ডোবায় বাসন ধুতে গিয়ে হঠাৎই উদাস হয়ে যায় দীপালি। তাদের প্রায় ভেঙে পড়া বসত ঘরের পেছনের এই বদ্ধ ডোবা, এর ঘোলাটে জল, পারের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে জলের গায়ে পড়া সূর্যের কৃপণ আলো- সবকিছু থেকেই অনেক দূরে চলে গিয়েছিল সে। সে কখনোই ভাবে নি, আবার তাকে ফিরতে হবে এখানেই। ওখানে, ওই স্বপ্নের পৃথিবীতে, সে পেয়েছিল এক সব পাওয়ার জীবন। আনন্দ ছিল, ছিল জীবনের নানা বিচিত্র সুর, অনেক সুরভি, অনেক পাওয়া। ওখানে না গেলে, এই জীবনে এগুলোর খবরই তার জানার কথা ছিল না । অনেক না জানা, অনেক অপূর্ণতা দিয়ে ভরা একটা ছোট্ট পৃথিবীতে আটকে থাকত তার জীবন। যেখানে জন্মেছে, জীবনভর সেখানে কাটিয়েই চলে যেতো এই পৃথিবী থেকে। না জানার, না পাওয়ার দুঃখটাও জন্মাতো না তার। যদিও ভরে উঠেছিল জীবন, তবু মাঝে মাঝেই তার ফেলে আসা মায়ের জন্য, তার ছিন্নবাস শীর্ণকায়া মায়ের অমলিন স্নেহের জন্য হু হু করে উঠত ভেতরটা। মায়ের স্নেহ সে পেয়েছে ওই সব পেয়েছির সংসারেও। সে মা-ও স্নেহময়ী। ফেলে আসা মায়ের জন্য রাত্তিরে ঘুমোতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলে বুকের উষ্ণ আশ্রয়ে জড়িয়ে ধরে ছড়ার সুরে সুরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নতুন মা-ও ফিরিয়ে নিয়ে যেত তাকে ঘুমের দেশে। সে হাতের ছোঁওয়া ছিল এতটাই অকৃত্রিম, এতটাই মায়ায় ভরা, কখনো মনে হয় নি এই মা তার নিজের মা নয়। কাজে বেরিয়ে যাবার আগে নিজের হাতে ভাত মেখে ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল গ্রাস তৈরি করে যখন তাকে খাইয়ে দিত নতুন মা, তখন তার দৃষ্টিতে ঝরে পড়ত পৃথিবীর সমস্ত মায়ের ভালোবাসা। নিজের মায়ের ঘরে স্নেহের অভাব ছিল না, অভাব ছিল সঙ্গতির। দু’বেলা অন্ন সংস্থানের সঙ্গতির। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পর সামান্য দু’মুঠো মুখে পুরে সে যখন কুপি লম্ফের আলোয় শক্ত পাটাতনের বিছানায় ছিন্নপ্রায় শীতল পাটির ওপর মলিন কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পড়ত, তখন ভাঙা পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গুণগুনিয়ে গান গাইত তার মা-ও। হঠাৎ মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে ভয়ে মা'র দিকে বাড়িয়ে দিত হাত। এ ভাবেই কখনো মায়ের ভাঙা গাল কিংবা শীর্ণ শরীরে গিয়ে নোঙর পেত অন্ধকারে দীপালির হাত। নোঙরের আশ্রয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ত সে। এই স্বভাবটা নতুন মায়ের কাছে এসেও যায় নি। এখানে গুড নাইট বা কচ্ছপের ধোঁয়ার নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা ও ফিনফিনে মশারির আশ্রয়ে থাকা বিছানায় মশার কামড়ে ঘুম ভাঙে কচ্চিৎ দীপালির। তবু, হয়তো অভ্যেসেই মাঝেমাঝে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতো। জিরো পাওয়ারের প্রায়ান্ধকার শোবার ঘরে একই ভাবে আধো ঘুমে তার হাত খুঁজত নিশ্চিন্ত পোতাশ্রয়। এবং, পেত এখানেও। কসমেটিক লাঞ্ছিত গাল কিংবা নাইটির আচ্ছাদনে ঢাকা নতুন মায়ের শরীরে আশ্রয় পেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ত সে। কখনো মেয়ের সাথে নিজেরও ঘুম ভেঙে গেলে ‘এসো সোনামণি’ বলে ফিসফিস স্বরে বুকের ওমে আশ্রয় দিত নতুন মা। তাই বলে কি নিজের মা'কে ভুলেছে কখনো দীপালি? মা তো মা-ই, সে তো কোনো স্মৃতি-বিস্মৃতির সীমায় বাস করে না। কুঁড়ে ঘরেও নয়, অট্টালিকাতেও নয়, মায়ের স্নেহ থাকে অন্তরের এমন এক গভীর প্রদেশে, যেখানে কোনো