হুয়ান রুলফোর ছোটোগল্প: স্মরণ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৫/২০১১ - ১০:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উরবানো গোমেজের কথা কি তোমাগো মনে আছে? যে আছিলো ডন উরবানোর পোলা আর দিমাসের নাতি? ঐ যে দিমাস বুইড়া যে রাখালপোলাগো গান করাইতো আর ইনফ্লুয়েঞ্জা হওনের টাইমে স্টেজে গান গাইতে গিইয়া গেছিল মইরা। আমরা বুইড়ারে ডাকতাম দাদু কইয়া। হ্যার আরেক পোলা ফেদেন্‌সিও গোমেজের আছিলো চনমনা দুইটা মাইয়া। একটা মাইয়া ইয়া মোটা, বাইট্টা- নাম ফুটছিল ‘পিচ্চি খাম্বা’। অন্যটা আছিলো তাগড়া লম্বা, নীল চোখা। লোকে কইতো- এই মাইয়াটা হ্যার না। ঐ মাইয়ার আবার আছিলো হিক্কা ওঠনের ব্যারাম। একবার গন্ডগোলের সুময় আমরা হগলে আছিলাম একলগে, আর তহনই মাইয়াডার ওঠে ঐ হিক্কার পর হিক্কা। মনে হইতেছিল হে কান্দে আবার লগে লগে হাসেও। তখন তো তারে বাইরে লইয়া গিয়া চিনিপানার শরবত খাওয়ানির পর হিক্কা ওঠনটা ধইরা আসে। মাইয়াটা পরে লুসিওরে বিয়া করছিল। লুসিও লিবার্ডোর কাছ থেইকা সরাইখানাটা কিইন্যা লইয়া হেইডা চালাইতো। ঐটা আছিল নদীর ঐপাড়ে, তেল বানানির ফ্যাক্টরির লগে।

উরবানোর মায়েরে হগলে ডাকতো বেগুন বেগুন কইয়া। ঐ বেটি একটা না একটা কোনো গিয়ানজামে ঢুইক্যা পইড়া শেষমেষ বিয়াইতো একটা বাচ্চা। লোকে কইতো হের নাকি ভালো টাকা-পয়সা আছিলো। কিন্তু হের পোলামাইয়াগুলা বাঁচতো না। বাচ্চাগুলা মইরা যাওনের পর লোকজন আইনা ধুমধাম কইরা কবরে নিয়া যাইতো উরবানোর মায়ে। পোলাপাইন গান করতো, বুইড়ারা আইসা মাটি দেওনের আগ পর্যন্ত মদমুদ খাইতো। ঐসবের সাপ্লাইও দিতো হেই বেডি। এই কইরা কইরা হের টাকাপয়সা সব শেষ হইয়া যায়। পোলামাইয়ার মইধ্যে উরবানো আর নাতালি কেমনে জানি বাঁইচা যায়। ওগো বাইড়া উঠতে দেখনের আগেই তাগো আম্মা মারা যায়। তখন বয়স কত হইবো হ্যার। পঞ্চাশ উঞ্চাশ।

হ্যারে নিশ্চয় তোমাগো মনে আছে। ঐ যে কাগজটাগজ টোকাইতো। আর বাজারের মাইয়ামানুষ দোকানদারগো লগে সমানে ক্যাঁচাল করতো। টমেটোর দাম শুইনা কইতো- হগলে আমার গলা কাটনের ধান্ধা করে। পরে যহন এক্কেরে গরীব হইয়া যায়, তখন ডাস্টবিনের আশপাশ ঘুরতো, পিঁয়াজের চোকলা, শিম নাইলে আধ-খাওয়া ছিবড়া আখ কুড়ায় লইয়া কইতো- এগুলান দিয়া পোলামাইয়াগো মুখ মিঠা করুম। আগেই কইছি হের বাচ্চা বাঁচছিল খালি দুইটা। পরে যে ঐ বেটির কি হয় তা আমাগো আর মনে নাইকা।

