ঘর কবিতা, সিঁদেল সুর

শুভপ্রসাদ এর ছবি
লিখেছেন শুভপ্রসাদ [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৩/১১/২০০৯ - ২:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতার সাথে গানের সম্পর্কটা কেমন? কবিতা কি শুধুই গানের একটা উপাদান, নাকি কবিতার চলা আর গানের চলা, মৌলিক ভাবেই ভিন্ন। বৈরিতা আছে কি গানের সাথে কবিতার, নাকি পাশাপাশি চলা রেল লাইনের পাশাপাশি চলা দুটো রেলের মত আজীবন পাশাপাশি, আজীবন দূরে। যাকে জোর করে মেলাতে চাইলে অঘটন ঘটারই সম্ভাবনা বেশি। দূরত্বে থেকেও অবশ্য কখনো সখনো একটা নৈকট্য তৈরি হয়, এই ক্ষণিক নৈকট্য থেকে কখনো কখনো কবিতা গান হয়ে ওঠে। তবে এই নৈকট্য গড়ে ওঠে অজান্তে, কবিতাও জানে না, আর, গানও,টের পায় না। কিছু কিছু কবিতা অবশ্য গান হয়ে ওঠার জন্যেই লেখা হয়, যাকে সাধারণত বলা হয় গীতিকবিতা। এই ধারার কবিতার গান হয়ে ওঠা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা এই ধারার বাইরের কবিতা নিয়ে।

কবিতায় সুরারোপ হয়ে আসছে অনেক দিন থেকেই, কিন্তু সম্প্রতিকালে কবিতাকে সুর করে গাওয়াটাই কোনো কোনো শিল্পীর পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলেই কবিতাকে জোরজবরদস্তি গান করে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টাও প্রত্যক্ষ করছেন কেউ কেউ এর মধ্যে। অভিযোগটা হয়ত একেবারে অসত্য নয়। তবে এখানেই আরেকটা প্রবণতাও কারো কারো নজর এড়ায় নি। এই জোরজবরদস্তির প্রতি বীতরাগ ব্যক্ত করার ছলে কেউ কেউ ’হঠাৎ কোনো হিরন্ময় আলোকে’ও কবিতার গানে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিচ্ছেন। এক ধরণের মৌলবাদী কট্টরপনা দিয়ে কবিতার সাথে সুরের যে কোনো ধরণের গুফতুগু সম্পর্কে এরা জারি করছেন নিষেধাজ্ঞা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই এই বিষয়টা নিয়ে একটুখানি আলোচনা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়ত। তার আগে একটু খানি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা।
##### #####
কাঁচের ওপারে বৃষ্টির ছাট দূরের ধানক্ষেত আর কাছের ছোট্ট খালের চলমান আভাসকে অস্বচ্ছ করে দিচ্ছে থেকে থেকেই। ওপরের ঘন কালো মেঘ আর নীচে দিগন্ত ছোঁওয়া সবুজ ধানের ক্ষেতে খেলে যাওয়া ঢেউ- এখানেই খুঁজতে চাইছি আমার সুরকে। বাসের সাথে সাথে গোটা দৃশ্যপটই চলেছে সাথে। কাছের খালটা ছুটছে দ্রুত, ধানক্ষেতের ঢেউ ছুটছে ঢিমে তেতালে, আর দূরের আকাশ এতই মন্থর কখনো মনে হয় চলছে, কখনো মনে হয় থেমে আছে। এটাই সেই বাংলা যেখানে কবি ফিরে ফিরে আসবেন। মানুষ নয়, বাংলারই প্রকৃতির লাবণী হয়ে। এ তো দেশাত্মবোধের মত উচ্চকন্ঠ চাওয়া নয়, কিংবা শুধু মাত্র প্রেমিকার বাহুবন্ধনে মুক্ত হওয়ার আকুলতাও নয়। এই নিবিড় অথচ ব্যাপ্ত ভালোবাসাবোধের গভীরে যেন এক আবহমান বিরহ যন্ত্রনা, যা উপচে পড়ে বাংলায় প্রতিদিনের সূর্যাস্তের রক্তিম আভায়, অথবা নিশুতি রাতের আকাশ আকুল করা কোনো বিচ্ছেদি গানে। এই আকুলতাই বাজে রাত্রি শেষের গ্রামীন মোয়াজ্জেমের ফজরের আজানে, বাজে বাংলার মায়েদের ঘুমপারানির চিরকালীন সুরে। একে 'কোন সুরে বাঁধিব’।

