টুকুন পোস্ট। ১।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: সোম, ২০/০৬/২০১১ - ১২:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দা জূ অ্যাটাক

পাকিস্তানি এক মেজর আর তার সাথে ছয়/সাতজন সেনা অফিসার একদিন দুপুরে মীরপুর চিড়িয়াখানায় আসে। গাড়ি পার্ক করে শিম্পাঞ্জির খাঁচার কাছাকাছি। তাদের হাতে শুয়োর মারার জন্য ব্যবহার করা হয় এমন কিছু ধারালো মাথার বাঁশ। তারপর সবাই মিলে খাঁচার মেয়ে শিম্পাঞ্জিটাকে বাঁশের ধারালো মাথা দিয়ে গুতানো শুরু করে। পরে বোঝা যায়, তারা মেয়ে শিম্পাঞ্জিটার যোনী ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছে। শিম্পাঞ্জি দুটো প্রথমে বুঝতে পারেনি এরা কি করতে চায়। খেলা মনে করে বাঁশের মাথা বারবার হাত দিয়ে ধরতে থাকে। পরে যখন বুঝতে পারে তাদেরকে ব্যথা দেয়ার জন্য এগুলো করা হচ্ছে, তখন রেগেমেগে চিৎকার চেঁচামেচি, বিশেষ করে পুরুষ শিম্পাঞ্জিটা। মেয়ে শিম্পাঞ্জিটা সেদিন মারা যায়। অন্যটা আহত হয়। সেনারা ১১টা বানরকে বেয়নেট বিদ্ধ করে। ১১ টা হরিণ, তিনটা শাম্বার, দুটা স্পটেড হরিণ মেরে নিয়ে যায় হরিণের মাংস খাবে বলে। ১৪ টা এলবিনো র‍্যাট আর তিনটা খরগোশ মেরে নিয়ে যায়, সম্ভবত সেগুলোও খাবে বলে। বেশ কয়েকটা গিনিপিগকেও মারে। ভালো ভালো অনেকগুলো পাখি লুট করে নিয়ে যায়। কয়েকটাকে মারে। ইমু পাখিটার গায়ের ওপর চেপে সেটা ক্লান্ত করতে করতে মেরে ফেলে। গরু, গাভী, বকনাও লুট করে। একটা গাধাকে মেরে ফেলে, অন্যটা ক্রসফায়ারে আহত হয়। চিড়িয়াখানার সর্বমোট ক্ষয়ক্ষতি: লুট হয় ৬৭ টির মতো পাখি ও প্রাণী, হত হয় ৩৪, মারাত্মকভাবে আহত হয় ৫। যাওয়ার আগে পাকিস্তানি মেজর ও তার সঙ্গীসাথীরা আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষজনকে ধরে এনে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের খাঁচার সামনে তাদের গুলি করে মেরে রেখে চলে যায়।

দা নার্সিসিস্ট

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে একাত্তরের গণহত্যায় বাংলাদেশে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিদেশের পত্রিকাগুলোতো নানা রকম সংখ্যা আসতে থাকে। তবে কোনো সংখ্যাই দশ লাখের কম ছিল না। রাশিয়ান পত্রিকা ‘প্রাভদা’য় (১৯৭২ সালের তেসরা জানুয়ারি) প্রথম সরেজমিনে নানা হিসাবপত্র করে একটা গ্রহণযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। সেখানে ছাপানো হয়- এই গণহত্যায় হত হয়েছে ত্রিশ লক্ষ। শেখ মুজিব স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২; হতাহতের সংখ্যা জানতে কিছু কিছু তথ্য তাঁর অজানা ছিল না। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের সাথে ৭০০ শান্তি কমিটির পঞ্চাশ হাজার রাজাকার ও বিহারিরা ২৬৭ দিন বাংলাদেশে গণহত্যার জোয়ার বয়ে দিয়েছিল। বাইরের পত্রিকাগুলো নানা রিপোর্টে প্রকাশ করেছিল- যুদ্ধের প্রথম ত্রিশ দিনেই পূর্ব পাকিস্তানে হত হয়েছে তিন লক্ষের বেশি বাঙালি। UN এর রিপোর্টে এসেছিল- পূর্ব পাকিস্তানের ৭০% গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে পাকিস্তানি হানাদার ও শান্তি বাহিনীর লোকজন। পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে বাঁচতে প্রায় এক কোটির মতো লোক সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান তাই বিদেশী সাংবাদিকের সাথে গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা বলার ক্ষেত্রে যৌক্তিকতার বিচারে প্রাভদার সংখ্যাটি ব্যবহার করেন। এইসব সত্যকে পাশ কাটিয়ে তিন লাখের গালগল্প করেন নার্সিসিস্ট সিরাজুর রহমান। দশ মাসের নির্জন কারাবাস, তারপর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে রাত জেগে পাকিস্তান থেকে লন্ডন পর্যন্ত বিমানভ্রমণ এবং হঠাৎ করে আবেগাপ্লুত সমর্থকদের সান্নিধ্য ইত্যাদির প্রেক্ষিতে মুখ ফসকে শেখ মুজিব (একান্তে নির্জনে শুধু সিরাজুর রহমান মারফত জেনে নেয়া) তিন লাখের পরিবর্তে তিন মিলিয়ন বলে বসেছিলেন- শীর্ষক সিরাজুর রহমানীয় গল্পের গরুটি নানা জায়গায় প্রসবিত হয়। তিন লক্ষের হিসাব মতি গুআ টাইপ কোন রাজাকার সিরাজুর রহমানের কানে চুপি চুপি বলে গিয়েছিল তা তিনি আমাদের জানান না। তবে ইদানিং প্রায়শ আফসোস করেন একটা কথা ভেবে। আফসোসটা এই ভেবে যে টিক্কা খানের ব্যবহৃত সংখ্যাটাই লেখালেখির শুরু থেকেই তাঁর ব্যবহার করা উচিত ছিল। টিক্কা খান ১৯৭২ সালের উনিশে মার্চ জানিয়েছে- একাত্তরে রাজনৈতিক দাঙ্গায় বাঙালি নিধন করা হয়েছে মাত্র ত্রিশ হাজার। আর ধর্ষিত হয়েছেন চারজন নারী।

ব্লাডি

শর্মিলার মিথ্যায় ঠাসা ‘Anatomy of Violence: An Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971’ লেখাটা শুরু হয় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ দিয়ে।

We have become strangers after so much expression of affection
How many meetings will it take before we become friends again
When shall we be able to see the beauty of unblemished green
How many monsoons will it take to wash away its patches of blood
-‘On Returning from Dhaka’, 1974

নায়ারা নূরের কণ্ঠে ফয়েজের এই একই গজল ‘ঢাকা সে ওয়াপসি পার’ বা ‘ঢাকা থেকে ফেরার পথে’ গানটা ব্যবহার করা হয়েছে শর্মিলার শিষ্য রুবাইয়াত হোসেনের সিনেমা মেহেরজানে। পাকিস্তান-বাংলাদেশ পুনর্মিত্রতার মুখপাত্র প্রথম আলোতে সাজ্জাদ শরীফ অনুবাদ করে ফেলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কতিপয় কবিতা। পুনর্মিত্রতার এইসব দিনে ফয়েজ আহমেদের মার্কেট ভ্যালু চড়চড় করে বেড়ে যায়। একাত্তরের সাচ্চা বন্ধু ফয়েজ আহমদের ফ্যান ক্লাব চালু হতে থাকে নানা জায়গায়। এই লোকের নাকি সুনাম ছিল মানবতাবাদী ও জুলুম অত্যাচারের প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে। ১৯৭১ সালের আগে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক ছিল অনেকেই। অথচ ৭১ এর গণহত্যায় ত্রিশ লক্ষ লোক মেরে ফেলার ঘটনার তাঁর তথাকথিত মানবতাবাদী কণ্ঠ প্রায় নীরব-ই থেকে যায়। ত্রিশ লক্ষ হত্যার বিপরীতে ভূমিষ্ট করেছিলেন মাত্র দুটি কবিতা। ‘তাওতো কিছু কৈছেন’ বলে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফয়েজ চর্চা অব্যাহত রাখি।


বইপত্র:
১। Malik, Amita, The Year of the Vulture, Orient Longman, New Delhi, 1972
২। Chaudhuri, Kalyan, Genocide in Bangladesh, Orient Longman, New Delhi, 1972
৩। Ahmar, Yunus, Modern Urdu Poets, Royal Book Co., 1995


মন্তব্য

আশালতা এর ছবি

অনেক ভেবেও ঘৃণা প্রকাশের উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেলাম না। এই লেখাগুলো ছড়িয়ে দেয়া খুব খুব দরকার। নতুন এমনকি পুরনো জেনারেশনেরও অনেকেই এই তথ্যগুলো জানেনা। শয়তানগুলো এই সুযোগটাই নিচ্ছে।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

guest_writer প্রকৌশলী আতিক এর ছবি

একটা অংক করি,
ধরি যুদ্বে মোট ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য অংশ নিয়েছিল, নয় মাসের যুদ্বে কেউ হতাহত হয়নাই। আবার ধরি, তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ছিল, মাসে তারা একজনের বেশী হত্যা করিত না।

তাহলে নয় মাসে কতজন হয়, ৮,৩৭,০০০ জন। এরকম হইলে সেটাকে যুদ্ব বলা যায়না। টিক্কা খান কেমনে ত্রিশহাজারের কথা কইছে? ওরে যদি ওরকম বাশের আগায় চাকু বাইন্ধা পশ্চাৎদেশে খোচানো যাইতো তাইলে যোগ বিয়োগে আর ভূল হইত না।

lনাবিক এর ছবি

মজার ব্যাপার হচ্ছে তথাকথিত মুক্তমনা ও বিশিষ্ট প্রগতিশীল গবেষক গোলাম মুরশিদও তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ে(মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি র্নিদলীয় ইতিহাস, ঢাকা ২০১০) সেই ছাগুলিয়া সুরেই একটি ম্যাতাকার রচনা করেছেন :

তবে মনে হয়, তিরিশ লাখ লোকের জীবনহানি হয়েছিলো বলে যে-দাবি করা হয়, তা কিংবদন্তী মাত্র।...রুডলফ পামেলের অনুমান পাকিস্তান দশলাখের চেয়েও বেশি লোককে হত্যা করেছিলো। যদি তিরিশ লাখ অথবা দশ লাখের বেশির অনুমানে অতিরঞ্জনও থাকে, তা হলে অন্তত তিন/চার লাখ যে নিহত হয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। (পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৮)

দেখুন! রাজাকারের লোম সিরাজুর রহমান, ছাগলীলা বসু(গালাগালি দিলাম না,দিলে কমেন্ট শেষ হতো না) কিংবা নব্য মেহেরজানোয়ার পেয়ারুদের সাথে এই ভদ্রলোকটির কথাবার্তার কি অনবদ্য মিল!
আর হ্যাঁ, এইটা দ্রষ্টব্য যে বইখানার প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন, নব্যমিলনবাদের প্রবর্তক আলু পেপারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, আর বইখানা গোলাম মুরশিদকে লিখতে প্রথমালুর সেই ফজফজের পুর্নমিলন কাব্যি অনুবাদক সাজ্জাদ শরীফই প্রথম অনুরোধ করেন, এইটাও খেয়াল করে!

lনাবিক এর ছবি

সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের 'সমুদ্যত দৈব দুর্বিপাকে' থেকে দুইটা কোটেশন দিলাম খালি, তারপর ফয়েজ ফয়েজের আসল রূপটা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের:

'প্রগতিশীল কুলচূড়ামণি কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের বাঙালি অনুরাহগীর সংখ্যাওই ছিল বেশি। পাকিস্তানি জঙ্গিশাহীর জঘন্য গণহত্যার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও তিনি করেননি। বরং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে দৃঢ় সোভিয়েত সমর্থনের প্রতিবাদে এই 'রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা'র অন্যতম আসামি ঘৃণাভরে 'লেনিন পুরস্কার' ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার সম্পর্কে বিদেশি সকল গণমাধ্যম বাস্তব প্রতিবেদন প্রচার করা সত্ত্বেও তিনি তার বিন্দুবিসর্গও জানতেন না।'

'অধুনা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীলদের আনাগোনা তাদের একাত্তরের নির্লজ্জ ভূমিকা ঢাকার নির্লজ্জ প্রয়াসে, এতে আমাদের প্রতারিত হবার কোনো কারণ নেই'

কৃতজ্ঞতা : কবি পিয়াস মজিদ

দময়ন্তী এর ছবি

প্রথমটা পড়ে গা গুলিয়ে উঠল মন খারাপ

প্রথম দুটো বই পড়ে ফেলতে হবে৷

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

.......................

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

আয়নামতি1 এর ছবি

.......................

সুরঞ্জনা এর ছবি

দিন সবারই আসে। মনে রাখলাম।

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

................

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নজমুল আলবাব এর ছবি

এইসব পড়লে খালি গাইল আসে, কমেন্ট করা কঠিন বিষয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।