সমসাময়িক আমেরিকান লেখকদের মধ্যে সল বেলো আর ফিলিপ রথের মতো খ্যাতনামা আর কেউ নেই। সল বেলো মারা যান ২০০৫ সালে, জীবিত হিসেবে থেকে যান খালি রথ। ফিলিপ রথের জন্ম ১৯৩৩ সালের উনিশে মার্চ; আমেরিকার নিউজার্সিতে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. । জীবিকা নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখার পাঠশালাগুলোতে পড়ানো। পেয়েছেন বেশ কিছু বিখ্যাত সাহিত্য পুরস্কার। দুইবার ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, দুইবার ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস্ সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, তিনবার পেন/ফকনার পুরস্কার। এছাড়া আমেরিকান পেসটোরাল উপন্যাসের জন্য ১৯৯৭ সালে পান পুলিৎজার পুরস্কার। টাইম ম্যাগাজিন ২০০১ সালে থমাস পিঞ্চন এবং ফিলিপ রথকে ঘোষণা করে আমেরিকার সেরা ঔপন্যাসিক হিসেবে।
রথের এই পর্যন্ত লেখা উপন্যাসের সংখ্যা তেইশ। রথের উপনাসগুলোতে তাঁর নিজের জীবনের কাহিনী মিলেমিশে উপন্যাসের চরিত্রের সাথে গলা মেলায়। নাথান জুকারবার্গ নামের একটি চরিত্র তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাসে এসে হাজির হয়েছে। ফিলিপ রথের জুকারবার্গ উপন্যাসের সংখ্যা নয়। ডেভিড কেপেস নামের অন্য একটি চরিত্র হাজির হয়েছে রথের তিনটি উপন্যাসে। কেপেস বা জুকারবার্গ ব্যক্তিমানুষ রথকে অনেকাংশে ফুটিয়ে তোলে। ইহুদি আমেরিকান পরিবারে বড় হওয়ার কারণে চারপাশের ইহুদি বলয়ের মধ্যে থেকে নিজের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে ভাবনাচিন্তা তাঁর উপন্যাসগুলোর একটা কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। সমালোচকদের মতে, ফিলিপ রথের লেখায় একটা ব্যাপার সবসময় উপস্থিত- সেটা হচ্ছে রুডনেস বা অমার্জিত আচরণ। এই আচরণকে তিনি তাঁর শৈল্পিক বয়ানে বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন।
ফিলিপ রথের লেখালেখিতে অন্যান্য লেখকদের প্রভাব অনেক সময় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সেই প্রভাব সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকজন লেখকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটা বিশাল ক্যানভাসে ঘোরাফেরা করে। ফলে তাঁর কিছু কিছু লেখার মধ্যকার টেক্সট বোঝার জন্য সাধারণ পাঠকের চশমায় দেখলে সেটার আসল অর্থ অনেক সময় ধরা পড়ে না। এই গোত্রের উল্লেখযোগ্য তাঁর কেপেস উপন্যাস ‘দা প্রফেসর অব ডিজায়ার’। উপন্যাসের চরিত্র কেপেস নিজে সাহিত্যের মাস্টার বলে উপন্যাসের যত্রতত্র নানা লেখকদের কথাবার্তা, লাইন ইত্যাদি ইত্যাদি হামলে ঢুকে পড়ে। ইন্টারটেক্সুয়ালিটি ও মেটাফিকশনের ধারার বাইরে রথের এই লেখাকে বোঝার জন্য উত্তরাধুনিক চশমার দরকার পড়ে। এই ব্যাপারে জীবিত দার্শনিক জুলিয়া ক্রিস্টেভার ব্যাখ্যা কিছু কাজে লাগে। লেখা বা টেক্সটের দ্বিমাত্রিক অবস্থান ভেঙ্গে তিনি ত্রিমাত্রিক স্পেসের অবতারণা করেছেন। এর অক্ষ তিনটি। লেখার বিষয় বা লেখক, যাদেরকে বলা হচ্ছে (পাঠক) আর লেখা বা টেক্সটের বাইরের বিষয় যা টেক্সটে আনা হয় উল্লেখ হিসেবে। ফলে লেখা পাঠের অর্থ অনেক সময় অনর্থে ঠেকলেও সেটার কিছু মানে থেকে যায়। বিষয়টা অল্প কথায় বোঝানো মুশকিল বলে উত্তরাধুনিক দার্শনিকদের কথাবার্তা অনেক সময় বুজরুকি বলে মনে হয়। মজার ব্যাপার, অনেকে সেটার পক্ষে যুক্তি হিসেবে হাজির করেন অ্যালান সোকালের ফাৎরামি ব্যাখ্যাসকল।