শ্রেণীভেদ নেই। হঠাৎ নেমে আসা এক প্রলয়ের ফেরে আবার নিজের মায়ের মলিন কূটিরে ফিরে এসে পেছনের এই ক্ষণিক প্রবাসকে স্বপ্নই মনে হয় দীপালির। নতুন মায়ের হাত ধরে প্রথম যেদিন শিশু চলচ্চিত্র উৎসবের অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র নামক শিল্পমাধ্যমের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল, সেদিনের সেই অর্থহীন দৃশ্যপ্রবাহের মতই মনে হয় তার এই মাঝখানের সব পেয়েছির দিনগুলি। কি অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় যে নতুন জীবনে দীপালির অভিষেক ঘটিয়েছিল নতুন মা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তুলতুলে বিছানায় রাতের ঘুম শেষে ছোট্ট টুথব্রাশে পেস্ট মাখিয়ে দিয়ে নিজের হাতে মুখ ধুইয়ে দিত নতুন মা মীনাক্ষী। এগুলো কি আর জানত দীপালি। তাদের গ্রামের বাড়িতে ভোরের আলো ফুটলে রান্নাঘরের চুলোর ধারে রাখা পোড়া কাঠ কয়লা দিয়ে নিজের হাতে দাঁত মাজতে মাজতে ঘরের পেছনের ডোবায় গিয়ে মুখ ধুতো সে। নিজের হাতে কন্যার মুখ ধুইয়ে দেওয়ার বিলাসী স্নেহ প্রদর্শনের অবসর দীপালির নিজের মায়ের ছিল না। দীপালিরও ছিল না এমনতর স্নেহপ্রাপ্তির কোনো প্রত্যাশা। প্রত্যাশা থাকার কথাও নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সামাজিক ভূগোলে অপত্য স্নেহের ধরনটাও ভিন্ন। ওখানে স্নেহ ভালোবাসা একটি সহজাত জীবন প্রক্রিয়ার অঙ্গ। কথায় কথায় ‘সোনামণি’ সম্বোধনের, আর সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাল টিপে আদর করে স্নেহপ্রকাশের কোনো পরিসর থাকে না। জীবনের বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম খুব তাড়াতাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যায় শৈশব কৈশোরকে। এই ছায়ায় ঢাকা, পাখি ডাকা, মায়ায় ঘেরা, কিন্তু অভাবের কুঁড়ে ঘরের জীবন থেকে স্বপ্নের মতই হঠাৎ একদিন সিদ্ধার্থ-মীনাক্ষীর সংসারে এসে পৌঁছল সে। সব কি আর মনে আছে? কতই বা বয়স ছিল ওর। তবে এটাই মনে আছে, আসার আগের ক’দিন মা শুধু কেঁদে উঠত থেকে থেকে, আর বাবা বোঝাতো মা'কে কখনো অনেক মায়া দিয়ে, কখনো রেগে গিয়ে। তবে গাড়ি চেপে সুন্দর পোশাক পরে আসা দম্পতির সাথে চলে আসার মুহূর্তে বাবাও দু'চোখ ঢেকে ফেলেছিল তাঁর শীর্ণ দু’হাত দিয়ে। চলে আসার পথে গাড়িতে বারবার রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিল মীনাক্ষীও। ‘মনে হচ্ছে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কারো জীবনের সর্বস্ব ধন’। মীনাক্ষীর মুখে এ কথা শুনে সিদ্ধার্থ প্রবোধ দেয়, ‘অনেক বেশি সৌন্দর্য দিয়ে ওর জীবন ভরিয়ে দেবো আমরা। দেখবে তখন ওর এই বাবা মা-ই সেদিন আনন্দাশ্র“ ফেলবে’। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে শোনা শৈশবের ওই সেদিনের কথাগুলো আজও ভোলে নি দীপালি। নতুন মা মীনাক্ষীর সংসারে দীপালির শৈশব পেয়েছিল স্বপ্নাতীত ব্যাপ্তি। তারপর তো শুধু ফুলে ফুলে ভরে ওঠা। নানা রঙে জীবনটা ভরে ওঠার পর আবার এই ধুলো মাটি মশা মাছি ঝিঁঝিঁ পোকা লাঞ্ছিত অভাবের কুঁড়ে ঘরে পুরোনো জীবনে ফিরতে হবে কখনো ভেবেছে কি? বুকের ভেতর কান্নার রোল উঠলেও, বাইরে, শুধু একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত বাসন মাজায় মন দেয় দীপালি। মাঝের এই কত বছরে বাসন মাজাটাও ভুলেই গিয়েছিল। ওখানে ঠিকে মাসি দু'বেলা নিয়ম করে এঁটো বাসন মেজে দিত। হঠাৎ কোনো কারণে মাসি না এলেও মেয়েকে বাসন মাজার কাজে কখনো ঠেলে নি মীনাক্ষী। ওইটুকু মেয়ে, আগে নিজের পড়া করুক। বড় হলে এমনিতেই সব শিখে নিতে হবে। এখন ক’টা দিন একটু না হয় আরামই করুক মায়ের সংসারে।
