বেলা না যেতে

শুভপ্রসাদ এর ছবি
লিখেছেন শুভপ্রসাদ [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৯/২০১০ - ৪:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টাউন হলের বাইরের মাঠে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা মানুষ। কেউ নাটকের, কেউ গানের, কেউ রাজনীতির, কেউ সে অর্থে কিছুরই না। কথা বলছে না কেউ খুব একটা। কেমন যেন নিথর হয়ে আছে মানুষজন। তঁণদের সহযাত্রী নাট্যকর্মী গৌতম বণিকের মরদেহবাহী শকট একটু আগেই এখানকার নারী পুরুষের চোখের জল ফুল আর নিস্তব্ধ চেয়ে থাকা গ্রহণ করে বেরিয়ে গেছে পরবর্তী গন্তব্যে। এই ভীড়ে এসেছি আমিও, যদিও এখানে উপস্থিত আর সকলের মত এত ঘনিষ্ঠ সহযাত্রা আমার ছিল না তাঁর সাথে। শুধু গৌতমই কেন, কার সাথেই বা এখানে আছে আমার সুদীর্ঘ সহযাত্রার সম্পর্ক। আমি তো আলটপকা। এই সেদিন ছিটকে এসে পড়েছি। একটা ছোট্ট অতীত সময়খ- মাত্র এই মাটির সাথে আমার সম্পর্ককে সম্বল করে তারই ধারাবাহিকতায় বাকিটা জীবন এখানে কাটাবো বলে এসেছি। গৌতমের মরদেহ এখানে এসে পৌঁছতেই খুবই অনুচ্চ এবং একান্ত কান্নায় আছড়ে পড়লেন যাঁরা ওই শকটে, তাঁরাই হয়ত জানেন কতটা পথ পেরিয়ে এলে এমন চোখের জল বাঁধ ভাঙে। আমি তো তার কিছুই জানি না। গৌতমের কোনও নাটক দেখি নি, জানিও না ভালো করে এখানকার নাট্য আন্দোলনের কতটা জুড়ে তাঁর উপস্থিতি। তবু সেই সকাল থেকে কেন এক বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে মন, আজকের বর্ধমানের আকাশের মতোই কালো, কিন্তু অ-জল।