রথের উপন্যাসের মধ্যে মেটাফিকশন ভাব প্রথম ভালোমতো ধরা পড়ে ‘দা লাইফ অ্যাজ আ ম্যান’(১৯৭৪) উপন্যাসে। নাথান জুকারবার্গ প্রথম হাজির হন সেই উপন্যাসে। তবে প্রোট্যাগনিস্ট হিসেবে নয়। সেখানে পিটার টার্নোপল নামের এক ঔপন্যাসিক নাথানকে সৃষ্টি করেন। মানুষ হিসেবে দায়দায়িত্ব বুঝে নেয়ার ভার চাপানো হয় সেই চরিত্রের ওপর। উপন্যাসটির দুইটা ভাগ। ‘ইউজফুল ফিকশনস্’ অধ্যায়ে জুকারবার্গকে নিয়ে দুটি ছোটোগল্প যেগুলোর লেখক পিটার। দ্বিতীয় অধ্যায়ে পিটার নিজের আত্মকাহিনী বয়ান করেছে ‘মাই ট্রু স্টোরি’ নাম দিয়ে। ফলে পাঠক পিটার ছোটোগল্পের মধ্যকার জুকারবার্গের কাহিনীর সাথে পিটারের নিজের জীবনের মিল খোঁজার একটা সুযোগ পায়। এক হিসেবে তারা দেখতে পায় জুকারবার্গের মধ্যকার পিটারকে কিংবা আরো সহজ করে বললে পিটারের মধ্যকার রথকে। রথ পাঠককে একটা সূত্র ধরিয়ে দেন লেখার শুরুতে। বলা হয় শুরুর দুইটা ছোটোগল্প আর আত্মজীবনী পিটার টার্নোপল নামের এক লেখকের লেখা থেকে নেয়া। ফলে কে কার সম্পর্কে কি লিখছেন সেটা নিয়ে একটা গোলোকধাঁধা তৈরি করেন ফিলিপ রথ। প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়- এখানে কে কার দর্পন?
রথের ‘দা কাউন্টারলাইফ’ উপন্যাসে জুকারবার্গ নিজেই রথের চরিত্র। সেখানে সে ভাই হেনরিকে চিঠিতে লেখে-
We are all the invention of each other, everybody a conjuration conjuring up everyone else. We are all each other's authors.
নাথান জুকারবার্গ নিজেই সেখানে লেখক হিসেবে, একজন আমেরিকান ইহুদি লেখক হিসবে নিজেকে দেখতে চায়। সারেন কিয়েরকেগরের Either/Or কে ভেঙ্গে রথ দেখাতে চান and কাহিনী। উপন্যাসে পাঁচটি অধ্যায়। উপন্যাসের শেষের দিকে জুকারবার্গ সেই পাঁচ অধ্যায়ের অ্যান্ড কাহিনীর সাথে নিজের মেটাফিকশনের মধ্যে ঢুকে পড়াকে ব্যাখ্যা করেন-
The burden [of subjectivity] isn’t either/or, consciously choosing from possibilities equally difficult and regrettable-it’s and/and/and/and/and as well. Life is and: the accidental and the immutable, the elusive and the graspable, the bizarre and the predictable, the actual and the potential, all the multiplying realities, entangled, overlapping, colliding, conjoined- plus the multiplying illusions! This times this times this times this …
রথের লেখার মধ্যে রয়েছে নিজেকে খোঁজার অহরহ চেষ্টা। কখনো জুকারবার্গের মধ্যে, কখনোবা কেপেসের মধ্যে অথবা বলা যায় তাঁর লেখা বা টেক্সটের মধ্যে। ‘দা ফ্যাক্টস্: আ নভেলিস্ট’স অটোবায়োগ্রাফি’ বইতে রথ লিখেছেন-
You have written metamorphoses of yourself so many times, you no longer have any idea what you are or ever were. By now what you are is a walking text.