উরবানো গোমেজের বয়স কতো হইবো- এই ধরো আমাগো সমান ,আর বেশি হইলে দুই চাইর মাসের বড়ো হইবো। খেলার মইধ্যে চুরিদারির ব্যাপারে খুব পাকনা আছিলো। আমাগো কাছে লাল ফুল বেচতো। মাগার পাহাড়ে উইঠা একটু কষ্ট করলে আমরাই ঐ ফুলগুলা আনতে পারতাম। স্কুলের গাছ থেইকা আম চুরি কইরাও বেচতো আমাগো কাছে। স্কুলের বাইরে থেইকা দুই সেন্টের কমলা কিনা আমাগো কাছে বেচার চেষ্টা করতো পাঁচ সেন্টে। হের পকেটে ভর্তি থাকতো হরেক কিসিমের জিনিস- মার্বেল, লাটিম, আর থাকতো পা বান্ধা সবুজ পোকা ঐগুলা যাতে উইড়া পলাইতে না পারে। আমাগো থেইকা উরবানোর জিনিসপাতি আছিলো বহুত বেশি- জানোই তো তোমরা।

উরবানো আছিলো নাকিতোর শালা। ঐ বেটা আবার ইনে-রে বিয়া করনের লগেলগেই পাগলা হইয়া যায়। ইনে সংসার চালানির লাইগা বড়ো রাস্তার ধারে একটা ফলের জুসের দোকান দেয়। নাকিতো এক নাপিতের দোকান থেইকা একটা ম্যান্ডোলিন ধার কইরা আইনা ঐটা দিয়া বেসুরে গান কইরা কইরা দিন পার করতো।

আমরাও উরবানোর লগে যাইতাম ঐ জুসের দোকানে। জুসমুস খাইতাম, কিন্তু টাকাপয়সা দিতাম না, দিমু কই থিকা, টাকাই তো থাকতো না আমাগো লগে। হের পরে কেমনে কেমনে জানি ওর লগে মিশা বন্ধ কইরা দেই। ও কাছ থেইকা থাকতাম দূরে দূরে। আমাগো কাছ থেইকা বাকির টাকা পরে আর আদায়ও করতে পারে নাই।

হইতে পারে এইসব হওনের পর থেইকা উরবানো খারাপ হইয়া যায়। আবার এইডাও হইতে পারে ব্যাটা জন্ম থেইকাই এমুন।

কেলাস ফাইভে হ্যারে স্কুল থেইকা টিসি দিয়া দেয়। ব্যাটায় স্কুলের নিচতলার বাথরুমের পিছে দেয়ালের ঐখানে গিয়া চাচাতো বইন ‘পিচ্চি খাম্বা’র লগে জামাই-বউ জামাই-বউ খেলতে গিয়া ধরা পড়ছিল। হ্যারে কানে ধইরা স্কুলের মেইন গেট দিয়া বাইর কইরা দেয়, জনা ষাট লোক দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া ঐসুময় মজা লইতেছিল। শরম দেয়ানির লাইগা পোলামাইয়াগো ভিড়ের মইধ্য দিয়ে তারে বাইর করনের ব্যবস্থা হয়। হ্যায় কিন্তু যাইতেছিল হাতের মুঠি পাকাইয়া, যেন কইবার চায়- এগুলার মাশুল তোমাগো একদিন দিতে হইবো।

হ্যারপর তো মাইয়াটার পালা। কোনোদিকে না তাকাইয়া মেঝের লাল ইট দেখতেছিল মাইয়াটা। এমুন সময় হঠাৎ কইরা এমন মরণকান্না জুইড়া দ্যায়, কি আর কমু, মনে হইতেছিল য্যান নেকড়েবাঘ চিল্লান ছাড়ছে।

মগজের মইধ্যে ঘিলু থাকলে সবগুলান কথাই তোমাগো মনে আছে। নাকি কও?

লোকে কয়- হ্যার চাচা ফেদেনসিও সব শুইনা এমন মাইর দিছিল যে হে প্রায় লুলা হইয়া গেছিল। পরে রাইগা মাইগা গেরাম ছাইড়া চইলা যায়।

ঠোলা হইয়া এখানে আওনের আগে হ্যারে আমরা আর গেরামে দেখি নাই। থানার অফিসে একটা বেঞ্চিতে বইসা থাকতো। পায়ের লগে একটা বন্দুক রাইখা আমাগো দিকে তাকাইতো কিড়মিড় কইরা। কারো লগে কথা কইতো না। হ্যালোম্যালো কিসসু না। কেউ হের দিকে তাকাইলে এমন ভাব মারতো য্যান কাউরেই ব্যাটায় চ্যানে না।

তা একদিন হইলো কি, ম্যান্ডেলিনওয়ালা সেই দুলাভাইরে উরবানো মাইরা ফালায়। নিকাতো বাজনা বাজানির লাইগা রাত আটটার সুময় বাইরে বাইর হইছে, গির্জায় তহন ঘন্টা বাজতেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুইনা গির্জা থেইকা লোক বাইরাইয়া দেখে- নিকাতো ম্যান্ডেলিন দিয়া নিজেরে বাঁচানির চেষ্টা করতেছে আর উরবানো বড় রাইফেলের বাট দিয়া তারে মারতেছে পাগলা কুত্তার লাহান। হ্যার পর কেডা জানি, আমাগো গেরামের কেউ না, আইসা উরবানোর কোমর থেইকা পিস্তল লইয়া মাথায় দেয় বাড়ি। এক বাড়িতেই সে বাগানের বেঞ্চির উপ্রে চিৎপটাং হইয়া পইড়া যায়।

পুরা রাইত ঐখানেই পইড়া ছিল অমন কইরা। লোকে কয়- সকালে উইঠা হ্যায় চার্চে গিয়া পুরোহিতের কাছে মাফ চাইছিল, পুরোহিত হ্যারে মাফ করে নাই।

উরবানোরে পরে রাস্তা থেইকা গ্রেপ্তার হয়। চুপচাপ বইসা আছিলো এক জায়গায়। পুলিশ আওনের বাধাউধা দেয় নাই। লোকে কয়- হ্যায় নাকি নিজেই দড়িটা গলায় ঢুকাইয়া দিছিল, আর কোন গাছে হ্যারে ঝুলাইয়া মারন হইবো হেইডাও নিজে বাইছা লইছিল।

তোমাগো আর কি কমু। জানো তো সবই। হ্যায় তো আমার লাহান তোমাগোরও স্কুলের বন্ধু আছিলো।

(হালকা ভাবানুবাদ)

বহি
The Burning Plain and other Stories
Juan Rulfo
Translated by George D. Schade
University of Texas Press
Austin & London
1967


মন্তব্য

আব্দুর রহমান এর ছবি

একটু আড়ষ্ট লাগলো।

"তোমরা তো সবই জানো, সে তো আমার মতোন তোমাগোরও স্কুলের বন্ধু আছিলো। "

এখানে, "তোমরা তো সবই জানো, হ্যায় তো আমার লাহান তোমাগোরও স্কুলের বন্ধু আছিলো। "

এরকমটা হলে কি আরও বেশি মানানসই হতো না?

আমি আপনার লেখার ভক্ত, কিন্তু এ লেখাটা পড়ে মনে হল, যেই কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষা আপনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তা পুরোপুরি আসেনি।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

এই গল্পটা এই ভাষায় অনুবাদ না করলে পুরো এসেন্সটা আসতো না। দ্বিতীয় ড্রাফটটা এখন দিলাম।

আরো দুই/চারটা ড্রাফট করা লাগবে। ভাষাটা কোনোমতেই পুরাটা উঠে আসছে না। মন খারাপ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো

অ:ট: হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র নামে একটা বই মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের অনুবাদে আর ঐতিহ্যর প্রকাশনায় বাজারে বর্তমান

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

অট: এইজন্যই বইপড়ুয়াতে নোটিশ টাঙাইছিলাম। তখন কেউ জানাতে পারে নাই। এই অনুবাদ ব্যক্তিগত ব্লগে ঢুকাইয়া ফেললাম। থ্যাঙ্কস।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

কথা সমগ্র মানে গল্প কি না আমি জানি না... বইটা পড়ি নাই
আর যদি থাকেও তাহলেও বা আপনার অনুবাদ ব্যক্তিগত ব্লগে ঢুকাতে হবে কেন?

নোটিশ পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন জানা ছিলো না, পরে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি... জানাতে দেরির জন্য দুঃখিত

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।