ভালোবাসা নিয়ে কথা তো আর নতুন নয়। বরং বলা যায়, আমাদের তাবৎ কথাবার্তা এই ভালোবাসা, নয়ত না-ভালোবাসা নিয়েই চলছে সেই অনাদিকাল থেকে। তার পরও কথা থেকে যায়, তারপরও কথা ফুরোয় না। ভালোবাসার আবেগ, ভালোবাসার ক্রোধ, ভালোবাসার অধিকার, ভালোবাসার দায়িত্ব, ভালোবাসার উপেক্ষা, ভালোবাসার স্বপ্ন, ভালোবাসার স্বপ্নভঙ্গ, ভালোবাসার জন্ম, ভালোবাসার মৃত্যু কিংবা ভালোবাসার মৃত্যুবরণ - কত কত কথা কিংবা কথকতা, এই ভালোবাসাকে ঘিরেই। ভালোবাসা নিয়ে রাস্তার জলের কলের ধারের অভব্য ঝগড়াও হয়, ম্যানিফেস্টোও লেখা হয় হয়ত। ভালোবাসার সাথে সহযাত্রা করতে করতেই আমরা জীবনপথে হাঁটি। জীবনের খররোদে তামাটে হই। এক অর্থে পৃথিবীর ইতিহাস ভালোবাসা না-ভালোবাসারই ইতিহাস। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়েই মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা নামক অনুপম এই শিল্প। ভালোবাসায় বাড়িয়ে দিয়েছে হাত, ভালোবাসায়ই সেই প্রসারিত হাতকে ধরেছে অন্য মানুষ। এভাবে ভালোবাসায় পরস্পরের হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাওয়ার নামই সভ্যতার পথচলা। ভালোবাসা হয়ত কখনো অস্ত্রও হয়ে উঠতে পারে। ভালোবাসার প্রকাশ হয়ে উঠতে পারে একটি যুদ্ধ। গত শতকের নয়ের দশক থেকে সারা পৃথিবীতে বেশ কিছু শব্দ ঘোষিত হল বাতিল হিসেবে। বেশ কিছু শব্দ পেল নতুন মানে। ধূলায় লুটানো লেনিনের মূর্তির রাশিয়ায় যারা মানুষের স্বপ্নের সমাজ ভাঙলেন, তাদের বলা হল বামপন্থী, আর যারা চাইলেন লেনিন স্তালিনের রাশিয়া থাকুক রক্তপতাকালাঞ্ছিত কক্ষপথে, তাদের বলা হল রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী। ওয়াশিংটন লন্ডন থেকে ঘোষিত হল গরিবের গরিব হয়ে থাকা, কিংবা আরো গরিব হওয়াটাই সভ্যতার নীতিবোধ। সমাজে যার সব আছে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আরো অঢেল করে দেওয়াই নাকি অর্থনীতির একমাত্র গন্তব্য, যাদের কিছু নেই তাদের সহায় ভরসা হওয়া, তাদের নিঃস্বদশার অবসান ঘটানো, কোনোওটাই নাকি আর সমাজনীতি অর্থনীতির দায় নয়। পৃথিবীর তৃতীয় ভুবন নামক দরিদ্র দেশগুলির রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারি নীতিমালা থেকে অর্ধচন্দ্রদান করা হবে গরিব নিঃস্ব মানুষের জন্যে উদ্বেগ। বাঁচার মত ন্যূনতম ব্যবস্থা করার জন্যে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অনুদান দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে হবে। যাদের নেই তাদের আরো নেই করা, যাদের আছে তাদের আরো আরো নতুন নতুন খিদে তৈরি করে খাওয়ানো এটাই নাকি সমাজের জন্যে একমাত্র পথ। লোভ, হিংসা, দ্বেষ, অন্ধ অমানবিক প্রতিযোগিতা - এই সমস্ত কিছুই নাকি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, সুতরাং তার জয়ই গাইতে হবে রাষ্ট্র সরকার প্রশাসনের নানা নীতিমালায়। ভালোবাসার বিদেয়ের আয়োজনও শুরু তখন। যে ভালোবাসাবোধে উদ্বুদ্ধ হলে মানুষ গান গায়, কবিতা লেখে কিংবা অন্ধকার পাথরের গুহায় ফুটিয়ে তোলে দুরন্ত বাইসনের প্রতিকৃতি। যে ভালোবাসায় মানুষ দুর্বল সহ-নাগরিকের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, অসংখ্য মানুষের জন্যে একটি সুখী সমাজ রচনার স্বার্থে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে - হাজার হাজার বছরের সভ্যতার ওমে বেড়ে ওঠা সেই ভালোবাসাকে ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক পরিসর থেকে, সরকার ও রাষ্ট্রের নানা স্তর থেকে নির্বাসন দেওয়ার এক অমানবিক রাষ্ট্রনীতি, এক সর্বগ্রাসী সংস্কৃতি হয়ে উঠল এই সময়ের স্বাক্ষর। লুন্ঠনের এক বিশ্বজোড়া বাজার তৈরি করতে মানচিত্রের বেড়া ভাঙার ফতোয়া এল। বলা হল এর নাম বিশ্বায়ন। কিন্তু বেড়া ভাঙতে চায় তো ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ মানুষও। সে ভাঙা তো বিশ্বায়ন নয়, শোষণ লুন্ঠন সর্বস্ব পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন নয় তার নাম। তার নাম আন্তর্জাতিকতা, যার পরতে পরতে রয়েছে ভালোবাসাবোধের এক মতাদর্শের অনুপ্রেরণা। এই ভালোবাসাবোধ থেকেই নিজের দেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ভিয়েতনামের গেরিলাদের জন্য রক্তদান করে মার্কিনী যুবক। এই ভালোবাসাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই নিকারাগুয়ার ছাত্রদের জন্য খাতা পেন্সিল পাঠায় পশ্চিমবাংলার ছাত্রসমাজ, এই ভালোবাসাবোধেই সারা পৃথিবীর অসুস্থ মানুষের শুশ্র“ষায় দেশে দেশে ছুটে যায় কিউবার চিকিৎসকদল। এই ভালোবাসা প্রকৃতপক্ষেই একটি অস্ত্র। লোভের বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ভালোবাসার আর্ন্তজাতিকতার প্রতিরোধের অস্ত্র। বিশ্বায়ন যখন বলে, ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’, তখন আন্তর্জাতিকতা বলে, ‘বল কী তোমার ক্ষতি / জীবনের অথৈ নদী / পার হয় তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি’। এই ভালোবাসাকে হয়ত অন্য নামে বলব মতাদর্শ। শুধু বিশ্বায়ন কেন, যখন দাঙ্গায় জ্বলতে থাকে গুজরাট, লেলিহান আগুনের তপ্ত শিখার ভেতর থেকে ভেসে আসে এহসান জাফরির আর্তস্বর, যখন ত্রিশূলের খোঁচায় মাতৃগর্ভে পূর্ণতা পাবার আগেই শিশুর ভ্রƒণের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যায় তার ধর্মীয় পরিচয়, তখন ভালোবাসা হয়ে ওঠে সর্বব্যাপী ঘৃণার থিসিসের প্রতিস্পর্ধী অ্যান্টি-থিসিস। তখন ‘কেন তারার মালা গাঁথা / কেন ফুলের শয়ন পাতা / কেন দখিন হাওয়া গোপনকথা জানায় কানে কানে / যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’ ঘৃণার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী সঙ্গীত হয়ে ওঠে। শুধু এই সামাজিক উচ্চারণ কেন, যখন ব্যক্তি প্রেমিক তার প্রেয়সীর চোখের গভীরে সমুদ্রের জলোচ্ছাস, আকাশের নীলাভ বিস্তার দেখতে পায়, তখন সে এই সভ্যতার নান্দনিকতারই একজন হয়ে ওঠে। তখন সে আর থাকে না ওই ব্যক্তি প্রেমিকে। মানুষের প্রকাশের এই শিল্পিত প্রকাশ, মানুষের নান্দনিকতার সমস্ত প্রহরগুলোতেও এখন হানা দিয়েছে বিশ্বায়নের পৃথিবী। সম্প্রতি একটি নিবন্ধে শুভেন্দু মাইতি বলেছেন, মে দিবসের ঐতিহাসিক লড়াই করে শ্রমজীবী মানুষ আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা বিশ্রাম আর আট ঘন্টা বিনোদনের অধিকার ছিনিয়ে এনেছিল। ওই আট ঘন্টা বিনোদনের প্রহর হচ্ছে নান্দনিকতার প্রহর, যখন সে গান গায়, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, প্রেমে হাত বাড়ায় প্রেমিক / প্রেমিকার দিকে। বিশ্বায়নের পৃথিবী কাজের প্রহরকে আট ঘন্টা থেকে দীর্ঘায়ত করে বারো ঘন্টা চোদ্দ ঘন্টা করতে চায়। অর্থাৎ তারা হানা দিচ্ছে মানুষের নান্দনিকতার আট ঘন্টায়। মানুষের কবিতার প্রহর, গানের প্রহর, নাটকের প্রহর, ছবি আঁকার প্রহর, প্রেমের প্রহর চুরি হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের পৃথিবী চায় কাজের প্রহরের দানবীয় বিস্তার। তার কাছে গান কবিতা ছবি প্রেমের নান্দনিকতার কোনও মূল্য নেই। সে চায় সপ্তাহ জুড়ে কাজ আর কাজ। আর সপ্তাহান্তে পাশ্চাত্যের উইকএন্ড-কালচারের বিকৃত আয়োজন। তখন গান নয়, চাই উন্মাদনা। প্রেয়সী নয়,প্রয়োজন সঙ্গিনীর। সুরা-নারী-জুয়ার ককটেল শেষে সোমবার থেকে আবার বারো ঘন্টা চোদ্দ ঘন্টার কাজের প্রহর। এ যেন রক্তকরবীর যক্ষপুরী। বিশ্বায়নের এই যক্ষপুরীকে ভাঙনের পথে নিয়ে যেতে পারে নন্দিনী-ভালোবাসা। সপ্তাহজোড়া উন্মাদের কাজের প্রহরের মাঝে মাঝে মানবিক কান্নাধারার দোলা বহমান রাখতে পারে ভালোবাসা। যে কান্নাধারা থেকেই জন্ম নেয় জিজ্ঞাসা, যে জিজ্ঞাসা থেকে জন্ম নেয় প্রতিরোধ। ফলেই ভালোবাসার প্রহর বাঁচলেই শ্রমের প্রহর মানবিক হবে। শ্রমের প্রহর অমানবিক হলেই ভালোবাসার প্রহর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এভাবেই মানুষের রুজির লড়াইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী হয়ে উঠেছে মানুষের রুচির লড়াই। এদের একের বাঁচা অন্যের বাঁচার ওপর এতটা নির্ভরশীল পৃথিবীতে আর কখনো হয়েছিল কি না কে জানে।
মনে পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাৎক্ষণিক বক্তৃতার বিষয় ছিল একটি কবিতার পংক্তি ‘ভালোবাসার জন্যে ঢের যুদ্ধ লড়তে হবে’। বিশ্বব্যাপী চলছে এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কলের মজুর খেতের কিষান যতটা সৈনিক, ততটাই সৈনিক ওই প্রেমিক যুবকও যে প্রেয়সীর প্রেমে মাতাল হয়ে রাত জেগে কবিতা লেখে।
মন্তব্য
চমৎকার বিশ্লেষন।
খুব ভালো লাগল।
শুভ'দা,
আপনাকে এখানে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।
আগের পোষ্টটা মিস করে গিয়েছিলাম।
নিয়মিত লিখবেন আশা করি।
---
সামরান
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ভালো লাগলো।
_____________________________________________
তুমি হতে পারো একটি স্বার্থক বিষাদের সংজ্ঞা। স্বার্থক নদী, স্বার্থক ক্লান্তি অথবা স্বার্থক স্বপ্ন।
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
অপূর্ব হয়েছে লেখাটা । একেবারে সমসাময়ীক এবং অতিপ্রয়োজনীয় বিষয় ।
নির্ভানা ।
এই যুক্তিতে কেউ যদি টাকা ভালোবেসে চুরি করে তাহলে তারে কী বলবেন?
আর ক্ষমতা ভালোবেসে যদি মারতে আসে কাউরে। তাইলে?
০২
শুভেন্দু মাইতিকে নিয়ে একটা লেখা দেন না
০৩
মৃণাল কান্তি দাশগুপ্তের যে পথ দিয়ে এলাম বইটার একটা রিভিউ করেন
০৪
আপনার বাবার এই মন্তব্যটা ধরে এটা লেখা তৈরি করেন
০৫
গোরা চক্রবর্তীর উপর একটা লেখা তৈরি করেন। আপনি অর্ধেক লিখেন। বাকি অর্ধেক লিখব আমি
০৬
এপার বাংলা ওপার বাংলা
আপনার গাওয়া প্রসাদের গানটার এটা অডিও আপলোড করেন সচলায়তনে
০৭
আপাতত এইগুলা করেন
বাকি লিস্ট দেবোনে আস্তে আস্তে
০৮
ছবিটাতে অনেক ভাব আছে
কিন্তুক ওইটাযে আপনার ভাব সেইটা বোঝা মুশকিল
(দাড়ি দিয়া থুতনি ঢাকার পরেও যদি হাত দিয়া ঢাকতে হয় তাইলে ভাব পেরকাশ হয় কোন রাস্তায়?)
ভাল লাগলো পুরো লেখাটিই আর এই দু'টি কথা সবচেয়ে বেশি।
আপনার এই লেখাটি বেশ ক'দিন আগে খুব ভাবিয়েছিলো -- খুব ভালো লেগেছিলো কয়েকটা লাইন, আবার বলা না হয়ে ওঠে সে কারণে আজ বলে গেলাম---
এভাবেই মানুষের রুজির লড়াইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী হয়ে উঠেছে মানুষের রুচির লড়াই। এদের একের বাঁচা অন্যের বাঁচার ওপর এতটা নির্ভরশীল পৃথিবীতে আর কখনো হয়েছিল কি না কে জানে।
কি ভীষণ সত্যি কথা!
চমৎকার লেখা--- চমৎকার!!
নতুন মন্তব্য করুন