ফিকশন ও বাস্তবতার মধ্যে থেকে রথ নিজেকে এভাবেই ভাবতে চান।
ফিলিপ রথের লেখালেখির মধ্যে বুড়ো ইহুদির যৌনকাতরতা কিংবা সেক্সিস্ট প্রণোদনার সন্ধান পান অনেকেই। ‘পোর্টনয়’স কমপ্লেইন্ট’ (১৯৬৯)উপন্যাসে স্বমেহন নিয়ে পোর্টনয়ের চরম ফ্যান্টাসি রথ প্রকাশ করেছেন মার্জিত প্রকাশভঙ্গির সীমা ভেঙ্গে। রথের অন্যান্য উপন্যাসেও অবদমিত যৌনাকাঙ্খা চরম ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে বলে বেশ কিছু সমালোচক অভিযোগ করেন। রথের সাবেক স্ত্রী ব্রিটিশ অভিনেত্রী ক্লেয়ারি ব্লুম তাঁর স্মৃতিচারণ ‘লীভিং আ ডল’স হাউজ’-এ রথের ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় কুরুচিকর অধ্যায় প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। এদিকে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ম্যানবুকার পুরস্কারের বিচারক পরিষদের একজন নারীবাদি বিচারক কারম্যান কালিল ফিলিপ রথের পুরস্কার জয়ের পর নিজেকে পরিষদ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
পাঠ:
১। Roth, Philip, Portnoy's Complaint, Vintage, 1994
২। Roth, Philip, The Counterlife, Vintage, 1996
৩। Roth, Philip, My Life As a Man, Vintage, 1994
৪। Roth, Philip, The Professor of Desire, Vintage, 1995
৫। Roth, Philip, The Facts: A Novelist's Autobiography, Vintage, 1997
৬। Bloom, Harold, Edited by, Philip Roth, Bloom’s Modern Critical Views, Chelsea House Publishers, 2003
৭। Parish, Timothy, Edited by, The Cambridge Companion to Philip Roth, Cambridge University Press, 2007
৮। Rose, Posnock, Philip Roth’s Rude Truth: The Art of Immaturity, Princeton University Press, 2006
৯। Safer, Elaine B., Mocking the Age: The Later Novels of Philip Roth, State University of New York Press, 2006
১০। Brennan, Timothy, Edited by, Facing Black and Jew: Literature as Public Space in Twentieth-Century America, Cambridge University Press, 1998
--
মন্তব্য
ভালো বিশ্লেষণ।
দারুন। কেন জানিনা
এই কথায় এসে চোখ আটকে গেল। আমি ণিশ্চিত আপনি জাত বলতে ইংরেজী রেস বোঝাননি। তারপরেও।
ঐটা আবার পড়ার পরে আমারও কানে লাগছে। ঐ বাক্যটাই ফেলে দিলাম।
দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
পাঠের তালিকা দেখে ভয় পেলাম।
অনেক কিছু জানলাম।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
অনেক কিছু শিখলাম। ধন্যবাদ বিশ্লেষনধর্মী এই লেখাটির জন্য।
ফিলিপ রথের নাম ছাড়া তার সম্পর্কে আর কিছুই জানতাম না।
রথ পড়া শুরু করেন তাড়াতাড়ি।
আমিতো নামও শুনলাম গতকালকে
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
কনকি! রথ তো ভার্সিটির পাঠ্যতালিকায় ঢুকে গেছেন অনেকদিন।
বিশ্লেষণ এবং বিষয়টাও ভাল লাগল।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
পুরষ্কার পাওনের আগে নামটাও জানতাম না
অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন