সুচিত্রা মিত্র - রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসামান্যা নারী

শুভপ্রসাদ এর ছবি
লিখেছেন শুভপ্রসাদ [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৬/০৩/২০১১ - ১০:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কখনও এমন হয় যখন একজন শিল্পী বেঁচে থাকেন তখন অনেক সময়ই আমরা বুঝতে পারি না আমাদের কতটা জুড়ে তিনি আছেন। মৃত্যু এসে হঠাৎ করে আমাদের মাঝ থেকে তাঁকে কেড়ে নিলেও সঙ্গে সঙ্গেই যে শূন্যতা অনুভব করি তাও নয়। যতদিন যায় শূন্যতার অনুভূতি স্পষ্টতর হয় আমাদের প্রতিদিন। সুচিত্রা মিত্রের মৃত্যুতে বাঙালিভুবন যতই শোকার্ত হোক না কেন, এই বিয়োগের তাৎপর্য সবটাই আমরা অনুভব করতে পারছি এমনটা নয়। হয়ত নিজের বোধ বা বোধহীনতাকে বহুবচনে বলা অবিধেয়, তবু কেন জানি মনে হয়, এ আমাদের সামূহিক দুরবস্থাই।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল, তাঁর অন্য সৃষ্টিকে যদি ভুলেও যায়, বাঙালিকে তবু তাঁর গান গাইতেই হবে। শোকে-দুঃখে-আনন্দে-বিরহে বাঙালিকে ফিরে ফিরে আসতেই হবে তাঁর গানের কাছে। কবিগুরুর এই আত্মবিশ্বাস বলা বাহুল্য তাৎক্ষণিক মন্তব্য নয়, এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এখানে দু’টি কথা গুরুত্বপূর্ণ। এক, তিনি বলছেন বাঙালির কথা। দুই, তাঁর গানের কথা। রবীন্দ্রনাথ হয়ত এই কথাই বলতে চেয়েছেন যে তাঁর গান বাঙালিত্বের এমন এক বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হয়ে আছে যে, সঙ্গীত পিপাসা মেটানোর জন্যে ভাবীকালের বাঙালিকেও তাঁর গানের সরোবরেই অবগাহন করতে হবে। তিনি এও বলেছিলেন যে, অন্য দেশের অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ হয়ত তাঁর অন্য লেখাগুলিকে অনুবাদের মাধ্যমে কিছুটা হলেও বুঝে নেবে, কিন্তু গানের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু কঠিনতর। তিনি হয়ত এটাই বলেছেন, গানের বাণী সুরে এমন এক বাঙালিয়ানা আছে, বাঙালি বা বাঙালির ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশে থাকা জনগোষ্ঠী ছাড়া যার মর্মে প্রবেশ করা কিছুটা কঠিনই। সেজন্যেই এই গান যেমন দাবি করে এক ভিন্ন গায়ন, তেমনি এক ভিন্ন গায়নও প্রয়োজন এর ভেতরে প্রবেশ করার জন্যে। সেজন্যেই সুচিত্রা মিত্রের মৃত্যু শেষ পর্যন্ত সুচিত্রা মিত্রদের যুগের অবসানের বার্তাবহ হয়ে আসে।

সেদিন দুপুরবেলা হঠাৎই আসামের একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদকের ফোন। রাতের মধ্যেই একটি লেখা দিতে হবে। আমি বলি, কি বিষয়ে এত তাড়া দিয়ে লিখতে বলা। সম্পাদক উত্তর দিলেন, সুচিত্রা মিত্র নিয়ে। আমি বজ্রাহত হয়ে বলি, তার মানে, নেই? কখন? সম্পাদক বললেন, সে কি, তুমি পশ্চিমবঙ্গে বসে জানো না? কি লিখব? ঘটনার আকস্মিকতা যেন ভাবার ক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছে। একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে যাওয়ার কথা। যেতেই হল। সেখানেও বলা বাহুল্য আলোচ্য বিষয়, সুচিত্রা মিত্র। বাঙালি ভুবনে সেদিনের সন্ধ্যায় এ ছাড়া আর কি আলোচ্য থাকতে পারে? তবে এখানকার আলোচনাটা অন্যরকম, অনেকেই ছিলেন যাঁরা নানা অনুষ্ঠানের সূত্রে সুচিত্রা মিত্রের সাথে সম্পর্কিত হয়েছিলেন। একজন শিল্পী, একজন সংগঠক। শিল্পী বলছিলেন, কবে কোথায় সুচিত্রা মিত্রের সাথে এক মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছেন এবং তাঁর উপস্থাপনা শুনে সুচিত্রা মিত্র কি বলেছিলেন, ইত্যাদি। সংগঠক ভদ্রলোক অনুষ্ঠান আয়োজনের দিক থেকে একজন সফল সংগঠক। তিনি বারবার বলছিলেন, কতবার কত সামান্য সাম্মানিকে সুচিত্রা মিত্রকে এনে অনুষ্ঠান করিয়েছেন এবং সেটা সম্ভব হয়েছে সম্পূর্ণতই সুচিত্রা মিত্র তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন এ জন্যে। ফলে তাঁদের কথায় সেই স্মৃতিচারণই ফিরে ফিরে আসছিল বারবার। আমার মনে হল, এটা সুচিত্রা মিত্রের প্রতি যতটা না শ্রদ্ধার্ঘ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে সেই সেই ব্যক্তির নিজেকে তুলে ধরা কিংবা নিজেদেরকে প্রমাণ করা। আমার তো তেমন ঐশ্বর্য নেই যা পাল্লা দিয়ে দেখাতে পারি। আমার তো আশৈশব জুড়ে শুধু শ্রবণ আর শ্রবণ, এক মুগ্ধ শ্রবণের স্মৃতি। বড় হয়ে যখন থেকে আমিও রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণনাট্যের দ্বিবেণীসংগমে ডুব দেওয়ার স্বপ্নে মজেছি, সেদিন থেকে তরুণ বাউল যেমন লালন সাঁইয়ের কথা বলতে গিয়ে বুকে হাত দেয়, আমিও একইভাবে ভেসেছি একান্তে সুচিত্রা মিত্রকে নিয়ে। দূর থেকে তাঁকে কখনো ভেবেছি পূর্বসূরী, কখনও সহ-পথিক, কখনও অনুপ্রেরণা। এ ছাড়া আমার আর কোনও ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ নেই। আমি তাঁর কাছে গান শিখি নি। তাঁকেও আমার গান শোনার মত দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হতে হয় নি জীবনে। শুনলে হয়ত কান মলে দিয়ে বলতেন, ঘটে এইটুকু নিয়ে আর কায়দা করে গাইতে হবে না রবীন্দ্রনাথের গান। তবে পীরের লাঠির ঘা খেয়েও যেমন কোনও কোনও মানুষ পুণ্য অর্জনের অনুভূতি হয় তেমন সৌভাগ্যও হয় নি আমার।

তবে একটি অনুষ্ঠানের জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম একবার তাঁর বাড়িতে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম কলিং বেল টিপলে দরজা খুলবে কোনো কাজের মানুষ বা অন্য কেউ। আমাদের হতচকিত করে দরজা খুললেন তিনিই। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা দুজনেই খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। আমি ভাবলাম প্রথম কথাটা আমার বন্ধু বলবে, আর সে ভাবল, সব-ব্যাপারে-আগ-বাড়িয়ে-বকবক-করা-আমিই বলব কি কারণে আমরা এসেছি। ফলে ঘটনাটা দাঁড়ালো, দুজনেই স্পিকটি নট। এরপরেই ঘটনায় আমাদের প্রায় ভিরমি খাবার জোগাড়। মুখ খুললেন প্রথমে সুচিত্রা মিত্রই। এবং সেটা তাঁর গায়নের মতই সতেজ। ‘কি আশ্চর্য! কিছু একটা বল। কারো মুখে তো লেখা থাকে না, কি নাম, কেন এসেছ ইত্যাদি। অমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে?’ তারপরের ঘটনাটা কেমন করে ঘটল এখন আর মনে নেই। তবে ঘরে নিয়ে বসানোর পর তিনি বললেন, প্রথমেই বলি, আমার কিন্তু আজ মেজাজ খুবই বিগড়ে আছে। কাজের লোক আসে নি। সর্দি হয়ে গান করতে পারছি না। ফলে মন মেজাজ খারাপ। কাজ করতে গিয়ে হাতের জিনিষপত্র পড়ে যাচ্ছে, সামনে যারা আছে তারা কথায় কথায় বকুনি খাচ্ছে। তোমরাও কিন্তু বকুনি খেতে পারো, ফলে কিছু মনে কোরো না। আগেই বলে রাখলাম।’ এমন একটি ভূমিকার পর প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ারই কথা। ফলে অনুষ্ঠানের কথা বলে যখন প্রসঙ্গ এলো, সাম্মানিকের কথা, তখনই আবার ধাক্কা। বললেন, কি দিতে পারবে শুনি? বললাম, আমাদের তো খুব বেশি সামর্থ্য নেই, আবার বুঝতে পারছি না কি বলব। এমন একটা বলে বসি যাতে আপনার অসম্মান হয়। এবার সোজা চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট কথায় বললেন, মানে, টাকার অঙ্ক দিয়ে সম্মান অসম্মান হয়? আমরা আমতা আমতা করি। বুঝি আজ আর গুছিয়ে কোনো কথাই বোধহয় বলতে পারব না। তারপর তিনি এসেছিলেন শিলচরে অনুষ্ঠানে।

