ছফাগিরি। কিস্তি এগারো।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: বুধ, ১৬/০৬/২০১০ - ১০:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আহমদ ছফার আনন্দবাজার পত্রিকা নিয়ে লেখাগুলো প্রথমবার পাঠে খুব একটা স্বস্তিদায়ক মনে হয় না। জোর করে নিজের এংরি রাইটার ইমেজের খাতিরে বলে ফেলা বলে ভ্রম হয়। তবে অনেকগুলো লেখা মিলিয়ে পড়লে সঙ্গে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে
আনন্দবাজারের অতি উচ্ছ্বাসের পেছনের কথা জেনে নিলে ছফার করা উপপাদ্যগুলো নিয়ে ভাবিত হওয়া প্রয়োজন।

বাংলা একাডেমীর ‘অমর একুশে বইমেলা’তে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বই বিশেষতঃ আনন্দ প্রকাশনীর বই বিক্রি বন্ধের জন্য মুখ্য সঞ্চালক হিসেবে ছফা আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রকাশকদের সাথে লেখকদের বাঁচাতে ছফার এই ক্ষ্যাপাটে বিদ্রোহ পরে অনেকের সমর্থন পেয়েছিল। বইমেলায় আনন্দবাজারের প্রবেশ তখন বন্ধ হয়। সব জেনে আনন্দবাজারের বাদল বসু এক সাক্ষাৎকারে ছফাকে কদর্য গালি দেন। বাংলাদেশের শওকত ওসমান কোন লেখায় ছফাকে বাজে লোক বলে অভিহিত করেন। ছফা এই ঘটনার পরে একদিন শওকত ওসমানকে নিয়ে নিউমার্কেটে যান। দোকানে দোকানে জিজ্ঞেস করেন শওকত ওসমানের কোনো বই তাঁদের কাছে আছে কি না। কেউ এই লেখকের নাম পর্যন্ত শুনে নাই। সুনীল গাঙ্গুলীর কথা বলা মাত্র এক ডালি বই দোকানদারেরা সামনে হাজির করেন। এই অবস্থা দেখে ছফা শওকত ওসমানকে জিজ্ঞেস করেন, দেশটা আমরা বাল ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি? … হুমায়ূন আহমদের একটা সাক্ষাৎকারে জানতে পারি- ছোটবেলা থেকে হিন্দু লেখকদের বই পড়তে পড়তে একসময় তাঁর মাথায় প্রশ্ন আসে, মুসলমান লেখকদের লেখা বই কম কেন? তখন থেকে লেখালেখির একটা জেদ তাঁর মাথার মধ্যে কুটুরকুটুর করতে থাকে। আপাতভাবে এইসব প্রসঙ্গ খুব একটা স্বাভাবিক আচরণ মনে না হলেও ঘটনা অসত্য নয়। ছফার মাধ্যমেই এর মুখ ও মুখোশ দেখি।

…সারা বাংলা জুড়ে নানা বাঁকে নানা সাহিত্য তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাহিত্যে এখানকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, এখানকার জীবন, সং গ্রাম, রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এসব নিয়ে লেখা হবে। পশ্চিম বাংলার সাহিত্য সেখানকার মত করে বিকশিত হবে। তবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটা স্বতন্ত্র। বাংলা এখানে রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় ভাষা। …

পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোটাদাগে একটা তফাত তৈরি করে ছফা তাঁর বিশ্লেষণ শুরু করেন। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা, পশ্চিমবঙ্গে সেটা একটা প্রাদেশিক ভাষা বৈ কিছু নয়। বাংলা সাহিত্যে ওপার বাংলার অবদান কম নয়। রেঁনেসাস সাহিত্যের প্রায় পুরো কৃতিত্ব তাঁদের দেয়া যায়। বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় প্রমুখ সতীদাহ রোধ, বিধবা বিবাহ নিয়ে যেসব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেগুলো বাঙালি মুসলমানের সমস্যা ছিল না। … আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সামনে এ ধারণা স্পষ্ট না থাকায় তাঁরা বাংলাদেশের ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রটি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন না। তাই সংস্কৃতির কোন মূল্যমানটি নিয়ামক এবং পথপদর্শক শক্তি হিসেবে জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন সে ব্যাপারে তাঁদের কোন চিন্তাভাবনা নেই। এ চিন্তা-ভাবনা না থাকার দরুণ তাঁরা বাঙালি বলতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মনীষীদের চিন্তা-ভাবনার ওপর নির্ভর করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বড় বড় মানুষদের চিন্তা-ভাবনার অনেকখানি আমাদের মানসপরিমণ্ডলে গ্রহণ করতে হবে একথা মানি। কিন্তু যেকথা আরো বেশি মানতে হবে, সেটা হল ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীদের চিন্তা-ভাবনা অনেকখানি ঝাড়াই বাছাই করার পরই নতুন বাস্তবতার নিরিখেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনগোষ্ঠী একটা জাতীয় রাষ্ট্র কায়েম করতে পারেনি। এখন বাংলাদেশ যতই খণ্ডিত হোক একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর চাহিদা আর একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা একবস্তু নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেক অমৃত এখন গরলে রূপান্তরিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী বাঙালি জাতি গোষ্ঠীর জন্য একটি উন্নত সংস্কৃতির নির্মাণের যে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল তাঁরা সেই কাজে একটি পদক্ষেপও নিতে পারেননি। এইখানে আমাদের জাতীয় ব্যর্থতার যাবতীয় উৎস। … এটাও সত্য, বাঙালি মুসলমান ইংরেজি ভাষা দখল করেছে বেশ পরে। বাংলাদেশ বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যে একটি জাতীয় রাষ্ট্র। এখানকার সাহিত্যের আওয়াজ নিজস্ব। আনকোরা। ছফার বাঙালি মুসলমানমানস নিয়ে করা ক্রমাগত ব্যাখ্যাকে অনেকে একপেশে ও প্রতিক্রিয়াশীলতা ধারণা করেন। এই ধারণার মধ্যে সত্যতা কম- আগের কিস্তিগুলোতে সেই ব্যাখ্যা হয়ে গেছে। ছফা বিপদজনক ভঙ্গিতে বরাবর সঠিক কথা বলে গেছেন। এটাও বলা হয় ছফা ভারত-বিদ্বেষী। ছফা যা করেছেন তা হলো বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় মানস নিয়ে ব্যাখ্যা করে তাঁদের একটা সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়ার কাজ।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা, সেটা জাতীয় ভাষা নয়। ফলে পেট্রোনাইজেশনের আর্থিক দিকটা সেখানে অসফল। সেখানকার লেখকেরা আগ্রাসী হিন্দির চাপে পড়ে অসহায় অবস্থায় আছেন। সর্বভারতীর রাষ্ট্রসত্তার মধ্যে বসবাস করে তাঁদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে হচ্ছে। নিজেদের বাঙালিসত্তার পরিচয় সেখানে হুমকির মুখে। আনন্দবাজার কিছু সাহিত্য বেনিয়া তৈরি করতে সফল হয়েছে। কলকাতার লেখকদের বইয়ের একটা বড় চালান বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে বাজার তৈরির জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এদেশে যজমান ঠাকুরের মর্যাদা পেলে বেফাঁসে ঢাকা দুই বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে ঘোষণা করেন। পরে স্বদেশে ফিরে জনমতের চাপে সেটা অস্বীকার করেন। আনন্দবাজার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবসময় নির্লজ্জ অপপ্রচার করে, অথচ বাংলাদেশে তাদের বিশাল বাজার।

উপপাদ্য এক। ভারত বাবরি মসজিদ ইস্যুতে বিশ্বের সামনে নিজের যে সাম্প্রদায়িক চেহারা হাজির করেছিল তা ঢাকতে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসকে।

আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমী’কে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করে। একাডেমী কর্তৃপক্ষ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সেই পুরস্কার গ্রহণে অপারগতা জানায়। তখন সেটা দেয়া হয় তসলিমা নাসরিনকে। বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে লাগাতার ঠিসারা করে চলেছে এই গোষ্ঠী। সুনীল, বুদ্ধদেব, সমরেশ তসলিমা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধ্বংসে নির্লজ্জ আচরণ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কিছু লেখকের সঠিক বিশ্লেষণ আনন্দবাজারের প্রচারণার উন্মাদনায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। নবনীতা দেবসেন তখন বলেছিলেন, এই তসলিমা আমাদের আবিষ্কার।

… এ সংবাদটি পাঠ করে আমার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিল। এই দেশে কোন পণ্ডিত, কোন লেখক, কোন কবি-সাহিত্যিক আনন্দবাজারের সিদ্ধান্তের প্রশ্নে টু-শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। এটাই আমাকে আরো বেশি স্তম্ভিত করেছে। বাংলা একাডেমী যে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করল তসলিমাকে সেই পুরস্কার প্রদান করা হল। তসলিমা এবং বাংলা একাডেমীকে একই আসনে স্থাপিত করা হল কিনা সে প্রশ্নে একটা হ্যাঁচ্ছো পর্যন্ত কেউ করেননি। বরং ঢাকা চট্টগ্রামে সর্বত্র বলাবলি করতে শুনেছি আনন্দবাজার তসলিমার পরিবর্তে অমুক কিংবা তমুককে পুরস্কারটি দিলে ভাল করতেন। …

বাংলাদেশে তসলিমার ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি প্রকাশের পরে সেটা নিষিদ্ধ হয়। মৌলবাদীরা তসলিমাকে মুরতাদ ঘোষণা করে। আনন্দবাজার তাদের প্রকাশনী থেকে বইটি ছাপে। সেটার অজস্র কপি পুরো ভারত জুড়ে বিক্রি হয়। ফলে তসলিমা হয়ে দাঁড়ায় আনন্দবাজারের কামধেনু। বাবরি মসজিদ ইস্যুতে ভারতবর্ষের যে সাম্প্রদায়িক রূপ বিশ্ববাসী দেখছিল, তার মোড় ঘুরাতে আঙুল তাক করা হয় বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশে তসলিমার ওপর নেমে আসা নির্যাতন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রায় সব উদ্যোগের পেছনে পয়সা ঢালতে বাঁধেনি বাদল বসুদের। তসলিমার পেছনে তাঁদের ব্যয় করা অর্থ কয়েকগুণ বেড়ে তাঁদের কাছে ফিরে এসেছিল। বুঝে বা না বুঝে তসলিমা তাঁদের ফাঁদে পা দিয়ে ক্রমশ এগিয়ে গেছেন। ভারতে সাথে সাথে বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দুদের সম্পর্ক দুর্বিষহ করে তুলতে বইটি অনুঘটকের কাজ করল।

… তসলিমার ওপর যে অত্যাচার করা হয়নি সে অত্যাচার করা হয়েছে বলে ফলাওভাবে প্রচার করা হল। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বিশেষ করে বিজেপি অধ্যুষিত সেন্টারগুলোতে তসলিমার একটা রণচণ্ডী ইমেজ খাড়া করা হল। রাতারাতি ‘লজ্জা’ বইয়ের ইংরেজি, তামিল, গুজরাটি অনুবাদ প্রকাশ করা হল। তসলিমার নামে শূন্য থেকে মহিলা সংগঠন গজিয়ে উঠল। সে মহিলারা দল বেঁধে বাংলাদেশের দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দিলেন, তসলিমার ওপর যদি কিছু হয় তাহলে এখানে তোমাদের কচুকাটা করব। এতেও শেষ নয়। সরকারের প্রচারযন্ত্রের মারফত আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং পশ্চিম-ইউরোপের দেশসমূহের গণমাধ্যমগুলোতে তসলিমার কথা তুলে ধরা হল। খ্যাতনামা ব্যক্তিদের বোঝাতে লাগলেন বাংলাদেশের এই মহিলা লেখিকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে লিখেছেন। তাই বাংলাদেশ এই লেখিকার উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। … ভারত কি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে? যুদ্ধের সময় সব ধরনের অপপ্রচার চলে। কারণ যুদ্ধের প্রথম বলি সত্য। দু-দেশের মধ্যে তো তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। বাংলাদেশ একটা ছোট দেশ। কোনভাবেই ভারতের সঙ্গে এঁটে ওঠার কথা নয়। ভারত তসলিমাকে নিয়ে এমনভাবে মেতে উঠেছে কেন? আমি তো একটা ছাড়া তার কোন কারণ খুঁজে পাইনি। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরে বিশ্বে ভারতবর্ষের যে সন্ত্রাসী চরিত্র ফুটে উঠেছে সেটা ধামাচাপা দেয়ার জন্যই ভারতের এই উন্মত্ত প্রচার অভিযান। …

উপপাদ্য দুই। পশ্চিম বাংলার ঐতিহাসিক অহং-এর মানসিক প্রবৃত্তি থেকে দেবী তসলিমার উদ্ভব।

এই অহং অনেক কিছুর জন্য দায়ী। এই অহং বোধের কারণে তাঁরা সাহিত্যে আমাদের ওপর দাদাগিরি করতে আসেন। আনন্দবাজারে মুসলমান নামের বানানগুলো বিকৃততর হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম –বাংলাদেশের জনগণ এসবে সরাসরি অংশ নিয়েছে। আমাদের রক্ত দিয়ে ভাষাকে তৈরি করতে হয়েছে। দেশকে মুক্ত করতে হয়েছে। আমাদের এইসব সংগ্রাম লেখার ভাষায় এসে যাবে। ভদ্রতার মুখোশ অনেক জায়গায় থাকবে না। সেটা অনিবার্য ধরে নিয়ে এগোলে আমাদের কথা ঠিকঠাক অন্যদের কানে যাবে। আমাদের কুলি মজুর, চাষা, রাস্তার ধারের ভিখিরি, বস্তির লোকজন, সাধারণ মধ্যবিত্ত, নব্য ধনী- এদের মধ্যে কি অমৃত লুকিয়ে আছে সেটা আমাদের নিজেদের বুঝে নিতে হবে। বাংলাদেশের লেখকেরা সেটা কারো অনুকরণে করবেন না। … কথা বলার প্রবহমানতা এইটা টিকিয়ে রাখতে হবে, এ ধারাটা। আর কেউ যদি কেবল বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে সমসাময়িকতা থেকে সরে যেয়ে, এটা বেদমন্ত্র আবৃত্তি হবে, সাহিত্য হবে না। কারণ ভাষাটা, বাংলাভাষাটা, এই যে ঠেলাঅলা, রিক্সাঅলা, গাড়িঅলা, মুটেমজুর এরা ভাষাটা কয় বলেই ভুলভাল শব্দ, এই আঞ্চলিক ডাইলেক্টভরা ভাষা উচ্চারণ করে বলেই একজন কবিভদ্রলোক কবিতা লিখতে পারেন। … যেগুলো হচ্ছে ভাষার জীবনের লক্ষণ। আর যে ভাষায় কেউ কথা বলবে না সেটা সংস্কৃত হয়ে উঠবে, তারপর চলে যাবে, কেউ কথা বলবে না। মরা ভাষা। … বাংলাদেশ নিজের আওয়াজে কিছু করলে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ লেখক সেখানে সারবস্তু পান না। বাংলাদেশের স্বাধীন অবস্থান কলকাতার লোকজনকে এখনো প্রশান্তি দেয়। মুখে বা লেখায় সেটা তাঁরা স্বীকার করেন না। ভারতবর্ষ কি অন্যান্য দেশের রেখে যাওয়া ফাঁদে বাংলাদেশ পা দিলে ওপার বাংলার লেখকদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বরং স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলা ভাষাভাষী একটি রাষ্ট্রের বিকাশে তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত। তসলিমা নাসরিন ঘটনায় কলকাতার লোক কেন উলঙ্গ প্রচারণায় সামিল হয়েছিল ছফা তার মনোবিশ্লেষণ করেছেন।

… ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল, বাংলার এই অংশ স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক একটি ভারতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম-বাংলার বাঙালিদের অন্তত একটি আলোকিত অংশ স্বপ্নদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করতে আরম্ভ করলেন, বাঙালিদের সব শেষ হয়ে যায়নি। পদ্মার অপর পারে বাঙালির যে একটি নতুন ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে তাতে বাঙালির অপূর্ব স্বপ্নসাধনা সবটাই বিকশিত হবে, মুকুলিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এখানে কি ঘটল? তিন বছর না যেতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। পর পর সামরিক শাসন এসে গেল। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হল। পাকিস্তান আমলে সংখ্যালঘু হিন্দুসম্প্রদায়ের যতটুকু নিরাপত্তা ছিল পরিস্থিতি তার চাইতে অনেক খারাপ হলো। হিন্দুদের দেশত্যাগের হার অনেক পরিমাণে বেড়ে গেল, উপর্যুপরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে থাকল। এ সকল দাঙ্গায় তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক দলগুলো ছদ্মবেশে অংশগ্রহণ করতে থাকল। ইত্যকার ঘটনা দর্শন করে পশ্চিম-বাংলার জনগণের যে অংশ বাংলাদেশের ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের বিকাশ প্রসঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন তাঁদের হতাশা অনেকগুণ বেড়ে গেল। তাঁরা মনে মনে আফসোস করতে থাকলেন এ রাষ্ট্রটি সৃজন প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক কিছু দিয়েছি। বস্তুত পশ্চিম-বাংলা যদি সর্বতোভাবে বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা না করত অত তাড়াতাড়ি ভারতীয় সাহায্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত না। বাংলাদেশের সমাজের দিক চিহ্নহীনতা এবং মৌলবাদীদের জমজমাট আধিপত্য দেখে পশ্চিম-বাংলার জনমত একাংশ ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। আশাভঙ্গের বেদনা তাঁদের ভয়ঙ্করভাবে পীড়ন করছে। তাঁরা হালে অনেকেই মনে করতে বাধ্য হচ্ছে- এই দেশটির কোন পরিবর্তন হবে না। যেই ক্ষমতায় আসুক সাম্প্রদায়িকতা এখানে যেভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে তার হাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তি নেই। তসলিমার ‘লজ্জা’ বইটি তাদের এই চাপাক্রোধের বারুদের ঘরে অগ্নিশিখার মতো কাজ করছে। তাঁরা রাগের বশে, ক্ষোভের বশে এবং প্রতিহিংসার বশে তসলিমাকে নিয়ে এতখানি উলঙ্গ প্রচারণায় নেমেছিলেন। আমার মনে হয়েছে এটুকুই ভেতরের ব্যাপার। আমরা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছি। আজকে বাংলাদেশের আমরা যা-ই চেয়েছি তার বিপরীতটা করছে। সুতরাং এ দেশটির মানসিক প্রতিশোধ নিতে হবে। …

আমি নিজে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন। বাবরি মসজিদ ঘটনায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাজেভাবেই লেগেছিল। আমি যে পাড়ায় থাকতাম সেটা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। একাত্তর দেখি নাই, তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি কী বস্তু সেই সময়ে কিছু আঁচ পেয়েছিলাম। পাড়ার ছেলেরা রাতে খড়গ আর এসিডের বোতল নিয়ে পাহারা দিত। সেই সময় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন নেমে এসেছিল। প্রচুর মন্দির ভেঙ্গে চুরমার করা হয়। ধর্ষণ ঘটেছিল প্রচুর সংখ্যক। সামরিক সরকার এসব বন্ধে খুব একটা ভূমিকা পালন করতে পারে নাই। হিন্দুদের একটা বিশাল অংশ নিরাপত্তাহীনতায় ওপারে পাড়ি দেয়। তসলিমা নাসরিন ‘লজ্জা’ উপন্যাসে কিছুটা তাড়িত হয়ে নিপীড়িতদের কথা বলতে গেলে একটা শ্রেণী সেটাকে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ফেলে। দেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদীরা ১৯৯৪ সালে লেখককে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এক্সাইলে গিয়ে দেশের আচরণের প্রতি কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আনন্দবাজারের বেনিয়ারা সেই সুযোগে বাংলাদেশের মৌলবাদী রূপ বিশ্বের দরবারে বিশ্বস্ততার সাথে সামনে আনে। কলকাতা লেখককে অনেক সহায়তা করেছিল একটা সময়। ২০০৭ সালে সেখানে বাস করতে গেলে তসলিমা এবার মুখোমুখি হন সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের। ফলে আবার এক্সাইল। আনন্দবাজার তসলিমার কাছ থেকে যা নেবার এতদিনে নিয়ে নিয়েছে। ফলে এই ইস্যুতে একটা বিপ্লব ঘটানোর প্রয়োজন তাঁদের আর দেখা দেয় না।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নিজের মেরুদণ্ডের ওপর জোর নেই। তাঁদের আত্মবিশ্বাসের ব্যাপক ঘাটতি আছে। নিজেদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত সেটা নিয়ে তাঁরা আগাগোড়াই সন্দিহান। কিছু লেখক আছেন যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সার্টিফিকেট অমূল্য মনে করে। ধ্যানী বকের মতো তারা কেবল বুড়ো হতে জানে। কলকাতার ভাবুক সমাজ আমাদের কোন চোখে দেখছে সেই অনুসারে পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে থাকার প্রবণতা লেখকদের একাংশের মধ্যে সেঁধে গেছে। এই আচরণ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার এতোগুলো বছর পরেও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। আনন্দবাজার সেই কারণে জল বা পানি ঘোলা করার সাহস এখনো করে। পশ্চিমবঙ্গের উন্নাসিক লেখকেরা বাংলাদেশকে পূর্ববঙ্গ বলার স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নাই। আমাদের লেখালেখির ভাষা কলকাতার ভাষাভঙ্গির ধাঁচে হলে তাঁরা পড়বেন, নয়তো নয়। ওপার বাংলার বই ছাড়া আমাদের চলে না। কিন্তু ওপার বাংলার চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের গুটিকয়েক লেখকের লেখা সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে ঢোকে। আমাদের ওপর মাতব্বরি ফলানোর সুযোগ হেলায় তাঁরা কখনো ছাড়েন না। এই প্রবণতা থেকে তাঁদের বেরিয়ে আসা জরুরি। উন্নাসিকতা নিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক একটা জাতীয় রাষ্ট্র। স্বাধীনতার পরে এখানে নানা কিছু হয়েছে। সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের মুখোশে স্বৈরতন্ত্র, অন্তহীন দুর্নীতি, মৌলবাদীদের উত্থান, রাজাকারদের মন্ত্রীত্ব, সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি- এসব ঘটেছে। … বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা খুব পরিচিত, একটা সময় পর্যন্ত তারা এখানকার সাহিত্যকে সার্ভ করেছেন। তাদের অনেকেই এখন সাহিত্যক্ষেত্রে একটা সময় যারা খুব জ্বলে উঠেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বর্জ্যপদার্থের কাছাকাছি এসে গেছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে পলিটিক্যাল ডেসটিনি না থাকলে, পলিটিক্যাল গোল ক্লিয়ার না থাকলে, শিল্প-সাহিত্য তার প্রধান ভিকটিম হয়। এখন বাংলাদেশের চিত্র কোনদিকে যাবে তার দিশা নেই। আপনি দেখবেন হাজার হাজার পাতা পত্রপত্রিকা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শ করার মত পঞ্চাশটি পাতা আপনি সেখানে পাবেন না। … তবু বাংলাদেশ একটা গতিপথে এগোচ্ছে। বিজাতীয় কোন ঐক্যবোধের দায় আমাদের মাথায় নেই। বাংলাদেশের সাহিত্য নিজের একটা শক্তিশালী পথ তৈরি করছে। সেটা সময়ে আরো শক্তিশালী হবে। কলকাতার লেখকদের বর্জনের পথে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই। একরকম জোর করে বাংলাদেশের সাহিত্যকে পরিহার করে চলার নীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বেরিয়ে আসতে হবে। দাদাগিরি, মাতব্বরি করার আগে নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর দরকার আছে। কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য আহমদ ছফার একটা সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ছফা সেখানে বলেন-

… আমাদের একুশের মেলা বাংলাভাষার মেলা, বাংলাদেশের বইমেলা। একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন নন। আপনাদের ভাষাও সেখানে পরাধীন। জাতি হিসেবে স্বাধীনভাবেই আমাদের পথ আবিষ্কার করতে হবে। … পরাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানসিকভাবেও এই দাসত্বকে আপনারা (ভারতের বাঙালিরা) মেনে নিচ্ছেন। কারণ ‘ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাঁধে। তাই স্বাধীন হবার ইচ্ছেও আর থাকছে না। আমরা 'পাকিস্তানি সংহতি' কে কবরে পাঠিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই পশ্চিম-বাংলা বা কলকাতাকে এক্ষেত্রে আমরা অনুসরণ করতে যাব না। যদি কোনদিন স্বাধীন হয়ে স্বাধীন চিন্তা এবং পথকে আবিষ্কার করতে পারেন, সেদিন নিশ্চয় আমরা পশ্চিম-বাংলা বা কলকাতার দিকে তাকাব। …

আহমদ ছফার টোন চড়া। তবে হাজার হলেও গুরুবাক্য।

সূত্র
১। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৪২৩]
২। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৪২০]
৩। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [১০৬,১০৭]
৪। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৮৫]
৫। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৯৮]
৬। আহমদ ছফা রচনাবলি- পঞ্চম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৪৩৪]
৭। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [১০০]
৮। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৪২০]
৯। আহমদ ছফা রচনাবলি- অষ্টম খণ্ড – সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি , ফেব্রুয়ারি ২০১০) [৪২২]

ছফাগিরি। কিস্তি দশ।


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

এক টানে পড়া গেল চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখাটার কিছু পয়েন্টে আলোচনা চালানো যায়। ছফা সম্পর্কে অনেকে ভালো বা মন্দ এক দুই বাক্যে ফলাফল ঘোষণা করেন। ছফাকে ভালো-মন্দ মিলিয়ে চিনে নেয়ার দরকার আছে।

--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নিবিড় এর ছবি

শুভাশীষ দা কোট করা লাইন গুলো বেশী ছোট হয়ে গেছে, পড়তে কষ্ট হচ্ছে। একটু ঠিক করে দিলে ভাল হয়। আর লেখাটা খোমাখাতায় পড়া হয়ে গেছে হাসি


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এক পয়েন্ট বাড়ালাম। হাসি

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

...অসমাপ্ত [অতিথি] এর ছবি

… ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল, বাংলার এই অংশ স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক একটি ভারতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম-বাংলার বাঙালিদের অন্তত একটি আলোকিত অংশ স্বপ্নদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করতে আরম্ভ করলেন, বাঙালিদের সব শেষ হয়ে যায়নি।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনি কি 'ভারতীয় রাষ্ট্র' শব্দ দুইটিকে নির্দেশ করতে চেয়েছেন?

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

তাসনীম এর ছবি

এক নিঃশ্বাসে পড়লাম ও দারুণ লাগলো।

এই লেখার বর্ণিত অনেক ঘটনাই হয়েছে নিকট অতীতে। এরশাদআমলে ঐ দাঙ্গার পেছনে সরকারের মদদও ছিল শুনেছি।

পশ্চিমবঙ্গে বইয়ের শিল্পটা অনেকখানিই দাঁড়ানো আমাদের তুলনায়। এই দাঁড়ানো শিল্পের মধ্যে শীর্ষে আছে আনন্দবাজার। ওদের আধিপত্যের চাপটা বাণিজ্যিক বলেই মনে হয় আমার কাছে, ঠিক যেমনটা মনে হয় মাইক্রোসফটের সর্বগ্রাসী চরিত্রে। এই চাপটা আমরা যেমন বোধ করি তেমনি আমি নিশ্চিত পশ্চিমবঙ্গের অন্য প্রকাশনাগুলোও বোধ করে।

এর পিছনে আমার ধারনা এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানসিকতার চেয়েও আনন্দবাজার গ্রুপের অসাধু ব্যবসায়ী মানসিকতাই প্রধান। বাংলাদেশ একটা বড় ব্যবসা ক্ষেত্র ওদের জন্য, ওরা নানানভাবে এটা ধরে রাখতে চায়।

নীরোদ চৌধুরি বাংলাদেশ নিয়ে অশোভন উক্তি করার কারণে "শারদীয় দেশ" একবার বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল। কাজটা যথার্থ জবাব হয়েছিল। কলকাতায় শুনেছি বাংলাদেশি চ্যানেল দেখা যায় না...ঢাকার প্রায় প্রতিটি ঘরে ভারতীয় চ্যানেল অবাধে চলছে। এটার প্যাট্রন শুধু সরকার নন, দেশের জনগনও। আমাদের মানসিকতাতে আত্মসম্মান না ঢুকলে এগুলো ঠিক করা সম্ভব না।

আরেকটা জিনিস,বাংলাদেশে তৈরি পাঠককুল তেমন ছিল না। খুব জনপ্রিয় লেখকরা (কাজী আনোয়ার হোসেন, হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল) নিজেরাই পাঠক তৈরি করেছেন। এরকম একটা আনস্যাচুরেটেড মার্কেটে পশ্চিমবঙ্গের সুস্বাদু লেখা (মানের প্রশ্নে যাচ্ছি না)
খুব সহজেই দখল স্থান করে নিয়েছে। মার্কেটিং এর পরাজয়টা জাতিস্বত্তা ও আত্মভিমানের পরাজয়ের চেয়েও বড় হতে পারে আজকের এই মুক্তবাজারে। এই মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে আনন্দবাজার ব্যবহার করেছে ওপার বাংলার জনপ্রিয় লেখক, প্রবন্ধক ও ওদের নিজেদের মিডিয়া মেশিনকে।

আনন্দবাজারে মুসলমান নামের বানানগুলো বিকৃততর হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম –বাংলাদেশের জনগণ এসবে সরাসরি অংশ নিয়েছে। আমাদের রক্ত দিয়ে ভাষাকে তৈরি করতে হয়েছে। দেশকে মুক্ত করতে হয়েছে। আমাদের এইসব সংগ্রাম লেখার ভাষায় এসে যাবে। ভদ্রতার মুখোশ অনেক জায়গায় থাকবে না। সেটা অনিবার্য ধরে নিয়ে এগোলে আমাদের কথা ঠিকঠাক অন্যদের কানে যাবে। আমাদের কুলি মজুর, চাষা, রাস্তার ধারের ভিখিরি, বস্তির লোকজন, সাধারণ মধ্যবিত্ত, নব্য ধনী- এদের মধ্যে কি অমৃত লুকিয়ে আছে সেটা আমাদের নিজেদের বুঝে নিতে হবে। বাংলাদেশের লেখকেরা সেটা কারো অনুকরণে করবেন না।

আমার নিজেরও সেই অভিমত। আমাদের মুখের ভাষার যথার্থ ব্যবহার করাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ছফার লেখাটাও একটা দারুণ সফল লেখা, আমাদের ক্ষোভটা উনি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন...এই লেখাতে অপ্রয়োজনীয় ভাবে আমাদের সাধারন লোকের ভাষাটা উনি ব্যবহার করেন নি...বলেলনি একবারও যে আনন্দবাজারের চুতমারানিরা আমাদের গোয়া মারছে অহর্নিশ (এটাই সাধারন লোকের অভিমত হওয়া উচিত)।

কিন্তু যেখানে দরকার ঠিক সেই খানে এই কথাটা এসেছে, একদম সঠিক মাত্রায়...উদাহরণ নীচে।

এই অবস্থা দেখে ছফা শওকত ওসমানকে জিজ্ঞেস করেন, দেশটা আমরা বাল ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি?

অনেক অনেক ধন্যবাদ একটা দুর্দান্ত ছফাগিরির জন্য। পাঁচ তারা মারলাম।

অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও এই মোটামুটি বড় একটা কমেন্টটা করলাম, অনেকগুলো ব্যাপারে আমার নিজের অভিমতটা বোঝানোর জন্য।

++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

তাসনীম ভাই,

বড় মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

১। আনন্দবাজারের সাথে হিসাব করে চলেন বলে মিলন আর হুমায়ূন আহমেদ সেখানে কিছুটা পাত্তা পান। হুমায়ূন আহমেদ পূজা সংখ্যার লেখক পর্যন্ত হয়ে গেছেন।

২। নীরদ সি চৌধুরী বাংলাদেশের নামের আগে 'তথাকথিত' লাগানোর জন্য বাংলাদেশে 'দেশ' নিষিদ্ধ হয়। বিশাল বাজার হারানোর ফলে আনন্দবাজার 'দেশ' পত্রিকাকে মাসিক করার ভাবাগোনা করছিল। পরে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

৩। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ পাঠকের কাছে ছফা প্রায় ঢুকতেই পারেননি। আনন্দবাজারের চরম বিরোধিতা এর একটা প্রধান কারণ।

৪। আমরা বাজার ধরতে পারিনি এর অন্যতম না হলেও একটা কারণ আমাদের লেখকদের মেরুদণ্ডের অভাব।

৫। কলকাতার লেখকদের মাথায় তুলে নাচার স্বভাব থেকে আমাদের পাঠক ও লেখকেরা কেন যেন বেরোতে চান না। ওপারের সাহিত্য শক্তিশালী এই ধারণা মাথায় গেঁথে রাখেন অনেকেই। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী লেখক সন্দীপণ সাক্ষাৎকারে অক্লেশে বলে ফেলেন- 'বাংলাদেশে তেমন কোনো লেখক নেই।'

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
______________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আনন্দবাজার গোষ্ঠীকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। বলার নাই দাদাদের নিয়াও। আমাদের বুড়াগুলা কোলকাতার কোল পেলে ধন্য হয়ে যান। আর ছফা বুকে পোস্টার সাটিয়েঁ একুশে বইমেলায় ঘোরেন ভারতীয় বই মেলায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারীর দাবীতে।
মূলত তার উদ্যোগেই বাংলা একাডেমীর বইমেলা থেকে কোলকাতার বই সরানো গেছিলো। হাঁপ ছেড়ে বেচেঁছিলো বাংলাদেশের প্রকাশনা। সেই বিচারে ছফাকে স্যালুট।

তবে গত কয় বছরে তা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশের প্রকাশনীগুলোই সুনীল শীর্ষেন্দুর পুরনো বইগুলোর কপিরাইট নিয়ে ছাপিয়ে মেলায় বিক্রি করছে।
এবার ঠেকাবে কে? ছফা তো মরে ভূত
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ছফা অবশ্য আনন্দবাজার থেকে প্রকাশিত বই বইমেলায় প্রবেশ বন্ধের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই বাংলাদেশের প্রকাশনী থেকে বেরোলে দেশের প্রকাশনীগুলো কিছু টাকা পায়। সেই ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল না।

সুনীল শীর্ষেন্দুর কিছু বই বিক্রি হয়। বেস্ট সেলার অন্তত হয় না।


----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

মনমাঝি এর ছবি

সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে লেখিকা সেলিনা হোসেনের অবস্থান বিষয়ে শুভাশীষ দাশের মতামত জানতে চাই।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

সেলিনা হোসেন এই প্রসঙ্গে ( তসলিমা-ছফা প্রসঙ্গ?) কী বলেছিলেন আমার জানা নেই। আপনার জানা থাকলে মন্তব্যে লিখতে পারেন।

-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

স্বাধীন এর ছবি

পড়ছি। চলতে থাকুক ছফাগিরি।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বস্‌,

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

বাউলিয়ানা এর ছবি

কয়েক দফায় পড়ে শেষ করলাম। যথারীতি ভাল লেগেছে।
অনেক নতুন তথ্য জানলাম।
চলুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনি ছফাগিরি নিয়মিত পড়েন দেখে ভালো লাগলো।

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাইফ তাহসিন এর ছবি

পঞ্চতারকায় খচিত করলাম, আপনার এই লেখাগুলার পেছনের পরিশ্রম দেইখা ডরায়া যাই প্রতিবারেই, নমস্য আপনে। আপনার এই সিরিজ চলতে থাকুক।

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

পাঁচাইলেন ক্যান ঈমানে কন।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আনন্দ বাজার এবং তসলিমা সম্পর্কে আহমদ ছফার সবগুলো বক্তব্য এবং কার্যক্রমই আমি একবাক্যে সমর্থন করি

আর সব সময় কৃতজ্ঞ থাকি ২১ এর বইমেলাকে ভারতের বাংলা ভার্সন বইয়ের মেলা থেকে বাংলা বইয়ের মেলায় পরিণত করার উদ্যোগকে

০২

চলুক ছফাগিরি
চিহ্নিত হোক আমাদের ক্ষুদ্রতা আর উচ্চতার কেন্দ্রবিন্দুগুলো

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

খোমাখাতায় সাহস করে পড়ে উঠিনি... এখন পড়লাম...

_________________________________________

সেরিওজা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

সুহান,

পাউলোর কিছু বইয়ের লিঙ্ক পাঠাইছি।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

দরকারি লেখা ...
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কলকাতার প্রবন্ধকারদের নিয়ে একটা দরকারি লেখা আপনি লিখবেন আশা রাখছি।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

দিগন্ত এর ছবি

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা, সেটা জাতীয় ভাষা নয়। ফলে পেট্রোনাইজেশনের আর্থিক দিকটা সেখানে অসফল। সেখানকার লেখকেরা আগ্রাসী হিন্দির চাপে পড়ে অসহায় অবস্থায় আছেন। সর্বভারতীর রাষ্ট্রসত্তার মধ্যে বসবাস করে তাঁদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে হচ্ছে। নিজেদের বাঙালিসত্তার পরিচয় সেখানে হুমকির মুখে।

আমি এইটা বাংলাদেশের লেখায় অনেক শুনে আসছি কিন্তু কোনোদিন বুঝে উঠতে পারিনা ব্যাপারটা সঠিক কি ... আমার প্রশ্ন-উত্তর কিছু রইল
১) পশ্চিমবঙ্গে কি হিন্দি বই বিক্রি হয়?
হয়ত হয় ও তা হিন্দিভাষীরা কেনে। বাঙালীরা কেনেন না, কারণ তারা (অধিকাংশই) হিন্দি পড়তে পারেন না। তবে বাঙালী প্রকাশকরা হিন্দি বইকে প্রতিযোগিতার দৃষ্টিতে দেখেন না।

২) পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্রমে কি হিন্দি পড়ানো হয়?
অবশ্যই, তবে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে অথবা তৃতীয় ভাষা হিসাবে। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে সংষ্কৃত/আরবী/ফারসী/হিন্দি/নেপালী/পালি/সাঁওতালী (ও আরো কিছু ভাষা) তৃতীয় ভাষা হিসাবে পড়া যায়, নবম/দশম শ্রেণীতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে ঐ একই ভাষাগুলো নেওয়া যায়। বাঙালীদের মধ্যে হিন্দি বিষয় হিসাবে নেওয়ার প্রবণতা খুবই কম, কারণ অধিকাংশ জায়গায় হিন্দির শিক্ষকই পাওয়া যায় না। কোলকাতার কিছু অবাঙালীপ্রধান অংশে ও বিহার-সীমান্তে অনেক স্কুলে হিন্দি চলে।

প্রথম ভাষা বাংলা বাধ্যতামূলক নয় পশ্চিমবঙ্গে, প্রথম ভাষা হিসাবে ইংরেজী, হিন্দি, বাংলা, নেপালী, সাঁওতালী ও উর্দু নেওয়া যায়। এখানেও বাঙালী ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত বাংলা অথবা ইংরেজী প্রথম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজীর প্রায় বিকল্প নেই।

আমার তৃতীয় ভাষা ছিল সংষ্কৃত। ঐচ্ছিক বিষয় ছিল পদার্থবিজ্ঞান। সুতরাং আমি এখনও হিন্দি পড়তে/লিখতে পারি না। দেবনাগরী হরফ চিনি বলে বানান করে করে পড়ে দিতে পারি, সেভাবেই লিখতেও পারি। অধিকাংশ বাঙালী ছাত্র-ছাত্রী আমার মতই হিন্দিজ্ঞান। হিন্দি বই পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।

৩) জাতীয় স্তরে পরীক্ষায় হিন্দি পড়তে হয়?
কোনোভাবেই নয়। সব রাজ্যের পরীক্ষায় ইংরেজী মাধ্যম বাধ্যতামূলক হওয়ায় (ইংরেজী মাধ্যম বাধ্যতামূলক কারণ ভারতীয় কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্ষদ ইংরেজী মাধ্যম ব্যবহার করে)। আই-আই-টি প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ইংরেজীতে হয় কিন্তু উত্তর ২২টি ভাষার যে কোনোটিতে দেওয়া যায়। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক ভাষা হল ইংরেজী। বাকি ঐচ্ছিক দুটি বিষয়ের মধ্যে হিন্দি/বাংলা সহ অনেক কিছুই নেওয়া যায়।

আর থাকে বলিউড ও সিনেমা। এই দুই শিল্প আর যাই পাক, সরকারী কোনো সাহায্য তো পায়নি বটেই। সিনেমাগুলো আদৌ ভাষানির্ভর নয়, তার থেকে বেশী বাণিজ্যের ফসল। নাহলে মারাঠী-গুজরাটী অধ্যুষিত মুম্বাই কি ভাবে হিন্দি সিনেমার পীঠস্থান হয়?

ভারতে যদি কোনো ভাষার পেট্রোনাইজেশন থাকে তাহলে সেটা হল ইংরেজী। বহুভাষীর দেশে সবাই "নিরপেক্ষ আম্পায়ারের" মত বিতর্ক এড়াতে ইংরেজী ব্যবহার করে। সেইভাবেই ভারতে প্রায় সব সরকারী কাগজ থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম - সবই ইংরেজীতেই হয়। নিকট ভবিষ্যতে এর পরিবর্তন হবার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ ইংরেজী ভাষা সফটওয়ার আর বিপিও শিল্পের হাত ধরে ভারতে সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা যদি কোনো ভাষাগত আগ্রাসনের শিকার হয় তাহলে সেটা ইংরেজী ভাষা থেকেই - হিন্দি থেকে নয়। আর সেই আগ্রাসন আজ শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে আরও দুশো বছর আগে থেকেই।

শেষ করার আগে একটা ছোট পরিসংখ্যান দিই।
ভারতে হিন্দিভাষী - ৪০%
মোট ছাত্র-ছাত্রীর কত শতাংশ হিন্দি মাধ্যমে পড়াশোনা করে - ২০-২৫%
আই-আই-টি পরীক্ষায় যারা বসে তাদের মধ্যে হিন্দি মিডিয়ামের কত শতাংশ - ১৩%
আই-আই-টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের কত শতাংশ হিন্দি মিডিয়ামের - ২%

সুতরাং আহমদ ছফার মতামতের সাথে আমার দ্বিমত রইল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দিগন্ত ভাই,


বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য পড়ে গুগলাতে গিয়ে এখানে অনেক কিছু জানলাম।

ইংরেজির আগ্রাসন নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। ভারতে সেটা ব্যাপক। হিন্দির আগ্রাসী ভূমিকা ছিল বলেই নানা রাজ্যে এন্টি-হিন্দি এজিটেশান হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে ওভাবে ব্যাপক না হলেও প্রভাব যে নেই তা নয়। কলকাতার বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে প্রথমে থাকে হিন্দি, পরে ইংরেজি আর একদম শেষে বাংলা।

টিভি চ্যানেলগুলোতে হিন্দির আধিপত্য। ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে এক ভজঘটে ভাষার জনপ্রিয়তা পুরো ভারত জুড়ে। কলকাতা ভারতের বাইরে স্বতন্ত্র এনটিটি নয়। ফলে সেখানে প্রভাব থাকবেই।

ইংরেজি তো আছেই তার উপর আরো একটা বিজাতীয় ভাষা ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস নিলে বাংলা ভাষার চর্চা কিছুটা ব্যাহত হয়। যদিও হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়।

ছফা থেকে এটুকু নেয়া যায়। হাসি

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

দিগন্ত এর ছবি

প্রভাব তো থাকবেই, সেটা পশ্চিমবঙ্গ আলাদা রাষ্ট্র হলেও থাকত। কোলকাতার ৫৫% অধিবাসী বাঙালী, বাকিদের মধ্যে অনেকেই হিন্দিতে কথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী বিহারে হিন্দিভাষী থাকার কারণে হিন্দি আসবেই।

আমার পয়েন্টটা স্টেট পেট্রোনাইজেশন নিয়ে। ভারতে হিন্দির স্টেট পেট্রোনাইজেশন নেই, থাকলেও খুব বিচ্ছিন্নভাবে ও মৃদু।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এই ইস্যুতে আর একটা বই পেলাম।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

দিগন্ত এর ছবি

বইটা অনেকটা পড়লাম, অনেকবার স্টেট চেষ্টা করেছে কিন্তু হিন্দিকে দাঁড় করাতে পারেনি। ভারতে আরো পঞ্চাশ বছর পরে হিন্দিকে অফিসিয়াল ভাষার লিস্টি থেকে বাদ দেবার কথা উঠলেও অবাক হবার কিছু নেই, সব কাজ এখনও ইংরেজীতে হয়, তখনও হবে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

আলমগীর এর ছবি

শুভাশীষের ফ্যান হয়ে গেলাম। আগের পর্বগুলো এরকম সরল থাকলে কী ভালই না লাগত!

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আরে বস্‌, বলেন কী!!!

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাদা কালো এবং ধূসর [অতিথি] এর ছবি

খুব জোর দিয়ে বলা কথার প্রতি আগ্রহ কম সবসময়ই ছিল, তাই হয়তো তাকে তেমন পড়া হয়, আপ নার লেখাটি পড়ার মনে হচ্ছে দেখি কোন ড্রাইভে ডাউনলোডটা রেখে ছিলাম, দেখি আবার পড়ার চেষ্টা করে...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বুঝি নাই।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাদা কালো এবং ধূসর [অতিথি] এর ছবি

মানে আপনার লেখাটি পড়ে আমার ছফার লেখা আবার খুলে দেখার আগ্রহ হয়েছে = আপনার লেখাটি চমৎকার হয়েছে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এবার বুঝছি।

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাদা কালো এবং ধূসর [অতিথি] এর ছবি

তাই হয়তো তাকে তেমন পড়া হয়নি >

জোর করে অ্যাংরি ইয়াং
ম্যানের ইমেজ টাইপ নোশানের কারনে আরকি
মন খারাপ না টা কি বাদ পড়ে গেলে কি যে বিপদ মন খারাপ

মনমাঝি এর ছবি

একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে।
আনন্দবাজার গোষ্ঠী, দেশ পত্রিকা, ও তাদের সমমনা কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি মহল -- এরা একজন বিদেশিনী তসলিমা নাসরিনের ভাগ্যবিড়ম্বনা নিয়ে যত উচ্চকন্ঠ, ঠিক ততটাই নিরব কিংবা বিমুখ বা প্রতিকুল কেন অরুন্ধতি রায়ের মত স্বদেশি এক অসামান্য মেধাবী ও সৃজনশীল প্রতিভা, মরুভুমি ও ফণীমনসার ঝোপঝাড়ের মাঝে মহীরুহের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অমিতসাহসী ও তুমুল বিবেকবান এক সৎ প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের শত বিপদের ক্ষেত্রেও ? অরুন্ধতির বিরুদ্ধেও তো কত ডেথ-থ্রেট, হুমকি-ধামকি আসছে -- কই, তখন তো আনন্দ-গোষ্ঠী বা তার চ্যালাদের বিশ্বব্যাপী দূরে থাকুক স্বদেশব্যাপীও হৈ-চৈ লম্ফ-ঝম্প তুল্কালাম করতে দেখি না ?! কেন ? উলটে বরং কতভাবে তাকে ছোট করা যায় তাতেই দেখি তাদের বেশী আগ্রহ !!

অথচ কোন সৎ মানুষটি অস্বীকার করতে পারবে যে -- শিক্ষায়, মেধায়, প্রজ্ঞায়, প্রতিভায়, বঞ্চিত-নিপীড়িত-পশ্চাৎপদ-অএলিটমিডিয়াগোচর মানুষের নির্ভীক পক্ষাবলম্বনে সৎ নিরপেক্ষ বিবেকী সাহসিকতায়, এবং বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও উদার মানবিক পরিশীলনে এই অসামান্য মানুষটির এমনকি নখেরও যোগ্য নয় ঐ বিদেশিনী ?

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়নি করা কি তারা তবে শুধু তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসংরক্ষনকারী সুবিধাবাদী বিদেশিদের জন্যই সংরক্ষিত রেখেছেন ? স্বদেশিয়রা - বিশেষ করে যারা বিজেপি/আরএসএস-ঘেষা জাতিয়তাবাদের প্রবক্তা নন, তারা কল্কে পাবেন না ?

রহস্যটা কি ?

ও হ্যাঁ, ছফা বিষয়ে আমার আরেকটি প্রশ্ন এখানেঃ http://www.sachalayatan.com/subasish/29516#comment-339189

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

অরুন্ধতি রায়কে নিয়ে আনন্দবাজার এসব করবে না। এখানে তাঁদের ফায়দা নাই। আনন্দবাজার একটা প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়। তসলিমা ইস্যুতে সেটা মুখোশ খুলে বেরিয়ে পড়েছিল।

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

হাসান মোরশেদ এর ছবি

অরুন্ধতীকে আনন্দ বাজার ধারন করতে পারবেনা।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

পাঁচ তারা।

আপনার ছফাগিরি আর ইলিয়াসের লেখা নিয়ে সিরিজ দুইটা দুর্দান্ত হচ্ছে।

চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এই প্রথম আমার কোন লেখায় আপনার কমেন্ট পেলাম। হাসি

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আচ্ছা শুভাশীষ, একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা- 'লজ্জা' উপন্যাসে তসলিমা যা লিখেছেন সেগুলো কি বানোয়াট?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মোরশেদ ভাই,

না, বানোয়াট না। আমি নিজে এই সাম্প্রদায়িক জঘন্যতা নিজের চোখে দেখেছি। ছফাগিরি কিস্তি দুই আর এই কিস্তিতে সামান্য বিবরণ ও দিয়েছি।

১৯৯০ সালের ঢাকা-চট্টগ্রামের হিন্দুদের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার নেমে এসেছিল এরশাদ সেটা থামানোর কোন চেষ্টা করেননি। ঢাকেশ্বরী মন্দির,চট্টেশ্বরী মন্দির, কৈবল্যধাম সহ শয়ে শয়ে মন্দির ভেঙ্গে চুরমার করা হয়েছিল। সরকার এসব থামানোর উদ্যোগ না নিয়ে বরং ইন্ধন দিয়েছে। সেই ভয়ানক সময়ে বাংলাদেশের হিন্দুদের পাশে প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দল দাঁড়ায়নি।

তসলিমা নাসরিন কল্পনা করে 'লজ্জা' লেখেন নাই-এটুকু বলা যায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা সেখানে ঠিকমতো এসেছে। তবে সেখানে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মনোভাবের চর্চার লেশমাত্র নাই। বইটা দাঙ্গাকারীর মনোভাবকে ধারণ করেছে মাত্র।

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

হাসান মোরশেদ এর ছবি

তসলিমা নাসরিন কল্পনা করে 'লজ্জা' লেখেন নাই-এটুকু বলা যায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা সেখানে ঠিকমতো এসেছে। তবে সেখানে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মনোভাবের চর্চার লেশমাত্র নাই। বইটা দাঙ্গাকারীর মনোভাবকে ধারণ করেছে মাত্র।

দুটো ধারা আছে। একধারায় লেখক সমস্যার ছবি এঁকে তার সমাধান ও দিয়ে দেন আরেক ধারায় তিনি শুধু সমস্যাটাকেই দেখান। তসলিমা দ্বিতীয় কাজটি করেছেন, এ জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে কেনো?

চেখভ'কে একবার এরকম প্রশ্ন করলে কড়া উত্তর দিয়েছিলেন- লেখক তো ডাক্তার না যে তাকে প্রেসক্রিপশন দিতেই হবে।

তসলিমা কতো বড় না ছোট লেখক তার চেয়ে বড় কথা- অন্ততঃ তসলিমা তো তার সামর্থ্য অনুযায়ী 'লজ্জা' লিখেছেন। এ দেশে তো লেখক কম ছিলেননা কারো কিন্তু সাহস হয়নি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে লেখার।
আর তসলিমা যখন দেশ ও দেশের বাইরে খ্যাতি পেয়েছেন তখন মৌলবাদীদের সাথে সাথে কথিত প্রগতিশীল পুরুষ লেখকরাও অসূয়ায় ভুগেছেন। এমনকি ছফা ও।

তসলিমার ওপর যে অত্যাচার করা হয়নি সে অত্যাচার করা হয়েছে বলে ফলাওভাবে প্রচার করা হল।

ছফা'র এই মন্তব্য তো রীতিমত অসত্য এবং আপত্তিকর। তসলিমাকে মুরতাদ ঘোষনা করে তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিলো আমার নিজের শহরেই। এটি মিথ্যে ছিলো?

বাংলাদেশের কথিত 'ভাবমূর্তি' নিয়ে ছফার উদ্বেগ তো প্রগতিশীলতা নয় বরং চরম প্রতিক্রিয়াশীল। তসলিমা তার 'লজ্জা' উপন্যাসে যা লিখেছেন তা যদি মিথ্যে না হয়, বাংলাদেশে যদি এমন ঘটনা ঘটেই থাকে তো তা লিখলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে?
সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন করা যায় আর সেটা প্রকাশ করলে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। একজন লেখকের এতো কি দায় পড়েছে দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখার যদি সেই মূর্তি আসলেই ভঙ্গুর থাকে?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

রাজিব মোস্তাফিজ [অতিথি] এর ছবি

দুর্দান্ত মন্তব্য মো্রশেদ ভাই

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

১। তসলিমা তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী লিখেছেন-ঠিকাছে। ইমপ্যাক্ট নিয়ে ভাবেননি-ঠিকাছে। যখন বইটা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উন্মাদনা শুরু হলো, ভারতের সাম্প্রদায়িক আচরণ পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের ঘাড়ে সওয়ার হলো তসলিমা আনন্দবাজারের পুত্তলিকা হিসেবে কাজ করলেন- এটা ঠিক নাই। 'লজ্জা' বইতে কিন্তু প্রেসক্রিপসেন আছে। কলকাতায় দাঙ্গা শুরু তসলিমার প্রেসক্রিপসেন অনুযায়ী হয়েছে। রক্তের বদলে রক্ত, উন্মত্ততার পরিবর্তে ক্রোধান্ধতা। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছিলেন তসলিমা নাসরিন। বদলে জুটেছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি।

২।

তসলিমা যখন দেশ ও দেশের বাইরে খ্যাতি পেয়েছেন তখন মৌলবাদীদের সাথে সাথে কথিত প্রগতিশীল পুরুষ লেখকরাও অসূয়ায় ভুগেছেন। এমনকি ছফা ও।

হয়ত কিছুটা।

তবে দেশের সবচে প্রগতিশীল আর মহান লেখকের কাতারে তসলিমা নাসরিনকে ফেলা যায় না। যে হীন পথে তাঁর খ্যাতি এসেছে সেটা নিয়ে কথা বললে যদি বলা হয় অসূয়ায় ভুগে এসব বলছেন-তাহলে কিছু বলার নেই।

৩।

উদ্ধৃতি
তসলিমার ওপর যে অত্যাচার করা হয়নি সে অত্যাচার করা হয়েছে বলে ফলাওভাবে প্রচার করা হল।

ছফা'র এই মন্তব্য তো রীতিমত অসত্য এবং আপত্তিকর। তসলিমাকে মুরতাদ ঘোষনা করে তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিলো আমার নিজের শহরেই। এটি মিথ্যে ছিলো?

তসলিমাকে মুরতাদ করা প্রসঙ্গে ছফা এই কথা বলেন নি।

৪।

বাংলাদেশের কথিত 'ভাবমূর্তি' নিয়ে ছফার উদ্বেগ তো প্রগতিশীলতা নয় বরং চরম প্রতিক্রিয়াশীল।

এটাই ছফাকে নিয়ে করা ফলাফলের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জনপ্রিয়।

বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার দায়ে মিথ্যার প্রচারে ছফা নামেননি। ভারতের সাম্প্রদায়িকতার দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে আসলে বাকি লেখক-কবিরা আঙুল চুষতে থাকলে ছফা তখন দু কলম লেখেন।

একটা তথ্য, বিজেপি তসলিমার নামে সেই সময় দিল্লীতে বিলবোর্ড পর্যন্ত ঝুলিয়েছিল।

--

মোরশেদ ভাই,

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

একটা পিডিয়েফ পেলাম।

-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

হাসান মোরশেদ এর ছবি

১। তো তসলিমাকে যে বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো তাতে যে বাংলাদেশের আহমদ ছফা আর ইরানের খোমেনী গিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যান শুভাশীষ।
রুশদীর উপন্যাসের নামই 'শয়তানের ভাষ্য'। শয়তানের ভাষ্যে নবীর বিবিদের যে বর্ণনা সেটা ধার্মিকদের সাথে মিলবেনা। এই অপরাধে রুশদীকে মৃত্যুদন্ড দিলো খোমেনী, খোমেনীর না হয় এই সাহিত্যজ্ঞান ছিলোনা যে সাহিত্যের চরিত্র মানেই সবসময় লেখকের নিজের বক্তব্য নয়। একজন ধর্ষকের মানসিকতা লেখক চিত্রিত করলে কিংবা ধর্ষকের ভাষ্যে তার অপরাধের সাফাই গাওয়ালেই লেখক নিজে ধর্ষক হয়ে যায়না। এরকম হলে তো পৃথিবীর সকল উপন্যাস থেকে নেগেটিভ চরিত্রগুলো মুছে দিতে হবে।
বাংলাদেশে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া কোন হিন্দু তরুন যে ওখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের সুযোগ পেলে অত্যাচার করার মানসিকতা ধারন করবেনা এই নিশ্চয়তা আমরা পেলাম কোথায়?

এরকম একটা মানসিকতা যদি উপন্যাসের কোন চরিত্রের থাকে তার দায় লেখককে নিতে হবে?
আফসোস- খোমেনী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধই থেকে যায় আর আহমদ ছফা হয়ে উঠেন প্রগতিশীলতার আইকন।

২।
নাইবা থাকলেন তসলিমা দেশের সবচেয়ে 'প্রগতিশীল আর মহান লেখকে'র কাতারে। কোন 'হীন' পথে তসলিমা তার খ্যাতি অর্জন করলেন? গোটা বিশ্ব তসলিমাকে তখনই চিনেছে যখন বাংলাদেশ সরকার তার বই নিষিদ্ধ করেছে, বাংলাদেশের মোল্লারা তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে, সরকার তার একজন নাগরিককে রক্ষা না করে বরং মামলা, হামলা দিয়ে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছে। তো এই 'হীন' পথ কার তৈরী?

যে ভিকটিম তাকেই শিখন্ডী বানিয়ে দেয়া হলো?

৩।
ছফা বলেছেনঃ

তসলিমার ওপর যে অত্যাচার করা হয়নি সে অত্যাচার করা হয়েছে বলে ফলাওভাবে প্রচার করা হল।

কোন না হওয়া অত্যাচারের কথা তসলিমা প্রচার করেছেন? ছফা কোন প্রচারনার কথা বলেছেন?

৪।

ভারতের সাম্প্রদায়িকতার দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে আসলে বাকি লেখক-কবিরা আঙুল চুষতে থাকলে ছফা তখন দু কলম লেখেন।

এটাকে বলে 'জিঙ্গোইজম'। বাংলাদেশ এমন কোন অসাম্প্রদায়িক দেশ না যে ভারতের সাম্প্রদায়িকতার দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে পড়তে হয়। যে রাষ্ট্রের মুলনীতি ' আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস' সেই রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িকতা আমদানী করতে হয়না। অর্পিত সম্পত্তি আইনের সুযোগে যখন সংখ্যালঘু গ্রাম উজাড় করে দেয়া হয়, সেটা ভারত এসে করেনা।

তসলিমা হয়তো খুবই সামান্য লেখক আপনার কথিত 'প্রগতিশীল আর মহান লেখকের' দলে সে নয়, তার উপস্থাপন অনেকের পছন্দ নয়, অনেকে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করেছেন কিন্তু কেউ প্রমান করতে পারেননি তসলিমা অসত্য লিখেছে। তার বই নিষিদ্ধ করে সরকার এবং মৌলবাদীরা যখন হামলা, মামলা করে তাকে দেশ ছাড়া করেছে তখন বাংলাদেশের অমেরুদন্ডী লেখককুল মজা দেখেছে।

একটা তথ্য, বিজেপি তসলিমার নামে সেই সময় দিল্লীতে বিলবোর্ড পর্যন্ত ঝুলিয়েছিল।

তো? উগ্র খ্রীষ্টানগ্রুপ গুলো তো রুশদী'র পক্ষে ব্যাপক ক্যাম্পিং করেছিল। রুশদী কি খ্রীষ্টানদের দালাল?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

১।

আফসোস- খোমেনী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধই থেকে যায় আর আহমদ ছফা হয়ে উঠেন প্রগতিশীলতার আইকন।

আফসোস কইরেন না বস্। প্রতিক্রিয়াশীল তকমা ছফার গায়ে অনেকেই লাগিয়েছে। ধর্মান্ধ ট্যাগ কতিপয় কয়েকজন। ছফা তাঁর নিজের কাজেই পরিচিত হবেন। ক্ষুদ্রাঙ্গিকে আমার কাজ ছফাকে আমার মতো করে চিনে নেয়া। কিছুটা চেনানো। লং রানে ছফা ঠিকঠাক মানুষের কাছে পরিচিত হবেন এই আশা রাখি।

খোমেনীর সাথে ছফার তুলনা বা প্রতিতুলনা নিয়ে আর কিছু না বলি।

একজন ধর্ষকের মানসিকতা লেখক চিত্রিত করলে কিংবা ধর্ষকের ভাষ্যে তার অপরাধের সাফাই গাওয়ালেই লেখক নিজে ধর্ষক হয়ে যায়না।

কথা ঠিক। কোয়েটজির ডিসগ্রেসের কথা মনে পড়ছে।

২।

গোটা বিশ্ব তসলিমাকে তখনই চিনেছে যখন বাংলাদেশ সরকার তার বই নিষিদ্ধ করেছে, বাংলাদেশের মোল্লারা তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে, সরকার তার একজন নাগরিককে রক্ষা না করে বরং মামলা, হামলা দিয়ে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

এটা ঠিক- হীন পথটা তৈরিতে এদেশের মৌলবাদীদের সাথে ভারতের মৌলবাদীরা অনেকাংশে দায়ী।

এখানে প্রয়োজনীয় অনুঘটক ছিল আনন্দবাজার আর তসলিমা নাসরিনের কুটো আঁকড়ে ধরা। বাংলাদেশের মোল্লারা যখন তসলিমার সাথে গুন্ডামি করছিল, সরকার যখন ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ করল- ছফা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কলাম লিখেছিলেন। আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তির পর কলকাতায় ঘটতে থাকা উন্মাদনা দেখে ছফা তসলিমার বিরুদ্ধে কলম ধরেন। এগুলো জাস্ট তথ্য।

৩। আনন্দবাজার ঘেঁটে জানাই।

৪।

বাংলাদেশ এমন কোন অসাম্প্রদায়িক দেশ না যে ভারতের সাম্প্রদায়িকতার দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে পড়তে হয়। যে রাষ্ট্রের মুলনীতি ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস’ সেই রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িকতা আমদানী করতে হয়না। অর্পিত সম্পত্তি আইনের সুযোগে যখন সংখ্যালঘু গ্রাম উজাড় করে দেয়া হয়, সেটা ভারত এসে করেনা।

এগুলো ও ঠিক কথা।

ভারত তাঁর নিজেরটা ভালো বোঝে। তাঁদের সংখ্যাগুরু জনগণ ও। সেক্যুলারিজম সংবিধানে রেখে ধর্মান্ধ ফ্যানাটিকদের হাতে তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তুলে দেয়, দাঙ্গা চর্চা করে, পরে সুযোগ বুঝে অন্যের দোষ সামনে এনে নিজের গায়ে লেগে থাকা রক্তের দাগ ইরেজার দিয়ে মোছে। ঠিকাছে। আর আমরা কম বুঝি বলেই আমরা এখনো আমরাই আছি।


------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্য, টিভি চ্যানেল, সিনেমা, গান ইত্যাদির প্রবেশ যে প্রায় নিষেধ এটা সবাই জানেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কোন আইন করে বা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এগুলো নিষেধ করেনি। কিছু ইউনিক বাজার কৌশল ব্যবহার করে এই কাজগুলো করা হয়েছে। তারপরও পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের ভাষা, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এক হওয়া সত্ত্বেও এটা সম্ভব হয়েছে। এটা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে কখনো উচ্চবাচ্য হয়েছে অমনটাও শুনিনি। বাংলাদেশের পুস্তক-পত্রিকা আমদানীকারক ও বিক্রেতারা, কেবল অপারেটররা, চলচিত্র আমদানীকারক ও পরিবেশকরা, সঙ্গীতের ক্যাসেট/সিডি আমদানীকারক ও বিক্রেতারা বা শিল্পী আমদানীকারকরা তাদের পশ্চিমবঙ্গীয় প্রতিপক্ষের ন্যায় আচরণ করতে পারলেই অবস্থাটা দুই জায়গাতেই কেমন প্রতিক্রিয়া দেয় তা বোঝা যেত।

এই প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনোভাবটাও লক্ষণীয়। তারা পাকিস্তানী টিভি দেখতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশী টিভি না। বাংলাদেশে গত ছয় দশকে শিল্প-সাহিত্যে কী কাজ হয়েছে সেটা জানতেও তাদের আগ্রহ নেই। সেখানে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন সত্য, তবে সংখ্যায় তাঁরা নিতান্তই অল্প। এই ধরণের আচরণে পশ্চিমবঙ্গের কী লাভ হয় জানিনা, তবে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষতি হয়। একপক্ষ আরেকপক্ষের ব্যাপারে চোখ-কান বন্ধ করে রাখলে মিথষ্ক্রিয়া হয়না, জানার ঘাটতি থেকে যায়। তখন বার বার চাকা আবিষ্কার করতে হয়।

*************************

আনন্দবাজার গ্রুপের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক সাফল্য ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে তার ব্যাপক প্রভাব নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।

*************************

"ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাঁধে"

পশ্চিমবঙ্গ এই দায় ভারত ভাগ হবারও বহু আগে থেকে পালন করে আসছে। এটা নতুন কিছু নয়। এখনো এই দায়িত্ব সে পালন করে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

"ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাঁধে"

পশ্চিমবঙ্গ এই দায় ভারত ভাগ হবারও বহু আগে থেকে পালন করে আসছে। এটা নতুন কিছু নয়। এখনো এই দায়িত্ব সে পালন করে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার।

বস্‌,

আপনি আলোচনা শুরু করতে পারেন। হাসি

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সিরাত এর ছবি

লেখা আগেই পড়ছি, কমেন্টের লাইগা আবার পড়লাম। ভাল্লাগলো।

মনমাঝি এর ছবি

# "যে সাহিত্যের চরিত্র মানেই সবসময় লেখকের নিজের বক্তব্য নয়। একজন ধর্ষকের মানসিকতা লেখক চিত্রিত করলে কিংবা ধর্ষকের ভাষ্যে তার অপরাধের সাফাই গাওয়ালেই লেখক নিজে ধর্ষক হয়ে যায়না। এরকম হলে তো পৃথিবীর সকল উপন্যাস থেকে নেগেটিভ চরিত্রগুলো মুছে দিতে হবে।"

=>> আচ্ছা, এই যুক্তি বা অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে বা ছদ্মাবরনে একজন লেখক যদি সত্যি সত্যি নিজের প্রকৃত মনের কথাটাই প্রকাশ করেন - তখন সেটা বুঝা যাবে কি করে ? আর লেখকের সেই ধরি মাছ, না ছুঁই পানি-মার্কা "পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা" (এক্ষেত্রে 'চরিত্রের' ঘাড়ে)-র অসৎ প্রতারক মনোবৃত্তির যদি কোন বাস্তব নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট দেখা দেয়, তখন তার দায়-দায়িত্ব কি একটুও ঐ লেখকের উপরে বর্তাবে না ?

দুনিয়ার আর সব পেশার লোকের পক্ষেই অসৎ, প্রতারক বা দুর্নীতিবাজ হওয়া সম্ভব - কিন্তু স্রেফ 'লেখক' বা 'সাহিত্যিক' হলেই তিনি সর্বদা 'ধোয়া তুলসী পাতা' হয়ে যাবেন, এবং তার 'সাত খুন মাফ হয়ে যাবে' ?

# "...সবসময় লেখকের নিজের বক্তব্য.." না হতে পারে, কিন্ত ঐ 'সবসময়' শব্দটির ব্যবহার থেকেই বুঝা যায় যে অনেকসময় সেটা হতেই পারে, পারে না ? প্রশ্ন হল, কখন এটা তার নিজের বক্তব্য আর কখন নয় সেটা বুঝা যাবে কি করে ? প্রতি পদে 'এটা আমার বক্তব্য' - এই মর্মে লেখক বা তার সমর্থকগোষ্ঠীর কাছ থেকে লিখিত সার্টিফিকেট বা সম্মতিপত্র আদায় করে তবেই তার সমালোচনা করতে হবে ? অর্থাৎ, হাওয়া খারাপ দেখলেই যাতে তিনি 'চরিত্রের' ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দিয়ে ধরি মাছ, না ছুঁই পানি-মার্কা একটা বক্তব্য দিয়ে নিজের সব দায়িত্ব অস্বীকার করে হাত ধুয়ে ফেলতে পারেন, আর পরিস্থিতি অনুকুল ও লাভজনক মনে করলে লাফ দিয়ে সব কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন -- এরকম একটা অনৈতিক সুবিধাবাদী সুযোগ বা এস্কেপ রুট সবসময় তার জন্য খোলা রাখতে হবে ? অর্থাৎ, আমার কোন কাজের পরিনতিতে কোন ক্ষতি হলে তার দায় অন্য সবার আর লাভ হলে তার কৃতিত্ব শুধু আমার ? এই কি ?