ঘাড় নীচু করে অপরিসর মাটির রান্নাঘরে মায়ের পাশে ধুয়ে আনা বাসনগুলো নামিয়ে রাখতেই অবাক চোখে মা বলে,‘পেরেছিস ধুতে? কষ্ট হয় নি তো?’ উত্তর দেয় না দীপালি। কষ্ট যতই হোক এ কাজ ওকে তো করতেই হবে। বড় মানুষের মেয়ে হওয়ার স্বপ্নের জীবন চিরদিনের মতই হারিয়ে গেছে আলেয়ার মত। এখন আর সেদিনের কথা ভেবে কি লাভ? বর্ষার খেয়ালি আবহাওয়ায় কখন যে রোদ সরে গিয়ে আকাশ মেঘলা হয়ে ঝমঝমিয়ে হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে টেরই পায় নি দীপালি। বৃষ্টিতে ভিজে দূরে একটা বাছুর এক টানা ডেকেই চলেছে, ডেকেই চলেছে।
আকাশভাঙা বৃষ্টির সাথে বয়ে যাওয়া প্রবল হাওয়ায় গাছের ডালগুলো নাচছে মাতালের মতো। ঘন বৃষ্টির চাদরে ঢেকে গেছে আকাশ। এমন একটা ছবিই ভেসে উঠত মীনাক্ষীর গলায় কবিতা শুনতে শুনতে দীপালির মনে।
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘন ঘন ধবলীরে আনো গোহালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দ্যাখ দেখি মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি
রাখাল বালক কি জানি কোথায় সারাদিন আজি খোয়ালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
দীপালি যেন স্পষ্ট শুনতে পেলো মীনাক্ষীর গলার আবৃত্তি। স্কুলের প্রতিযোগিতার জন্য কত যতেœ শিখিয়েছিল এই কবিতা। ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের আষাঢ়’, এই আরম্ভের কথাগুলি শুদ্ধু বারবার আবৃত্তির অভ্যাস করিয়েছে মীনাক্ষী। সত্যি, কত কবিতা দিয়ে ঘেরা ছিল ওই জীবন। মীনাক্ষীর বাড়িতে দীপালির প্রথম পাঠ যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুশি, তারপর কবিগুরুর সহজপাঠ হয়ে সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, পাগলা দাশুর গল্প। যত বড় হয়েছে, তত বড় হয়েছে তার গল্প কবিতার জগৎ। সিদ্ধার্থ মীনাক্ষীর স্নেহচ্ছায়ায় এসে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি কবিতাও দীপালির মুখস্থ। মনে আছে মাঝে মাঝেই সিদ্ধার্থ গলা খুলে আবৃত্তি করত বাড়িতে,
একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে
এখনও রাত শেষ হয় নি;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিন পাথরের মতো, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছো না
কিংবা
রাজা যায় আসে রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ঐ রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়
দিন বদলায় না
এসব কি কক্ষনো জানতে পেতো দীপালি, মীনাক্ষী সিদ্ধার্থের স্নেহচ্ছায়ায় না এলে? তার দিন কেটে যেত এই কবিতার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে থাকা তাদের গ্রামেই। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ যেদিন শিখিয়েছিল মীনাক্ষী, সেদিন সত্যি তার নিজের গ্রামের জন্য ভেতরটা কেঁদে উঠেছিল। এখনও কানে বাজে,
তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়