অন্ধকারে সকলের কথাবার্তার মধ্যেই বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাই, ভাবি, কি লিখব। মনে পড়ে আমার স্বভাব-বাউণ্ডুলে বন্ধু দীপক সোমের কথা, যে কলেজে পড়ার সময়কার এক সন্ধ্যার পর থেকে সুচিত্রা মিত্রের হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে তাঁর স্থায়ী বসত গড়ে নিয়েছিল। বস্তুত দীপকের সাথে আমার পরিচয়ের দিনই জেনে গিয়েছিলাম সেই ঘটনার কথা। সম্ভবত আটের দশকের কোনও এক সময়ে সুচিত্রা মিত্র গান গাইতে গিয়েছিলেন করিমগঞ্জে। সেই অনুষ্ঠানে সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে ‘ওই রে তরী দিল খুলে’ গানটি শুনে দীপক অনুষ্ঠান শেষে হাউহাউ করে কেঁদে গ্রিনরুমে সুচিত্রা মিত্রের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। আর ঠিক সে সময়েই উদ্যোক্তারা সুচিত্রা মিত্রের হাতে তাঁর সেদিনের অনুষ্ঠানের সম্মানদক্ষিণা দিতে হাজির হয়েছে। সুচিত্রা মিত্র হাতজোড় করে উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, আমার সম্মানদক্ষিণা আমি পেয়ে গিয়েছি। আজ আমার আর অন্য কোনও কিছুর প্রয়োজন নেই। তরুণ যুবকের এমন আকুল কান্নার চেয়ে আর বড় কোনও পারিশ্রমিক হয় না। এই ঘটনার কথা সুচিত্রা মিত্র বহুবছর পর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেছেন। তারপর থেকে দীপক তাঁর কাছে পুত্রস্নেহ পেয়েছে। দীপকের গানের গলা ছিল উদাত্ত। সেই বয়সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভেতর প্রদেশে তার ছিল অনায়াস যাতায়াত। ওর এই গভীর সঙ্গীতবোধের কাছে আমার গানও ঋণী। একবার মনে হল দীপককে নিয়েও লেখাটা এগোতে পারে। কি নিয়ে লিখব? দূর থেকে তাঁকে দেখা আর তাঁর গান শুনে মুগ্ধ আবেশের কথা। তার জন্যেও আমিই বা কেন?

এ সব ভাবতে ভাবতেই বোঝার চেষ্টা করি, কি হারালাম আমরা তাঁর মৃত্যুতে। সুচিত্রা মিত্র বললেই ভেসে ওঠে এক দৃপ্ত, অথচ মগ্ন গায়ন। এই গায়ন এই বোধ জন্ম নিয়েছে অনেক কিছুর রসায়নে। পারিবারিক পরিমণ্ডল, শান্তিনিকেতনের শিক্ষা, গণনাট্যের দীক্ষা- আরো আরো অনেক কিছু। মেধা হৃদয় বোধ, আরো কত কিছুর রাসায়নিক মিলন হলে যে একটি দেবব্রত বিশ্বাস, একটি সুচিত্রা মিত্র আবির্ভূত হয়, জানি না আমিও। যদি সত্যিই জানতাম তবে হয়ত এতটা নিঃস্বতার অনুভূতি গ্রাস করত না হৃদয়কে। এঁরা এমন একজন শিল্পী যাঁদের গায়নে অনুভবে মিশে আছে উনবিংশ শতকের নবজাগরণের দীপ্তি, যা আজকের বুদ্ধিজীবীদের বুলিতে ধিক্কৃত। আবার যে নবজাগরণ সত্যিই কলকাতা নগরীর সীমায় আটকে ছিল, তাঁকে ব্যাপ্তি দিয়ে পরিপূর্ণতার পথে ধাবমান করল চল্লিশের যে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সেখানেও ছিল তাঁদের প্রাণময় উপস্থিতি। কে যেন সেদিন বলল, চল্লিশের প্রগতি সাহিত্য ও গণনাট্য আন্দোলনের উদ্ভাসকে অশোক মিত্র ব্যাখ্যা করেছেন আমাদের দ্বিতীয় নবজাগরণ হিসেবে। সত্যিই তো। উনবিংশ শতকের নবজাগরণ যদি কলকাতার ভদ্রলোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে থাকে, তবে তার বন্ধনমুক্তি তো হয়েছে চল্লিশের সাংস্কৃতিক জাগরণেই। তখন এক মঞ্চে গান গাইছেন দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র আর গ্রামবাংলার লোকশিল্পীরা। চিত্তপ্রসাদের ছবিতে ফুটে উঠছে সংগ্রামী কৃষকের ছবি, সাহিত্যে নাটকে নায়কের ভূমিকায় উঠে আসছে শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের হালের তথাকথিত উত্তর-আধুনিকেরা এই সত্যের দিকে কখনো নজর দেন না। নবজাগরণ থেকে গণনাট্য যে পূর্ণতার ইঙ্গিত দেয়, সুচিত্রা দেবব্রতরা তাঁরই সন্তান। ফলেই আশ্রম, উপনিষদ আর ব্রহ্মসঙ্গীতে থমকে থাকেন নি দেবব্রত-সুচিত্রারা। বরং রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্দরমহলে তাঁরা বইয়ে দিয়েছিলেন গণনাট্যের মুক্ত হাওয়া। এ ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এবং দেবব্রত-সুচিত্রা বিপরীত অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র গণনাট্যের গানে মূর্ত করেছেন রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার, তাঁর ‘নবজীবনের গান’ এ যা স্পষ্ট হয়েছে। পক্ষান্তরে দেবব্রত-সুচিত্রা রবীন্দ্রসঙ্গীতে এনেছেন গণনাট্যের পূবালী বাতাস। গণনাট্যের অনুষ্ঠানের মঞ্চে হঠাৎ করে যেদিন দেবব্রত বিশ্বাস মহড়ার গায়নকে পাল্টে দিয়ে অন্য ঢঙে ‘খরবায়ু বয় বেগে’ আলোড়ন তুলেছিলেন, সেদিনই জন্ম হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি নতুন পাঠের। আবার এ কথাও সত্য, যে গণনাট্য আন্দোলনে দেবব্রত-সুচিত্রাদের সঙ্গীতবোধ পূর্ণতা পেল, সেও এই দুই শিল্পীর উত্তরাধিকারকে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হল, কারণ কিসের উত্তরাধিকার বহন করছে এই আন্দোলন, তাঁর কোনো সচেতন অনুভব ছিল না তার সাংগঠনিক ভাবনায় বা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে। কারো কারো ধারণা, ট্রেমেলো ভয়েসে চীৎকার দিয়ে মোটা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেই বোধহয় ‘গণনাট্য গণনাট্য ভাব’ চলে আসে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণনাট্যচেতনার সংলাপ শুধুমাত্র একটি গায়নভঙ্গীর বিষয় নয়। এর বিষয়টি গানের কথা আর সুরের ব্যাপার নয় মাত্র, এটি সম্পূর্ণতই একটি গভীরতর তাত্ত্বিক প্রকল্প, যা পেরিয়েই একজন সার্থক গণনাট্য-সন্তান রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওই রূপায়ন করতে পারে। সুচিত্রা মিত্রের মৃত্যু গণনাট্য ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের এমনই এক সার্থক সংলাপের রূপকার এক গণনাট্য-সন্তানকে আমাদের মধ্য থেকে কেড়ে নিয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা নিঃস্ব। কেউ বলবেন সুচিত্রা মিত্র ও দেবব্রত বিশ্বাস, এই দু’টি নাম কি সত্যিই এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতে পারে? তাঁদের গায়ন তো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ কথা নিশ্চয়ই সত্যি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তাঁরা দুজন একই ধারার সন্তান। তাঁদের যা তফাৎ, তা শুধু ব্যক্তিত্বের তফাৎ, যার ছাপ পড়েছে নিজের নিজের গায়নে। গভীরে গিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের যাত্রাপথে তাঁরা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই সহ-পথিক।

নিঃস্ব হলাম এজন্যেই, কেউ রইল না যে আমাদের রবীন্দ্রনাথের গানের রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপের সন্ধান দেবে। ইদানিংকালে এক শ্রেণির ফেরিওয়ালা-গায়করা রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিসরের দখল নিয়েছেন। আমার এঁদের ভীষণ দরিদ্র মনে হয়। সর্বক্ষণ এঁদের একটাই উদ্বেগ, কি ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানকে অবলম্বন করেও গানকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠবেন তাঁরা নিজেরা। গান নয়, নিজেদেরকে যেনতেন প্রকারেণ তুলে ধরাই এঁদের উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রসঙ্গীতটা উপলক্ষ্য মাত্র। তাঁরা বারবার ব্যর্থ হন, আবার নতুন ধরনের নাচোন কোঁদনে মেতে ওঠেন। আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এখনকার শিল্পীরা সকলেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সব্বোনাশ করে চলেছেন। অন্যদের কথা ছেড়েই দিলাম, ব্যক্তিগতভাবে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের এ সময়ের শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলতে আমি কবীর সুমনকেই চিনি, যদিও গানের শব্দের উচ্চারণে এক ধরনের কৃত্রিমতা গ্রাস করেছে পরবর্তীতে তাঁকেও। অন্য কি বিষয়ে উনি কি করেন বলা বাহুল্য, এটা ধর্তব্যের বিষয় নয় কখনোই। আমি বলছি, যাঁর নামের দোহাই দিয়ে সকলে এখনকার বাংলা গানে ‘পরীক্ষানিরীক্ষা’ নামক একটি অশিক্ষিত এক্সার্সাইজ করেন, সেই সুমন কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে ভীষণই প্রথানুগ। একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে তাঁর গায়নে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি সমকালীন ভাষ্যই ফুটে ওঠে। আমি বলছিলাম, গান ও গায়কের সম্পর্কের কথা। আমাদের বিগত প্রজন্মের যে কোনো শিল্পী, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হোন, কিংবা অশোকতরু বা সুবিনয় রায়। অথবা দেবব্রত বিশ্বাস বা সুচিত্রা মিত্র। তাঁদের গায়নে তাঁদের ব্যক্তিত্বের অনন্য উপস্থিতি সত্ত্বেও, কখনো গানকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠতে চায় নি গায়ক তাঁর নিজের উপস্থাপনায়। সব সময়ই গান থেকেছে ওপরে, আর তাঁরা থেকেছেন সেই গানের সার্থক রূপকার হয়ে। গান যেন গুরু, তাঁরা অনুগত ভক্ত। কবীর সুমনের রবীন্দ্রসঙ্গীতেও, অন্তত আমি, এই গান-গায়ক এর এই আন্তঃসম্পর্কই দেখতে পাই। তবে তাঁর দ্বারা প্রাণিত বলে দাবি করা তাঁর ভক্তগায়কদের ফেরিওয়ালাই মনে হয় আমার।

কিছু না জেনেই সেদিন সকাল থেকে একটা গানের বিশেষ একটি পংক্তি মনের ভেতর ঘোরা ফেরা করছিল। তখন জানতামও না সুচিত্রা মিত্র নেই। ফেসবুকে আমার স্টেটাসে লিখেও ছিলাম সেই পংক্তি। তারই ঘন্টা খানেক পর সেই ফোন। ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা’ গানের সেই পংক্তিগুলি হল, ‘একলা ঘরে চুপে চুপে/ এসো কেবল সুরের রূপে/ এসো গো, এসো গো/ আমার চোখের জলে দিও সাড়া’। একজন বন্ধু লিখেছেন, শুভদা, আজকে তোমার পোস্টটা আরো সত্যি মনে হচ্ছে। আমি উত্তরে বললাম, তখন আমি এই মর্মান্তিক খবরটি জানতামই না। কেন জানি সকাল থেকেই গানটা আমার ভেতরে বাজছিল থেকে থেকে। হয়ত এভাবেই সময়ে অ-সময়ে অজান্তে আমাদের অন্দরে বেজে ওঠে গান। আর তার জন্যেই আমরা গানের বান্দা।

গান রইল, আমরাও থাকলাম, শুধু এই গানগুলিকে আমাদের হৃদয় দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার আপাতত শেষ ডাকহরকরা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

দশজনের নয়জনের ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রসঙ্গীত একপ্রকার ভেন্ট্রিলকিসম। সুচিত্রা আপন শক্তিতে গাওয়া শিল্পী। ব্যক্তিগত ঘটনাতেও তেমনই মনে হইল। তাকে নিয়া লেখার জন্য ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

সুচিত্রা মিত্রের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
সুমন চ্যাটার্জির গানে এক আশ্চর্য সতেজ রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করি। কিন্তু শ্রীকান্তকে ভুলি কিভাবে?
রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে "গিনিপিগ টেস্ট" এর কথা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।

---------------
সাত্যকি

---------------

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সুচিত্রা মিত্রের আত্মার শান্তি কামনা করি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সেদিন খুব কষ্ট লাগছিলো...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সেদিন খুব কষ্ট লাগছিলো

লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। টিভিতে মাঝে মধ্যে সকালে আপনার গান শুনি। লেখা পাই না... হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শুভপ্রসাদ এর ছবি

আগামী ২১ মার্চ ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে সাতটায় তারা মিউজিকের আজ সকালের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে আমি অতিথি শিল্পী হিসেবে থাকব। দেখার আমন্ত্রণ রইল।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভালো মানের শিল্পী অনেকেই আছেন কিন্তু মানুষ হিসেবে বড় ক'জন হতে পারে সেটাই মুখ্য। এই একটি লাইনেই সুচিত্রা মিত্রের বড় মনের পরিচয় পাওয়া যায়:

এবার সোজা চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট কথায় বললেন, মানে, টাকার অঙ্ক দিয়ে সম্মান অসম্মান হয়?

লেখাটা পড়ে মন খারাপ হোলো। সুচিত্রা মিত্রের আত্মার শান্তি কামনা করি।

(বাবা মায়ের প্রিয় গানের অনুষ্ঠান তারা মিউজিকের 'আজ সকালের আমন্ত্রনে' আপনার গান শুনেছিলাম। মুগ্ধতা জানিয়ে রাখলাম এই ফাঁকে।)

শুভপ্রসাদ এর ছবি

আগামী ২১ মার্চ ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে সাতটায় তারা মিউজিকের 'আজ সকালের আমন্ত্রনে' অনুষ্ঠানেআমি থাকব। দেখার আমন্ত্রণ রইল।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

শ্রদ্ধা

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দেবব্রত বিশ্বাস-সুচিত্রা মিত্র-কলিম শরাফীর প্রস্থান মানে হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নেকুদের জয়-জয়কার। রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে যে নুব্জ হয়ে, ক্ষয়ে যাওয়া মেরুদণ্ড নিয়ে, ন্যাকামী ভরা গান নয় এ'কথা এনারা বুঝিয়েছেন। এই তিন মহান শিল্পীর প্রতিই শ্রদ্ধা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশেষ ভক্ত হতে পারিনি কারন অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী বোঝার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তার পরেও কিছু কিছু শুনি। আমার বন্ধু শুভমিতার কন্ঠে 'আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে, তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে' গানটা আমার কাছে জোস লাগে।

তবে ছোটবেলা থেকেই আমি সুচিত্রা মিত্রের একটা গানে আমি দারূন অভিভূত। কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। তার পরিষ্কার উচ্চারন সবসময়েই আমার কাছে অসাধারন লাগতো। আজকাল তো দেখি রবীন্দ্রসঙ্গীত চিবিয়ে চিবিয়ে এবং নাকি সুরে না গাইলে নাকি তাতে রাবীন্দ্রিক আবেশ আসেনা। ভালো, যার আবেশ নিয়ে সে থাক, আমি চেপে যাই। তবে পান্ডবদার সাথে একটু সহমত জানিয়ে যাই।

দেবব্রত বিশ্বাস-সুচিত্রা মিত্র-কলিম শরাফীর প্রস্থান মানে হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নেকুদের জয়-জয়কার।

সুচিত্রা মিত্রের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। শ্রদ্ধা

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চেতনায় জেগে র'বে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ছায়াচ্ছন্ন ভালোবাসা। সেই সাথে জেগে রইবেন তাঁরাও যাদের বেলা গিয়েছে সাঝবেলাতে তাঁর সুরের নেশায় সুর মেলাতে! সুচিত্রার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

শ্রদ্ধা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।