদি পাকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো অসম্ভব। ভারতবর্ষ কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটা বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি আপন কাঁধে নিতে পারে, বোধ করি শ্রীমতি গান্ধী চাইছিলেন যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক। … ২৫… পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুর নরমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছে, যে রক্তস্রোত বইয়েছে, যেভাবে অগ্নিসংযোগ এবং নরহত্যার আয়োজন করেছে, তাতে করে দু’অংশের জনগণের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের শেষ সম্ভাবনাটুকু চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে আসন্ন সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কখনো ভারতের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ভারত একটি দুর্বল পাকিস্তান চায়। বিনা যুদ্ধে যদি সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়, যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি খুঁজে পান না। …২৬ … মাঝখানে পরিস্থিতি একেবারে থিতিয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এভাবেই সব কিছু চলতে থাকবে। যেখানেই যাই, সর্বত্র থমথমে পরিবেশ, কি ঘটবে, কি ঘটতে যাচ্ছে কেউ কিছু বলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দলাদলি ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওর বিরুদ্ধে বলছে, অমুক অমুকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কোলকাতার মানুষেরা আমাদের উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আর কতো। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, পার্কে, মাঠে, ময়দানে সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ দেখে দেখে তাদের চোখ পচে গেছে। … ২৭… এম. আর. আখতার মুকুল যখন স্বাধীনবাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে চরমপত্র পাঠ করেন তখন দোকানের সামনে আস্তে আস্তে লোক জমতে থাকে, তখন দোকানীর আওয়াজটা বাড়িয়ে না দিয়ে উপায় থাকে না। লোকজন শুনে এম. আর. মুকুলের কড়া রসিকতা চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। এম. আর. আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডুবাচ্ছেন, সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রীজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সৃষ্টি করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যতো পাকিস্তানি সৈন্য খুন করেছেন, জখম করেছেন, যতো ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যতো কনভয় ধ্বংস করেছেন সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানি সৈন্য বাংলার মাটিতে থাকার কথা নয়। তার পরদিন সন্ধ্যায় আবার সৈন্য মারতে আসেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবি এতো সৈন্য তিনি কোথায় পান। … ২৮ … কার্যক্রম যতোই অপ্রতুল হোক না কেনো এম. আর. আখতারের কণ্ঠ শুনে মনে একটা বিশ্বাস ঘনিয়ে উঠতো। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের নদী, আমাদের বনাঞ্চল, আমাদের বাঘ, আমাদের প্যাঁক পাকিস্তানি সৈন্য ধ্বংস করার অলৌকিক ক্ষমতা রাখে। …২৯ … শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বোধ করি মনস্থির করে ফেলেছেন, তাঁকে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাঁর কথাবার্তা, বিবৃতি ভাষণের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য পরিষ্কার ফুটে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের বেগও তীব্র হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।… ৩০ … শ্রীমতী গান্ধীর রাশিয়া সফরের পর থেকে রাশিয়ান নেতাদের মন্তব্যের ধরন ও বেশ পাল্টে গেলো। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটা বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। দুই দেশের যে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রথমবারের মতো পূর্বপাকিস্তানের জায়গায় পূর্ববাংলা শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। … ৩১ … বাংলাদেশ ভারতের নৌকায় পা রেখেছে। সুতরাং ভারত যা করে বাংলাদেশকে অম্লানবদনে মেনে নিতে হবে। তারপরেও ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত একটি যুদ্ধ ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। ভারতের স্বার্থ থাকে থাকুক।… ৩২
মাঝখানে ব্যস্ততায় আর তায়েবার খোঁজ নেয়া হয়নি। পরে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে তাকে এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। সময় আর বেশি নেই। তায়েবার এই পরিণতির জন্য কাউকে না কাউকে দোষারোপ না করে শান্তি পাচ্ছিল না দানিয়েল। জাহিদুল হক, ডোরা, হেনা ভাই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘুরে শেষ বিচারে দানিয়েল এই পরিণতির জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে। … কাউকে দায়ী না করে আমার মন শান্তি পাচ্ছিলো না। তখনই মনে পড়ে গেলো তায়েবা নিজের মুখে বলেছে, সে আমাকে ভালবাসে, তাহলে কি আমিই তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী? …৩৩… পাশে চারজন মানুষ খাটিয়ায় করে একটা সাদা চাদরে ঢেকে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছিলো। দানিয়েলের মগজে তখন দার্শনিকতার উদয় হয়। … মানুষের জন্ম মৃত্যুর রহস্যটা আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। মৃত্যু সর্বব্যাপী ওঁত পেতে রয়েছে। কেউ কারো জন্য দায়ী নয়। … ৩৪
তায়েবা ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের সময় আসাদ হত্যাকাণ্ডের দিনে আয়ুববিরোধী আন্দোলনে ১৪৪ ধারা অমান্য করে পত্রপত্রিকায় আলোচনার বিষয়ে হয়েছিল। কোলকাতার পিজিতে সে নীরবে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে আর অলীক কল্পকন্যা রওশন আরা ভারতের জনগণের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।
দানিয়েলের সাংবাদিক বন্ধু বিকচ চৌধুরি প্রতিদিন সীমান্তে গিয়ে সংবাদ এনে সেটা ফুলিয়ে পত্রিকার চারটা কলাম ভরাট করতেন। বিকচ তার ছোটপত্রিকায় এতো সৈন্য মেরেছেন, এতো ট্যাঙ্ক ছারখার করেছেন আগরতলার মানুষ তাকে পাকিস্তানি সৈন্যদের যম ডাকতো। একদিন বৃষ্টির তোড়ে পড়ে তার সীমান্তে সংবাদ আনতে যাওয়া হলো না। ঘরে বসেই একটা কাহিনী ফাঁদা হলো।
… ফুলজান নামের এক যুবতী বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি সৈন্যের একটা আস্ত ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখিয়ে বললো, দেখতো খবরটা কেমনহয়েছে। আমি বললাম, দ্যা আইডিয়া ইজ গ্র্যান্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরকম একটা বীরকন্যা জন্মাতে পারলে খুব ভালো হয়। বিকচ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, আমরা যদি না লিখি তাহলে জন্মাবে কেমন করে। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। সে বাঁ চোখটা টিপে একটু হেসেছিলো। আমি বললাম, এক্ষেত্রে একটা সেকেন্ড থট দিতে হবে।
যে কোনো সংবাদ কি, কেনো, কোথায়, কখন, কিভাবে এই এতোগুলো কেনোর জবাব দিতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তোমার গল্প সেই শর্তগুলো পূরণ করেনি। ধরো নাম নির্বাচনের বিষয়টি তুমি বলেছো ফুলজান। এই নামটি একেবারেই চলতে পারে না। বাঙালি মুসলমানের নাম সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। তাই ফুলজান শব্দটি তোমার কলমের মুখে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ফুলজান যাদের নাম, তারা বড়োজোর হাঁড়ি পাতিল ঘষে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিতে পারে না। সুতরাং একটা জুতসই নাম দাও, যাতে শুনলে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের ভাব জাগবে। রওশন আরা নামটি মন্দ কি। বঙ্কিম এই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। নামের তো একাটা মাহাত্ম্য আছেই। রওশন আরা নাম যে মেয়ের, সে যেমন হৃদয়াবেগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জয়সিংদের ভালোবাসতে পারে; তেমনি দেশ জননীর প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতিও দিতে পারে। নামটা মনে ধরেছিলো বিকচের। তারপর গল্পের নিয়মেই বাকি ব্যাপারগুলো বেরিয়ে এসেছিলো। তার বাড়ি নাটোর। তার বাবা পুলিশ অফিসার। সে ইডেনে পড়তো এবং শেখ মুজিবের আত্মীয়া ইত্যাদি। বিকচ যদি রওশন আরার বাবার মর্যাদা পায়, আমাকে কাকা টাকা কিছু একটা বলতেই হবে। সংবাদটি সামনের পাতায় বক্স করে। আগরতলার মানুষ এটাকেও আরেকটা বিকচীয় উদ্ভাবন ধরে নিয়েছিলেন। কেউ হ্যাঁচ্ছোটিও করেননি।
মাসখানেক বাদে আমি যখন কোলকাতায় এলাম অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই কোলকাতা শহরে বিকচের কল্পকন্যাটির নবজন্ম ঘটে গেছে। আকাশবাণীর দেবদুলাল বাবুর কল্যাণে রওশন আরার পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রওশন আরার আত্মীয়স্বজনেরা রেডিওতে সাজানো সাক্ষাৎকার দিতে আরম্ভ করেছে।
তারপর থেকে ভারতের পত্র পত্রিকাসমূহ রওশন আরাকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। আনন্দবাজার যদি হেডলাইন করে, যুগান্তর ছাপছে জীবনবৃত্তান্ত। অমৃতবাজার উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। মিতভাষী বলে স্টেটসম্যানের সুনাম আছে। এই সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রটি সম্পাদকীয় কলামে রওশন আরার প্রতি শ্রদ্ধা্র্ঘ্য নিবেদন করেছিলো। পত্র পত্রিকায় প্রচার একটু থিতিয়ে এলেই রওশন আরাকে নিয়ে কবিমশায়রা কবিতা লিখতে এলেন। ... যুদ্ধের প্রথম বলিইতো সত্য। কিন্তু আমি বা বিকচ ইচ্ছে করলেই রওশন আরাকে নিরস্তিত্ব করতে পারিনে। আমরা যদি হলফ করেও বলি, না ঘটনাটি সত্য নয় রওশন আরা বলে কেউ নেই। সবটাই আমাদের কল্পনা। লোকজন আমাদের পাকিস্তানি স্পাই আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য ছুটে আসবে। … ৩৫
তায়েবাকে বাংলাদেশের মেটামরফোসিস হিসেবেই ছফা হাজির করতে চেয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে কোলকাতায় পা রাখা ছাড়া যার উপায় ছিলো না। কোলকাতায় সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিন গুনছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোলকাতায় বসে ভারতের ইশারার দিকে তাকিয়ে ছিল। মৃত্যুসম সেসব দিন।
একটি নারী দিনে দিনে নীরবে নিভৃতে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে একটি কেবিনে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরা জানতাম সে মারা যাবেই। মারা যাবার জন্যই সে কোলকাতা এসেছে। যুদ্ধ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, আর তায়েবাকে এখানে রেখে যেতে হবে। তায়েবা অত্যন্ত শান্তভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলো। … ৩৬
কিন্তু ছফা পরে বিপরীত সূত্র হাজির করেন। গাণিতিক ফ্যালিসিতে পড়ে বাংলাদেশ আর তায়েবা একদেহ এক আত্মা হতে পারে না। মহৎ সাহিত্যের কাতারে ফেলার জন্য দানিয়েলের অন্তর্গত ভাবনার একমুখিতা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অলাতচক্রে ভর করে।
… ডিসেম্বরের চার তারিখ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই দিন সন্ধ্যে থেকে সকাল পর্যন্ত গোটা কোলকাতা শহরে বিমান হামলার ভয়ে কোনো আলো জ্বলেনি। সেই ব্ল্যাক আউটের রাতে তায়েবার কাছে কোন ডাক্তার আসতে পারেনি। কোনো আত্মীয়স্বজন পাশে ছিলো না। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে যে অন্ধকার কোলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই অন্ধকারের মধ্যে তায়েবা আত্মবিসর্জন করলো। ৩৭
[/justify]
মন্তব্য
তোমাদের দুজনের লেখা আজ একসাথে ব্লগ-এ পাওয়া গেল। তোমার লেখাটা পরে বিস্তারিত পড়ব। প্রমা-র কবিতা ভাল লেগেছে।
আংকেল,
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
আহ
আলাতচক্র যেন আবার পড়লাম
অলাতচক্র বারবার পড়া জরুরি।
--------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
মাস দেড়েক আগে অলাতচক্র (নতুন ভার্সান) আবার পড়লাম। এই উপন্যাসটার প্রতিটা অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাবে। ফ্যাক্ট আর ফিকশনের এমন নিবিড় বুনোট বাংলা সাহিত্যে আর কোথায় দেখেছি মনে পড়েনা। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিটি ফ্যাকশনের কথা এখানে উঠে এসেছে। আজ এতগুলো বছর পরও সেই ফ্যাকশনগুলো একটু অন্যরূপে কিন্তু প্রবলভাবে বিরাজমান। চেতনার তীব্রতা হয়তো সেই রকম নেই, কিন্তু চরিত্র একই প্রকার আছে - behavior পাল্টেছে কিন্তু attitude পাল্টায়নি। বস্তুতঃ এই অঞ্চলের বাঙালীদের জাতীয় চরিত্রকে বোঝার জন্য, ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোতে তাদের আচরণ বোঝার জন্য, ঘটনার বিস্তার ঘটলে তাদের ভাবনার বিবর্তনটা বোঝার জন্য অলাতচক্রকে একটা coup d'oeil বলা যায়।
আমি অলাতচক্রের ১৯৮৪ ভার্সান আর ১৯৯৩ ভার্সান দুটোই পড়েছি। '৯৩-এ এসে শুধু নামগুলোই পাল্টেনি আরো অনেককিছুই পাল্টেছে - এমনকি শেষটা পর্যন্ত। আমার কাছে '৯৩ ভার্সানটা অনেক বেশি factual মনে হয়েছে, ইতিহাস বেশি উচ্চকিত হয়েছে। '৮৪-তে "রূপক দানিয়েল" বা "রূপক তরুর" নিজস্ব অন্তর্গত দ্বন্দ্ব-ভাঙা-গড়া অনেক বেশি স্পষ্ট ছিল। তবে দুই ভার্সান দুটো ভিন্ন উপন্যাসের মর্যাদা পাবার মত না। এইখানে ৮/৯ বছরে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব ভাবনার পরিবর্তনটাও লক্ষণীয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অলাতচক্রের ১৯৮৪ ভার্সানটা আমার পড়া নাই। এই ভার্সান সংগ্রহ করার কোনো উপায় আছে?