মনে ভেসে ওঠে আজ থেকে বছর তিনেক আগের এক সন্ধ্যা। সদ্য আবার ফিরে এসেছি বর্ধমানে। জীবিকার প্রয়োজনে, জীবনের বাধকতায়। পুরনো বন্ধুরা, অগ্রজরা বারবার সতর্ক করে দেন। যে দিন এখানে ফেলে গেছিস, কুড়ি বছর পর তাকে খুঁজতে যাস না। দুঃখ পাবি, না পেয়ে। যে দিন যায় সে কখনো ফেরে না। পুরনোর যত আভাসই গায়ে মেখে থাক না কেন, প্রতিদিনই এক একটি নতুন দিন। এ সব শুনি, তবু খুঁজি, আর মনে মনে গাই রবীন্দ্রনাথের গান। ‘ভেবেছিলেম আসবে ফিরে তাই ফাগুণ শেষে দিলেম বিদায়/ তুমি গেলে ভাসি নয়ন নীরে, এখন শ্রাবণদিনে মরি দ্বিধায়’। এমনই এক দ্বিধাভরা সন্ধ্যায় গান গাইতে গিয়েছি কুড়মুনে, কুড়মুন উৎসবে। বন্ধু শ্রীরূপের সুবাদে কুড়মুন আমার কাছে পূর্বশ্রুত জায়গা, কিন্তু যাই নি কখনো আগে। অনুষ্ঠানের আগে মঞ্চের পাশে বসে আছি। পুরনো নয়, নতুন দিনে নতুন বন্ধু খুঁজতে এসেছি সাংস্কৃতিক সংগ্রামে। তাকাচ্ছি আশে পাশে। হঠাৎই আমাকে চমকে দিল পাশ থেকে ভেসে আসা একটি কন্ঠস্বর, ‘আমি যদি ভুল না করে থাকি, তবে আপনি-ই কি শিলচরের রক্তকরবীর বিশু পাগল?’ আমার নিজের মাটি থেকে ১৪০০ কিলোমিটার দূরের এক বান্ধবহীন পরিচিতিহীন গ্রামে শিলচরের রক্তকরবীর বার্তা এল কি করে? আমি বলি,‘হ্যাঁ, আমিই অভিনয় করেছিলাম শিলচরে। কিন্তু আপনি সেটা জানলেন কি করে?’ হেসে উত্তর এল, ‘আমার নাম গৌতম বণিক। আমি সেবার শিলচরে নাটক করতে গিয়েছিলাম ওই প্রতিযোগিতায়। পরের শো’টা আমাদের ছিল বলে তখন কথা বলি নি। তবে উইংসে দাঁড়িয়ে পুরোটা দেখেছি। আপনি এখানে কি করে?’ বলি তাঁকে আমার ফিরে আসার বৃত্তান্ত। এক গাল হেসে গৌতম বলে, ‘একটা কথা দিন, যদি আমি এখানে রক্তকরবী করি, তবে বিশু পাগল আপনি হবেন তো?’ আমি অপ্রস্তুত হই, ‘পশ্চিমবাংলা নাট্যতীর্থ, এখানে আমার মত লোক দিয়ে এই কাজ হবে? আমি তো নাটকের লোক নই। করতে বললে অবশ্যই করব, কারণ আমার জন্যে সেটা গৌরবেরই ব্যাপার।’ তারপর থেকে বছরে দুয়েকবার কৃষ্ণসায়র উৎসবে বা বর্ধমান উৎসবে দেখা। দেখা হলেই এক কথা, ‘আমার মাথায় কিন্তু রক্তকরবী-টা রয়েছে। আপনি কথা দিয়েছেন কিন্তু।’ আমিও সহাস্যে জানিয়েছি, আমার সম্মতি, সম্মানিত বোধ করেই। এই হঠাৎ হঠাৎ দেখা হওয়া আর টুকরো কথা বিনিময় আর তাঁর মৃত্যু, এই দুইয়ের মধ্যে যদি সঙ্গীত সমাজের রক্তকরবী না থাকত, তবে হয়ত আরো অনেক মৃত’্যর মত ক্ষণিক বিষন্নতায় ফুরিয়ে যেতো গৌতমের অকাল মৃত্যুও।

