জিরো গ্রাউন্ডস্-হেনরিক হার্জবার্গ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৮/২০১০ - ১১:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সর্বশেষ নির্বাচনের সপ্তাহ দুই আগে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দুইজন এনবিসির ব্রায়ান উইলিয়ামসকে একটা যৌথ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। নির্বাচনের অর্ধেক টিকেটের মালিকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন উইলিয়ামস্‌, ‘গভর্নর, অভিজাত/এলিট কে? কে কে অভিজাত গোত্রের মধ্যে পড়েন?' উত্তরে পালিন বলেন, ‘আমি মনে করি - যে নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে তাকে অভিজাত/এলিট গোত্রের ধরা যায়'। উইলিয়ামস্‌ জোর দেন, ‘তাহলে এটা মানচিত্রের উপর নির্ভর করে না?' পালিন বলেন, ‘অবশ্যই না।' নির্বাচনের বাকি টিকেটের ভাগিদার কিছুটা কাষ্ঠহাসি হাসেন। ম্যাক কেইনের ও কিছু বলার আছে।

ম্যাককেইন: এই অভিজাতদের বেশির ভাগের জমায়েত কোথায় আমি জানি।

উইলিয়ামস্‌: কোথায় বলুন?

ম্যাককেইন: দেশের রাজধানীতে আর নিউ ইয়র্ক শহরে। সেখানে আমি বসবাস করেছি। আমি দেখেছি।

ম্যাককেইন আরো ব্যাখ্যা করেন, ‘এই অভিজাতরা আমেরিকাবাসী কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটা পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মতামত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়'।

পালিন ভাগ্য ভালো মানচিত্রের অবতারণা আমাদের ওপর চাপান নি। উনি তাঁর দীক্ষাগুরুর 'আমেরিকানরা অন্য আমেরিকানদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়ার' বিরোধের কথা ভুলে যান। অন্তত তিনি ‘please' বলেছেন টুইটার কায়দায়। টুইটারস্ফিয়ারে "pls refudiate" নামের টুইট রাতারাতি বিখ্যাত করে পালিন জানিয়েছেন, ‘শান্তিকামী নিউ ইয়র্ক বাসিন্দা, আপনারা যদি বিশ্বাস করেন টুইন টাওয়ার এলাকায় ক্ষত এখনো দগদগে, জলজ্যান্ত তাহলে অনুগ্রহ করে গ্রাউন্ড জিরো মসজিদের চিন্তা বাদ দিন।'

গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ। শুরুতে এটা গ্রাউন্ড জিরোতে ছিল না। এটা ছিল পার্ক প্লেসে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুই ব্লক উত্তরে। কাছাকাছি রয়েছে এক দঙ্গল হোটেল, দোকান (ইলেকট্রনিকস্‌, পর্ণোগ্রাফি-যা যা নাম দেয়া যায় যাবে), চার্চ, অফিস, আর বাকিটা নিউ ইয়র্কের ঘিঞ্জি। পার্ক৫১, যেটাতে থাকবে একটা বড়োসড়ো ইসলামিক প্রার্থনা ঘর; ফলে একে মসজিদ নাম দেয়া যায়। বিল্ডিং-এ আরো থাকবে শ্রেণীকক্ষ,অডিটোরিয়াম, গ্রালারি, রেস্টুরেন্ট, ৯/১১ এর মৃতদের জন্য সৌধ, সুইমিং পুল আর জিম। ৯২ নম্বর স্ট্রিট Y__ , Y.M.I.A. এর মতো , টাইপ কিছু করার ইচ্ছা এর স্পন্সরদের। যেটা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। হিন্দু খ্রিস্টান সবার জন্য।

নিউ ইয়র্কের অনেক বাসিন্দাদের মতো পার্ক৫১ এর পেছনের দুইজন (এক দম্পতি) অন্য দেশ থেকে এসেছেন। ভদ্রলোক কুয়েত থেকে, ভদ্রমহিলা কাশ্মির থেকে। ফয়সাল আব্দুর রউফ কলম্বিয়ার ছাত্র ছিলেন। ট্রিবেকার একটি মসজিদের ইমাম হিসেবে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর। তাঁর একটা বইয়ের নাম "What's Right with Islam Is What's Right with America"; নিউ ইয়র্কের ইন্টারফেইথ সেন্টারের তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট।'আমি আর আমার সহকর্মীরা সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে।'-সম্প্রতি ডেইলি নিউজে তিনি লিখেছেন। নানা জায়গায় সাধারণ সন্ত্রাসবাদ বিশেষ করে ৯/১১ এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছেন। এফবিআই তার কথাবার্তা এজেন্ট আর পুলিশদের জন্য টেপ করেছে "sensitivity training" এর খাতিরে। তাঁর স্ত্রী ডেইজি খান 'আমেরিকান সোসাইটি ফর মুসলিম এডভানস্‌মেন্ট' নামের একটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠন সাংস্কৃতিক আর ধর্মীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য কাজ করে। এছাড়া এটি তরুণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্প সংস্কৃতির আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখে।

ভয়ের ব্যাপার স্যাপার। পালিনসহ অন্যান্য যাঁরা ভয় পাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রিপাবলিকান দলের বুদ্ধিজীবী ন্যুট গিংগ্রিচ। তাঁর মতে, ‘পার্ক৫১ ইসলামপন্থী বিজয়ের একটা ঝাণ্ডা হতে যাচ্ছে। এখানে আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য ইসলামিক ভাবাপন্ন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কুকাজগুলো চাপানো হবে। আমেরিকার ধর্মীয় স্বাধীনতার বুলি আউড়ে যাঁরা এটা তৈরির পক্ষে আছেন তাঁরা রেডিক্যাল ইসলামপন্থী ভণ্ডামির সমর্থনকারী।' তিনি বরং ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের একাগ্রতাকে জিম্মি করে রাখতে পরামর্শ দেন: 'সৌদি আরবে যেমন চার্চ বা সিনাগগ নেই ঠিক তেমনি নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরোর কাছাকাছি কোন মসজিদ ও থাকবে না।'

এই প্রজেক্টের যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁদের সবাই গিংগ্রিচের চরম কথাবার্তা সমর্থন করেনি। পালিনের মতো তাঁরা আপিল করেছেন ৯/১১ এ নিহতদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের বেদনার প্রতি। এন্টি-ডিফেমেশন লীগ, ইহুদিদের অধিকার আদায়ের জন্য খ্যাতনাম প্রতিষ্ঠান (স্থানীয় ইহুদি সংগঠন যেমন ম্যানহাটানের ইহুদি কম্যুনিটি সেন্টার, দা ইউজিএ-ফেডারেশন অভ নিউইয়র্ক-এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে) পালিনের লাইনে কথা বলে। ৯/১১ এর অনেক পরিবার ভিন্ন লাইনে শক্তভাবে চিন্তা করে। এডিএল (এন্টি-ডিফেমেশন লীগ)-এর অবস্থান বোঝাতে তাদের ন্যাশনাল ডাইরেক্টর আব্রাহাম এইচ ফক্সম্যান এন্টি-পার্ক৫১ মনা পরিবারগুলোকে হলোকস্ট উত্তরজীবীদের (survivor) সাথে তুলনা করেন। ‘মানসিক যন্ত্রণার কারণে তাদের নেয়া অবস্থানকে অনেকে অযৌক্তিক এবং গোঁড়া মনে করবে।' পাবলিক পলিসির নির্দেশনা মানলে তীব্র মনঃকষ্ট গোঁড়ামি থেকে কোন অংশে ভালো নয়। যৌক্তিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখার ভালো অস্ত্র নয়।

যখন ‘গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ' নিয়ে উদ্বিগ্নতা শুরু হলো, এটা নির্মাণের বিপক্ষের লোকজনের অনুপাত অনেক কমে গেল, এমনকী খোদ নিউ ইয়র্কে। সাম্প্রতিক একটা জরিপে জানা যায়, ম্যানহাটানের বেশিরভাগ লোকজন এটার পক্ষে, কিন্তু স্ট্যাটান আইল্যান্ডের এর বিরুদ্ধে। কম্যুনিটি বোর্ড ওয়ানের তথ্য মতে, ২৯ বনাম এক; এই কাউন্সিল এক চিলতে ম্যানহাটানকে প্রকাশ করে যেখানে পার্ক৫১ আর ৯/১১ এলাকা দুটোই আছে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে আমরাও এই এলাকার মধ্যে ঢুকে যাব।ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আবার নির্মিত হলে নিউ ইয়র্কার পত্রিকা টাইম স্কোয়ার থেকে সেখানে স্থান্তরিত হবে। মতামতের ভিন্নতা এসেছে কার দূরত্ব সংক্ষিপ্ত হবে কী হবে না তার ওপর। পার্ক৫১ নিয়ে কারো সমস্যা নেই।

গত মঙ্গলবার, নগরের প্রিসার্ভেশন কমিশন সর্বসম্মতি নিয়ে পার্ক৫১ কে সবুজ সংকেত দেয়। মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ অনুষ্ঠান উদযাপন উপলক্ষ্যে বাকপটু ভাষণ দেন। এই ভাষণ তাঁর মেয়াদকে উচ্চকিত করে। ‘অনেক সময় আমাদের প্রতিবেশীদের প্রত্যেকের সাথে আমরা একমত হতে পারি না।'


এটাই জীবন। এইরকম ভিন্ন মতাবলম্বী আর ঘনবসতির শহরে এরকম ঘটে থাকে। কিন্তু এর সাথে নিউইয়র্কের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে পারস্পরিক সম্মান ও সহিষ্ণুতা নিয়ে বাস করতে হবে। ৯/১১ পরবর্তী উন্মুক্ত ও গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের জিইয়ে রাখতে হবে।

ঘটনা এখানে শেষ হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। মধ্যবর্তী নির্বাচন আসন্ন। রিপাবলিকানরা বিশেষ করে আঞ্চলিক নিবেদিতপ্রাণ নেতারা তুরুপের তাস পেয়ে গেল। এখানকার দুইজন প্রধান রিপাবলিকান গভর্নর পদপ্রার্থী ‘গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ' কে একটা ইস্যু বানিয়ে ফেলেন। এদের একজন প্রাক্তন মেয়র রুডি জুলিয়ানি। অন্যজন প্রাক্তন গভর্নর জর্জ পাটাকি। সারাদেশে পার্ক৫১ বিরোধী মনোভাব দ্রুতগতিতে রিপাবলিকানদের রক্ষণশীল গোঁড়ামিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। গত সপ্তাহের শেষে জন ম্যাককেইন তাঁর প্রাক্তন সঙ্গীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন (‘অবশ্যই আমার মতামত এর বিপক্ষে')।

জর্জ ওয়াশিংটন এক বিখ্যাত চিঠিতে আশির্ব্বচন শুনিয়েছিলেম (যেখানে উল্লেখ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোঁড়ামিকে অনুমোদন করে না, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানাকে সহায়তা করে না, আর এটা দাবী করে –এই নীতি যারা মেনে চলে তারাই দেশের আদর্শ নাগরিক):

আব্রাহামের সন্তানেরা যারা এই দেশে বাস করে তারাঅন্যান্য নাগরিকদের মতো সকল সুযোগ সুবিধা পাবে, নিজের দ্রাক্ষালতা ও ডুমুর গাছের নিচে তারা নিরাপদে থাকবে আর কোন কিছু তাদের ভয়ার্ত করবে না।

ম্যানহাটানের নিম্নাঞ্চলে এখন দ্রাক্ষালতা আর ডুমুর গাছের সংখ্যা কম, তবে এখনো সেখানে কিছু ভালো সুরার দোকান আছে। তাঁর চিঠি লেখা হয়েছিল রোড আইল্যান্ড, নিউপোর্টের ইহুদিদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি জানতেন মুসলমানেরাও আব্রাহামের সন্তান। ম্যাককেইনের সাথে তুলনা করলে ওয়াশিংটন তিনটা জায়গায় হেরে যাবেন: প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নিউ ইয়র্কে থাকতেন। দেশের রাজধানী তাঁর নামে। আর তাঁর সময়ের হিসেবে তিনি একজন এলিটিস্ট। তারপরেও তিনিই ঠিক ছিলেন।

সূত্র

The New Yorker
August 16 & 23, 2010
(Comment-Talk of the Town)
Page 27 &28

ইন্টারনেট সূত্র


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এই জন্যই সংবিধানে গণতন্ত্র থাকলেও, সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাটা (যেটা থিওরিটাকালি গণতন্ত্রের একটি শর্ত) আলাদা করে দেয়া আছে। দেয়া লাগে।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ নিয়ে দুটা সমস্যা।

১। ৯/১১ নিয়ে রাজনীতি করার জন্যই কী এই পার্ক৫১ এ মসজিদ বানানোর প্ল্যান?

২। বিরোধিতা যাঁরা করছেন তাঁদের যুক্তিগুলো বুশ মার্কা। এর পেছনে কারণ কী?

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

দুইটাই কি সারফেসের সমস্যা না? রাষ্ট্রের কি যায় আসে ওইখানে কোন ধর্মের উপাসনালয় হইল তাতে? এখানে পক্ষের ভিত্তিও রাষ্ট্র, বিপক্ষেরও। রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে যখন (ক) ওই মসজিদের স্থাপনা অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করতেসে, অথবা যখন (খ) ওই মসজিদের স্থাপনা করতে না দিয়ে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। এর বাইরে আর কি বিবেচনা থাকতে পারে?
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এটা আগে দেখি নাই। লিঙ্কানোর জন্য ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

কেমন সুর [অতিথি] এর ছবি

... অনুবাদের উদ্যোগ টা চমত্কার ... তবে অনুবাদটা শাব্দিক(word by word) না হয়ে ভাবানুবাদ হলে আরো সহজপাঠ্য হতো ...

... যাই হোক, চালিয়ে যান ...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এটা একটা কারখানা। পরে কিছু ঘষামাজা করে দিব। হাসি

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।