সব কথা কি আর বুঝত প্রথম প্রথম দীপালি। অনেক কথাই বুঝত না। যেমন ‘আমার মেয়ে’ বলে কারো সাথে দীপালির পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর যখন কেউ জিজ্ঞেস করত ‘কি নাম গো তোমার, বুড়ি’? সিদ্ধার্থ দেব ও মীনাক্ষী সেনের মেয়ের নাম ‘দীপালি দাস’ জেনে কেউ কৌতূহল প্রকাশ করলে, ‘মাতৃত্ব কি শুধু গর্ভধারণ করলেই হয় বুঝি?’ বলে মীনাক্ষী যে সুদীর্ঘ আলোচনায় প্রবৃত্ত হতো তার তো কিছুই বুঝত না দীপালি। আজ এই কুঁড়ে ঘরের এখানে ওখানে চাল দিয়ে পড়া বৃষ্টির জলের নীচে গামলা বালতি রাখতে রাখতে মনে হয় এখনও সে আলোচনার কিছুই বোঝা হয়ে উঠল না ওর। তবে অনেক কিছুই বুঝেছে, শিখেছে সে। শুধু বড় বড় জিনিসই নয়, অনেক সাধারণ, কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিসও শিখেছে। যেমন কাশি এলে মুখের সামনে ডান হাতকে মুঠো করে ধরতে হয়, হাঁচি দিলে বলতে হয় ‘কিছু মনে করবেন না’- সবই তো শিখেছে মীনাক্ষীর মাতৃত্বে, সিদ্ধার্থের পিতৃত্বে। ....পিতৃত্ব! কথাটা মনে হতেই বুক ভাঙা কান্নায় ভেসে যায় প্রায় দীপালি। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে বাঁশের টোকা মাথায় হাত-দা এর বাঁট দিয়ে প্রায় ভেঙে পড়তে বসা গরু ঘরের বেড়ার খুঁটিকে এই মুহূর্তে যিনি প্রাণপণে শক্ত করার চেষ্টা করছেন, সেই জন্মদাতা বাবার সাথে এত বছরে কোথায় যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল নতুন বাবা সিদ্ধার্থ। বরং এতদিনের দূরে থাকার পর ফিরে এসে নিজের বাবাকেই মাঝেমাঝে অপরিচিত মানুষ মনে হচ্ছে দীপালির। কাছে আসতে গিয়েও কোথাও যেন বারবার একটা আটকা। তার তরফে, তার বাবার তরফেও। শৈশব থেকে আজ অবধি বড় হয়ে ওঠার এই দীর্ঘ সময়ে অভিভাবকত্ব প্রদান করে সিদ্ধার্থই যেন স্বাভাবিক বাবা হয়ে উঠেছিল তার। প্রথম দিককার কয়েকটা বছরের পর থেকে বাবা বললে সিদ্ধার্থের ছবিই ভেসে উঠত দীপালির মনে। সিদ্ধার্থের মুখে ছড়া শোনা, সকাল বিকেল নদীর ধারে হাত ধরে বেড়াতে বেড়াতে ফুলের গল্প, জঙ্গলের গল্প, আকাশের তারার গল্প শোনা। কোন কথায় রেগে গেলে গুমগুম শব্দে সিদ্ধার্থের পিঠে দীপালির কিল মারা, মাথার চুল খিমচে ধরা । এতে সিদ্ধার্থের কপট আর্তনাদ শুনে, ‘উফ্, তোমরা বাপ মেয়েতে সারাক্ষণ বাড়িটাকে মাথায় করে রাখো’ বলে মীনাক্ষীর মায়াভরা কোপ। এভাবেই শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে প্রথম যৌবন অবধি দীর্ঘ সময়ে পরতে পরতে বয়ন হয়েছিল গ্রামের মায়ের সুক্ষ্ম নক্সী কাঁথার অনুপম সৌন্দর্যের মতো সিদ্ধার্থ দীপালির বাবা মেয়ের সম্পর্ক। মাঝে মাঝে দুজনে তারা একসাথে হেসে উঠত অকারণ। কখনো উল্টো করে শব্দ উচ্চারণ করে হেঁয়ালি ভাষায় বাক্য বিনিময়ের খেলায় মেতে উঠত। মীনাক্ষীকে না বুঝতে দেওয়ার জন্য দীপালির নানা আবদার জানানো এবং সিদ্ধার্থের তাতে সম্মতি বা অসম্মতি প্রকাশ, সবই হতো বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত কিশোর কিশোরীদের এই হেঁয়ালি ভাষায়। এমন সুখের ঘরেই হঠাৎ একদিন এলো প্রলয়। বনস্পতির মত ছায়া দিয়ে মায়া দিয়ে তার জীবনকে ভরিয়ে দেওয়া তার এই বাবা আর মায়ের সম্পর্কে অবিশ্বাসের ফাটল একদিন হয়ে উঠবে সে নিজেই ? এ কথা কি ইহজন্মেও কখনো ভেবেছিল দীপালি। বর্ষা বসন্তের লীলায়িত খেলায় যেভাবে পৃথিবী বয়সী হয়ে চলেছে আবহমানকাল ধরে, তেমনি হাসি কান্না মান অভিমানের স্বাভাবিক তরঙ্গস্রোতে এগিয়ে যাচ্ছিল সিদ্ধার্থ-মীনাক্ষী-দীপালির সংসার। তখন কৈশোর পেরিয়ে দীপালির দেহে মনে প্রথম বসন্তের হাওয়ার ঝাপট একটু একটু করে লাগছে প্রায়। দেহের রেখায় তার নারী হয়ে ওঠার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠলেও মনে সে তখনও কিশোরী-ই। এমনি একদিন ঝুঁটি দুলিয়ে স্কুলের পথে বেরিয়ে যাওয়া দীপালির দিকে সহাস্য সিদ্ধার্থের অপলক তাকিয়ে থাকা দেখে অশনি সংকেত ভেসে ওঠে মীনাক্ষীর মনে। সিদ্ধার্থের এই তাকিয়ে থাকা কি শুধুই এক পিতার স্নেহময় চাহনি, নাকি অন্য কিছু। অযৌক্তিক