মে মাস থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের রক্তকরবী শ্রুতি নাটকের পরিকল্পনা। তখন থেকেই আবার যোগাযোগটা বাড়ল। এই আসা যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই একটু একটু করে চিনছিলাম তাঁকে, মানে গৌতম বণিক নামের এক নাটক-পাগল ছেলেকে। মহড়া শুরু হতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। চারধারে নাটকের মানুষদের পাশে ‘অ-নাটক আমি’। সঙ্কোচও হচ্ছিল, ওদের কুশলী অভিনয়ের পাশে আমার ছেলেমানুষীকে তাঁরা প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে। নাটকের মানুষদের আমি এমনিতেও অসম্ভব শ্রদ্ধা করি, তাঁদের সমবেত শিল্পপ্রয়াসের জন্যে। স্বার্থপরের মত দরজা জানালা বন্ধ করে প্রহরে পর প্রহর ধরে রেওয়াজ করে গান যদিওবা কিছুটা হয়, নাটক এভাবে হওয়ার নয়। কারণ শিল্পমাধ্যমটিই সমবেত চরিত্রের। এক অপরের দিকে হাত না বাড়ালে শিল্পের ফুল ফোটে না। সেজন্যেই দলবদ্ধতার শিক্ষা নাটকের সহজাত বিষয়। সেই সহজাত গুণ থেকেই আমাদের রক্তকরবীর অন্য অভিনেতা অভিনেত্রী বন্ধুরা কাছে টেনে নিলেন আমাকে, গৌতমের নেতৃত্বেই। এতসব গুণের মধ্যেও কিছু কিছু নাটকের পরিচালকদের একটা দোষ বা বৈশিষ্ট্য থাকে, তাঁরা ভীষণ একনায়কতন্ত্রী হন। নিজের বোধ, নিজের বিবেচনাতেই চালিত করতে চান সবাইকে। অন্যের মতামত সেখানে গৌণ। আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় গৌতমকে মনে হয়েছে একটু আলাদাই। মহড়ায় সবার মতামত শোনা এবং প্রয়োজনে নিজের মতামতকে গৌণ করে অন্যের মতামতকে প্রাধাণ্য দেওয়া, এটা আমার কাছে তাঁকে আকর্ষণীয়ই করে তুলেছিল। নাটকের দলে কড়া অনুশাসন আমার ধাতে নেই, ফলেই মাঝে মাঝেই অনিয়মিত থেকেছি মহড়ায়। মৃদু হেসে, কিন্তু বুঝতে পেরেছি দৃঢ় অন্তরেই বলেছে, ‘আসলে কি, এটা সমবেত শিল্প তো, আপনি না এলে আপনার অসুবিধা না হলেও অন্যদের অসুবিধা হবে। একটু চেষ্টা করবেন সময়মত আসতে।’
এভাবেই ঘনিষ্ঠ করেছে হয়ত আমাকে। মহড়ার ফাঁকে ফাঁকে শুনেছি তাঁর চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা। নির্দেশনা দিতে গিয়ে কোনো বিশেষ দিক বোঝাতে গিয়ে অতীতের কোনও নাট্যঅভিজ্ঞতার কথা বলেছে। বলতে গিয়ে কখনো প্রসঙ্গক্রমে এসেছে পরবর্তীতে তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সে সময়ের কোনও নাট্যসতীর্থের কথাও। একদিন মুষল ধারে বৃষ্টি পড়ছে। মহড়া শেষ হতে বেশ কিছুটা দেরিই হয়েছে। গৌতম উশখুশ করছে বাস পাবে কি না। আমি বললাম, ‘চলো তোমাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।’ প্রথমে কিছুতেই রাজি না হলেও পরে উঠে এল আমার গাড়িতে। উঠেই বলল, ‘তবে চলুন ল্যাংচা খাই আগে।’ হাইওয়েতে একটি বিশেষ দোকানে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এখানকার ল্যাংচাই খাবেন শ্ুভ দা। এটা সবচেয়ে ভালো।’ খেতে খেতে নানা গল্প। রাজনীতির কথা। তাঁর কিছু নাট্যকর্মী বন্ধু যাঁরা এখন মতাদর্শগত বিভ্রান্তিতে এখন মাওবাদীদের সাথে যোগ দিয়েছে, তাঁদের জন্যে দীর্ঘশ্বাসও ছড়ালো তাঁর কথায়। লোডশেডিং-এর অন্ধকারে তাঁকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বিদায় নেওয়ার জন্যে গাড়ির গতি আস্তে করলাম। গৌতম বলল, ‘নামবেন না?’ আমি বললাম, ‘আজ থাক। পরে আসব, অনেক রাত হয়েছে।’ হঠাৎই বিষন্ন গলায় বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু একা থাকি, আপনি জানেন কি?’ আমি এড়িয়ে যেতে বললাম, ‘জানি। আরে আমরা সবাই আসলে একাই। তুমি সাতদিন একা থাকো, তবে আমিও পাঁচদিন একা থাকি। ওটা শুধু পরিমাণের তফাৎ।’ হো হো করে হেসে উঠল গৌতম। আমিও এক্সেলেটারে চাপ দিয়ে গাড়ির গতি বাড়াই।

তারপর আমাদের রক্তকরবীর শো গেছে। আবার বর্ধমানে ও কলকাতায় করার পরিকল্পনা নিয়ে গৌতম একবার বাড়ি এসেছে। নানা নতুন পরিকল্পনার কথা বলে আমাকে বলেছে, ‘শ্ুভ দা, তুমি যদি সঙ্গে থাকো, তাহলে অনেক কিছু করা যাবে।’ আমি হেসে বলি, ‘তুমি এসব বললে আমার লজ্জা হয়। আমার সঙ্গদান কি সত্যিই এতটা শক্তি রাখে?’

