অনুবাদ: টুকুন গল্প। ১১।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: রবি, ১৭/১০/২০১০ - ৭:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মা
গ্রেস পালে

একদিন এএম রেডিও শুনছি। সেখানে একটা গান শুনতে পাই: ‘ও, আই লং টু সি মাই মাদার ইন দা ডোরওয়ে।’ গানটা ভালোমতো বুঝতে পারি। মাকে আমিও দরজার কাছে দেখতে চাই। সত্যি বলতে – মা আমাকে নানা দরজায় বিভিন্ন দিক থেকে দেখেছে। একদিন গভীর রাতে সদর দরজায়। মার পেছনের প্যাসেজে অন্ধকার। বছর শুরুর দিন। মা মন খারাপ করে বলে, সতের বছর বয়সে তুই রাত চারটায় বাসায় ফিরিস, বিশ বছর বয়সে তুই কী করবি? মার এই প্রশ্নের মধ্যে কোনো হাস্যরস থাকে না। মা নিজের মৃত্যুর কথা বলে। বলে আমার যখন বিশ হবে, মা পৃথিবীতে থাকবে না।

মা একদিন আমার ঘরের দরজায়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিবারের অবস্থান নিয়ে একটা পলিটিক্যাল ম্যানিফেস্টো তৈরি করছি। মা বলে, দয়া করে এখন ঘুমাতে যা। তুই, তোর এইসব কম্যুনিস্ট চিন্তা সব ফালতু। আমরা এইসব দেখেছি। তোর বাবা। আমি। এগুলোর কিছু আর জানতে বাকি নেই।

একদিন রসুইঘরের দরজায়। - খাবারটা খা ঠিকমতো। এই যে পাগলের মতো এতো দৌড়াস- তোর কী হবে রে?

তারপর মা মারা যায়।

এরপর থেকে মাকে দেখার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি। কেবল দরজার কাছে না আরো নানা জায়গায়- আন্টিদের সাথে ডাইনিং-এ, জানালার কাছে, গ্রামের বাড়িতে জিনিয়া বা ম্যারিগোল্ড গাছের কাছে অথবা বাবার সাথে লিভিং রুমে।

বাবা মা সোফায় বসে। মোজার্টের গান বাজছে। নিজেদের দিকে তারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। যেন মনে হচ্ছে- সবেমাত্র তারা নৌকাভ্রমণ করে ফিরেছে। কিংবা সেই প্রথম তাদের ইংরেজিতে ভালোমতোন কথা বলতে পারার দিন। যেন মনে হচ্ছে- এইমাত্র আমেরিকায় অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদবিদ্যার প্রফেসর হবার পরীক্ষায় বাবা শতভাগ সফলতা দেখাল। অথবা যেন রান্নাঘরের দায়িত্ব নিতে মার দোকানের কাজ ছেড়ে দেয়ার দিনটা।

আমার ইচ্ছে হয় মাকে লিভিং রুমের দরজায় আবার দেখি।

মা সেখানে একটু দাঁড়ায়। তারপর গিয়ে বাবার কাছে বসে। তাদের একটা দামি রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। বাখের মিউজিক চলছিল। মা বাবাকে বলে- আমার সাথে একটু কথা বল। অনেকদিন ভালো করে কথা হয় না।

বাবা বলে- আমি ক্লান্ত। দেখছো না? আজকে কম করে হলে ত্রিশটা রোগী দেখেছি। এতোসব রোগী, এতোসব কথা কথা কথা। বাখ শোনো। একদিন একটা কোনো পারফেক্ট পিচ তুমি বুঝতে পারবে। বাবা আবার বলে- আমি খুব ক্লান্ত।

তারপর মা মারা যায়।

লেখক পরিচিতি:

গ্রেস পালে আমেরিকান ছোটোগল্পলেখক। কবি।

হতে
Sudden Fiction: American Short-Short Stories
Publisher: Gibbs Smith
December 31, 1983

---

অনুবাদ: টুকুন গল্প। ১০।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বড়ই অদ্ভুত! আজ যাই পড়ছি সবই মন খারাপ করে দিচ্ছে। মা কে সরাসরি দেখিনা অনেকদিন। অনেক দিন বলতে মাস পাঁচেক হবে। তারপরও প্রতিদিন মাকে দেখতে চাই। সারাক্ষণ। তাই প্রতিদিনই কথা বলি মায়ের সাথে।

অনন্ত

কৌস্তুভ এর ছবি

অদ্ভুত।

স্পর্শ এর ছবি

ভালো লেগেছে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

কামরুল হাসান রাঙা [অতিথি] এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর একটা লেখা।

নিবিড় এর ছবি
মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

... এরপর থেকে মাকে দেখার জন্য আমিও মুখিয়ে থাকি। কেবল দরজার কাছে না আরো নানা জায়গায়- নিমন্ত্রিত ছোটমামার সাথে ডাইনিং-এ মায়ের হাতে তার ছোটভাই আর ছেলের প্রিয় ডিশ ভালোবাসা আর অপার মমতায় মোড়া 'সবডেগ' নিয়ে, চট্টগ্রামের সেই স্কুল হোস্টেলে আমার ডরমিটরির দরজায় হঠাৎ করে ঢাকা থেকে একগাদা খাবার আর উপহার নিয়ে হাজির হতে, ছুটিতে বাসায় আসলে ডাইনিং-এ নানারকম চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় সাজিয়ে অপেক্ষা করতে, জানালার কাছে ঘুমিয়েছি কিনা দেখতে বা মশারির কোনা গুঁজে দিতে, বাবার সাথে লিভিং রুমে - একজনের হাতে বই আরেকজনের হাতে তার প্রিয় এম্ব্রয়ডারির উপকরন - এমনকি শেষের সেইসব দিন যখন উল্টে আমারই তাকে রান্না করে মুখে তুলে খাওয়াতে হয়েছে ....

ও, আই টু লং টু সি মাই মাম ইন দা ডোরওয়ে। হার ওয়ারিড ফেইস, হার ওয়ার্ম আইজ, এ্যন্ড হার লাভিং স্মাইল। তবে আর দেখা হবে না কিছুতেই, কেবল নিজের মস্তিষ্কের কোন নিউরনের অলিন্দে ছাড়া। সেটাও একদিন মুছে যাবে আমারই সাথে সাথে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চমৎকার একটা ছোটগল্প।

_________________________________________

সেরিওজা

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

"এরপর থেকে মাকে দেখার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি। কেবল দরজার কাছে না আরো নানা জায়গায়- আন্টিদের সাথে ডাইনিং-এ, জানালার কাছে, গ্রামের বাড়িতে জিনিয়া বা ম্যারিগোল্ড গাছের কাছে অথবা বাবার সাথে লিভিং রুমে।"
মন খারাপ হয়ে গেলো খুব...

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রানা মেহের এর ছবি

সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

এভাবেই মায়েরা মারা যায়। ব্যাস্ত মানুষগুলোর অবহেলায়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।