সাইবার ক্রাইম - অপরাধের বিপ্লব

শুভপ্রসাদ এর ছবি
লিখেছেন শুভপ্রসাদ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৬/০৯/২০১০ - ৩:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতিদিনের মত একবার করে অর্কুট খুলে সুজন-বন্ধুদের খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। এ কী? আমার এতকালের ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু আমায় এত অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে স্ক্র্যাপ করল কেন? সেই প্রায় স্কুল থেকে আজ অবধি আমাদের অবিচ্ছিন্ন বন্ধুত্বে কোনও দিনই তো কোনও ছেদ পড়ে নি। কী ব্যাপার? সৌমিত্র নামের আমার কবি-বন্ধু যখন হায়ার সেকেন্ডারিতে পড়ে তখন এস.এফ.আই করত, আমি তখনও সক্রিয়ভাবে জড়িত হই নি বামপন্থী আন্দোলনে। পরে আমি যখন এস.এফ.আই করছি চুটিয়ে, তখন ডি.এস.ও করে। কিন্তু আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে একদিনের জন্যেও ছেদ পড়েনি। ক্লাসে একে অপরের বিরুদ্ধে প্ল্যাটফর্মে উচ্চকন্ঠে সমালোচনা করে এসে আবার একটু পরেই ক্যান্টিনে একসাতে চা খেয়েছি। কোনও দিনও এমন ভাষা একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব কখনও ভাবতেও পারি নি।

দুঃখ এতটাই পেলাম যে সরাসরি ফোন না করে ম্যাসেজ করলাম। ‘সৌমিত্র, তোর আজ কী হয়েছে। এমন কথাবার্তা তুই আমার উদ্দেশ্যে ব্যবহারর করবি, এ আমার দুঃস্বপ্নেরও অতীত। বুঝতে পারছি তুই বন্ধুত্ব শেষ করতে চাস। তা অন্যভাবেও বলতে পারতি। আমি কিন্তু চেষ্টা করব তোর আজকের অশ্লীল স্ক্র্যাপ নয়, বিগত বহু বছরের উষ্ণ দিনগুলিকেই বেশি মনে রাখতে।’ শুয়ে পড়লাম, কিন্তু সারারাত ঘুম এলো না। সকালবেলায় সৌমিত্রর ফোনে ঘুম ভাঙল, ‘তুই কী সব ম্যাসেজ করেছিস? আমি তো গত পনেরো দিন নেটে যাওয়ারই সময় পেলাম না, তোকে স্ক্র্যাপ করার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে?’ আমি বললাম, ‘তবে এটা কী করে হল বল্? তোর প্রোফাইল থেকেই তো আমাকে গালিগালাজ করা হয়েছে?’ সৌমিত্র বলল, ‘তুই বলার পর আমি আমার প্রোফাইল খুলে দেখলাম। আমার প্রোফাইল থেকে তো কোনও স্ক্র্যাপ যায় নি!’
পাঠক, এভাবেই কোনো এক রাত্রি-প্রভাতে আমারও পরিচয় হল অপরাধের নবতম সংস্করণ সাইবার ক্রাইমের সাথে।

পরের ক’দিন সৌমিত্র ও আমার যৌথ গোয়েন্দাগিরির পর আবিষ্কৃত হল, সব কিছুর পেছনে আছে এক বিকৃতমনস্ক কবি যে পেশায় একজন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। অধুনা বেঙ্গালুড়– প্রবাসী এই কবির ধারণা ছিল বাংলা কবিতার জগতে জয় গোস্বামীর পরবর্তী আসনটি তার জন্যেই বাঁধা। কিন্তু যেহেতু বিধির লিখন তা হল না, ফলে তার রাগ গিয়ে পড়ল সকলের ওপর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পচা আঙুরের রস সহযোগে তার নতুন প্যাশন হয়ে দাঁড়াল সাইবার দুনিয়ায় মস্তানি করে বেড়ানো। আমাকে ও সৌমিত্রকে জব্দ করতে সে আমার ও সৌমিত্র দুজনেরই ভুয়ো প্রোফাইল তৈরি করে নানা মানুষকে আমাদের বকলমে নানা অকথা কুকথা বলে বেড়াত। সৌমিত্র যদিওবা ওর ভূয়ো প্রোফাইলটি বাতিল করিয়ে দিতে পেরেছে। আমারটা সে এমন কায়দা করে করেছে, কমপ্লেন করতে গেলে আমারটাই ভূয়ো হয়ে যাচ্ছে। আমার ভূয়ো প্রোফাইলে লেখা আমার প্রিয় গান, সেই গান যা প্রকাশ কারাট শুনতে ভালোবাসেন। সেই খাদ্যই আমার প্রিয় খাদ্য, যা সীতারাম ইয়েচুরি খেতে ভালোবাসেন। এখনও বহাল তবিয়তে অর্কূটে রয়েছে আমার ভূয়ো প্রোফাইলটি।