----------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
পড়ছি
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ঠিকাছে।
--------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ফিকশনটি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিলো তা হলো এই অলাতচক্র। শরণার্থী শিবিরের তথা কলকাতার সেই নয়মাসের এতো জীবন্ত বর্ণনা আমি আর কোথাওই পাইনি(অবশ্য অনেক পরে জেনেছি যে এটা আসলে তার আত্মজীবনী!)। আহমদ ছফার যে প্রবল দার্ঢ্য আর আত্মসম্মানবোধ আমাদের মুগ্ধ করে, তার ক্রমান্বয়ে যে ক্ষয়ে যাওয়ার রূপরেখা, শরণার্থী জীবনে নিজেকে ক্রমাগত তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ হতে দেখা, স্রেফ গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য চরম সাম্প্রদায়িক একজনের অধীনে কাজ করা, নেতাদের নৈতিক স্খলন(সোনাগাজির উল্লেখও এসেছে!) এক্কেবারে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এই উপন্যাসে।
আহমদ ছফার মুক্তিযুদ্ধ দর্শন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের দর্শন অনেকাংশেই অভিনব। বড্ড নির্মোহ থাকতে পেরেছেন তিনি অনেকাংশেই। তবুও কিছু কিছু ব্যাপারে মনে হয়েছে আরো খোলামেলা হতে পারতেন। যতদুর জানি তিনি সেসময় সক্রিয় বামে ছিলেন। সেসময়ের রহস্যময় বামেরা, দুই কুকুরের লড়াই খ্যাত তত্ত্বগুলো, নকশাল আন্দোলন, মুজিব বাহিনী এগুলো আরো বেশি করে আসতে পারতো। কিন্তু যদি তরু/তায়েবার জন্য তার মনস্তাত্বিক বিপন্নতাকে মাথায় রাখি তাহলে বলবো এতকিছুর পরেও এতটা নির্মোহ থাকা কেবলমাত্র আহমদ ছফার পক্ষেই সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে কখনোই মোটাদাগের সাদাকালো বিভাজন বলে মনে হয়নি। অনেক ধূসর এলাকা আছে এর। মাত্র ৩০/৪০ বছরে হয়তো তার অনেক কিছুই আমরা জানতে পারবোনা। হয়তো আরো ৩০/৪০ বছর লাগবে পুরোপুরি জানতে। দুঃখ শুধু একটাই, যাদের এই দলিলগুলো সংরক্ষণ করার কথা, তারা আজ তা ইচ্ছামতো পাল্টাচ্ছেন, একেকজনের মতামত একেকরকম। আহমদ ছফার মতো শরণার্থী জীবন নিয়ে এরকম অকপট কথা কয়জন বলে যেতে পেরেছেন? আরো অনেক অনেক কবি-সাহিত্যিক ছিলেন তখন কলকাতায়, তাদের কারো লেখায়ই তো আম এই তীব্র মর্মযাতনা, আত্মসম্মানহীনতায় কুঁকড়ে যাওয়ার ছাপ পাই না। আল-মাহমুদ(কবি হিসেবে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন এতে কোনো দ্বিমত নেই।) একটা কবিতা এরকম, তিনি কলকাতায় আছেন, বুদ্ধদেব বসুর একটি আড্ডায় সবাই জড়ো হয়েছেন, পানাহার করছেন সবাই, তার কেন জানি ভালো লাগছেনা। এর চেয়ে বেশি তীব্র কোনো অনুভূতি আমি আর পাইনি আর কোনো কবিতায়!! আবদুল মান্নান সৈয়দ তো আরো এককাঠি বাড়া! গোটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই তার কোনো কবিতা নেই!!! আর অন্য লেখকের যেগুলো রয়েছে, তীব্র আবেগের মোটা খোলসটুকু সরালে সারবস্তু খুব কম লেখাতেই পাওয়া যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের ভুগোল ইতিহাস আমরা সবাইই জানি; সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসের কতটুকু জানি? কতটুকু জানি আদিবাসীদের ভূমিকা? কতটুকু জানি সমাজবাস্তবতা? বিভিন্ন প্রেক্ষাপট(সাম্প্রদায়িকতা/সূফিজম/জামাতপন্থী/মুসলিম লীগ পন্থী/ আওয়ামী লীগের মধ্যবিত্তকেন্দ্রিকতা/ভাসানীর প্রান্তিকতা, চীনপন্থা!/বামদল গুলোর ভূমিকা/বিহারী মনস্তত্ত্ব/সেনাবাহিনী/গণবাহিনী) নিয়ে বিশ্লেষণ ঠিক কতটুকু হয়েছে বলার মতো?
একটা মুক্তিযুদ্ধ মানে স্রেফ মানচিত্রের বদল নয়, বরং একটা আদর্শের বদল, নতুন চিন্তাচেতনার উন্মেষ। সামাজিক/আর্থরাজনৈতিক অনেককিছুই তখন পালটে যেতে পারে, পালটায় মূল্যবোধের ক্রমও। জানিনা আর কোনো সাহিত্যিক আহমদ ছফার মতো এতো ভালো করে তা বুঝেছিলেন কিনা। শুধুমাত্র এইই একটি উপন্যাসেই স্রেফ নয়মাসে একজন দানিয়েল এর মানসিক বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা জেনে যাই যে হ্যাঁ, আমাদের এখন পরিবর্ত্নন হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন।
পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ যদি একান্ত নিজস্বতায় নির্বাণ এর আখ্যান হয় তবে অলাতচক্র হলো সর্বস্বতায় নিজের একান্ত দুঃখকে ছড়িয়ে দেওয়ার দলিল।
(বিশাআআআল মন্তব্যে অগোছালো চিন্তা-প্রলাপের বিপুল সমাহারে আমি নিজেই অতিশয় লজ্জিত। আসলে প্রিয় লেখকের প্রিয় উপন্যাসের কথা অনেকদিন পর আবার মনে করিয়ে দিলে এমনটাই হয়। আশা করি নিজগুণে ক্ষমাঘেন্না কইর্যা নেবেন। )
________________________________
বিধিবদ্ধ পঙ্কিলতা।
জীবন বাবু,তাঁর কবিতা।
তৃপ্তিদায়ী আত্মশ্লাঘা।
এবং এ রাতজাগা।
************************************
মন্তব্য পড়ে খুব ভাল্লাগলো।
অলাহত চক্র মধ্যে প্রেমের অঙ্কুর
রূপ রস বাক্য যোগে সৃজিল প্রচুর।
--- সৈয়দ আলাওল, পদ্মাবতী।
--------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
ভাইরে ভাই! হাঁপিয়ে গেছি পড়তে পড়তে!
লেখা আরো বড় ছিল। পুরাটা কপি পেস্ট করে প্রিভিয়্যু দিলে দেখি কিছু আসে না। তারপর এনালগ সিস্টেমে কিছু কিছু এডিট মার্লাম। যতোটুকু দিলাম তার চেয়ে একটা বাক্য বেশি দিলে প্রিভিয়্যু গায়েব হয়ে যায়।
-------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
দৈর্ঘ্য হিসেবে আমার এইটা পছন্দ হয়েছে।
আয়েস করে পড়ার মতো।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আপ্নের জন্য হয়তো ঠিকাছে। তবে ব্লগ হিসেবে এই লেখা বেসাইজের।
-------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
আগাগোড়া গিলে খেলুম
ক্যারমে? এক ঢোঁকে?
----------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
১.
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশ- বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি অধ্যায় আহমদ ছফা ধরে রেখেছেন তিনটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে। 'ওঙ্কার', 'অলাতচক্র' আর 'একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন'। এই তিনটি উপন্যাস ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধে যতোটা দেশাভ্যন্তরে সশরীর যুদ্ধে হয়েছে, তার কোন অংশেই কম হয়নি সীমান্তের ওপারে। দাবাটা খেলা হয়েছে মূলত কোলকাতাতেই আর সেই চিত্রটাই একেঁছেন আহমদ ছফা তার অলাতচক্র উপন্যাসে। আহমদ ছফা এখানে দানিয়েল হয়ে যান। আর তায়েবা হয়ে যান বাংলাদেশ।
আহমদ ছফার দেখার দৃষ্টি মারাত্মক। তার উপর যুদ্ধের অনেক পরে যখন এই উপন্যাস পরিমার্জন করেন, তখন দেখা চেহারাগুলোর স্পষ্ট রূপই তিনি তুলে আনতে পেরেছেন এই উপন্যাসে।
৭১-এ দেখা চরিত্রগুলোকে ছফা বিচার করেছেন ৭৫ পরবর্তীকালে দাড়িয়েঁ। আবার তা পরিমার্জন করেছেন ৯০ পরবর্তীকালে। অলাতচক্রকে পড়তে গিয়ে এই তিনটা সময়কাল তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বেশির ভাগকেও এই তিন সময়কালেই নানান রূপে পাল্টে যেতে দেখেছি। ছফা এই মানুষগুলোকে কোন সময়ের চোখে দেখেছেন? কোন চোখে দেখেছেন তায়েবারূপী বাংলাদেশকে? ৭১-এ কিন্তু ছফা 'জাগ্রত বাংলাদেশ' লিখেছিলেন।
এই উপন্যাসের সঙ্গে ছফার "বেহাত বিপ্লব" তত্ত্ব অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত। তায়েবার মৃত্যুর মাধ্যমে স্বপ্নের বাংলাদেশের মৃত্যুই তিনি দেখেন আসলে। যেই বাংলাদেশকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ওঙ্কারে।
অলাতচক্রর চরিত্রগুলো একেবারেই আমাদের ইতিহাসের চরিত্র। চেনা জানা। এই মানুষগুলোকে ছফা দেখেছেন বিশ্লেষণ করেছেন নিজস্ব চিন্তা দ্বারা। স্বভাবতই এই চিন্তার সঙ্গে কারো কারো দ্বিমত থাকবে। ছফার শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যেমন একে সরাসরিই অপছন্দ করেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও এই কারণেই বলেন "অনেক সম্ভাবনা নিয়েও অলাতচক্র কোনো উপন্যাসের খসড়ার একটি অংশ বলেই গণ্য হয়, বড়মাপের একটি শিল্পকর্মের মর্যাদা পায় না।" আবার রশীদ করীম একেই অনেক শক্তিশালী সাহিত্যকর্ম মনে করেছেন।
মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু একাত্তরের বাংলাদেশকে এরচেয়ে শক্তিশালী চোখে আর কাউকে দেখতে দেখি নাই। এজন্যই অলাতচক্র আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
২.
এরকম একটি উপন্যাস নিয়ে এত বড় একটি লেখা তৈরি করার জন্য আপনাকে অবশ্যই অভিনন্দন। দারুণ একটি কাজ করেছেন।
৩.
আমি ছফাগিরির আগের পর্বগুলো পড়িনি। পড়া হয়নি সময়াভাবে। তাই সেগুলো নিয়ে বলতে পারছি না। কিন্তু এই পর্বটা পড়ে মনে হলো আপনি সলিমুল্লাহ খান দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত। অনেক জায়গাতেই সলিমুল্লাহ খান সরাসরি হাজির হয়েছেন আপনার কলমে। বার বার মনে হয়েছে এই লেখাটা হয়তো আগে পড়েছি আমি কোথাও।
আমার অনুরোধ থাকবে ছফাগিরি লেখার সময় সলিমুল্লাহ খানকে এড়িয়ে যেতে। আপনার চিন্তাটাই পড়তে আগ্রহী বেশি আমি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
১। হ্যাঁ। বেহাত বিপ্লব অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
২। ধন্যবাদ।
৩। হালকা। সলিমুল্লাহ স্যার তো লাঁকা দিয়ে বাসনার ব্যাখ্যা দিছিলেন। আমি সেই লাইনে যাই-ই নাই।
-----------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
উপন্যাসের সাথে এত মিশে গিয়েছিলাম যে তায়েবার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব, আফসোস হচ্ছিল, তায়েবাকে যদি বাঁচানো যেত! আহমদ ছফার উপন্যাসগুলির মধ্যে 'অলাতচক্র' আর 'পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ' আমার সবচেয়ে পছন্দের। খুব নির্মোহ, সৎ, সোজাসাপ্টা আবার একইসাথে কখনো কখনো তির্যক, প্রথমবারের মত ছফার উপন্যাসপাঠ - একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আর 'গাভী বৃত্তান্ত' তো চরম ! উপন্যাসটা যখন পড়েছিলাম, তখন আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম - তাই বক্তব্য অনুভবও করছিলাম খুব ভালোই।
লেখা ভালো লেগেছে। উদ্ধৃতি একটু বেশি এসেছে মনে হয়েছে - মানে আমার কাছে বেশি লেগেছে। তবে এই উপন্যাস যারা এখনো পড়েননি তাদের জন্য হয়তো এটাই ঠিক আছে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
দারুন হয়েছে এই পার্টটা...তিন/চার বৈঠকে পড়েছি যদিও।
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
তাসনীম ভাই,
ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
পড়ার পর বুঝতে পারলাম লেখাটা আসলে অনেক বড় দৈঘের্র হয়ে গেছে................. পড়ার সময় অন্য কিছু ভাবার ফুরসত হয়নি.............
পরবর্তী কিস্তির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
নবীন পাঠক
shahriarsajib@gmail.com
ট্যাগে হাতিপোস্ট এন্ট্রানো দর্কার ছিল।
-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
আপনার ছফাগিরি পরতে পড়তেই ছফার সাহিত্য জগতে আমার প্রবেশ । প্রবন্ধগুলো আগে পড়ছি । এবারের পর্ব পড়ার পর, এখনি অলাতচক্র পড়তে ইচ্ছে করছে । পরের পর্ব পড়ার আগ্রহ জানিয়ে গেলাম ।
একজন অন্তত ছফাগিরি পড়ে ছফার বই পড়তে আগ্রহী হয়েছেন। এটাই অনেক।
-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
আহমদ ছফা, আমাদের ছফা ভাই আবার জেগে উঠেছেন
দুর্ভাগ্য ছফা ভাই'র সাথে কোনদিন আমার সাক্ষাত হয়নি। কিন্তু তার সব লেখাই গিলে খেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। একদিন আজকের কাগজে এসেছিলেন, তখন আমি পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক। তার বিশাল কেলানো দাতের হাঁসির কথা কেবল মনে পড়ে। আমার সহকর্মী বন্ধু-বড়ভাই জহিরুল আহসান টিপু (সদ্য প্রয়াত ভোরের কাগজের বার্তা সম্পাদক)পরিচয় করিয়ে দিয়েছলেন।
বাংলাদেশে দলবাজ বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক কিংবা সাহিত্যিকের ভীড়ে ছফাভাইরা বেঁচে থাকবেন সবাইকে ছাড়িয়ে সময় থেকে সময়ান্তরে।
ছফাভাইকে আমি কেবল সাহিত্যিক হিসেবে ভাবি না, তিনি ছিলেন আমাদের প্রজন্মের দিগ্দর্শন। বাংলাদেশের সর্বত্র যে দলবাজ গোষ্ঠী গুড়ে উঠেছে- প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে কবিতা পরিষদ কিংবা রাইটার্স ক্লাব পর্যন্ত; ছফা ভাই জীবিত থাকলে তাদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে দু'গালে চড় কষে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে 'সোজা তাকাতে হয়'।
অশেষ ধন্যবাদ লেখককে,
zic2010@yahoo.com
ছফা তো ছফা-ই।
দলবাজি না করে কিংবা কোন কিছুর তলে আশ্রয় না নিলে দেশের ফাউল লেখকেরা টিকতেন না। এদেরকে চড় কষানোর মাপের লোক কোথাও নেই। সাহস দেখিয়ে কেউ যদি চড় ও কষায় এরা দলবাজি আদৌ ছাড়তেন কিনা সন্দেহ।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
লেখাটার একটা লাইন সম্পাদনা কর্তে গিয়ে হাপিশ হয়ে গেছে। মন্তব্যে লেখাটা দিয়ে দিলাম।
--
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা সাহিত্যের মধ্যে আহমদ ছফার ‘অলাতচক্র’ উল্লেখযোগ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একরকম বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে কোলকাতায় ঢুকে পড়ে। ছফা সেই অনুষঙ্গে তাঁর উপন্যাসের কাহিনি টেনেছেন। তায়েবা যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অবস্থার রূপক। প্রাণ বাঁচাতে তাকে কোলকাতা শহরে আসতে হয়েছে। যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে তায়েবার (তরুর) মৃত্যু ঘটে কিন্তু রাষ্ট্র বাংলাদেশের আবির্ভাব হয়। গাণিতিক এই ফ্যালাসি উপন্যাসকে অন্য মাত্রা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা মহৎ সাহিত্যের যাবতীয় গুণাগুণ এই উপন্যাসের মধ্যে আছে।
‘অলাতচক্র’ উপন্যাস প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে সাপ্তাহিক নিপুণের ঈদসংখ্যায়। পরে পরিমার্জিত আকারে প্রকাশ পায় মুক্তধারা থেকে। ১৯৯৩ সালে। নিপুণে প্রকাশ করার সময় উপন্যাসের চরিত্রগুলো ছিল তরু, হেলেন ইত্যাদি নামে। এই নামগুলো উল্লেখ করার কারণে অনেকে ছফার কাছে অভিযোগ পেশ করেন। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে ছাপার সময় নামগুলো পাল্টে দেন। তরুর নাম পাল্টিয়ে লেখা হয় তায়েবা এবং আহমদের জায়গায় দানিয়েল। আহমদ ছফা রচনাবলির অষ্টম খণ্ডের পরিশিষ্টে তরুকে নিয়ে লেখা ছফার অনুভূতি জানা যায়।
… তরুর এই গল্পটা আমাকে চব্বিশ তারিখের মধ্যে শেষ করতে হবে। যে বাসর আমার রচিত হয়নি এই গল্পটির মধ্যেই সে বাসর আমি পাতব। মানুষের আত্মা বলতে কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা আমার কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবু দোষ কি বিশ্বাস করতে, মানুষের আত্মা আছে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করছি তরুর আত্মা আমাকে সাহায্য করে, যাতে জীবনবৃত্ত আমি মেলে ধরতে পারি।
এক সময় তো তাকে সব দিয়ে ভালবেসেছি। সে ভালবাসার বেদনাঘন গহন কাহিনীটি আমি প্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছি। আমি প্রার্থনা করব সূক্ষ্ম চেতনারূপী তরুর আত্মার সকাশে আমার অনুভবে সত্য যেন প্রকাশমান হয়, যতই নিষ্ঠুর হোক আমার বিশ্বাসে স্থির নিশ্চিত এবং অটল থাকতে পারি।… ১
আহমদ ছফার ডায়েরি অনুসারে জানা যায় এপ্রিলের মাঝামাঝি কোন একটা সময়ে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কোলকাতা চলে যান। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ইচ্ছা থাকলেও পরে তাঁকে বোঝান হয় যুদ্ধ করার অনেক লোক আছে। কিন্তু লেখালেখির যুদ্ধের জন্য কিছু লোক দরকার। আহমদ ছফা না হয় সেই কাজ করুক। কোলকাতায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি সংগঠন শুরু করেছিলেন। সেখানে সভাপতি ছিলেন ডক্টর অজয় রায় এবং সাধারণ সম্পাদক আহমদ ছফা। কোলকাতায় থাকাকালীন সময়ে প্রবীণ সিপিএম নেতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সান্নিধ্যে আসেন।
ম্যারি ডানহ্যামকে ছফা একটা চিঠিতে লিখেন-
… আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে বন্দুক, ট্যাংক, কামান নিয়ে ঘুমন্ত ঢাকা মহানগরীর ওপর হামলা করে বসল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রতিরোধকামী গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে মিলে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পাড়ি দিলাম। প্রথমে আগরতলা, তারপর কোলকাতা। আমি কোথাও বিশেষ সুবিধে করতে পারলাম না। আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা তাদের দলের লোক ছাড়া অন্য কাউকে ফ্রন্টে যেতে দিচ্ছিল না। আমি মুখ আলগা স্বভাবের লোক। কখন কী বলে ফেলি তার কোন স্থিরতা ছিল না। আমাকে নিয়ে বন্ধু-বান্ধবেরা মুশকিলে পড়ে গেলেন। ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা প্রবাসী বাঙালিদের ভেতর থেকে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের খুঁজে খুঁজে বের করতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছিল। এক কথায় যদি কারও ওপর তাদের নেকনজর পড়ে আমরা ধরে নিতাম, তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে লাশটা পাওয়া যাবে কি না। আমি যেভাবে চলাফেরা করতাম এবং বেপরোয়া কথাবার্তা বলতাম, অনায়াসে আমাকে পাকিস্তানি স্পাই হিসেবে চিহ্নিত করা যেত। সেই সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সে যাত্রায় জানে বেঁচে গেলাম। তখন কাকাবাবু ছিলেন একেবারে থুত্থুরে বুড়ো। শ্বেতীরোগে সারা শরীর ছেয়ে গিয়েছিলো। চলাফেরা করতে পারতেন না। কিন্তু তখনও তিনি ছিলেন সিপিএমের অফিসিয়াল প্রেসিডেন্ট। তাঁর কাছে জ্যোতিবসু, আবদুল্লাহ রসুল, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার উনারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমি পরিচিতও হয়েছিলাম। মুজফফর সাহেব মাসে মাসে আমাকে চলাফেরা করার জন্য কিছু টাকা দিতেন। পরে জেনেছি, আমি একা নই, আরও অনেকে এ টাকায় ভাগ বসাত। আমার ধারণা আমি কাকাবাবুর স্নেহদৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। তিনি সকলকেই আপনি বলে সম্বোধন করতেন। একবার আমাকে বলেছিলেন, কাজী নজরুলের পর একমাত্র আমাকেই তিনি তুমি বলে ডাকছেন। সেবার আমার খুব অসুখ হয়েছিলো। বাঁচব এমন ধারণা আমার ছিলো না। মৃত্যুর পূর্বে শরীরের সর্বশেষ প্রাণশক্তিটুকু দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিবেগ যেন ত্বরান্বিত করা যায়, এ নিয়ে একটা বই লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাগ্যক্রমে মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তবাবুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। তিনি কথা দিলেন, আমি যেটুকু লিখব সঙ্গে সঙ্গে প্রুফ করে দেবেন। আমি জ্বরের ঘোরের মধ্যে একটানা লিখে যেতাম। লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বন্ধুদের ডিকটেশন দিতাম। তারা শুনে শুনে লিখে নিতেন। অল্পদিনের মধ্যে বইটি প্রকাশিত হয়ে গেল। ওটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম লেখা। কিন্তু আমার বইটি আশানুরূপ প্রচার পাচ্ছিল না। এই ব্যাপারটি আমি একদিন কাকাবাবুর কাছে খুলে বলেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি আগামীকাল এসে আমাকে গোটা লেখাটি পড়ে শোনাবে। পরের দিন গিয়ে আস্ত লেখাটি পড়ে শোনালাম। তিনি দুদিন পর যেতে বললেন। দুদিন পর যখন গেলাম তিনি মুখে মুখে আমার বইটার ওপর একটা আলোচনা ডিকটেট করে বললেন, যাও, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকায় দিয়ে এস। ওই পত্রিকার মালিক ছিলেন অরুণ রায়। লালবাজার থেকে কাগজটি বের হতো। কাকাবাবুর আলোচনাটি বের হওয়ার পর আমার বইয়ের কাটতি বেড়ে যায়।... ২
বইটির নাম ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বাংলাদেশের প্রথম বই। প্রকাশ করেছিল চিত্তবাবুর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তধারা’।
মুজতবা আলীর একটা কথা আছে। মানুষের মধ্যে যখন দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণতা আসে, তখন সে যেকোনো জিনিসকে ঠিকঠাক পারস্পেক্টিভে দেখে। ছফার মধ্যে এই গুণ ছিল। রাষ্ট্র ভারতের কোলকাতা শহর বাংলাদেশের অজস্র উদ্বাস্তুদের যুদ্ধকালীন সময়ে আশ্রয় দেয়। কিন্তু নগরে আগত আগন্তুকদের প্রতি অচেতন শ্লেষ আহমদ ছফার নজর এড়ায় না।
… লোকটা এপর্যন্ত দু’ দু’বার ‘জয়বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। কোলকাতা শহরে লোকদের মুখে ইদানীং জয়বাংলা শব্দটি শুনে আমার অস্তিত্বটা কেমন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যান্ডেল। এক সপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা-ছাতা, কতো জিনিস বাজারে বাজারে ছেড়েছে কোলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাঁকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিছুদিন আগে যে চোখওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো, কোলকাতার মানুষ মমতাবশত তারো নামকরণ করেছিলো জয়বাংলা। …৩
বইটিতে উত্তম পুরুষের চরিত্রের নাম দানিয়েল। কিন্তু কেন দানিয়েল? সলিমুল্লাহ খান এর কিছুটা তালাশ করেছেন। দানিয়েল শব্দটি হিব্রু। ব্যাবিলনে নির্বাসিত ইহুদি জাতির একজন বুদ্ধিজীবী। কিতাবুল মোকাদ্দেস অনুসারে শব্দটির অর্থ ‘আল্লাহ আমার বিচারক’।
ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতেনাসার প্রকাশ নবুৎখদনিসর (Nebuchandnezzar) একদিন স্বপ্নে দেখলেন, একটা বিরাট মূর্তি। মূর্তিটা বিরাট, অতিশয় তেজোবিশিষ্ট আর তার চেহারা ভয়ঙ্কর। সেই মূর্তির মাথাটা খাঁটি সোনার, বুক ও হাত রূপার এবং পেট ও রান ব্রোঞ্জের তৈরি। তার পা লোহার এবং পায়ের পাতা কিছুটা লোহা ও কিছুটা মাটি দিয়ে তৈরি ছিল। বাদশাহ যখন তাকিয়ে ছিলেন, তখন দেখলেন একটা পাথর কেটে নেওয়া হল। কিন্তু তা মানুষের হাতে কাটা হয় নাই। সেই পাথরটা লোহা ও মাটি মেশানো দিয়ে তৈরি পায়ে আঘাত করে সেটা চুরমার করে ফেলল। তখন লোহা, মাটি, ব্রোঞ্জ, রুপা ও সোনা টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙ্গে পড়ল এবং গরমকালে খামারের মেঝেতে পড়ে থাকা তুষের মত হয়ে গেল। বাতাস তা এমন করে উড়িয়ে নিয়ে গেল যে তার আর কোন চিহ্নই রইল না। যে পাথরটা মূর্তিকে আঘাত করেছিলো, সেই বিরাট পাহাড় হয়ে গিয়ে সমস্ত দুনিয়া দখল করে ফেলল।
হজরত দানিয়েল আলায়হেস সালাম এই স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করলেন। তার আগে ব্যাবিলনের কোন গুণিন, ভূতের ওঝা, জাদুকর কিংবা গণক এর অর্থ উদ্ধার করতে পারেন নাই। দানিয়েল বললেনঃ হে মহারাজ, আপনি বাদশাহদের বাদশাহ। বেহেশতের আল্লাহ আপনাকে রাজ্য, ক্ষমতা,শক্তি ও সম্মান দান করেছেন। আপনার হাতে তিনি মানুষ, পশু আর পাখিদের দিয়েছেন। তারা যেখানেই বাস করুক না কেন, তিনি তাদের সকলকে আপনার অধীন করেছেন। আপনিই সেই সোনার মাথা।
আপনার রাজ্যের পর যে রাজ্য উঠবে, সেটা আপনার রাজ্যের মত মহান হবে না। তারপর তৃতীয় আর একটা রাজ্য উঠবে, সেটা সেই ব্রোঞ্জের পেট ও রান। আর গোটা দুনিয়া সেই রাজ্যের অধীন হবে। শেষে লোহার মত শক্ত চতুর্থ একটা রাজ্য উঠবে। লোহা যেমন সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে তেমনি সেই রাজ্য অন্য সব রাজ্যকে ভেঙ্গে চুরমার করবে। আপনি স্বপ্নে সে পায়ের পাতা ও পায়ের আঙ্গুলগুলোর কিছু অংশ মাটি ও কিছু অংশ লোহা দিয়ে তৈরি দেখিয়েছিলেন তা আসলে ভাগ করা রাজ্য। তবে আপনি যেমন মাটির সঙ্গে লোহা মেশানো দেখেছেন,তেমনি সেই রাজ্যেও লোহার মত কিছু শক্তি থাকবে। পায়ের পাতা ও আঙ্গুল যেমন মেশানো ছিল তেমনি সেই রাজ্যের কিছু অংশ হবে শক্তিশালী ও কিছু অংশ দুর্বল। লোহার সঙ্গে মাটি মেশানোর অর্থ রাজ্যের লোকরা হবে মেশানো এবং লোহা যেমন মাটির সঙ্গে মেশে না, তেমনি তারাও এক হয়ে থাকবে না। ঐ সব বাদশাহর সময় বেহেশতের আল্লাহ এমন একটা রাজ্য স্থাপন করবেন, যেটা কখনো ধ্বংস হবে না কিংবা অন্য লোকের হাতে যাবে না। সেই রাজ্য ঐ সব রাজ্য চুরমার করে শেষ করে দেবে, কিন্তু সেই রাজ্য চিরকাল থাকবে। এটা হল সেই পাহাড় থেকে কেটে নেওয়া পাথর যেটা মানুষের হাতে কাটা হয়নি। পাথরটা লোহা,ব্রোঞ্জ, মাটি,রুপা ও সোনাকে টুকরা টুকরা করে ভেঙ্গে ফেলেছিল।ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তা এইভাবে আল্লাহ তা’লা মহারাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন। (বাইবেল সোসাইটি ২০০০: ১২৫১)
দানিয়েল পয়গম্বরের স্বপ্নের সঙ্গে আহমদ ছফার দানিয়েল চরিত্রের অনেক খাতির দেখা যায়।... ৪
এই মিল করাটা অমূলক নয়। কোলকাতার পিজি হাসপাতালের ঊনত্রিশ নম্বর বেডের তায়েবাকে দেখতে যায় দানিয়েল। তায়েবার বয়স সাতাশ। তার পরিবারের মধ্যে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব। উপন্যাসের শুরু এখান থেকে। তায়েবা জানতে চায় দানিয়েলের খবর। তার অন্তরমহলের চিন্তা ছফার বয়ানে জানতে পারি।
কোলকাতা শহরে আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে দিন কাটাচ্ছি, বিশেষ করে মুসলমান ছেলেরা। আমাদের সঙ্গে মা, বোন বা পরিবারের কেউ আসেনি। সে কারণে শরণার্থী শিবিরে আমাদের ঠাঁই হয়নি। আমরাও শিবিরের মানুষদের প্রাণান্তকর কষ্ট দেখে মানে মানে শহরের দিকে ছিটকে পড়েছি এবং কোলকাতা শহরে গুলতানি মেরে সময় যাপন করছি। একজন আরেকজনকে ল্যাং মারছি। বাংলাদেশের ফর্সা কাপড়চোপড় পরা অধিকাংশ মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন বেকার জীবনযাপনের ক্লেদ কোলকাতার হাওয়া দূষিত করে তুলেছে। আমরা সে হাওয়াতে শ্বাস টানছি। সীমান্তে একটা যুদ্ধ হচ্ছে, দেশের ভেতরেও একটা যুদ্ধ চলছে। অবস্থানগত কারণে আমরা সে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? যুদ্ধে চলে গেলে ভালো হতো। দেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটুকু করতে পারতাম জানিনে। তবে বেঁচে থাকবার একটা উদ্দেশ্য চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। আমার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধকে ভয় করি বলে নয়। আমাদের দেশের যে সকল মানুষের হাতে যুদ্ধের দায়দায়িত্ব, তারা আমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবার উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেননি। আমি তিন তিনবার চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই মহাপুরুষদের দৃষ্টি আমার ওপর পড়েছে। অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছেন, আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন? আপনার মতো ক্রিয়েটিভ মানুষের কতো কিছু করবার আছে। যান কোলকাতায় যান। সেই থেকে কোলকাতায় আছি। হাঁটতে, বসতে, চলতে, ফিরতে মনে হয় শূন্যের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছি। ... ৫
দানিয়েলের এইসব অন্তুর্গত ভাবনা তায়েবাকে আর জানানো হয় না। কোলকাতায় ডেরা পাততে এসে অনেক তরুণ দিনের পর দিন খোলা রাস্তার ওপর রোদ বৃষ্টির মধ্যে দিন কাটিয়েছে। অন্যদিকে কিছু লোক ব্যাংক থেকে পয়সা কি সোনা হাতিয়ে দেদারসে পয়সা ওড়াচ্ছে। বার ও নাইটক্লাব বাংলাদেশীতে সয়লাব। ভারত সরকারের অতিথি হয়ে মহানন্দে এরা দিন কাটাচ্ছে। এদের সাথে থিয়েটার রোডের কর্তাব্যক্তিদের যোগাযোগ নেই বলা যাবে না। ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন সোনাগাছির রেডলাইট এলাকায়। পুলিশ পরে পরিচয় জানতে পেরে ছেড়ে দেয়।
যুদ্ধের অঙ্গন ছেড়ে আসা লোকজনের এই বিকৃতিগুলো বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল চারপাশে। শরাণার্থী শিবিরগুলোতে অবর্ণনীয় কষ্ট। ক্যাম্পে প্রতিদিন মারা যাচ্ছিল শিশু আর বৃদ্ধ। সৎকারের কোন ব্যবস্থা নেই। মৃতদেহ পাশে রেখে পরিবারের লোকজন মরিচ মেখে বাসী ভাত খাবার দৃশ্য পর্যন্ত দেখেছেন দানিয়েলের নরেশদা।
জাহিদুল হক রাশেদা খাতুন দম্পতির মধ্যে ডোরা ঢুকে পড়ে। বয়স্ক স্বামীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রাশেদা শশীভূষণ নামের একজনকে নিয়ে শান্তিনিকেতন চলে যান। বেশি দেরি না করে জাহিদুল ডোরাকে নিকে করে ফেলে। তায়েবা ছোটোবোন ডোরাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে আবার জাহিদুলকে বাবার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করত। ফলে এই কিম্ভূত অজাচারে তায়েবার অসুস্থ না হয়ে উপায় থাকে না। দানিয়েল আর কাউকে না পেয়ে তায়েবার অসুস্থতার জন্য প্রাথমিকভাবে জাহিদুল-ডোরাকেই দায়ী করে। দানিয়েল তার রাগ চেপে রাখে না। ডঃ মাইতির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলে।
আপনি অনেক আনকোরা তরুণের মধ্যে জীবনের মহত্তর সম্ভাবনা বিকশিত হয়ে উঠতে দেখেছেন, একথা যেমন সত্যি, তেমনি পাশাপাশি একথাও সত্য যে যুদ্ধের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠিত মহাপুরুষের খোলস ফেটে খান খান হয়ে পড়েছে এবং আমরা এতোকালের ব্যাঘ্র চর্মাবৃত ছাগলদের চেহারা আপন স্বরূপে দেখতে পাচ্ছি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমাদের দুর্দশার সীমা নেই। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে আমাদের তরুণ ছেলেরা হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন দেখতে পাচ্ছি। দেশের ভেতরের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখানে কোলকাতায় সাদা কাপড়চোপড় পরা ভদ্রলোকের মধ্যে স্খলন, পতন, যতো রকমেই নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, তার সবগুলোর প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। এখানে যত্রতত্র শুনতে পাচ্ছি, আধবুড়ো মানুষেরা যত্রতত্র বিয়ে করে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে এই ভদ্রলোকদের তুলনায় কম নিষ্ঠুর মনে হয় না।… ৬
যুদ্ধের সময়ে বাসনার এই অসংযম দানিয়েলকে আহত করে। ব্যক্তিবিশেষের অজাচার এক হিসেবে রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ভেবে নেয়। জয়সিংহ ব্যানার্জী আর তার যজমানের মেয়ের ক্ষেত্রে একই ঘটনা। মেয়েটার কোন অভিভাবক নেই। পোষার দায়িত্ব স্বভাবত জয়সিংহ ঘাড়ে নেন। কিন্তু আসল ঘটনা জানা যায় অন্য একজনের মুখে।
শালা বদমাইশ বাউন, মা আর বুন দুইডা ক্যাম্পে কাঁইদ্যা চোখ ফুলাইয়া ফেলাইছে। আর হারামজাদা মাইয়াডারে কইলকাতা টাউনে আইন্যা মজা করবার লাগছে। আর ওই মাগীডাও একটা খানকি।… ৭
রেজোয়ান নামক এক যুবকের আত্মহত্যার পেছনেও নর-নারীর সম্পর্ক। রেজোয়ানের বোন এক পাকিস্তানি মেজরকে বিয়ে করে ফেলেছে। এই শক কাটাতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে। একটা চিঠি রেখে যায়। দানিয়েলের বেশে আহমদ ছফা রেজোয়ানের মৃত্যুর জন্য যুদ্ধকে দায়ী করেন।
বড়ো আপা, যাকে আমি বিশ্বাস করতাম সবচাইতে বেশি, সে একজন পাকিস্তানি মেজরের স্ত্রী হিসেবে তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোচ্ছে, একথা আমি চিন্তা করতে পারিনে। দেশে থাকলে বড়োআপা এবং মেজরকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতাম। এখন আমি ভারতে। সুতরাং সে উপায় নেই। অথচ প্রতিশোধ স্পৃহায় আমার রক্ত এতো পাগল হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত নিজেকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই। … ৮
সিপিএম বাংলাদেশ ইস্যুতে কংগ্রেসের ভূমিকাতে ফাঁকফোকর নিয়ে বেশ চড়া টোনে থাকত। ইয়াহিয়া আর ইন্দিরার মধ্যে যোগসূত্র আনার জন্য রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতরে করা নাটকে এক সিপিএম কর্মীর অনুরোধে এক চরিত্রের কণ্ঠ দিয়ে বলানো হয় ‘এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার জনগণের যে জাগ্রত সহানুভূতি ইন্দিরাজী সেটাকেই নিজের এবং দলের আখের গুছাবার কাজে লাগাচ্ছেন। এতোকাল সিপিএম বলতো শাসক কংগ্রেস বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধাপ্পা দিচ্ছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠাবার কোনো কর্মপন্থা গ্রহণ করবে না। এখন সে কথা সবাই বলছে। এই তো সেদিন যুগান্তরের মতো কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকায় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সাংবাদিকও লিখতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা তুঙ্গে উঠেছে। আর ওদিকে শ্রীমতি ইউরোপ, আমেরিকায় ‘বাবু’ ধরে বেড়াচ্ছেন। … ৯
জয়বাংলার বাবু দানিয়েল থাকেন ছাত্রদের এক হোস্টেলে। অজন্তা ছাত্রাবাস। সেখানে অনেক ছাত্রদেরই আসল নিবাস পূর্ব বাংলা। অনেকের গায়ে টোকা দিলেই গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ এইসব এলাকার গন্ধ পাওয়া যায়। সাম্প্রদায়িকতায় টিকতে না পেরে বা গা বাঁচাতে এরা এপাড়ে চলে এসেছে।
কোলকাতা শহরে থাকে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে ঢেউ খেলছে পূর্ববাংলার দীঘল বাঁকের নদী, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, হাটঘাট, ক্ষেতফসল, গরুবাছুর। আমি গোসল করতে গেলেই নিজেরা বলাবলি করতো, কিভাবে একজনের বোনকে মুসলমান চেয়ারম্যানের ছেলে অপমান করেছে। অন্যজন বলতো পাশের গাঁয়ের মুসলমানেরা এক রাতের মধ্যে ক্ষেতের সব ফসল কেটে নিয়ে গেছে। ছোটোখাটো একটি ছেলে তো প্রায় প্রতিদিন উর্দু পড়াবার মৌলবীকে নিয়ে নতুন কৌতুক রচনা করতো। ভাবতাম আমাকে নেহায়েত কষ্ট দেয়ার জন্যই এরা এসব বলাবলি করছে। অথচ মনে মনে প্রতিবাদ করার ও কিছু নেই। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য। উঃ সংখ্যালঘু হওয়ার কি যন্ত্রণা! তাদের কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হতো সুলতান আহমেদ, আলাউদ্দিন খিলজী থেকে শুরু করে আওরেঙ্গজেব পর্যন্ত যতো হিন্দুদের ওপর হয়েছে তার জন্য যেনো আমিই অপরাধী। মাঝে মাঝে ভাবতাম, বার্মা কি আফগানিস্তান কোথাও চলে যাওয়া যায় না। এখন অবশ্য আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন এসেছে। যেখানেই পৃথিবীর দুর্বলের ওপর অত্যাচার হয়, মনে হয়, আমি নিজেও তার জন্য অল্প বিস্তর দায়ী। কেনো এসব অনুভূতি হয় বলতে পারবো না। এখন আমাকে সবাই সমাদর করে। আমি অসুস্থ মানুষ বলে কেউ কেউ আমাকে বালতিতে পানি ভরতি করে দিয়ে যায়। সম্যক পরিচয়ের অভাবই হচ্ছে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের মূল। … ১০
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাজে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। লিফলেট বিলি করে শেখ মনির প্রচারণার কথা ছফা উল্লেখ করেছেন।
লিফলেটটি আগরতলা থেকে বেরিয়েছে। সংক্ষেপে তার মর্মবস্তু এ রকম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে ধরা পড়বার আগে এক ঘরোয়া সভা ডেকেছিলেন। তাতে তিনি যদি পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন, কী কী করতে হবে সে সকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ওই সভায় একজন নাকি শেখ সাহেবের কাছে সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলো, বঙ্গবন্ধু, আপনার অবর্তমানে আমরা কার নেতৃত্ব মেনে চলবো? শেখ সাহেব আঙুল তুলে শেখ মনিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, তোমরা এর নেতৃত্ব মেনে চলবে। … ১১
আগরতলাতে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলের মধ্যে সম্মুখসমরের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিলো। প্রতিবাদে সেখানকার মানুষ মিছিল করে এই হানাহানি বন্ধের ব্যবস্থা নিয়েছিলো।
তায়েবার সাথে দানিয়েলের প্রীতির সম্পর্ক ছিল কিন্তু প্রেমে মোড় নেয়ার আগেই তায়েবা অসুখ বাঁধিয়ে বসে। সেই অসুখ সারার সম্ভাবনা ও নেই। তায়েবা এক কথায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে এইটুকু বলা যায়। তায়েবার অসুখ নিয়ে কথা পাড়তে গিয়ে ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে ভদ্রলোকের সাথে নানা কিছু নিয়ে আলোচনা হয় দানিয়েলের। যুদ্ধকালীন সময়ে কোলকাতার মানুষের সাহায্যের কথা দানিয়েল নির্দ্বিধায় স্বীকার করে।
বাঙালি এবং বাঙালিত্বের প্রতি পশ্চিম বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের একটা অতুলনীয় সহানুভূতি এবং জাগ্রত মমত্ববোধ আছে বলেই এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিরদাঁড়া উঁচু করে থাকতে পেরেছে। পশ্চিমবাংলার বদলে যদি গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় গ্রহণ করতে হতো, ভারত সরকার যতো সাহায্যই করুক না কেনো, আমাদের সংগ্রামের অবস্থা এখন যা তার চাইতে অনেক খারাপ হতো। পশ্চিম বাংলার মানুষের আবেগ, উত্তাপ এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণবন্ত এবং সজীব রেখেছে। …১২
দানিয়েল সেখানেই রাত গুজরান দেয়। একটা স্বপ্নও দেখে। তার আব্বা এসেছেন। তাঁর পরনে ধুতি। সুন্দর জামাকাপড় পরার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে আব্বা জানান- বেটা জানো না বুঝি, আজ তোমার বিয়ে। এতে অবাক হলে আব্বা জানান-এমন মাঝে মাঝে হয়। এই উপলক্ষ্যে চাপকান কি শাল চাইলে জানানো হয় সাদা ধুতি পড়েই বিয়ে করতে যেতে হবে। যাওয়ার জন্য কোনো ঘোড়ার গাড়ির এন্তেজাম নাই। বরং একটা খাটিয়া করে চারজন লোক দানিয়েলকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সুর করে বলা হচ্ছে- বলো মোমিন আল্লা বলো। খাটিয়া বহনকারী একজন বলে ওঠে- এই লাশ পাথরের মতো ভারী। আর বয়ে নিতে পারবো না। কাঁধ থেকে কাত করে দানিয়েলকে তারা রাস্তার ওপর ঢেলে দিলো।
উপন্যাসের কেন্দ্রে এসে এই স্বপ্ন কিছুটা সুলুক দেয়। বাসনা কামনা ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব নয়। অন্যের কামনা নিজের কামনা হয়ে প্রকাশ নেয়। বাবার বাসনা দানিয়েলের বাসনা হয়ে যায়। বাঙালি মুসলমান আসলে জানে না সে কী চায়। ফ্রয়েডের স্বপ্ন তত্ত্ব আর জাঁক লাঁকার সেমিনার দিয়ে সলিমুল্লাহ খান এর ব্যাখ্যা হাজির করেছেন ‘রাষ্ট্র ও বাসনাঃ আহমদ ছফার বিষাদ-সিন্ধু’ প্রবন্ধে।
দানিয়েলের আবাসে প্রতিদিন রীতিমতো কনফারেন্স বসে। আলোচনা ঘিরে থাকে শেখ মুজিব , তাজউদ্দিন , থিয়েটার রোডের লোকজনের কাজকারবার।
আপনার মাও সে তুং এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে কী করছেন, সে খবর রাখেন? পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশে খুন, জখম, হত্যা, ধর্ষণ সবকিছু অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। আর আপনার মাও সে তুং সে ইয়াহিয়ার জল্লাদ সৈন্যদের ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ ভর্তি করে বোমা,কামান, অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। ... ১৩… বাংলাদেশের সালাম এবার মুখ খুললো। মওলানা ভাসানী মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, যাতে চীন পাকিস্তানের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে কোনো রকম সহায়তা না করে। আরে থোন ফালাইয়া, আপনার মওলানা ভাসানীর টেলিগ্রাম দুইখান চৌ এন লাই আর মাও সে তুং যতন কইরা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে থুইয়া রাখছে। মওলানা এখন ইন্ডিয়া কেনো আইছে কইবার পারেন? তাবিজ দেয়ার মৌলবী, আপনেরা তারে বিপ্লবী লিডার বানাইছেন। কথাগুলো খুরশিদের। … ১৪
খুরশিদ নিজেকে আওয়ামী লীগের লোক বলে জাহির করে। হাই কমান্ডের লোকজন যদিও খুব একটা পাত্তা দেয় না। আসল জায়গায় ঢুকতে না পেরে দানিয়েলের ডেরায় আওয়ামী লীগ বিরোধীদের মুণ্ডুপাত করে। আড্ডায় মওলানার প্রসঙ্গ চাপা পড়ে শেখ মুজিব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
খুরশিদ বললো, থিয়েটার রোডের যে সকল মাস্তান আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে সব কিছু লুটপাট করে খাচ্ছে, এখানে বঙ্গবন্ধু হাজির থাকলে পেঁদিয়ে তাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। সালাম ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো, আরে রাখো তোমার বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিদের সঙ্গে শলাপরামার্শ করেই ধরা দিয়েছে। পৃথিবীর কোন বিপ্লবী নেতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তোমার ওই বঙ্গবন্ধুর মতো শত্রুর কাছে সগৌরবে আত্মসমর্পন করেছে তার কোনো নজির আছে কী? শেখ মুজিব সব সময় স্যুটকেস গুছিয়ে রাখতেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই জেলে চলে যেতেন, আর আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে বিজয়ী বীরের বেশে জেলখানা থেকে বেরিয়ে ক্রেডিটটুকু নিতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। শেখ পাকিস্তানের জেলে আর আমরা এখানে কোলকাতার পথে পথে ভেরেন্ডা ভেজে চলছি। এই অবস্থাটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তোমার ওই শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ। শেখের মতো এতো বড়ো জাতীয় বেঈমান আর দ্বিতীয়টি নেই। খুরশিদ হুংকার দিয়ে উঠলো, খবরদার সালাম, ছোটো মুখে বড়ো কথা বলবে না। অন্য লোকের নাম বললে কিছু মনে করতাম না। বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু বললে মুখের বত্রিশটি দাঁতের একটিও আস্ত রাখবো না। … ১৫
দানিয়েল একদিন যায় পশ্চিমবঙ্গে তার একমাত্র পরিচিত অর্চনার বাসায়। অর্চনা একসময় নকশাল আন্দোলন করত। কোলকাতার একটা কলেজে ফিলোসফির মাস্টারনি। লেখালেখির সূত্র ধরে তাদের পরিচয়। অর্চনাকে জানায় তায়েবার কথা। সেখানে দুজন ভদ্রলোকের সাথে দানিয়েলের দেখা হয়। সত্যব্রত আর অনিমেষ। সত্যব্রতবাবু পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে যুদ্ধের সমস্ত মাঠ ছেড়ে দিয়ে ভারতে পাড়ি জমানো দিয়ে কথা শুরু করেন। অনিমেষবাবু আশংকা প্রকাশ করতে থাকেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হবে। কংগ্রেসের এই সুযোগে জল ঘোলার কথা বলে সত্যব্রত। অর্চনা এর প্রতিবাদ করে। কংগ্রেসের ভুল না ধরে বরং বামপন্থী দলগুলোর আচরণ দেখা উচিত। বাংলাদেশের এই জাতীয় সংগ্রামে তাদের সমর্থন নেই। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান থেকে তারা সরে আসছে না। পাকিস্তানের সাথে চীনের বন্ধুত্ব- তাই পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া তারা অব্যাহত রেখেছে। প্যাঁচগোজের এই আলোচনা সরিয়ে অর্চনার বড়ভাই সুনীল সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। … দেখবে একদিন তোমাদের জয় হবেই। এ তোমাদের ন্যায়যুদ্ধ। জানো তো, যথা ধর্ম তথা জয়। ধর্ম তোমাদের পক্ষে। …১৬ কথা যুদ্ধ পাল্টে জাগতিকতার উর্ধ্বে চলে যায়। … মানুষের মনে এই যে ট্যানশন তার পেছনে দু’টি কারণ, একটি হলো লোভ, অন্যটি অনিশ্চয়তা। মনের ভেতর থেকে এই দু’বস্তুর অবসান ঘটাতে পারলে দেখবে জীবন অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে। … ১৭
তায়েবাকে হাসপাতালে দেখতে গেলে তায়েবার মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। জাহিদুল, ডোরা সেখানে হাজির ছিল। আশ্চর্য খোশগল্পের আবহাওয়া। দানিয়েল অবাক হয়। …
তায়েবা জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ডোরা তার জীবনের মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটিয়ে বসে আছে। আমাদের সকলের অস্তিত্ব চিকন সুতোয় ঝুলছে। এই ধরনের অবস্থায় নির্বিকার মুখ ঢেকে এঁরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের আলোচনা কি করে করতে পারেন। জীবন সম্ভবত এ রকমই। আঘাত যতো মারাত্মক হোক, দুঃখ যতো মর্মান্তিক হোক, এক সময় জীবন সব কিছু মেনে নেয়। দুনিয়াতে সব চাইতে আশ্চর্য মানুষের জীবন। … ১৮
‘অলাতচক্র’ উপন্যাস পড়লে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক গবেষণাগ্রন্থ পড়ার কষ্ট বেঁচে যায়। ছফা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সাথে ইতিহাসের কিছু সহিপাঠ গল্পচ্ছলে আমাদের বলে দেন। কোনো চরিত্রের মুখ থেকে বের হওয়া তথ্যের বিশ্লেষণ সময়মতো দানিয়েলের চিন্তাভাবনার মধ্যে প্রকাশ পায়।
… থিয়েটার রোডের লোকদের বিরুদ্ধে এসব নালিশ নতুন নয়। সবাই নালিশ করে। কিন্তু তাদের করবার ক্ষমতা কতোদূর তা নিয়ে কেউ বিশেষ চিন্তাভাবনা করে বলে মনে করে না। আমি মনে মনে তাজুদ্দিনের তারিফ করি। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমার বিশ্বাস সবদিক চিন্তা করে দেখার ক্ষমতা তাঁর আছে। কিন্তু তিনি কতোদূর কি করবেন। আওয়ামী লীগারদের মধ্যে অনেকগুলো উপদল। ভারত সরকার সবক’টা উপদলকে হাতে রাখার চেষ্টা করছে। আবার তাদের অনেকেই তাজুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। পাকিস্তানি এবং আমেরিকান গুপ্তচরেরা এখানে ওখানে ফাঁদ পেতে রেখেছে। তাদের খপ্পরে আওয়ামী লীগারদের একটা অংশ যে পড়ছে না, একথাও সত্যি নয়। … ১৯
আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে তাঁর করা উপপাদ্যের সরলপাঠ দানিয়েলের অন্তর্গত ভাবনার মধ্যে সহজে বলে দেন। একটা গোঁজামিলের আভাস দেন। এই গোঁজামিল কী জিনিস?
যে বাঙালি মুসলমানদের অকুণ্ঠ আত্মদানে পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিলো, সেই পাকিস্তানই তিরিশ বছর ধরে তাদের বুকের ওপর বসে তাদের ধর্ষণ করেছে। একটা জাতি এতোবড় একটা ভুল করতে পারে? কোথায় জানি একটা গড়বড়, একটা গোঁজামিল আছে। আমরা সকলে সেই গোঁজামিলটা ব্যক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে অদ্যাবধি বহন করে চলেছি। পাকিস্তানের গণপরিষদে তো পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাভাষার দাবিটি তো তারা সমর্থন করতে পারতেন। হলেনই বা মুসলিম লীগার। তবু তাঁরা কি এদেশের মানুষ ছিলেন না? তবু কেনো, বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের ছাত্র তরুণদের প্রাণ দিতে হলো? পূর্বপুরুষদের ভুল এবং ইতিহাসের তামাদি শোধ করার জন্য কি এই জাতিটির জন্ম হয়েছে?
উনিশশো আটচল্লিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এই জাতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আর চূড়ান্ত মুহূর্তটিতে আমাদের সবাইকে দেশ ও গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় ছিলো, সুযোগ ছিলো। কোলাহল আর চিৎকার করেই আমরা সেই সুযোগ এবং সময়ের অপব্যবহার করেছি। পাকিস্তানের কর্তাদের আমরা আমাদের বোকা বানাতে সুযোগ দিয়েছি। তারা সৈন্য এনে ক্যান্টনমেন্টগুলো ভরিয়ে ফেলেছে এবং সুযোগ বুঝে পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা আমাদের যুদ্ধটাকে কাঁধে বয়ে ভারতে চলে এসেছি। হয়তো যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। তারপর কি হবে? আমাদের যুদ্ধটা ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মন বলছে পাকিস্তান হারবে, হারতে বাধ্য। কিন্তু আমরা কি পাবো? ইতিহাসের যে গোঁজামিল, আমরা বংশপরম্পরায় রক্তধারার মধ্য দিয়ে বহন করে চলেছি তার কি কোনো সমাধান হবে? কে জানে কি আছে ভবিষ্যেতে। … ২০
আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখে রেডিওতে শোনা গেল ইয়াহিয়ার দম্ভোক্তি। এইসব শুনে দিনের অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে দানিয়েল যায় অর্চনার বাসায়। সেখানে অর্চনার প্যারিস ফেরত দাদা প্রমোদের সাথে দেখা হয়। সাতাশ আটাশ বছর আগেকার
পূর্ব-বাংলার স্মৃতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন। ভদ্রলোক নিজের ভাবাগোনা নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন।
মুক্তিযুদ্ধ যদি জয়যুক্ত হয় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানেন এটা একটা বিরাট ব্যাপার। বাংলার ইতিহাসে আমি যতদূর জানি, এই ভূখণ্ডে বিক্ষোভ বিদ্রোহের অন্ত নেই। কিন্তু বাঙালি আপন প্রতিভা বলে নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারে তাহলে একটা অভিনব ব্যাপার হবে। কোলকাতায় খোঁজখবর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তা থেকে স্থির কোনো ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন মুজিব একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সোহ্রাওয়ার্দীর চ্যালা ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি মহাত্মাজীর মন্ত্রশিষ্য। অহিংস অসহযোগ নীতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এই বিরাট গণসংগ্রাম রচনা করেছেন। দু’চারজন কমিউনিস্ট বন্ধুর কাছে জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি তাতে সংশয়টা আরো বেড়ে গেলো। মুজিব নাকি ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী। মুজিব লোকটা কেমন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কি সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আমার কাছে সবটা ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়া ছায়া মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষটার ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নইলে তাঁর ডাকে এতোগুলো মানুষ বেরিয়ে এলো কেমন করে। আমি টিভিতে মুজিবের অনেকগুলো জনসভার ছবি দেখেছি। দেখার সময় শরীরের পশম সোজা হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম মারমুখী মানুষের ঢল আমি কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। … বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সামান্য অধিকার আছে, তা দিয়েই বলতে পারি ভারতবর্ষের বহু জাতি এবং বহু ভাষার একটা মহাদেশ। উনিশশো সাতচল্লিশে ধর্মের প্রশ্নটি যখন মুখ্য হয়ে অন্য সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়েছিলো। আরো একটা কথা, নানা অনগ্রসর পশ্চাৎপদ জাতি এবং অঞ্চলের জনগণ তাদের প্রকৃত দাবি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই আপার সমাধান হিসেবে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্র দু’টির জন্ম হয়েছিলো। পরিস্থিতি যে রকম দেখা যাচ্ছে , পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র জন্ম দিতে যাচ্ছে। একথা যদি বলি আশা করি অন্যায় হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। …২১
ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কারণে ভারত রাষ্ট্রের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দেয়ার তত্ত্বটি ছফা অনেক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। ভারতে কিছু আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা আছে। তবে সেটা আমলে দেয়ার মতো আকার ধারণ করে নাই।
উইল ডুরান্টের ‘সিজার এন্ড খ্রিস্ট’ বইতে রোমান সাম্রাজ্যের পতন নিয়ে লেখা ছিল- A great civilization is not conquered from without until it has destroyed itself within. The essential causes of Rome’s decline lay in her people, her morals, her class struggle, her failing trade, her bureaucratic despotism, her stifling taxes, her consuming wars.
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ থেকে সহায়তা করেছে। তবে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি আমাদের অমিত সাহস দিয়ে। রক্ত দিয়ে। আর অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গিয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে আমাদের দুর্দশা আরো তীব্র হতো। ডুরান্টের তত্ত্বমতে ভেঙে চুরমার হয়ে আবার নতুন করে হয়তো সব শুরু হত। তবে শোষিত হবার ইতিহাস আমাদের কম প্রাচীন নয়। এসবের মধ্যে আমাদের দীর্ঘকাল অতিবাহিত করতে হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে ঊনচল্লিশ বছর ধরে আমরা বিশ্ব মানচিত্রে শিরদাঁড়া সোজা করে টিকে আছি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। তবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির জন্য। যুদ্ধ দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব হওয়ার সাথে এর সম্পর্ক কম।
অলাতচক্র উপন্যাসে ছফার কৃতিত্ব সত্যনিষ্ঠ থাকার। এমনকি নিজের আওড়ানো কথার ওপর নিজেই পরে কঠোর হন। উপন্যাসে জয়েসীয় স্ট্রিম অব কনসাসনেস থাকলেও ছফার সহজ পাঠকবান্ধব গদ্যশৈলীর জন্য কোন জায়গায় আটকে যেতে হয় না। জাহিদুল ডোরাকে নিয়ে দানিয়েলের মধ্যের অস্বস্তি অনেক জায়গায় এসে গেছে। দানিয়েলের করা অনুসিদ্ধান্ত এক জায়গায় টলে যায়।
ডোরা জাহিদুলকে বিয়ে করেছে। তাতে এমন অন্যায়টা কি হয়েছে? এরকম অনেক তো ঘটে। হেনা ভাই একটা বিধবা মেয়েকে এ সময়ে বিয়ে করে অপরাধ কি করেছে? মহিলা এবং হেনা ভাই পরস্পরকে পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছে। আমি একধারসে সকলকে অপরাধী মনে করি কেন? পৃথিবীর সকলে ঘোরতর পাপে লিপ্ত, আর আমি একা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এ কেমন করে হয়। … ২২
উপন্যাসের অধ্যায় বারোতে রয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ছফার বিশ্লেষণ। ব্যাখ্যায় না গিয়ে কিছু সারকথা জড়ো করলে একসাথে অনেক তথ্য জানা যায়।
… নাদুসনুদুস নেতারা স্নো-পাউডার চর্চিত মুখমণ্ডল এবং স্নিগ্ধ তেলঢালা শরীর নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পেছন পেছন হাজির হয়ে জনসভায় বক্তৃতার ঢঙে হাত উঠিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর নকল করে বলতে থাকেন, ভাইসব, তোমরা বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। তোমরাই বাংলা জননীকে মুক্ত করবে। সেই দামাল ছেলেরা তখন তাঁদের অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে শালা বাঞ্চোত বলে গালাগাল করে। … ২৩ … তাজুদ্দিন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে। নিজদের স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা বিশেষ নেই। সব সময় ভারত যা বলছে, সায় দিতে যাচ্ছে, যা চাপিয়ে দিচ্ছে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের বিপক্ষে কেউ কিছু বলতে সাহস না করলেও আওয়ামী লীগের একাংশ আমেরিকার মাধ্যমে গোপনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের যুক্তি একটাই ভারত কখনো বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবে না, সুতরাং ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় আসাই হবে সবচেয়ে ভালো কাজ। … ২৪… পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে ভারতকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করবে। যদি একটা যুদ্ধ সত্যি সত্যি লাগে, পাকিস্তানের মিত্র চীন কিংবা আমেরিকা যদি পাকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো অসম্ভব। ভারতবর্ষ কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটা বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি আপন কাঁধে নিতে পারে, বোধ করি শ্রীমতি গান্ধী চাইছিলেন যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক। … ২৫… পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুর নরমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছে, যে রক্তস্রোত বইয়েছে, যেভাবে অগ্নিসংযোগ এবং নরহত্যার আয়োজন করেছে, তাতে করে দু’অংশের জনগণের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের শেষ সম্ভাবনাটুকু চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে আসন্ন সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কখনো ভারতের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ভারত একটি দুর্বল পাকিস্তান চায়। বিনা যুদ্ধে যদি সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়, যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি খুঁজে পান না। …২৬ … মাঝখানে পরিস্থিতি একেবারে থিতিয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এভাবেই সব কিছু চলতে থাকবে। যেখানেই যাই, সর্বত্র থমথমে পরিবেশ, কি ঘটবে, কি ঘটতে যাচ্ছে কেউ কিছু বলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দলাদলি ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওর বিরুদ্ধে বলছে, অমুক অমুকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কোলকাতার মানুষেরা আমাদের উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আর কতো। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, পার্কে, মাঠে, ময়দানে সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ দেখে দেখে তাদের চোখ পচে গেছে। … ২৭… এম. আর. আখতার মুকুল যখন স্বাধীনবাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে চরমপত্র পাঠ করেন তখন দোকানের সামনে আস্তে আস্তে লোক জমতে থাকে, তখন দোকানীর আওয়াজটা বাড়িয়ে না দিয়ে উপায় থাকে না। লোকজন শুনে এম. আর. মুকুলের কড়া রসিকতা চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। এম. আর. আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডুবাচ্ছেন, সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রীজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সৃষ্টি করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যতো পাকিস্তানি সৈন্য খুন করেছেন, জখম করেছেন, যতো ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যতো কনভয় ধ্বংস করেছেন সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানি সৈন্য বাংলার মাটিতে থাকার কথা নয়। তার পরদিন সন্ধ্যায় আবার সৈন্য মারতে আসেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবি এতো সৈন্য তিনি কোথায় পান। … ২৮ … কার্যক্রম যতোই অপ্রতুল হোক না কেনো এম. আর. আখতারের কণ্ঠ শুনে মনে একটা বিশ্বাস ঘনিয়ে উঠতো। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের নদী, আমাদের বনাঞ্চল, আমাদের বাঘ, আমাদের প্যাঁক পাকিস্তানি সৈন্য ধ্বংস করার অলৌকিক ক্ষমতা রাখে। …২৯ … শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বোধ করি মনস্থির করে ফেলেছেন, তাঁকে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাঁর কথাবার্তা, বিবৃতি ভাষণের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য পরিষ্কার ফুটে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের বেগও তীব্র হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।… ৩০ … শ্রীমতী গান্ধীর রাশিয়া সফরের পর থেকে রাশিয়ান নেতাদের মন্তব্যের ধরন ও বেশ পাল্টে গেলো। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটা বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। দুই দেশের যে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রথমবারের মতো পূর্বপাকিস্তানের জায়গায় পূর্ববাংলা শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। … ৩১ … বাংলাদেশ ভারতের নৌকায় পা রেখেছে। সুতরাং ভারত যা করে বাংলাদেশকে অম্লানবদনে মেনে নিতে হবে। তারপরেও ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত একটি যুদ্ধ ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। ভারতের স্বার্থ থাকে থাকুক।… ৩২
মাঝখানে ব্যস্ততায় আর তায়েবার খোঁজ নেয়া হয়নি। পরে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে তাকে এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। সময় আর বেশি নেই। তায়েবার এই পরিণতির জন্য কাউকে না কাউকে দোষারোপ না করে শান্তি পাচ্ছিল না দানিয়েল। জাহিদুল হক, ডোরা, হেনা ভাই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘুরে শেষ বিচারে দানিয়েল এই পরিণতির জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে। … কাউকে দায়ী না করে আমার মন শান্তি পাচ্ছিলো না। তখনই মনে পড়ে গেলো তায়েবা নিজের মুখে বলেছে, সে আমাকে ভালবাসে, তাহলে কি আমিই তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী? …৩৩… পাশে চারজন মানুষ খাটিয়ায় করে একটা সাদা চাদরে ঢেকে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছিলো। দানিয়েলের মগজে তখন দার্শনিকতার উদয় হয়। … মানুষের জন্ম মৃত্যুর রহস্যটা আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। মৃত্যু সর্বব্যাপী ওঁত পেতে রয়েছে। কেউ কারো জন্য দায়ী নয়। … ৩৪
তায়েবা ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের সময় আসাদ হত্যাকাণ্ডের দিনে আয়ুববিরোধী আন্দোলনে ১৪৪ ধারা অমান্য করে পত্রপত্রিকায় আলোচনার বিষয়ে হয়েছিল। কোলকাতার পিজিতে সে নীরবে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে আর অলীক কল্পকন্যা রওশন আরা ভারতের জনগণের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।
দানিয়েলের সাংবাদিক বন্ধু বিকচ চৌধুরি প্রতিদিন সীমান্তে গিয়ে সংবাদ এনে সেটা ফুলিয়ে পত্রিকার চারটা কলাম ভরাট করতেন। বিকচ তার ছোটপত্রিকায় এতো সৈন্য মেরেছেন, এতো ট্যাঙ্ক ছারখার করেছেন আগরতলার মানুষ তাকে পাকিস্তানি সৈন্যদের যম ডাকতো। একদিন বৃষ্টির তোড়ে পড়ে তার সীমান্তে সংবাদ আনতে যাওয়া হলো না। ঘরে বসেই একটা কাহিনী ফাঁদা হলো।
… ফুলজান নামের এক যুবতী বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি সৈন্যের একটা আস্ত ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখিয়ে বললো, দেখতো খবরটা কেমনহয়েছে। আমি বললাম, দ্যা আইডিয়া ইজ গ্র্যান্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরকম একটা বীরকন্যা জন্মাতে পারলে খুব ভালো হয়। বিকচ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, আমরা যদি না লিখি তাহলে জন্মাবে কেমন করে। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। সে বাঁ চোখটা টিপে একটু হেসেছিলো। আমি বললাম, এক্ষেত্রে একটা সেকেন্ড থট দিতে হবে।
যে কোনো সংবাদ কি, কেনো, কোথায়, কখন, কিভাবে এই এতোগুলো কেনোর জবাব দিতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তোমার গল্প সেই শর্তগুলো পূরণ করেনি। ধরো নাম নির্বাচনের বিষয়টি তুমি বলেছো ফুলজান। এই নামটি একেবারেই চলতে পারে না। বাঙালি মুসলমানের নাম সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। তাই ফুলজান শব্দটি তোমার কলমের মুখে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ফুলজান যাদের নাম, তারা বড়োজোর হাঁড়ি পাতিল ঘষে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিতে পারে না। সুতরাং একটা জুতসই নাম দাও, যাতে শুনলে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের ভাব জাগবে। রওশন আরা নামটি মন্দ কি। বঙ্কিম এই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। নামের তো একাটা মাহাত্ম্য আছেই। রওশন আরা নাম যে মেয়ের, সে যেমন হৃদয়াবেগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জয়সিংদের ভালোবাসতে পারে; তেমনি দেশ জননীর প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতিও দিতে পারে। নামটা মনে ধরেছিলো বিকচের। তারপর গল্পের নিয়মেই বাকি ব্যাপারগুলো বেরিয়ে এসেছিলো। তার বাড়ি নাটোর। তার বাবা পুলিশ অফিসার। সে ইডেনে পড়তো এবং শেখ মুজিবের আত্মীয়া ইত্যাদি। বিকচ যদি রওশন আরার বাবার মর্যাদা পায়, আমাকে কাকা টাকা কিছু একটা বলতেই হবে। সংবাদটি সামনের পাতায় বক্স করে। আগরতলার মানুষ এটাকেও আরেকটা বিকচীয় উদ্ভাবন ধরে নিয়েছিলেন। কেউ হ্যাঁচ্ছোটিও করেননি।
মাসখানেক বাদে আমি যখন কোলকাতায় এলাম অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই কোলকাতা শহরে বিকচের কল্পকন্যাটির নবজন্ম ঘটে গেছে। আকাশবাণীর দেবদুলাল বাবুর কল্যাণে রওশন আরার পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রওশন আরার আত্মীয়স্বজনেরা রেডিওতে সাজানো সাক্ষাৎকার দিতে আরম্ভ করেছে।
তারপর থেকে ভারতের পত্র পত্রিকাসমূহ রওশন আরাকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। আনন্দবাজার যদি হেডলাইন করে, যুগান্তর ছাপছে জীবনবৃত্তান্ত। অমৃতবাজার উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। মিতভাষী বলে স্টেটসম্যানের সুনাম আছে। এই সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রটি সম্পাদকীয় কলামে রওশন আরার প্রতি শ্রদ্ধা্র্ঘ্য নিবেদন করেছিলো। পত্র পত্রিকায় প্রচার একটু থিতিয়ে এলেই রওশন আরাকে নিয়ে কবিমশায়রা কবিতা লিখতে এলেন। ... যুদ্ধের প্রথম বলিইতো সত্য। কিন্তু আমি বা বিকচ ইচ্ছে করলেই রওশন আরাকে নিরস্তিত্ব করতে পারিনে। আমরা যদি হলফ করেও বলি, না ঘটনাটি সত্য নয় রওশন আরা বলে কেউ নেই। সবটাই আমাদের কল্পনা। লোকজন আমাদের পাকিস্তানি স্পাই আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য ছুটে আসবে। … ৩৫
তায়েবাকে বাংলাদেশের মেটামরফোসিস হিসেবেই ছফা হাজির করতে চেয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে কোলকাতায় পা রাখা ছাড়া যার উপায় ছিলো না। কোলকাতায় সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিন গুনছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোলকাতায় বসে ভারতের ইশারার দিকে তাকিয়ে ছিল। মৃত্যুসম সেসব দিন।
একটি নারী দিনে দিনে নীরবে নিভৃতে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে একটি কেবিনে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরা জানতাম সে মারা যাবেই। মারা যাবার জন্যই সে কোলকাতা এসেছে। যুদ্ধ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, আর তায়েবাকে এখানে রেখে যেতে হবে। তায়েবা অত্যন্ত শান্তভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলো। … ৩৬
কিন্তু ছফা পরে বিপরীত সূত্র হাজির করেন। গাণিতিক ফ্যালিসিতে পড়ে বাংলাদেশ আর তায়েবা একদেহ এক আত্মা হতে পারে না। মহৎ সাহিত্যের কাতারে ফেলার জন্য দানিয়েলের অন্তর্গত ভাবনার একমুখিতা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অলাতচক্রে ভর করে।
… ডিসেম্বরের চার তারিখ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই দিন সন্ধ্যে থেকে সকাল পর্যন্ত গোটা কোলকাতা শহরে বিমান হামলার ভয়ে কোনো আলো জ্বলেনি। সেই ব্ল্যাক আউটের রাতে তায়েবার কাছে কোন ডাক্তার আসতে পারেনি। কোনো আত্মীয়স্বজন পাশে ছিলো না। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে যে অন্ধকার কোলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই অন্ধকারের মধ্যে তায়েবা আত্মবিসর্জন করলো। ৩৭
[/justify]
সূত্র
১। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পরিশিষ্ট]
২। আহমদ ছফা রচনাবলি- চতুর্থ খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [পৃষ্ঠা ২২১]
৩। অলাতচক্র- আহমদ ছফা ( শ্রীপ্রকাশ, জুন ২০০০) [পৃষ্ঠা ৬]
৪। আহমদ ছফা মহাফেজখানা , প্রথম খণ্ড , বেহাত বিপ্লব ১৯৭১ – সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত (অন্বেষা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৭) [পৃষ্ঠা ১৮০]
৫। অলাতচক্র- আহমদ ছফা ( শ্রীপ্রকাশ, জুন ২০০০) [পৃষ্ঠা ১২]
৬। [পৃষ্ঠা ৫২] ৭। [পৃষ্ঠা ৩৩] ৮।[পৃষ্ঠা ৮৬-৮৭] ৯।[পৃষ্ঠা ২৬]
১০। [পৃষ্ঠা ২৮-২৯] ১১। [পৃষ্ঠা ৩১] ১২।[পৃষ্ঠা ৪৮] ১৩।[পৃষ্ঠা ৬১]
১৪। [পৃষ্ঠা ৬১] ১৫। [পৃষ্ঠা ৬২] ১৬।[পৃষ্ঠা ৭০] ১৭।[পৃষ্ঠা ৭০]
১৮। [পৃষ্ঠা ৭২] ১৯। [পৃষ্ঠা ৮৪] ২০।[পৃষ্ঠা ৮৮] ২১।[পৃষ্ঠা ১০৮]
২২। [পৃষ্ঠা ১১৭] ২৩। [পৃষ্ঠা ১২৩] ২৪।[পৃষ্ঠা ১২৩] ২৫।[পৃষ্ঠা ১২৪]
২৬। [পৃষ্ঠা ১২৫] ২৭। [পৃষ্ঠা ১২৯] ২৮।[পৃষ্ঠা ১৩০] ২৯।[পৃষ্ঠা ১৩০]
৩০। [পৃষ্ঠা ১৩১] ৩১। [পৃষ্ঠা ১৩২] ৩২।[পৃষ্ঠা ১৩৩] ৩৩।[পৃষ্ঠা ১৩৪]
৩৪। [পৃষ্ঠা ১৩৪] ৩৫। [পৃষ্ঠা ১৪২-৪৩] ৩৬।[পৃষ্ঠা ১৪৪] ৩৭।[পৃষ্ঠা ১৪৪]
ছফাগিরি। কিস্তি নয়।
নতুন মন্তব্য করুন