সেপ্টেম্বরেই আবার রক্তকরবী হওয়ার কথা টাউন হলে। এই পরিকল্পনার মধ্যেই এক সকালে বিমলানন্দের ফোন, গুরুতর অসুস্থ গৌতম। বর্ধমানের নার্সিং হোম থেকে কলকাতার পি.জি- যেন গৌতমের আরো অসুস্থ হয়ে পড়ারই পর্ব। ফোন করি পরিচিতজনদের, কিন্তু পি.জির পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলেও ভেতরে ঢুকি না। অসুস্থতার চেহারা দেখতে চাই না গৌতমের। তারপর গতকালের অমোঘ সংবাদ।

অনেকেই ফুল মালা নিয়ে এসেছিলেন গৌতমের মরদেহে দেওয়ার জন্যে। বিষন্নতায় আমি ভুলেই গিয়েছি এই আনুষ্ঠানিকতার কথা। সকলে যখন দরজা খুলে ফুল মালা দিচ্ছে আমি রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে অন্তিম অবসন্নতায় শুয়ে থাকা গৌতমকে দেখব বলে গাড়ির পাশ থেকে কাঁচের দেওয়ালের কাছে এগিয়ে যাই। কোথায় রোগাক্রান্ত চেহারা! শান্তিতে যেন ঘুমিয়ে আছে গৌতম, হয়ত কোনও নাটকের প্রয়োজনে গালে দাড়ি রেখেছে।

একা একা ভাবি গৌতমের কথা। তাঁর মরদেহ নিয়ে গাড়ি হয়ত এতক্ষনে তাঁর জন্মগ্রাম বড়শূল হয়ে ত্রিবেণীর পথে ছুটছে। আকাশ কালো, তবে বৃষ্টির দেখা নেই। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গৌতমের স্বজনদের একজন হয়ে উঠতে চাইছি নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে। অংশুমান ঘোর ভাঙালো, ‘চলো শ্ুভ দা, যাই।’ আমার মত অংশুও শোকাক্রান্ত, দুজনেই ভাবি, হয়ত আরো ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী হয়ে উঠত গৌতম বেঁচে থাকলে। আমাদের বন্ধু হত। অংশু বলে, ‘এই প্রথম আমি শ্ুভ দা, আমার কাছাকাছি বয়সের কারো মৃতদেহ দেখলাম’। গৌতমের বন্ধুদের আনা ফুলের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে আছে টাউন হলের রাস্তায়। বুকের ভেতর আবার জেগে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ, ‘কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও, শেষে দাও মুছে/ ওহে চঞ্চল, বেলা না যেতে খেলা কেন তব যায় ঘুচে’।


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

গৌতম শান্তিতে থাকুক। আজ শুনলাম আমাদের অভিনেতা সাইফুদ্দিনও মারা গেছেন।

...........................
Every Picture Tells a Story

সুমন সুপান্থ এর ছবি

অ-সাধারণ ।
বিহ্‌বল করে দেয়া লেখা আপনার । পড়তে পড়তে গৌতমের সঙ্গেই যাচ্ছিলাম যেন । যেন এক যৌথ শিল্প ও স্বপ্নযাত্রার অংশী ।

কিছু যাবে আসবে না জানি, তবু গৌতম দা`কে একটা স্যালুট রেখে যাই ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

বইখাতা এর ছবি

এমনই গদ্য আপনার, লেখার শেষে এসে নিজেও বিষণ্ণ হয়ে গেলাম। গৌতমদা শান্তিতে থাকুক, এটাই চাওয়া।

কৌস্তুভ এর ছবি

দুঃখজনক। ওনার প্রতি শ্রদ্ধা রইল। আজকেই সচলে এরকম খবর একসাথে আসছে কেন কি জানি।

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

দাদা,
বড্ড বিষণ্নতায় ডুবে গেলাম...
মাঝে মাঝে কোন কোন ঘটনায় সময় এমনই উদাস করে দিয়ে আরও বেশি একা করে দিয়ে যায় আমাদের।
মনের ভেতরে কোথায় যেন নাড়া দিয়ে গেল লেখাটা...

-----------------------------------------------------------------
নির্জলা নৈবেদ্য


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

স্নিগ্ধা এর ছবি

লেখা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারলাম না ...... এমনই এক বিষয় নিয়ে লেখা ...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।