সেদিন আমার আরেক সহকর্মী, যিনিও আবার ঘটনাচক্রে কবি, প্রায় একগাল হাসি ও কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস মুখে নিয়ে বললেন, দেখুন স্যার, একটা এসএমএস এসেছে। ঠিক বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কী? আমি বললাম, কী লিখেছে? মৃদু অবিশ্বাস ও গোপন-আনন্দ নিয়ে বললেন, বলছে, আমি নাকি এক লক্ষ টাকা পুরস্কার জিতেছি। কথা না বাড়াতে দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি ম্যাসেজটা মুছে দিয়ে ভুলে যান ওই কথা। এটা এক ধরনের অপরাধের ফাঁদ। এর নাম সাইবার ক্রাইম। শোনেন নি? কাগজে তো আজকাল সবসময় বেরোচ্ছে। আরেকজন বললেন, আমি তো ভেবেছি এই অপরাধগুলো মার্কিন দেশে বা ইউরোপেই হয়। আর আমাদের দেশে হলেও ওই মুম্বাই বা দিল্লিতে। এই ধ্যাধ্েেধড়ে বর্ধমানেও এসে গেলে বুঝি সাইবার ক্রাইম? আমি বললাম এটাই বিশ্বায়ন। যা আসবে একসাথে সর্বত্রই আসবে। এ ক্ষেত্রে ফিলিপিনসের মধ্যবিত্ত, পেরুর চাষি আর বর্ধমানের কর্মচারি একই দূরত্বে বিরাজ করছেন।

প্রকৃতপক্ষেও তাই। সাইবার অপরাধের বৈচিত্র্যও বিশাল। কোনও সাইবার অপরাধের লক্ষ্যবস্তু হয়ত কোনও ব্যক্তি, আবার কোনওটার কোনও প্রতিষ্ঠান। কখনও কখনও কোনও দেশ বা জাতি-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও সংঘটিত হচ্ছে সাইবার অপরাধ। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যারা বিচরণ করেন তারা জানবেন এই অপরাধের নানা বৃত্তান্ত। যখন গুজরাটে দাঙ্গা হচ্ছিল, তখন সাইবার দুনিয়ায় বিভিন্ন ব্লগ ও বিভিন্ন চ্যাটরুমগলিতে সঙ্ঘপরিবার ও তার সহযোগী সংগঠনগুলি পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিরোধী প্রচার চালিয়ে গেছে। কখনও কখনও তা ভয়ঙ্কর ধরনের বিষাক্ত প্রচার বা গুজব রটানোর পর্যায়েও গেছে। অন্যদিকে বিগত বেশ কিছুদিন ধরে সারা পৃথিবী জুড়েই সন্ত্রাসবাদীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর জাতিবিদ্বেষী প্রচার চালিয়ে আসছে। ভারত-পাক সম্পর্ক, শ্রীলঙ্কায় তামিল-সিংহলি সম্পর্ক বা মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইহুদি সম্পর্ক যখনই কোনও স্পর্শকাতরতার জায়গায় গেছে তখনই ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিদ্বেষ ও জিঘাংসার প্রচার করেছে বিভিন্ন সংগঠন। সাইবার আইনের চোখে এগুলিও কিন্তু মারাত্মক অপরাধ।

আবার কিছু অপরাধ আছে বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যক্তি বিশেষের সংঘটিত অপরাধ। কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে দেখলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনৈক মহিলা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মচ্যুত হওয়ার পর সন্ধ্যের মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুকে প্রচুর প্রয়োজনীয় তথ্যভা-ার ও প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য যোগসূত্রগুলিকে নষ্ট করে দিয়েছেন। সাইবার অপরাধসংক্রান্ত আদালতে মহিলা তাঁর দোষ কবুল করতে বাধ্য হয়েছেন। সাইবার অপরাধের বিশেষ বৈশিষ্ট্যটাই হচ্ছে যে সে কোনও দেশ মহাদেশের সীমারেখা মানে না। কিছুদিন আগে ইতালিতে পাঁচজন পাকিস্তানি নাগরিক গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের অপরাধ তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো তিনজন অপরাধীদের সাথে যোগসাজসে ইতালির একটি টেলিফোন নেটওয়ার্ককে বেশ কয়েকটি মার্কিনী প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন নেটওয়ার্কে অবৈধভাবে ঢুকিয়ে দিয়ে মার্কিনী প্রতিষ্ঠানগুলির কোটি কোটি টাকা ক্ষতি করিয়ে দিয়েছেন।

বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি সভ্যতাকে যেমন নতুন এক সকালে নিয়ে এসেছে, নতুন সকাল এনেছে অপরাধের দুনিয়াতেও। ইন্টারনেট যোগাযোগ বলা যায় এক বিপ্লবই নিয়ে এসেছে অপরাধ জগতেও। এখন অপরাধীকে কষ্ট করে আজ শিকারের কাছাকাছি আসতে হবে না। সমুদ্রপারের দূর দেশ থেকে বসেই সর্বনাশ করে দিতে পারে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের এক নিরপরাধ মানুষের জীবনেও।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইগুলা কিছু না। জনপ্রিয়তার বাড়তি পাওনা হিসেবে ধরে নিলেই ফতে

রণদীপম বসু এর ছবি

হা হা হা ! বেশ বলেছেন !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম খুব ভালো জিনিস। তাছাড়া এক্ষেত্রে লিঙ্গ-বৈষম্যও কম। সাইবার ক্রাইমের ভয়ে ফেসবুকে ঢুকি না, আগে দুয়েকটা টুকটাক ছবি ছিলো নেটে, এখন সেগুলোও সরিয়ে ফেলেছি। তারপরেও আল্লার মাল আল্লায় কখন কোন অপবাদ ছড়ায় আল্লাই জানে।

কাছের লোকদের সম্পর্কে তৃতীয় মাধ্যম থেকে কোন তত্ত্ব বা তথ্য পেয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার আগে কাছের লোকটির সাথে প্রথমেই সরাসরি কথা বলে নেয়া ভালো।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সাফি এর ছবি

আপনের ইনকামের যেই বয়ান শুনলাম, তাতে ভয়ের যথেষ্ঠ কারণ আছে চোখ টিপি

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অনেকদিন পর। লেখাটা ভালো লাগল। ঘটনাটা না, অবশ্যই।
_________________________________
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

'সাইবার ক্রাইম' কথাটির তাৎপর্য অনেক ব্যাপক। ইন্টারনেট থেকে অবৈধভাবে গান ডাউনলোড করাটাও এক ধরণের সাইবার ক্রাইম। তবে বড় ধরণের সাইবার ক্রাইম তৃতীয় বিশ্বে তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়।

সত্যান্বেষী

কৌস্তুভ এর ছবি

আমার দোস্তরা একবার অর্কুটে আমার জালি প্রোফাইল খুলে কিছু যুবতীদের সঙ্গে লুলালাপ করবে বলে ছক করেছিল। খবর পেয়ে সেটাকে আমিই হ্যাক করে নি। দেঁতো হাসি
লেখাটা ভাল লাগল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।