এক বন্ধু বলছিলেন, লোকসুরে হতে পারে কি এর উন্মোচন। অসম্ভব, আমার বিবেচনায়। এই চাওয়ার ভাষা যে স্বতন্ত্র। এই চাওয়ায়, নাগরিক রাত্রির গাড়লের মত কেশে যাওয়া ট্যাক্সির কালো ধোঁয়া না চাওয়াও যে মিশে আছে। সে প্রত্যাখান কি লোকসুরে বেজে ওঠা সম্ভব? বাসের জানালায় ঘাড় হেলে গুনগুন করি নানা সুর। সানুরাগ ভালোবাসার মেজর কর্ড ছেড়ে বারবারই সুর কেন চলে যায় মাইনরের মর্মছেঁড়া যন্ত্রনায়? বাস্তুহারা বাঙালির চোখের জলোচ্ছাস কেন বেজে ওঠে মাইনর কর্ডের পালে ভর করে।’বাড়ি কোথায় ছিল?’ ’বাড়ি!.....সবই তো গেছে,.. আছে শুধু স্মৃতি...’ । জনম ভর শোনা এই সব কথোপকথন কি বাসা খুঁজতে চায় আমার গলায়? প্রতি বছর পনেরো আগস্ট সারা দিনের কোনো না সময় বাবা বলত,“ সাতচল্লিশে এই দিনে আমি চাকরী সূত্রে ছিলাম যোরহাটে। চারধারের আলোর রোশনাই আর বাজি পটকা ফাটানোর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বীরেনকে বলেছিলাম, শেষ অবধি সত্যিই এদেশ ছেড়ে চলে গেল ব্রিটিশ। অভাবনীয় ঘটনা,বল্। বীরেন বলেছিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হ্যাঁ, ব্রিটিশ এ দেশ ছেড়েছে ঠিকই, তবে আমাদের সিলেট কিন্তু বিদেশ হয়ে গেল চিরতরে। এরপর আমি আর বীরেন দুজনেই কোনো কথা না বলে হাঁটলাম অনেকক্ষণ । অন্ধকার শেষ হয়ে লাইট পোস্টের তলায় আসতেই দেখি আমাদের দুজনেরই চোখ থেকে অঝোরে নামছে জল।”

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, যে বাংলা বাবার উদাস স্মৃতিচারণে, মায়ের বাষ্প জমে আসা চোখের চাওয়ায়। জীবনানন্দের আর্তি একাকার হয়ে যায় ভিটে মাটি হারা উদ্বাস্তুর দীর্ঘশ্বাস আর সুগভীর বিষাদের সাথে। এতক্ষণ চেতনায় জেগে ছিলেন জীবনানন্দ। আর তাঁর পেছনে গভীর সন্দেহ চোখে নিয়ে ভিড় করেছিলেন তাঁর পাঠক। সকলে মুহূর্তে অন্তর্হিত হল। পরের দিন বাড়ি ফিরে হারমোনিয়াম টেনে গলায় তুলতে গেলাম গান। এ কি! বুকের ভেতরটা এত ভারী হয়ে আসছে কেন? মনে ভেসে আসছে কেন কুশিয়ারার পার, আর আমাদের চিরদিনের কেঁদে চাওয়া ওপার? গলায় গাইছি,’আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে’,আর ভেতরে গুমরে ফিরছে,’আমার শান্তির গৃহ সুখের স্বপনরে, ও দরদী কে দিল ভাঙিয়া, মন কান্দেরে পদ্মার চরের লাইগ্যা’?
এ ভাবেই কি একটি কবিতার মৃত্যু ঘটলো আমার হাতে?

#### #####
পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে বাস, এ পাশে যদি উজ্জ্বল রোদ, ও পাশটায় হয়ত ঘন ছায়া। ছেলেবেলা থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে এখনো এই পাহাড়ি পথ আষ্টেপৃষ্টে আছে সমস্ত স্মৃতি জুড়ে। কত গান, কত ছড়া, কত কথা, কত গল্প মনের ভেতর খেলা করেছে এ পথে যেতে যেতে। সেবার বাড়িতে কীর্তনের আসরে এক ভদ্রলোক ভৈরবীতে গেয়েছিলেন ’শিবের বুকে দাঁড়িয়ে কেন বল মা শ্যামা শিবানী গো’। এ সুরের নাম যে ভৈরবী তা জানার বয়স হয় নি তখনো । কিন্তু নাছোড়বান্দা সে সুর নেমে এসেছে ক্ল্যারিয়েটের বিজন প্রান্তর থেকে, ডাক বাংলার চারধার ঘিরে থাকা পাইনের মর্মরে মর্মরে। কিংবা সোনাপুরের পাহাড়ি স্রোতের ওপর ফেরিতে দাঁড়িয়ে দেখা দূরে পাহাড় মেঘের মিতালীতেও বারবার যেন সেই ভৈরবী।

আরেকবার কোনো গান নয়, সমস্ত পথ জুড়েই গাছে গাছে পাতায় পাতায় পাহাড়ে ছিল এক ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার ফিরে ফিরে মনে পড়া। এক গানের আসরেই আমাদের বাড়ির প্রতি সকালের সহাস্য অতিথি অমিয়াংশু কাকুর দাঁত কপাটি লেগে মুর্ছা যাওয়ার স্মৃতি। মৃগী শব্দটা তখনই প্রথম শুনি। এক ভদ্রলোক আশ্চর্য্য, এক পাটি জুতো নাকে শোঁকাতে শশব্যস্ত, আর কীর্তনে বেভুল জেঠু একটু চোখ খুলে নির্লিপ্ত হয়েই বলল, এই গানেই কেটে যাবে সব। কিছু করতে হবে না। ঐ ঘটনাই বোধহয় শিশু মনে আমার প্রথম মৃত্যু ভয় জাগিয়েছিল। সে বার গোটা পাহাড়ি পথ জুড়ে তাই কোনো গান ছিল না, ছিল ঐ ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার ফিরে ফিরে আসা।

এবার এই উজ্জ্বল রোদ ভরা পথে বারবারই ভেসে উঠছে শ্মশানের মত হাহাকার ভরা মধ্যরাতের ছবি। স্মৃতির গভীর থেকে উঠে আসছে ছোট বেলায় দেখা কাঠের পাটাতনের কড়া ওয়ালা এক জোড়া দরজার ছবি। হয়ত সুধীর মৈত্র বা সমীর সরকারের আঁকা। আড়াআড়ি লেখা ’অবনী, বাড়ি আছো?’ গভীর নির্জন রাতে কে কড়া নাড়ে? শ্মশানের মত নিস্তব্ধতায় কার কড়া নাড়া আর আর্ত কন্ঠ যেন বধির রাত্রিকে খান খান করে গেল, সাড়া পেল না একটুও কোথাও। ফিরে ফিরে যাচ্ছে আর আসছে সেই আর্তি। কেউ শুনছে না, হয়ত কেউ নেই এ শহরে, আছে ঘুমন্ত শহরের বাড়ি ঘর নর্দমা নি®প্রভ লাইটপোস্ট আর নিকষ অন্ধকার। কোনো মানুষ নেই, জেগে থাকা বা ঘুমোনো। তবে কড়া নাড়ে কে? বুকের দরজায় আছড়ে পড়ে কড়া নাড়ার অবিরাম খটখটানি। কেবলি শুনি রাতের কড়া নাড়া। গভীর রাতই কড়া নাড়ে চেতনে অবচেতনে। এ কি? তিনটে ভিন্ন ধাপে একই সুরেই প্রায় কে বলে উঠল,অবনী, বাড়ি আছো? এই পংক্তি উচ্চারণ করলেই কবির স্বকন্ঠের যে হুঙ্কার বাজত কানে এতদিন।

আজ সেই বজ্রকন্ঠের বদলে অনেক কালের চেনা সেই পংক্তির পরতে পরতে এত রোদন ধ্বনিত হচ্ছে কেন? সুরে ভর করে জাগছে কেন আর্তি? এই ভর দুপুরে পাহাড়ি সবুজের বুকে যেতে যেতে হঠাৎ অন্ধ রাত কেন বুকের দরজায় আছড়ে পড়ে চেনা কবিতার শব্দে আর অস্ফুট অচেনা সুরে? এক লহমায় কেটে গেল ঘোর, এই অন্যায় অনধিকার অনুপ্রবেশ আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। পরবর্তী এক বছর ধরে চলল এক অদ্ভুত খেলা, একে ভুলে থাকতে চাওয়ার আপ্রাণ বাসনা আর যখন তখন সে সুরের হ্যাংলার মত হানাদারি। নিতান্ত বেহায়ার মতই একদিন হার মেনে ফিরে যাই আবার কবিতাটির কাছে নাছোড়বান্দা সঙ্গীটিকে নিয়ে। সুর করা গেল না কবিতাটির, তা অসম্ভব বলেই। সুরে বলা হয়ে রইল শুধু এক বিশেষ মুহূর্তের সেই কবিতাটির একটি ব্যক্তিগত পাঠ।
##### #####
কবিতা কি সত্যিই সুর করা গেল? কি করেই বা যাবে। কবিতার অনেকান্তকে ধরতে পারার মত সুর যে এখনো অধরা। নানা পাঠের নানা স্তর কি ভাবে উন্মোচিত হবে একটি সুরে। কবিতা তো শুধু শব্দের সৃষ্টি নয়। শব্দ আর নৈঃশব্দ্য নিয়েই তো কবিতা। শব্দ না হয় ধরা গেল সুরে, কিন্তু দুটি শব্দের বা দুটি পংক্তির অন্তর্বর্তী নৈঃশব্দ্যকে বা গোটা কবিতার অন্তর্গত নৈঃশব্দ্যকে ধরার মত সুর তো আজও অজানা। আমাদের তার এখনো বাঁধা কাছের সুরে, কিন্তু কবিতার বাঁশি যে বাজে সুদূরে। হয়ত একদিন সৃজিত হবে সেই সুর। 'তোমার চোখের ভর্ৎসনা’ বা ’তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন’ এর মত পংক্তিও সুরে বেঁধেছিলেন বিশ্বকবি কিংবা সম্প্রতি সময়ের আমাদের নাগরিক কবিয়ালের গানে শুনি,’এই তো জীবন ধ্যাত্তেরিকা’। তবে কবিতা এবং সুর নিয়ে যে বর্তমান হুজুগ, যাকে কবিয়াল কবীর সুমন বলেছেন মধ্যবিত্তের কলকাত্তাই ব্যাধি,তাতে বাণিজ্যের গন্ধটাই বেশি। এই ডামাডোলেও মাঝে মাঝে নাড়া দেয় কিছু সুর। তবে তা কিছুতেই কবিতার সুর হয়ে ওঠে না। হয় কবিতার কোনো একটি পাঠের সুর আরোপ। এর বেশি কিছুই প্রাপ্তি হয় নি হয় তো।
#### ##### ##### #####
পাঠক, এবার আপনার বিচার। আমি বাদী, না বিবাদী?


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।