এতো মনে হচ্ছে একেবারে ঢাকাই পলিটিশিয়ানদের সবচেয়ে মনোমত দর্শনটারই অপূর্ব সাহিত্যিক প্রয়োগ হো হো হো

কয়েকদিন আগে একটি ছাত্র-সংগঠনের কিছু সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে আমাদের এক প্রধান দলের সিনিয়র নেতা বললেন (কিছুটা প্যারাফ্রেইয করছি) -- ওরা আমাদের অঙ্গসংগঠন নয়, সুতরাং ওদের কর্মকান্ডের দায়িত্ব আমরা কেন নেব ? কথাটা টেকনিকালি বা অফিশিয়ালি এখন হয়তোবা আপাতদৃষ্টে সত্য -- উনারা কাগজেপত্রে (জানামতে) আর 'অঙ্গসংগঠন' নন, 'সহযোগী সঙ্গঠন' মাত্র (অনেকটা যেন সাহিত্যের চরিত্রের মত !) -- কিন্তু এই 'হাসির এটমবোমা'-রূপী দুনিয়া-কাঁপানো 'সত্য'-টার মধ্যে প্রকৃত সত্যতা কতটুকু বা সেই সত্যের চরিত্র কি, সে তো দেশসুদ্ধ সবাই জানে !! কিন্ত না, সবার জানা ভুল - কেবল সমর্থকগোষ্ঠী যা জানেন বা বলেন - সেটাই কেবল সত্যি ? ওনারা যখন যেমন সার্টিফিকেট দিবেন - দেশসুদ্ধ আর সবাইকে তখন তেমন তেমন করেই ভাবতে হবে - তার বাইরে আর কিচ্ছুটি ভাবা বা বলা যাবে না ?!! আর ভাবলে, তারা সবাই হয় গনণ-অযোগ্য মস্তিস্কশুন্য মূর্খ বর্বর পর্ণভোজী বলে গন্য হবেন, আর নয়তো আমাদের বিরোধীদলীয় মহাসচিবের মতো করে এক্ষেত্রেও বলতে হবে তারা সবাই 'ফ্যাসীবাদী' (যেহেতু তারা আমার দায়িত্ব আমাকে ওন করতে বলছেন) ?

উপরে বেশ কিছু প্রশ্ন করলাম (এবং এগুলো একটাও ব্যক্তিগত নয়, কারন একদম শুরুতে উদ্ধৃত সূত্রটা অনেক পূরনো এবং ব্যপকভাবে ব্যবহৃত এবং এখানে যিনি উল্লেখ করেছেন তার আবিস্কারও নয়), এবার আমি একটা অর্বাচীন মতামত দেইঃ
রাজনীতির মত সাহিত্যেও এখন আর জমিদারতন্ত্রের যুগ নেই। এখন যেটা আছে সেটা স্রেফ লোকদেখানো ভেক বা ঢং এবং গা-জোয়ারি - ভাবখানা এই যে - পাবলিকও বুঝে, আমরাও বুঝি, এবং পাবলিক যে বুঝে সেটাও আমরা বুঝি এবং আমরা যে বুঝি সেটাও ওরা বুঝে - স্রেফ মুখে স্বীকার না করলেই হলো, বলে যাও যা খুশী যত খুশী হোক না যত উদ্ভট বা এবসার্ড বা উস্কানিমূলক ! হুবহু সেই বিখ্যাত 'নগ্ন-সম্রাটের' মতো ! উনি যে নগ্ন সেটা সম্রাটও বুঝছেন, পাবলিকও বুঝছে, পাবলিক যে বুঝছে সেটাও উনি বুঝছেন - কিন্তু তবু আত্নসম্মানরক্ষার্তে সত্য ঢাকার (অর্থাৎ ওনার নগ্নতা ঢাকার জন্য) জন্য একটা আধিবিদ্যিক বা তুরীয় তত্ব ও আবহ তাঁকে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। সাহিত্যেও মনে হয় ঠিক এই খেলাই চলছে এখন।

তবে, আধিবিদ্যিক বা তুরীয় তত্বকথার ধুম্রজাল বা "ওরা আমাদের অঙ্গসংগঠন নয়..."-মার্কা হাসির-এটমবোমারূপী অজুহাতের আড়াল নেয়া এখন আর সম্ভব নয়। পাঠক/জনগন এখন আগ-পিছ মিলিয়ে অনেক গোমরই বুঝে ফেলতে সক্ষম। কে কার অঙ্গসঙ্গঠন, সহযোগী-সংগঠন, 'কথা বলতে দেয় না...বা একটা সিট বেশি দেয় না...এই জন্য সংসদে যাচ্ছি না', কে নায়ক কে ভিলেন - নাকি পাত্রপাত্রী তাদের পিছনের গডফাদাররাসহ সবাই ভিলেন, বা আসলে কে কার 'চরিত্র' বা কোনটা 'কার' বক্তব্য -- এইসব মেটাফিজিক্স ভেদ করাটা এখন ঐ অদৃশ্য-পোশাকের অদৃশ্যমানতাটা ভেদ করার চেয়ে বেশী শক্ত নয়, এবং সে জন্য কারো কাছ থেকে কোনও NOC বা ক্রেডেনশিয়ালের কোন প্রয়োজন বা দরকার নেই । সম্রাটের ক্ষেত্রে যেমন দরকার হয়নি ঐ শিশুটির। সবাই যা বুঝেছিল, ঐ শিশুটি সেটা মুখ ফুটে বলে দিতে দ্বিধা করেনি। শিশু বলেই হয়তো গুরুজনদের চাক্ষুষ সত্যের প্রতি আত্নপ্রতারনামূলক মেটাফিজিক্যাল (এবং ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো আইডিওলজিকালও) -- ভীতি, বা গুরুবাদীদের চোখ-রাঙানি -- এসব তার চোখে পড়েনি। পড়েছে স্রেফ আসল ব্যাপারটা। বেচারা শিশু !

হ্যাঁ তবে, অন্ততঃ তসলিমার ক্ষেত্রে ঐ শিশুটাই যথেষ্ট।
ভয় পেতে পেতে কানের কাছে হাসির-এটমবোমার বুশীয় 'শক এন্ড অ'-জাতীয় আক্রমণ সত্ত্বেও হাসতে ভুলে যাওয়া -- মানসিকভাবে গুরুবাদ, ভক্তিবাদ, গোষ্ঠীবাদ, আইডিওলজি, পোলারাইজেশন আর পার্টিজানশীপের গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে জাজ্বল্যমান-দৃশ্যমান বাস্তবতাকে বা সত্যকে এবং কোদালকে-কোদাল বলার মতো নিজের বিবেক ও সৎ-সাহসকে 'অদৃশ্য-পোশাক'-জাতীয় উদ্দেশ্যপরায়ন অধিবিদ্যার কাছে বন্ধক রাখা বা সেই অধিবিদ্যাকে ভয় পেয়ে যাওয়া ঘুলিয়ে-যাওয়া মনের গুরুজনদের এক্ষেত্রে কোন প্রয়োজন নেই।

আর হ্যাঁ, সাহিত্যের চেয়ে বাস্তবতা অনেক বড়! একটি মানুষও যদি ঐ সাহিত্যের ইন্ধনে আহত-নিহত-নির্যাতিত-লাঞ্ছিত হয়ে থাকে, তবে আমি বলবো বিশ্বব্ররম্মান্ডের কোন আধিবিদ্যারই ক্ষমতা নাই যে ঐ 'সাহিত্য' (বা তার স্রষ্টার) থেকে এই পাপের দায়িত্ব বা কালিমা মুছে দিতে পারে! এবং এর দায়িত্ব তাকে নিতেই হবে।

এ প্রসঙ্গে আমার শেষ কথাটি হচ্ছেঃ ১. সুচনার উদ্ধৃতিটির সাথে আমি কিন্তু এ্যাজ সাচ পুরোপুরি দ্বিমত প্রকাশ করি না। তবে এই ক্ষেত্রে করি। আর মনে হয়, এই যুক্তিটা কোন অসৎ লেখকের আত্নরক্ষার ঢাল হয়ে উঠতে পারে না। ২. নিজ ঘরের চার দেয়ালের বাইরে পাবলিক জীবনে আপনি কোন কাজ করলে বা ভূমিকা পালন করলে, সেই কাজের পরিনতির দায়িত্ব আপনাকে নিতেই হবে। সেটা এক্সপ্লিসিটলি ইন্টেনশনাল হোক বা না হোক। বিশেষ করে যেখানে দাঙ্গার মতো, মানুষের জীবনের ঝুঁকি যেখানে আছে তেমন ইস্যুতে। বাস্তব মানুষের বাস্তব জীবন কোন ছেলেখেলার বিষয় নয়, নয় ছিনিমিনির বিষয় ! শিল্প-সাহিত্য কেন, পৃথিবীর কোনো কিছুর খাতিরেই নয় !!! সাহিত্য থেকে জীবন অনেক বড় এবং বাস্তব। এটা যারা বুঝেন না, পাবলিক জীবনে তাদের কোন ভূমিকা রাখার অধিকার থাকা উচিত নয় - অন্ততঃ কোনো আধিবিদ্যিক ঢালের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার তো নয়ই। ভালো হয়, নিজে ভিক্টিম না সেজে অমন এক্টা সাহিত্য-জনিত দাঙ্গায় কোনো প্রিয়জন হারানো বা লাঞ্ছিত মানুষের কাছে ঐ সাহিত্যিককে সাহিত্য-তত্ব ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া তাকে বুঝাতে কেন তার নিজের বা প্রিয়জনের বাস্তব জীবনের চেয়েও ওই বায়বীয় সাহিত্য বা সাহিত্য-তত্বের কাল্পনিক কূটকচালী বেশি গুরুত্বপুর্ন এবং বেঁচে থাকার অধিক দাবিদার।
৩. আসল কথা হচ্ছে, বর্নিত বিভিন্ন ঘটনাকে চরিত্রকে লেখক কিভাবে উপস্থাপন করছেন, সিলেক্ট করছেন, লেখকের নিজস্ব নৈতিক-আবেগিক ঝোঁক বা সমর্থন কোনদিকে -- এসব কিন্তু স্পষ্ট করে না বল্লেও অনেক সময়ই স্পষ্টই বোঝা যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না। 'ধর্ষক-চরিত্রের আত্ন-সাফাইয়ের' পক্ষে যদি তার মৌন সমর্থন, এমনকি দায়িত্বহীন উপেক্ষা বা মৌনতা থাকে বা এমন আবহ সৃষ্টি করা হয় যাতে লেখকের নৈতিক-মৌনতা বা নিরপেক্ষতাই সম্মতির বা সে কাজের ঔচিত্যের লক্ষন বা নিরব প্রেস্ক্রিপশন বলে অনুদিত হতে পারে বা তা বাস্তব-জীবনে বাস্তবায়িত করার 'কিউ' হয়ে উঠতে পারে কারো কারো কাছে -- তাহলে তার দায় লেখককে নিতেই হবে। কেননা সমাজে সব রকম মানুষই আছে। বাস্তব মানুষ হিসাবে তার দায়িত্ব রয়েছে অন্য বাস্তব মানুষের প্রতি - তাদের জীবনের জন্য তারই সৃষ্টিকর্ম যেন বিপজ্জনক হয়ে না উঠে সেজন্যে নিজের সৃষতিকর্মে তেমন সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অন্তর্নিহিত সুরক্ষা রাখা তার অনস্বীকার্য দায়িত্ব। তসলিমা এই দায়িত্ব বহু ক্ষেত্রেই অত্যন্ত প্রকট এবং বিকট ভাবেই পালন করেননি, করতেও চাননি।

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

## "বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নিজের মেরুদণ্ডের ওপর জোর নেই। তাঁদের আত্মবিশ্বাসের ব্যাপক ঘাটতি আছে। নিজেদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত সেটা নিয়ে তাঁরা আগাগোড়াই সন্দিহান।"
(‘ছফাগিরি’। কিস্তি ১১। শুভাশীষ দাশ।)

=>> কিন্তু কেন তাঁদের মধ্যে সেই জোর, আত্নবিশ্বাস, আত্নমর্যাদাবোধ, আত্নবোধ ও "strength of purpose" নেই ? এই প্রশ্নটা কি আরো মৌলিক নয় ? এর জবাবটাই কি আরো বেশি জরুরী নয়? হয়তো এজন্যেই -- শুধু ছফা কেন, নিজেদেরই আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনা ?

শুভাশীষদা, আমার ধারনা এই "মেরুদণ্ডের ওপর জোর" না থাকা, "আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি" আর "নিজেদের ভূমিকা" নিয়ে দ্বিধা, সন্দেহ, দোদুল্যমানতার পিছনে আসলে এখনো আমরা যে স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের "জাতীয় পরিচয়" (national identity) বা জাতীয়-আত্নপরিচয়বোধ এবং পার্পাজ-বোধের ইস্যুতে কোন সর্বজনীন (বা নিদেনপক্ষে অধিকজনীন(?)) স্থির সিদ্ধান্ত, ঐক্যমত্য, বা উপলব্ধিতে পৌঁছুতে পারিনি সেটি একটা মূল বা প্রধান কারন। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মত এই ইস্যুতে আবার সমাজে একটা মেরুকরন ঘটে গেছে। ফলে অনেক সময়ই আমরা এই বিষয়গুলি কোন গ্রে এরিয়া বা শেড ছাড়াই বিশুদ্ধ 'সাদা-কালো' দৃষ্টিতে দেখে থাকি বা দেখানো হয়ে থাকে। আমরা একে অপরের বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গিতে বিন্দুমাত্র সত্যতা বা যাথার্থ্য আর খুঁজে পাই না। (ছফার যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার এটাও হয়তো একটা কারন)।

নিজেদের জাতীয়তা বা জাতীয়-পরিচয় প্রশ্নে এই দোদুল্যমানতাটা পার্টি-পলিটিক্সের পর্যায়ে "বাঙালি না বাংলাদেশি" প্রায়ই এই স্থুল বিতর্কের রূপ ধারন করে। আর সে বিতর্কে দুই প্রধান শিবিরের ধ্বজাধারী বুদ্ধিজীবীরা 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের' না 'বিপক্ষের', 'পাকিস্তানপন্থী' না 'ভারতের দালাল' -- এই জাতীয় ফালতু বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বা কাদা-ছোঁড়াছুড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে মূল ইস্যুটাকে আরো ঘুলিয়ে দেন।

অবশ্য ওই বিষয়গুলার একেবারেই যে কোন প্রাসঙ্গিকতা নাই তা হয়তো নয়, তবে উনারা এগুলোকে প্রায়ই নিজেদের ব্যক্তিগত আবেগ/পছন্দ, পক্ষপাতিত্ব, রাজনীতি, গোঁয়ার্তুমি, মেগালোম্যানিয়া, এলিটিজম, অসহিষ্ণুতা, গোঁড়ামি, প্রেজুডিস, প্যারানইয়া অথবা ফ্যাসিবাদী মনোবৃত্তির কারনে কেন্দ্রীয় বিষয় করে তুলেন এবং এসব ক্যাচ-ফ্রেইজ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ও শর্টকাটে বা গায়ের-জোরে নিজেদের মতপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করে থাকেন বলে মনে হয় -- মূল ইস্যুটাকে আরো পরিস্কার করার বা তার গভীরে যাওয়ার জন্য নয় । অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়। অথচ, ঐ মেরুদন্ডের জোর, আত্নবিশ্বাস বা 'নিজেদের ভুমিকা' নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার জন্য বিষয়ের গভীরে যাওয়া এবং নির্মোহ, খোলা ও সহানুভূতিশীল মনে সবপক্ষের বক্তব্য ও অনুভূতি মনোযোগ দিয়ে শোনা ও গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সবপক্ষকে নিয়েই 'জাতি' হয় - কেবল একপক্ষকে নিয়ে নয়। তবেই জোর ও আত্নবিশ্বাস আসতো, কিন্তু এখন যা হয়েছে তা হলো - কেউই আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারে না যে তারা সবপক্ষেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এখানেই দুর্বলতা। এই দুর্বলতা শুধু এই ইস্যুতে নয় -- জাতীয় জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দৃশ্যমান।

আবার এঁদের মধ্যে যারা একটু চালাক বেশী (এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত) এবং নিজেদের পার্টি-পরিচয়, রাজনীতি-বিশ্বাস ও ভূ-রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, ধর্মীয়/মতাদর্শিক/দার্শনিক ঝোঁক ইত্যাদির পরিচয়ের গন্ডীতে পাবিলিকলি ধরা পড়তে বা সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত হতে চাননা (যাতে করে তাদের প্রকৃত মোটিভেশন বা উদ্দেশ্য প্রকাশ্যে বুঝা না যায় ), তাঁরা আরো সুক্ষ সব কৌশল ব্যবহার করেন যেগুলো সবাই সাধারনত চট করে ধরে উঠতে পারে না।

যেমন একটা উদাহরন ধরুনঃ যারা ভারত বা হিন্দু-বিরোধী বা তাদের থেকে স্বাতন্ত্র্য রচনায় পক্ষপাতী, বা নিজেদের মুসলমানিত্বের পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে চান এবং বাঙ্গালিত্বের ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী নন অথচ একই সাথে রাজাকার/মৌলবাদী/সাম্প্রদায়িক/পাকিস্তানের দালাল/স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি/পশ্চাৎপদ কুপমন্ডূক/স্বজাতিবিদ্বেষী ইত্যাদি গালাগাল শুনতে চাননা -- তারা "বাংলাদেশী" পরিচয়টা বেশী পছন্দ করেন। কারন 'বাংলাদেশী" পরিচয়ের আশ্রয় বা ছাতাতল থেকে তারা পশ্চিম এশিয়া, ইসলাম, বৃহত্তর ইসলামী ইতিহাস (বা মধ্যপ্রাচ্যীয়)- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে নৈকট্য/একাত্নতা অনুভব করা অধিকতর সহজ বলে অনুভব করেন। বাঙালি বললে কেমন যেন একটা দুরত্ব সৃষ্টি হয় তাদের মনে, হয়তো খানিকটা এতিম-এতিম ভাবও। কিন্তু এই কথাগুলি তাদের সবাই (একটি অংশ) সবসময় স্পষ্ট করে প্রকাশ্যে বলতে পারেন না -- তাই তারা এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশের এথনিক মাইনরিটিদের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। প্রসঙ্গটা বৈধ, কিন্তু পিছনের উদ্দেশ্যটা সবসময় তা নয়।
আমি এখানে অবশ্য চরম ধর্মীয়-দক্ষিনপন্থী ও চরম-বামপন্থীদের হিসাবের বাইরে রাখছি আপাতত। তারা মনে হয় না জাতি/জাতীয়তাবাদ বা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মনুষ্যত্ব নিয়েও বিশেষ চিন্তিত। তাদের কাছে প্রায়ই সবার উপরে-নিচে তত্ত্ব সত্য, তাহার উপরে-নিচে আর কিছু নাই। অন্য সবকিছুই সেই তত্ত্বের প্রতিভাস মাত্র। সুতরাং তাদের হিসাব আলাদা। তাছাড়া তারা মনে হয় একদম প্রান্তিক উপাদান।

অন্যদিকে আবার, ধরুন যাঁরা সেকুলারপন্থী, নাস্তিক্যবাদী, এগ্নস্টিক বা রাজনৈতিক/ঐতিহাসিক/মতাদর্শিক/দার্শনিক ইত্যাদি না-না কারনে রাজনীতি বা জাতীয় পরিচয়ের ইস্যূতে ধর্মের কোনরকম ভূমিকা থাকা উচিত বলে মানতে চান না, তাদের অনেকে (সবাই নন) কথাটা স্পষ্ট করে প্রকাশ্যে না বলে (তাদের মনে হয় ভয় যে তারা এমন কিছু বললে তারা ধর্মবিরোধী এমন একটা পাবলিক-পারসেপশন তৈরি হবে এবং এর ফলে জনমনে তাদের গুরুত্ব কমে যাবে) -- জাতি, জাতীয়তা, 'জাতিসত্তা', নেশন, ন্যাশনালিটি, জাতীয়তাবাদ, নাগরিকত্ব, এথনিসিটি, রেস, বায়োলজি, এনথ্রপলজি, সায়েন্স, পলিটিকাল সায়েন্স - সবকিছু মিলিয়ে-গুলিয়ে একাকার করে ফেলেন ইচ্ছে করেই যেন। কোনটা কি জিনিষ, কোনটার সাথের কোনটার কি সম্পর্ক পার্থক্য বা মিল, তাদের চরিত্র কি এবং গ্রহণযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু আধুনিক চিন্তার প্রেক্ষিতে, এসব মূলত পাশ্চাত্য-জাত ঐতিহাসিক এবং নিয়ত-বিবর্তনশীল প্রত্যয়গুলির বিষয়ে কয়েকশ’ বছর বা শতাব্দীকাল আগে নয় বরং বর্তমানে পশ্চিমে কি ভাবা হয়, এবং আমাদের ক্ষেত্রে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে এগুলি কোনটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক সেসব পরিস্কার না করে, তারা এগুলোর বিভ্রান্তিকর বাংলা অনুবাদ করে তারপর তার উপর ভিত্তি করে আরো বিভ্রান্তিকর গোলকধাঁধার মতো স্বরচিত (কিন্তু সাধারনত বিজ্ঞান, আধুনিকতা, বৈশ্বিকতা বা প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের নামে) নতুন (?) সব তত্ত্ব দিয়ে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে চান। সোজা কথাটা সোজাসাপ্টা না বলে। সমস্যা হলো, আমার মত সাধারন মানুষ যারা এত ইতিহাস, দর্শন, পলিটিকাল সায়েন্স, এন্থ্রপলজি, বিজ্ঞান ইত্যাদি পড়িনি, তারা পন্ডিতদের এত পন্ডিতির ধুম্রজালে দিশেহারা হয়ে যাই।

তবে আমি এটুকু বুঝি বা মনে করি যে, ঐসব পাশ্চাত্য-জাত প্রত্যয় ও পরিভাষাগুলি সুদীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমা দুনিয়ার বিশেষ ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন-লব্ধ বা বিবর্তনের ইউনিক অভিজ্ঞতাজাত চিন্তা, চেতনা ও উপলব্ধির নিষ্কাশিত ফসল ও প্রকাশ। এবং এই চিন্তা ও উপলব্ধিও কোন স্থির, জমে যাওয়া বা ফসিলিভূত বিষয় নয়, বরং নিয়ত-বিবর্তনশীল। এই বিশেষ ধারায় বিবর্তনজাত অভিজ্ঞতা অন্যদের বা এই উপমহাদেশের (বিশেষ করে আমাদের) মানুষের নেই, ফলে নেই ঐ-রকম অভিজ্ঞতাজাত সুস্পষ্ট উপলব্ধি/চেতনা; সুতরাং নেই সেই উপলব্ধি-জাত দেশি শব্দভান্ডার বা একই উপলব্ধির অথেনটিক ধারক-বাহক-প্রকাশক ও সমার্থক দেশজ পরিভাষাও। আমাদের সমাজ, ইতিহাস, ইতিহাস-বোধ, ঐতিহাসিক বিবর্তনের অভিজ্ঞতা ও সেই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উপলব্ধি ভিন্নরকম, ফলে এ সংক্রান্ত আমাদের শব্দভান্ডারও ভিন্ন দ্যোতনার ধারক। অনেকসময় আবার আমার মনে হয়, পাশ্চাত্যের মতো আমাদের ইতিহাসের ক্ষেত্রে সর্বদা কোন সুস্পষ্ট বৌদ্ধিক উপলব্ধি নেইও – বরং অনেক ক্ষেত্রেই যা আছে তা আসলে অন্য প্রকাশ্য নামে বা চেহারায় কোন সামষ্টিক অবচেতনের সুপ্ত অবশেষ* (সেটা ভালো-মন্দ ঠিক-বেঠিক যাই হোক) – তত্ত্ব, চিন্তা, মনোভঙ্গি, অনুভুতি, ইতিহাস, মিথ, ফোক, ভাষা ও শব্দের মধ্যে লুকিয়ে। এখন অনুবাদের নামে জোর করে সম্পুর্ণ ভিন্ন এক ধারার ইতিহাস, ইতিহাসসঞ্জাত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি আরেকটি ধারার শব্দ বা পরিভাষার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না – বিশেষ করে সেই শব্দটা নিজেও যদি একই রকম ‘লোডেড’ হয় বা তারও নিজস্ব একটা ইতিহাস থাকে – সেটা সচেতন বৌদ্ধিক স্তরেই হোক, বা না হয়ে উপরোক্ত অবচেতনের স্তরেই হোক। এরকম জবরদস্তি করতে গেলে অনেকসময় মনে হয় সোর্স শব্দের খোলসটা হয়তো আপাতদৃষ্টে ঢুকে, কিন্তু অন্তঃসারটা ঠিকই পড়ে থাকে বাইরে। ফলে সৃষ্টি হয় অনেক বিভ্রান্তির। আর সোর্স-শব্দের শানে-নুযুলটাও একই সাথে ঢুকানোর চেষ্টা করতে গেলে প্রয়োজন পড়ে যায় অনেক রাখ-ঢাক-গুড়গুড়, অপব্যাখ্যা, বিভ্রান্তি, স্পিনিং বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। এর ফলে আবার বিভ্রান্তির সাথে সাথে সৃষ্টি হয় অনেক সচেতন আর অবচেতন দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত ও বিরোধও।

এই যেমন ধরুন, ‘নেশন’ ও ‘জাতি’ শব্দ দুটির কথা - এবং নেশনের অনুবাদ হিসাবে ‘জাতি’র কথা। আপাতঃদৃষ্টে নিতান্তই নিরীহ দুটি শব্দ! কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ও সামষ্টিক অঙ্গনে, সেনসিটিভ ও ক্রিটিকাল লেভেলে, এগুলি কি আর ততটা নিরীহ-নির্বিরোধ থাকে ? এর কারন আসলে (অন্যতম অন্তত) কি এই না যে, নেশন-জাতি দুটি শব্দের পিছনেই আলাদা-আলাদা নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহাসিক-অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধি এবং অন্তত শেষেরটার (জাতি) ক্ষেত্রে উপরন্তু হয়তো সেই সামষ্টিক অবচেতনের সুপ্ত অবশেষ বা বর্তমান, বা উভয়েরই কোন অত্যন্ত জটিল, বহুপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক সংশ্রব রয়ে গেছে ? এ কারনেই হয়তো আমাদের এখানে সেকুলারপন্থিদের জন্য ‘জাতি’কে বাংলায় ‘নেশনের’ সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলতে এত কষ্ট হচ্ছে। এজন্যেই হয়তো তাদেরকে পাব্লিকলি অনেক রাখ-ঢাক-গুড়গুড়, বিভ্রান্তি, স্পিনিং বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আশ্রয় নিতে হচ্ছে (হয়তো উনারা সেটা অনেকসময় নিজেরাও বিশ্বাস করেই বলেন)। এই জটিলতা থেকেই হয়তো জাতি/জাতীয়তা/জাতীয় পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে এত সংশয়, বিতর্ক ও বিরোধের সৃষ্টি - যা কি ধর্ম, কি বায়োলজি-এনথ্রপলজি-ফিলসফি- সায়েন্স-পলিটিকাল সায়েন্স বা দুনিয়ার তাবৎ বিষয়ে পান্ডিত্যপুর্ন বাক্যজাল বিস্তার করেও ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। মেলানো যাচ্ছে না পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত, দীক্ষিত ও উজ্জিবীত বৌদ্ধিক এলিটদের রাজনৈতিক, দার্শনিক বা মতাদর্শিক অবস্থানের সাথে ভিন্ন পক্ষের বা সঙ্খ্যাগুরু আমজনতার সামষ্টিক সচেতন ও অবচেতনের সুপ্ত অবশেষ ও বর্তমান। একই কথা ডানপন্থী বা মধ্য-ডানপন্থীদের বেলাতেও সত্য। তবে তাদের এপ্রোচটা অত ইনটেলেকচুয়াল নয়, বরং উলটো – নিজেদের অজান্তেই বোধহয় অবচেতনের নির্বাচিত একটা অংশকেই তারা এ্যকসেনচুয়েটেড ও ম্যাগ্নিফায়েড করে প্রকাশ্য বৌদ্ধিক রূপদান করার চেষ্টা করেন নিজেদের মতো করে।

আমাদের ‘উদারপন্থী’ বা ‘প্রগতিশীল’ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ইদানিংকালে জাতীয়-পরিচয় সঙ্ক্রান্ত একটা শ্যাম-মান দু-কুল রাখা জনপ্রিয় ব্যাখ্যা (অন্তত মিডিয়াতে যেভাবে আসে এবং আমি যদি বুঝে থাকি) মনে হয় এমন যে – ‘জাতীয়তা’ একটি বিদেশি শব্দ ‘ন্যাশনালিটি’র অনুবাদ। এর দুরকম অর্থ – ‘নাগরিকত্ব’ (সিটিজেনশীপ) এবং ‘জাতিসত্তা’’ (ন্যাশনালিটি)। এখন এই ‘জাতিসত্তা’ জিনিষটা উনাদের ব্যখ্যায় আমার মনে হয়েছে ‘এথনিসিটি’ বা রেস-এর মত বা সমার্থক কোন একটা বিষয় এবং এটা পরিচয়ের ক্ষেত্রে একদম ইউনিক (অন্য সবার থেকে যা আমাকে সিগনফিক্যান্টলি পৃথক করে), মৌলিক, অপরিবর্তনযোগ্য, জন্মগত, অব্জেক্টিভ, বায়োলজিকাল এবং কঠিনভাবে বৈজ্ঞানিক বিষয় (সুতরাং এর উপরে আর কথা চলে না!)।

মনে আছে টিভির কোন এক অনুষ্ঠানে কোন এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী নিজের গায়ে আঙ্গুল ঘষে বলেছিলেন - (একটু প্যারাফ্রেইজ করছি) আমার এই ‘বাঙালিত্ব’ তো আমি ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলতে পারবো না – পৃথিবীর যেখানেই যাই আমার এই ‘বাঙালিত্ব’, আমার এই জাতিসত্তাগত অনন্য পরিচয়, আমার সাথেই থাকবে আমৃত্যু (বা আমি ‘বাঙালিই’ থাকবো) আমি না চাইলেও - কিন্তু পাসপোর্টের ঐ ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় যেকোন সময়ই বদলাতে পারে নাগরিকত্ব বদলানো মাত্রই। তাই আমার প্রকৃত ‘জাতীয় পরিচয়’ আমার বাঙালিত্ব -- এবং ‘বাংলাদেশি’টা নেহাৎ একটা পরিবর্তনযোগ্য রাজনৈতিক ‘নাগরিকত্ব’ ( অর্থাৎ কোন ক্লাবের সদস্যপদের মত?)।

উপরের ব্যাখ্যায় আমার মনে হয় ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদের পারসিভড ধর্ম-ঘেষা সাম্প্রদায়িক চরিত্র একোমোডেট করেও (সবপক্ষকেই খুশি রাখার জন্য) তাকে আবার একইসাথে নালিফাই বা কন্টেইন (কোনঠাসা) করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা বা উদ্দেশ্য লক্ষনীয়। অর্থাৎ ‘জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা ঘুরপথে অস্বীকার করা – স্পষ্টভাবে তা না বলেও। তবে এতে করে আত্নপরিচয়ের মধ্যে একটা দ্বৈততা, অন্তর্বিরোধ, আনুগত্যের দ্বন্দ্ব এবং দোদুল্যমানতা রোপন করা হয় বলে আমার মনে হয়। সৃষ্টি হয় আত্নবিশ্বাসের সংকট। কারন যারা এটা বলেন, তারা ভালো করেই জানেন যে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই এটা বিশ্বাস করেন না (সেটার ভালোমন্দ/ঠিকবেঠিক অন্য প্রসঙ্গ) এবং তারা ঐ সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করছেন না এক্ষেত্রে। তারা হয়তো এটাও অনুভব করেন যে, তারা এ বিষয়ে বিচ্ছিন্ন ও সঙ্খ্যালঘু এবং তাদের এই অনন্য-মৌলিক ‘বাঙালিত্বের’ পিছনে দেশের সংখ্যাগুরু অংশের ভাব-ও-বিশ্বাসগত জোরালো ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের জোর নেই, নেই কোন নিঃসংশয় সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ/সামষ্টিক/জাতীয়ভাবে স্বীকৃত চর্চা ও কন্টিনিউইটির জোর। ফলে দেশের ভিতর অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গে তারা যতই ইন্টেলেকচুয়াল এলিটিজম ও উচ্চমন্যতাবোধের আত্নপ্রসাদ উপভোগ করুন না কেন (অনেকটা আপনা গলিমে শোর ভি রাজার মত?), দেশের বাইরে – বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সামনে বা তুলনাবোধে -- যাদের মধ্যে এধরনের এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় নেই, যারা নিজেদের সিটিজেনশীপ, জাতীয়তা, জাতিসত্তা, ন্যাশনাল আইডেনটিটি ও সাব-ন্যাশনাল আইডেনটিটি ইত্যাদির মধ্যে উনাদের মত এমন বিশাল কোন দ্বন্দ্ব বা দ্বৈততা ম্যানুফ্যাকচার করেননি, নিজেদের সামষ্টিক আত্নপরিচয়বোধ স্রেফ চামড়া বা ভাষার উপর ছেড়ে দেননি নিজেদের বাঙ্গালিত্ব বিসর্জন না দিয়েই, এবিষয়ে দেশের সংখ্যাগুরু অংশের ভাব-ও-বিশ্বাসগত জোরালো ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের জোরের বলয় থেকে ছিটকে পড়ে উনাদের মতো অপ্রতিনিধিত্বশীল, এতিম বা না-ঘরকা-না-ঘাটকা হয়ে যাননি মানসিকভাবে, জাতির ধর্ম-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের সামষ্টিক/সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ-ভাবে স্বীকৃত ও নিঃসংশয়চিত্ত চর্চা ও কন্টিনিউইটির জোর বা গর্ব হারিয়ে ফেলেননি, এবং সর্বোপরি নিজেদের স্বাভাবিক বাঙালিত্ব ও তজ্জাত গর্ববোধ ও আত্নবিশ্বাস বিসর্জন না দিয়েও নিজেদের বৃহত্তর কম্পোজিট আত্নপরিচয়বোধে নিঃসংশয়ে স্থিত, আত্নঃস্থ, সন্তুষ্ট ও গর্বিত থাকার কারনে – তাদের তুলনায় আমাদের এতিম, ঘর-ঘাটবিহীন, শিকড়বিহীন, চালচুলোহীন, কচুরিপানা-মার্কা ‘বাঙালিত্ব’-ওয়ালারা যে ভীষণভাবেই আপনার ভাষায় “মেরুদন্ডহীন”, “আত্নবিশ্বাসহীন”, পার্পাজ বা নিজ-“ভুমিকা”-বোধহীন হবেন এবং হীনমন্যতায় ভুগবেন – সেটাই তো স্বাভাবিক। এখানেই বোধহয় ‘বাঙালি’ হওয়ার সাথে ‘বাঙালিত্ব’-ওয়ালাগিরির পার্থক্য।

ছফা বোধহয় এই অবস্থা থেকেই উত্তরন চেয়েছিলেন। তাই নয় কি ?

আরেকটি ব্যাপার, উপরে আমাদের কোন কোন ‘প্রগতিশীল’ বুদ্ধিজীবীদের জাতীয়-পরিচয় সঙ্ক্রান্ত দু-কুল রাখা ‘প্রগতিশীলজন’-প্রিয় তত্ত্বে বাঙালি ‘’জাতীয়তা ও জাতীয়-পরিচয়কে যেভাবে একটা এক্সক্লুসিভলি অব্জেক্টিভ এবং জন্মগতভাবে শরীরতাত্ত্বিক ও শরীরতাত্ত্বিকভাবে অন্তর্গত বৈজ্ঞানিক বিষয় হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে – তা কতটুকু সঠিক? এই এক্সক্লুসিভলি অব্জেক্টিভ এবং জন্মগতভাবে শরীরতাত্ত্বিক বাঙালিত্বকে বাংলাদেশিদের ‘’জাতীয়তা ও জাতীয়-পরিচয়ের একক, ইউনিক ও এক্সক্লুসিভ নিয়ামকশক্তি হিসাবে ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে ? তার গাত্রবর্ণে ? উচ্চতায়? হাড়ের কাঠামোয়? মাথার খুলির গঠনে ? নাকের গড়নে? মুখাবয়ব বা মুখাবয়বের ইউনিক বৈশিষ্টে? নাকি তার রক্তে? জেনেটিক্সে ? তার ডিএনএ-তে?

বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত-প্রমানিত তেমন কিছু কি সত্যি বাস্তবে আছে যা একটা মানবগোষ্ঠিকে তার সমস্ত ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক-কাল্পনিক-সাবজেক্টিভ উপাদান বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র ঐ মৌলিক-ইউনিক শরীরতাত্ত্বিক উপাদানের (জেনেটিক?) ভিত্তিতে আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পুর্ণ পৃথক, স্বতন্ত্র, ইউনিক, এক্সক্লুসিভ পুর্নাঙ্গ অপরিবর্তনীয় ‘জাতি’ বা এমনকি মানবগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলবে ? মানুষে মানুষে কি আসলেই এতটা ‘গুরুত্বপূর্ন এক্সক্লুসিভ-মৌলিক-ইউনিক শরীরতাত্ত্বিক পার্থক্য’ আছে? আমার জানা নাই (এটুকু জানি যে শেষবার যিনি একথাটা বলেছিলেন, তার নাম ছিল জনাব হিটলার)। আমি অত বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান-দর্শন পড়ি নাই। তবে সন্দেহ আছে। কেউ সেটা নিসংশয়ে নিরসন করলে ভালো হয়।

কাছাকাছি আরেকটা তত্ত্ব শুনি – যেখানে বলা হচ্ছে আমাদের জাতীয়তা বা জাতীয়-পরিচয় সেটাই - যতখানি আমাদের লিঙ্গুইস্টিক ও এথনিক (বায়োলজি-ভিত্তিক অর্থে) আইডেন্টিটি পরস্পর কো-এক্সটেন্সিভ (তবে পরস্পর নির্ভরশীল নয় বোধহয়)। একটা আরেকটা থেকে যেখানে বাইরে চলে যায় সেখানে আর বাঙালিত্ব থাকে না। উপরের তত্ত্বটা থেকে এটায় সমস্যা বোধহয় অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু তারপরেও এটা কি ঠিক ? এথনিসিটি কি আসলেই একটা গুরুত্বপূর্ণ এক্সক্লুসিভ-মৌলিক-ইউনিক-অপরিবর্তনীয় শরীরতাত্ত্বিক/জেনেটিক ফেনোমেনন ? এককালে রেস-তত্ত্বের যখন জয়-জয়কার ছিল, তখন এরকম কিছু একটা মনে হয় বলা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিকতম চিন্তা ও বিজ্ঞান কি বলে? আমার নিশ্চিত জানা নাই। কেউ জানাবেন?

অপরদিকে, বাংলাদেশি-ওয়ালারাও সমস্যামুক্ত নন। তারা বাঙালিত্ব-ওয়ালাদের বাঙালিত্বের জায়গায় ‘মুসলমানিত্ব’-কে বসিয়ে দিয়েছেন একরকম। তাদের জাতীয় পরিচয়বোধেও রয়ে গেছে অনেকটা একইরকম আত্নবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধের অভাব, দোদুল্যমানতা, ইত্যাদি। স্থানীয় বা পুর্বপুরুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিঃসংশয়চিত্ত চর্চা ও কন্টিনিউইটি বা স্বীকৃতির সাথে সচেতনভাবে সম্পর্ক-ছিন্নকারী, কিন্তু নতুন কিছু নিঃসংশয়ভাবে এখনো নির্মান করে উঠতে না-পারা বা নতুন কোন ইতিহাস-ঐতিহ্য খুঁজে পেয়ে সেটাকে সম্পুর্ণ আপন ও নিজের করে নিয়ে গর্বিত ও আত্নস্থ হতে না-পারা -- এবং একটি বিশ্বব্যাপী বিশাল ছড়ানো-ছিটানো প্রায়-মরিচীকাময় ভাব-সাম্রাজ্যের কেন্দ্র-মুখাপেক্ষী গুরুত্বহীণ প্রান্তিক-উপাদানের এতিম, না-ঘরকা-না-ঘাটকা-মার্কা, শিকড়বিহীন, আত্নস্থতাহীন অস্তিত্ত্বের হীনমন্যতাবোধে তারাও মনে হয় কমবেশি আক্রান্ত। বাঙালিত্ব-ওয়ালাদের মতো, তারাও মধ্য-পশ্চিমের সংস্পর্শে বা তুলনা-অনুভবে আসলে কি রাখবেন আর কি ছাড়বেন বা নিজের অবস্থানবোধ-অধিকারবোধ-ভূমিকাবোধের সঙ্কটে পড়ে যান।

আমার মনে হয়, উপরোক্ত দুই পক্ষই একটা ‘এসেনশিয়ালিস্ট’(?) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করাতে এইরকম সমস্যায় পড়ছেন।
কিন্তু আমার কৌতুহল, উপরোক্ত কোন সমস্যাতেই যার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বা উপায়ই নেই, ধর্মীয় বা ধর্ম-বিবর্জনকারী কোন মাইনরিটি কম্পলেক্সেই যিনি মনে হয় আক্রান্ত নন (বা উর্ধে উঠতে পেরেছেন) কিন্তু একই সাথে যার সেই মাইনরিটিত্বের নিজস্ব – এবং উপরোক্তধরনের মেজরিটিদের সমস্যা ভিতর থেকেই, কিন্তু তবুও দূরত্ব বজায় রেখে দেখার – অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার নিশ্চয়ই একটা অনন্য বা নিজস্ব পার্স্পেক্টিভ থাকতে পারে ? তেমন কিছু আছে, শুভাশীষদা? আপনার কি মনে হয়? সমস্যা ও তার সমাধান কোথায়? ঐ “নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর জোর”, আত্নবিশ্বাস বা “ভূমিকা”-বোধ কিভাবে আসতে পারে বলে আপনার মনে হয় ? কি হওয়া উচিত ?

আশা করি আগ্রহবোধ করলে এ-বিষয়ে নিজস্ব ভাবনা নিয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত লিখবেন!
……………………………………………….

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।