সন্দেহ থেকে স্পষ্ট এক অবিশ্বাস বাসা বাঁধতে থাকে মীনাক্ষির মনে। কি অত হাসাহাসি, অত ফিস্ফাস্ কথা? সময়োচিত মাসান্তের জোয়ারভাঁটার খেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পরও একজন পরিণত বয়স্ক পুরুষের গায়ে কথায় কথায় ঢলে পড়বে কেন কোন জোয়ান মেয়ে? এর মধ্যদিয়ে অন্য কোনও চাওয়া ব্যক্ত হচ্ছে না তো? সিদ্ধার্থও কি পাল্টে গেছে? এমনটা হওয়াও অবশ্য অসম্ভবও নয়। কারণ, হাজার হোক দীপালি তো আর নিজের মেয়ে নয়। সহজাত প্রবৃত্তির কাছে হেরে যায় মানুষ, এটা তো মনুষ্যত্বেরই ধর্ম? আর শুধু বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক কেন সত্যজিৎ রায়ের মত মানুষরা তো রক্তের সম্পর্কের সাথেই জীবন গড়েছেন। এমন দুর্বলতায় বন্দী হয়ে পড়া সিদ্ধার্থের দিক থেকে সম্ভাবনা থাকলেও, মীনাক্ষীর পক্ষে তা বাস্তবে মেনে নেওয়া অসম্ভব। এমনিতে সিদ্ধার্থ-মীনাক্ষী দম্পতি কোনও কুসংস্কারে আদৌ বিশ্বাস করে না। নিজেদেরকে তারা স্বামী স্ত্রী না ভেবে বন্ধু ভাবতেই বেশি ভালোবাসে। নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে কোনও ব্রাহ্মণ্য সংস্কার বা খ্রিস্টীয় শূচিতার ধারণাও নেই । বরংচ, তাদের মতে কোনও ধরনের পরকীয়া সম্পর্কহীন বিবাহিত পুরুষ-নারীর দাম্পত্যসুখ এক ধরনের অবদমনজাত বিকার। এ সুখ মূর্খের। তনু বাসনার ভাবের জোয়ারে কোনও বাধাই বাঁধ মানে না। এমন একটি নৈতিক অবস্থানে তারা যুগলে বিশ্বাস করলেও, পালিতা কন্যার সাথে এ ধরনের একটি সম্পর্ককে বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছু বিবেচনা করা অসম্ভব মীনাক্ষীর পক্ষে। কথাটা মনে এলেও হুট করে বলা যায় না। প্রথম যেদিন দীপালির অনুপস্থিতিতে মীনাক্ষী সিদ্ধার্থকে বলে, ‘বোঝ না কেন, দীপালি এখন বড় হয়েছে। ওর সাথে কথায় কথায় গায়ে গায়ে ঘষ্টাঘষ্টি করে কথা বলাটা দৃষ্টিকটূ লাগে। লোকে কি বলবে? সকলেই জানে দীপালি আমাদের নিজের মেয়ে নয়।’ এ কথায় তার প্রতি যে অভিযোগের ইঙ্গিত আছে তা বুঝতেই পারে না সিদ্ধার্থ। সে আকাশ থেকে পড়ে ‘দীপালি আমাদের নিজের মেয়ে নয়’ কথাটা মীনাক্ষীকে অবলীলায় বলতে শুনে। দীপালিকে ঘিরে এক অস্বাভাবিক স্পর্শকাতরতা ছিল মীনাক্ষীর। ঘরে বাইরে তার যে কোমলতা ও দৃঢ়তার এক নান্দনিক ভারসাম্যের ভাবমূর্তি রয়েছে, দীপালির পরিচয় সংক্রান্ত যে কোনও কৌতূহলের সামান্যতম ইঙ্গিতে তা মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়ে আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভাস্রোতে পরিণত হত। এ কথা তাদের আত্মীয় অনাত্মীয় পরিচিত সব মহলেই জানা, ফলে এ ধরনের কথাবার্তা বা যে আলোচনা থেকে এ ধরনের সামান্যতম ইঙ্গিত ব্যক্ত হয়, তা সকলেই মীনাক্ষীর সাথে কথাবার্তায় সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। .... সে-ই মীনাক্ষী আজ নিজের মুখে নিজের মাতৃত্বকে অস্বীকার করছে? ‘দীপালি আমাদের নিজের মেয়ে নয়, এ কথাটা তুমি নিজের মুখে উচ্চারণ করতে পারলে?’ সভ্যতার সমস্ত বিস্ময় ঝরে পড়ে সিদ্ধার্থের কথায়। বিস্ময় এতটাই প্রবল যে, প্রায় কোনও শব্দ সৃষ্টি হয় না উচ্চারিত কথাটিতে। গভীর গহন থেকে আছড়ে পড়া এক রাশ দমকা বাতাসের মত গর্জনহীন সুতীব্র ফিস্ফিসানিতে উচ্চারিত হল বাক্যটি। ইতিমধ্যেই মীনাক্ষীর সন্দেহও এতটাই দূরযাত্রা করেছে যে, সিদ্ধার্থের বিস্ময় থেকে কোনও বার্তাই পৌঁছল না তার কাছে। বরং ফল হল উল্টো। ‘সামান্য একটা কথা বলতেই তুমি এত অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছ কেন? তার মানে আমার সন্দেহ অমূলক নয়’। এরপর আর কোনও কথা চলে না। সমস্ত অন্তরলোক ভাসিয়ে দিয়ে যে বন্যাধারা বয়ে যেতে চাইল দু'চোখ দিয়ে, তাকে কোনমতে প্রতিহত করে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সিদ্ধার্থ। পথে পথে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়াল। না, কোনও ভাবনা গ্রাস করল না তার মন। মীনাক্ষীর ওই বাক্য থেকে যে গরল উদগার হলো তা নিয়ে কিছুই ভাবতেই পারল না। একটা সর্বগ্রাসী শূণ্যতা, শূণ্যতা শুধু চারধারে। শূণ্যতা শুধু মনে নয়। যেদিকে দুচোখ যায়, জনাকীর্ণ রাজপথ, বাপ মেয়ের প্রিয় নদীর ধার, সবুজে সবুজে ব্যাপ্ত খেলার মাঠ, যেখানে নিজের দুলালীকে নিয়ে বছরের পর বছর প্রাতঃভ্রমণ করেছে সে ও মীনাক্ষি, সবই শূণ্য শুধু। চোখে কোনও ছবি-ই ফুটে উঠছে না চরাচরের। আদিগন্ত শুধু শূণ্যতা আর অন্ধকারের অনিঃশেষ বিস্তার। অনেক দূর দ্বীপের বাসিনী হয়ে পড়েছে মীনাক্ষী। এতটা সুদূর যেখানে কোনও সংকেত পৌঁছয় না। ফলে সংকেত পাঠানো অর্থহীন। অন্ধকার নদী তীরে এক ঠায় বসে থেকে কখন যে হাতের সিগারেটের আগুন আঙ্গুলের কাছে এসে পৌঁছেছে, টের পায় নি। অতর্কিত দহনে সম্বিৎ ফিরে দূরে ফেলে দেয় তার ভেসে ওঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টার খড়কূটো অনেক দিনের অনভ্যেসের সিগারেটটি। এক ঘোরের মধ্যেই কখন যে সিগারেটটা সে কিনেছিল, আর তার ধূম উদ্গীরণকে সঙ্গী করে এসে পৌঁছেছে এই প্রিয় নদীর তীরে, কিছুই মনে নেই। ওপারের পল্লী থেকে ভেসে আসে নিয়ম-মাসের কীর্তনের ভাঙা টুকরো কলি, চোখে পড়ে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো ডিঙি নৌকোর আবছা আলো। অন্ধকার শেষ হয়ে মনে এবার ছবি ভেসে ওঠে, অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া ছবি। তাদের প্রেম, স্বপ্ন, স্বপ্ন বিনিময়। পৃথিবীর রঙ গায়ে মেখে জীবনটাকে তারা রঙীন করার স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন দেখেছিল নিষ্কলুষ একটি জীবনের যেখানে চিত্রাঙ্গদা হয়ে উঠবে মীনাক্ষী। অবহেলায় নয়, পুজোয় নয়, সঙ্কটে সম্পদে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলবে তারা জীবনপথ। মনে পড়ে, ঋতু গুহর গলায় তখন আকাশবাণী থেকে বাজত একটি গান, ‘নাথ হে, প্রেমপথে সব বাধা ভাঙিয়া দাও’। তাদের যদিও কোনও আকাশবিহারী নাথের প্রতি কোনও প্রার্থনা ছিল না, তবে একটি পরিপূর্ণ ভালোবাসার পথে থাকা সব বাধা ভাঙার আন্তরিক অঙ্গীকার ছিল। সচেতনভাবেই গর্ভে সন্তান ধারণ করে নি মীনাক্ষী। এই সিদ্ধান্তে সিদ্ধার্থও ছিল পাশে। একটি সন্তানের পৃথিবীতে আবাহন জানাতে পুরুষের অংশীদারী তো আক্ষরিক অর্থেই এক ফোঁটা। অন্য দিকে নারীর! কত দীর্ঘ সময় ধরে ভার বহণ করা, কত ব্যথা, কত কষ্ট, কত নিয়ম, কত বিধিনিষেধ এবং সর্বোপরি কত রক্তক্ষরণ। প্রকৃতি এত নির্দয়ভাবে এক চক্ষু! ফলে, ওপথে তারা হাঁটতে চায় নি কখনো। পরিবর্তে, চেয়েছে এ পৃথিবীর অসংখ্য অনাথের কোনও একজনের নাথ হয়ে উঠতে। ভালোবাসা দিয়ে, নিজেদের সঙ্গতি দিয়ে, সামর্থ্য দিয়ে তারা কোল দিতে চেয়েছে কোনও নিঃসম্বলের ঘরের সন্তানকে। না ফোটা কলিকে ফুটিয়ে তোলার স্বপ্ন পূরণেই তাদের ঘরে দীপালির আসা। এতটা বছরে দীপালি তার মেয়েই হয়ে উঠেছে, অথচ মীনাক্ষীর ক্ষেত্রে এমন হল কেন? মীনাক্ষীও তো ভরিয়ে তুলেছিল দীপালির শৈশব, কৈশোর স্নেহে মমতায়। কোথাও কোনও ফাঁক রাখে নি। এতটা পথ হেঁটে আসার পর আজ তাদের কন্যা বা কন্যাসম দীপালি মীনাক্ষীর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে?
এই কথাগুলো দীপালি জানে না। জানার কথাও নয়। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সে দেখেছিল মীনাক্ষী গম্ভীর মুখে বই পড়ছে। গাম্ভীর্য প্রদর্শনের এই সামান্য দৃষ্টান্ত থেকে কিছুই বোঝার কথা নয় দীপালির। তার খটকা লাগে খেতে বসে। তার ভালো না লাগা বেগুণভাজার বেশ খানিকটা না খেয়ে পাশে ফেলে দিতেই অস্বাভাবিক ধরনের রাগ প্রকাশ করেই মীনাক্ষী বলে,‘ফেলছো কেন? এগুলো কি পয়সা দিয়ে কেনা নয়? কতটা পরিশ্রমের এই টাকা তুমি জানো?’ আশৈশব কখনোই মীনাক্ষীকে এই ভাষায় কথা বলতে শোনে নি দীপালি। ফলে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, তারপর মুখ গুঁজে শেষ করে নেয় অবশিষ্ট খাবার। মায়ের এমন অদৃষ্টপূর্ব আচরণে ‘বাবা কোথায়’ কথাটা জিজ্ঞেস করারও সাহস হয় না। সেদিন রাতে ভাত খেয়ে দীপালি বিছানায় চলে যাওয়ার আরো অনেক পরে বাড়ি ফিরেছিল সিদ্ধার্থ। ড্রইং রুমে বসেও কোনও কথা না বলে বুঁদ হয়েছিল সিগারেটে। ‘আবার সিগারেট ধরে ফেললে? ভাত খাবে না?’ মীনাক্ষীর গলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সুর যদি থাকেও সে দিকে মন না দিয়েই সিদ্ধার্থ বলে, ‘দেখো, তোমার এই সন্দেহ আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ-ই শুধু নয়, দীপালির বাবা মায়ের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গও। তাঁদের কন্যাকে সন্তান জ্ঞান করে অভিভাবকত্ব প্রদানের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলাম আমরা।’ ‘সে প্রতিশ্র“তি যদি ভঙ্গ হয়ে থাকে, তবে তা করেছো তুমি, আমি নই। তোমাদের মেলামেশা স্বাভাবিক নয়।’ সিদ্ধার্থ আবিষ্কার করে বিকেল বেলা করা মীনাক্ষীর মন্তব্যটি হঠাৎ করা আলটপকা কথা নয়, গভীরে প্রোথিত একটি বদ্ধমূল ধারণা। অস্ফুটে একটি স্বর বেরোয়, ‘কি যে বল?...’ আবার অন্ধকারের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করে সিদ্ধার্থ। মীনাক্ষীর এক নাগাড়ে বলে যাওয়া কথাগুলো দূর থেকে ভেসে আসা অর্থহীন কোলাহলের মত শোনায়। নিখাদ মাতৃত্বে এতদিন ছাউনি দিয়ে রাখার পর কি ভাবে সম্ভব কন্যাকে এমন একটি দূরত্বে ঠেলে দেওয়া। পালিতা কন্যা বলেই কি সম্ভব হয়েছে এই মনবদল? সন্তান গ্রহণ তো করেছে তাদের পরিচিত বৃত্তের আরো অনেকেই। তাদের তো ঘরের সব অন্ধকার দূর হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। যা কিছু দ্বিধা ছিল, সবই সন্তান গ্রহণের আগে। একবার কোল দেবার পর আত্ম-পরের কোনো ভেদাভেদ কোন পক্ষেই থাকে না। মীনাক্ষীর ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম কেন? এতটা বছর পরও আত্ম-পরের ভেদ ঘুচল না কেন? হঠাৎ-ই অন্য এক সন্দেহ বাসা বাঁধে সিদ্ধার্থের মনে। তাদের পরিচিতজনেরা যারা সন্তান গ্রহণ করেছে, তাদের সাথে মীনাক্ষীর তফাৎ রয়েছে। তারা সকলেই ছিল নিজেদের সন্তান ধারণে অক্ষম। এই অক্ষমতা থেকেই তারা সন্তান গ্রহণ করেছে। মীনাক্ষী-সিদ্ধার্থ তো যেচে নিজেদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায় নি। সন্তান আবাহনের ভার গ্রহণে পুরুষ নারীতে প্রকৃতি যে ভেদ রেখেছে, তার কালো ছায়া তাদের জীবনে পড়তে দেবে না বলেই তারা অন্যের সন্তান গ্রহণ করেছে। তবে কি প্রগতিশীলতার এই ব্যতিক্রমী অবস্থানের আড়ালে ছিল তাদের সন্তান কামনায় অনাগ্রহ। প্রকৃতির নিয়মের বিপ্রতীপ এই অস্বাভাবিক অনাগ্রহেরও আড়ালে প্রকৃতপক্ষে ছিল কোন স্বার্থপরতা? পৃথিবীর কোলহীন সন্তানের কোনও একজনকে স্নেহের কোল প্রদানের অঙ্গীকারের আবরণে ঢাকা পড়েছিল মানব সভ্যতার দায় গ্রহণের অনাগ্রহ? কে জানে? কিছুই স্পষ্ট নয় সিদ্ধার্থের কাছে। এই মীনাক্ষীই তো পরম যতেœ এতদিন হাসিমুখে বয়ে বেড়িয়েছে দীপালির মাতৃত্বের ভার। মীনাক্ষীর সন্দেহ যে কত বড় মিথ্যা তা সিদ্ধার্থ জানেই, দীপালির তরফেও এমন একটি চিন্তা কখনো হতে পারে, এ কথা সে কখনোই মানতে পারে না। না, যাকে অভিভাবকত্বের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে, তাকে সন্দেহের আবর্তে রাখা আরো বড় অন্যায়। তার নিজের যত কষ্টই হোক বা দীপালিও যত দুঃখই পাক, তাকে অপমানের আরো বড় জ্বালা না দিয়ে বরং ফিরিয়ে দেওয়া হোক অকৃত্রিম পিতা মাতার সংসারে। সে সংসার সঙ্গতিতে দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু স্নেহে নয়। এবার মীনাক্ষীর চোখে চোখ রেখে বলে সিদ্ধার্থ, ‘ওকে আর অপমান না দিয়ে চল ফিরিয়ে দিই ওর নিজের বাপ মায়ের কাছে।’
সিদ্ধার্থ-মীনাক্ষীর সংসারে দীপালির বাকি দিনগুলি কাটল দুঃস্বপ্নের মত। কিভাবে সেই চরম কথাটি সে শুনল, কিভাবে তাকে স্বর্গ থেকে ঠেলে ফেলা হল বাস্তবের পৃথিবীতে, তা আর মনে করতে চায় না। শুধু আজই নয়, যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন কক্ষনো মনে আনবে না সেই বিষবৎ দিনগুলির কথা। এমন পরাভব যেন কারো না হয়। তার চেয়ে সারাজীবন না খেয়ে না পড়ে না জেনে বাঁচা ভালো। অনাহার অর্দ্ধাহারের যে বাঁচা মরার সমতুল, যে জীবনে বাঁচে দীপালিদের নিজের মা বাবারা, যে জীবনের দহনের বাস্তবতায় কোনও স্বপ্নের ভ্রম হয় না, সে জীবন তুলনায় স্বর্গসম।
গ্রামে ফিরে ইস্তক মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে না, কারো সাথে মেশে না, এমনকি মা বাবা ভাই বোনদের থেকে সমস্ত দিন দূরে দূরে থাকে। সারাদিন জীবনের কোন গহনে যে ডুবুরী হয়ে ঘুরে বেড়ায় দীপালি, কে জানে? ভাই বোনেরা ডাকলে উদাস চেয়ে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তাদের, চোখ ভরা জল নিয়ে মা কাছে টানলে, মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বসে থাকে। কঠোর পরিশ্রম ও দারিদ্রে নুইয়ে পড়া বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় আর গভীর উদাসীনতায়। দীপালি ভাবে এই নুইয়ে পড়া দারিদ্রই তার প্রকৃত জনক, এই সর্বগ্রাসী দারিদ্রেরই সে সন্তান। আর বাকি সব মিথ্যা। তবু মাঝেমাঝেই ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠে মীনাক্ষীর স্নেহচোখ, সিদ্ধার্থের সীমাহীন প্রশ্রয়ের চাউনি। এক অদ্ভুত আবেশ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার অন্তর বাহির। আর তারপরই মুহূর্তেই কালবৈশাখীর দানবের মত ধেয়ে এসে সবকিছুকে কালো অন্ধকারে ঢেকে দেয় দুঃস্বপ্নের দিনগুলি। ঘুমের মধ্যে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটতে না ফুটতেই মুহূর্তে ডুকরে কেঁদে ওঠে দীপালি। আধো ঘুমে পাশে শুয়ে থাকা মা উঠে বসে মাথায় হাত বোলাতে থাকে তার। পাশের খাটে ঘুম ভেঙে গেছে বাবারও। আবার কেঁদে উঠল মেয়েটা। আসার পর থেকে এই চলছে। ঘুমের মধ্যে কখনো হাসে, কখনো কেঁদে ওঠে। ‘আবার কান্দের?’ অন্ধকারে জিজ্ঞেস করে মেয়ের মাকে। ‘হুম্’ শব্দটা উচ্চারণ করেই আনচান করে ওঠে মায়ের পরান। কি যে হল মেয়েটার। মায়ের কাছে ফিরেও শান্তি নেই। ‘সব আমার কপাল!’ দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলে অন্ধকারে আবার শুয়ে পড়ে বাবা। মুখে না বলে মায়ের পরানও সায় দেয় ওই কথায়। মেঘ কেটে গিয়ে বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে খাটের ওপর। কান্নার রেশ মিলিয়ে যেতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে দীপালি। স্বপ্নে দেখে, বাংলা ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ পড়াচ্ছেন দিদিমণি। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে ফটিক, ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না’। শুয়ে পড়েছে মা-ও। অনেকদিনের অভ্যেসে ঘুমের মধ্যেও তার হাতপাখাটা চালু রয়েছে ঠিক। দীপালি আবার বিড়বিড় করে তার প্রিয় গল্পের লাইন, ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না’। .....‘ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
আবার হয়ত ডুকরে কেঁদে উঠবে অনিকেত মেয়েটি।
মন্তব্য
দাদা, প্যারা ব্রেক ছাড়া পড়তে গেলে সমস্যা হয় ।
"কুঁড়ে ঘরেও নয়, অট্টালিকাতেও নয়, মায়ের স্নেহ থাকে অন্তরের এমন এক গভীর প্রদেশে, যেখানে কোনো শ্রেণীভেদ নেই।"
আহ্------ অকৃত্তিম, চিরসত্য-সুন্দর তথ্যটি লেখনিতে এত্তো চমৎকারভাবে তুলে আনার জন্যে; সর্বোপরি সমগ্র লেখাটির জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেক---অনেক দিন পর একটা কিছু পড়লাম মনে হচ্ছে।
এস হোসাইন
----------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
সব জায়গাতেই শেষমেষ পর কি পরই থেকে যায়? পড়তে খুব ভালো লাগলো, শুভদা। তবে প্যারাগুলো একটু ঘন ঘন করলে চোখে আরো একটু আরাম লাগতো।
একটু প্যারায় প্যারায় ভাগ থাকলে আরামে পড়তে পারতাম।
লেখা ভালো লেগেছে। যদিও বর্ণনার মতন করে না হয়ে সংলাপে বা ঘটনাপ্রবাহে টানাপড়েনটা ধরা পড়লে লেখাটা আরো ভালো লাগতো।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন