(এই লেখাটি শাহবাগের সংগ্রামের প্রেক্ষিতে আমার ভাবনা। প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার একটি পত্রিকায়)
এখনও কানের কাছে বাজে সেই কথাটি। ২০০১ সালের একুশের মরশুম। ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে মোড়ক উন্মোচন হবে নতুন একটি বইয়ের। নাম ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা’। লেখক মেসবাহ কামাল,লেখক মেসবাহ কামাল,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, অগ্রণী বামপন্থী বুদ্ধিজীবী। অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত বাংলাদেশের সমস্ত বামপন্থী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সে সময়কার আহ্বায়ক এবং ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটবুরো সদস্য আবদুল মতিন। জনসমাজে বাহান্নর আন্দোলনের তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতিতে তাঁকে লোকে বলে ‘ভাষা মতিন’। বইয়ের মোড়ক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে ছোট্ট একটি ভাষণ দেন মতিন ভাই। ভাষণের আগাগোড়া একটিই বক্তব্য। মুক্তিযুদ্ধ অতীত নয়, এটি একটি বহমান ইতিহাস। এই কথা বোঝাতে গিয়ে প্রায় দুটি তিনটি বাক্য পরপরই মতিনভাই বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ ইজ কন্টিনিউয়িং। মুক্তিযুদ্ধ এখনো চলছে। ছোট্ট একটি বক্তৃতায় মতিনভাইয়ের বারবার ওই বাক্যটি বলা বাংলাদেশ-সম্পর্কে-অজ্ঞ আমাদের কাছে খানিকটা হাস্যকর ঠেকেছিল সেদিন। বারো বছর পর শাহবাগ এখন মতিনভাইয়ের সুরেই কথা বলছে।
ঢাকায় এখন যেন ফিরে এসেছে আবার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। মতিনভাইয়ের উত্তরসূরীরা শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে ডাক দিয়েছে একাত্তরের অপূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করার। দু’হাজার এক সালের মতিনভাইয়ের কথা ‘মুক্তিযুদ্ধ ইজ কন্টিনিউয়িং’ এখন বাস্তব সত্য। একদিকে মানুষ উদ্বেল হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, অন্য দিকে ঘাতক দালাল মৌলবাদীরা জোট বেঁধেছে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে পরাস্ত করতে। পার্থক্য একটাই, তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নি, ফলে ক্ষমতায় ছিল অত্যাচারী শাসকরা। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছে সহানুভূতিশীল একটি সরকার। রাজাকার তখনও ছিল এখনও রয়েছে। সেদিন শত্রুর সাথে দালালের ভূমিকায় ছিলেন যারা, সেই রাজাকাররাই আজ প্রধান শত্রু। আজ দালালের ভূমিকায় রয়েছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দল। বাংলাদেশে আজ শিবির বিভাজন সুস্পষ্ট। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্রযুবসমাজ, সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদসহ নানা ধারার বামপন্থী দলগুলি। এঁদের বিপরীতে রয়েছে জামাত-ই-ইসলামি, একাত্তরে পাকিস্তানী শাসকদের পাশে দাঁড়িয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেছে বললে কম বলা হয়, ওরা প্রত্যক্ষভাবে হত্যালীলায় অংশ নিয়েছিল। এবার জামাতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি দল এবং মুষ্টিমেয় কিছু বিপথগামী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
আমাদের এই বাংলায় এখনো বাংলাদেশের এই চলমান সংগ্রাম নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি। বেশিরভাগ মানুষ জানেনই না এই লড়াই কার বিরুদ্ধে, কারা করছেন এবং কী নিয়ে লড়াই হচ্ছে। বাংলাদেশে সংগ্রাম শুরু হয়ে যাওয়ার পরও অনেকদিন ধরেই আমাদের এই বঙ্গের সংবাদ মাধ্যমে খুব একটা উল্লেখ ছিল না তার। রাজনৈতিক দল, সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরাও এক ধরনের উদাসীনতাই দেখিয়েছেন। সংগ্রাম অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর সম্বিৎ ফিরল এই বঙ্গের। এখন একটুখানি নড়াচড়া শুরু হয়েছে। এই নড়াচড়াতে আবার স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতার প্রকৃত রূপ। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে জনৈক তারকাশিল্পী গান গাওয়ার আগে বললেন, এখন বাংলাদেশে যে ভাষাসংগ্রাম চলছে আমরা তার পাশে আছি। আসলে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের যত আবেগই থাক, আমরা অনেকেই বাংলাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস জানি না। আমাদের ধারণা অনেকটাই ভাসাভাসা। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের এই সময়ের লড়াই শুধু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আরো বড়ো, অনেক বড়ো এর তাৎপর্য, যার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাপ্ত আজকের পৃথিবীর সমকালীন বাস্তবতায়।
আমরা যদি আমাদের আলোচনার শুরুর বিন্দু হিসেবে উনিশ শ সাতচল্লিশকেই ধরি, তবে হয়ত আমরা কিছুটা হলেও বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিকে বুঝতে পারব। প্রকৃতপক্ষে দেশভাগ আমাদের মধ্যে শুধু বিভাজনেরই সূত্রপাত করেনি, আমাদের পারস্পরিক অজ্ঞানতাও তখন থেকে এক ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছে। তখন থেকেই আমাদের দুই বঙ্গের যাত্রাপথ ভিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের মিলিত ইতিহাস ছিল মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলন। আমাদের বৈষ্ণব সাহিত্য বাঙালি হিন্দু মুসলমানের যৌথ সৃষ্টি। উনবিংশ শতকের নবজাগরনে যদি বাঙালি মুসলমান অংশগ্রহণে কিছুটা পিছিয়ে থাকে, তবে সেই পিছিয়ে থাকাকে পূর্ণ করার ইঙ্গিত পেয়েছি বিংশ শতকের দুইয়ের দশকের ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও ‘শিখা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভাব আন্দোলনে। কাজী আবদুল ওয়াদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল হোসাইন, আচার্য শহীদুল্লাহের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘শিখা’ পত্রিকা গোষ্ঠী পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলিম সমাজে নতুন যুগের হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিল। তাঁদের আদর্শ ছিল উনিশ শতকের নবজাগরণ, ইউরোপের নবজাগরন, কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের বুকে জন্ম নেওয়া নবজাগরন। তাঁরা অনুপ্রেরণা খুঁজেছেন গ্যেটের সাহিত্যে, হজরত মহম্মদের ধর্মশিক্ষায়, রাজা রামমোহন রায়ের ভাব আন্দোলনে। এই অবধি আমাদের ইতিহাস অভিন্ন, যদিও পারস্পরিক অজ্ঞতাও কম নয়। চারের দশকের ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন এই ভাব আন্দোলনকে অনেকটাই দুর্বল করে দেয়। জন্মলগ্ন থেকেই ‘শিখা’ গোষ্ঠীকে লড়তে হয়েছে ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে। চারের দশকে মুসলিম সমাজকে অন্ধ করে দিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্ব। এই ঘনঘটার মধ্যেই দেশভাগ ও পাকিস্তানের জন্ম। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলিমরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার আদর্শের অন্তঃসারশূন্যতা অনুভব করতে থাকেন।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও একুশের রক্তদানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় সমাজের মূল আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের। একে তাঁরা বললেন তাঁদের ‘ঘরে ফেরা’। এই ‘ঘরে ফেরা’ জন্ম দিল ধর্মীয় উৎসবের বাইরে গিয়ে হিন্দু মুসলমানের মিলিত সাংস্কৃতিক উৎসবের। এ ভাবেই নববর্ষ হয়ে উঠল পূর্ব বাংলার হিন্দু মুসলিম বাঙালির অভিন্ন সামাজিক উৎসব। এই অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের গড়ে ওঠার মধ্যে মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক-বাঙালিত্বের নির্মানে অগ্রণী হলেন তাঁরা। এই বাঙালিত্ব নির্মানে ধার্মিকতা কোনো বাধা হিসেবে প্রতিপন্ন হল না। হয়ে উঠল সহ-পথিক। এই বাঙালিত্ব নির্মানের পথ ধরেই এল পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের লড়াই। এল মুক্তিযুদ্ধ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক আন্দোলনগুলিতে প্রধান ভূমিকা বরাবরই ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। পাকিস্তানী জমানার কোনো সময়েই যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে তার রাজনৈতিক সাংগঠনিক কাজকর্ম করতে পারত না, তারা অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমন ন্যাপ কিংবা আওয়ামী লীগের মধ্যে তাঁদের কাজকর্ম চালাতেন। তবে তাঁদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ছিল স্বাধিকারের লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকায়। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতেও তাঁরা ছিলেন অগ্রভাগে। প্রকাশ্যে কাজ করতে না পারলেও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ও ছাত্র আন্দোলনের তাঁদের নেতৃত্বকারী ভূমিকার ফলেই পূর্ব বাংলার সমস্ত পর্যায়ের গণআন্দোলনে একটি প্রগতিশীল অভিমুখ ছিল। এই প্রগতিশীল অভিমুখ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলিতে একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় নেতুবৃন্দ।
কিন্তু সত্তরের পৃথিবী ছিল ভিন্ন। জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শাসক আওয়ামী লীগের তরফে বাকশাল নামে নতুন পার্টি গঠন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ সহ বেশ কিছু বিতর্কিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে ক্ষোভের দেখা দিল।
এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজেদের চক্রান্তের জাল বিস্তার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ সাহায্যে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বকলমে ক্ষমতায় ফিরে এল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রত্যাখাত পাকিস্তানপন্থী নেতা ও সংগঠনগুলি ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে মাথা তুলতে শুরু করল। জিয়া ও এরশাদ জমানায় এরা মতাদর্শের ক্ষেত্রেও নানা রকমের বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে খর্ব করার প্রচেষ্টা নিলেন। শেখ মুজিবের ‘জয় বাংলা’ ম্লোগানের পরিবর্তে চালু হল নতুন শ্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের আদর্শের পরিবর্তে সামনে নিয়ে আসা হল অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের আদর্শের পরিবর্তে সামনে নিয়ে আসা হল ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’কে। সমাজের সর্বস্তর থেকে ‘বাঙালি’ শব্দটিকে নির্বাসন দিয়ে ‘বাংলাদেশী’ কথাটির প্রচলন ঘটানোর প্রচেষ্টা হল। পুরনো পাকিস্তানপন্থীরা নতুন তত্ত্ব দিলেন ‘একুশের চেতনা’ দিয়ে হবে না, সঙ্গে ‘সাতচল্লিশের চেতনা’ যুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ একদা যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের শ্লোগান দিয়েছিলেন, তারা স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দ্বিজাতি তত্ত্বকে পুনর্বাসন দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি শুরু হল। সামরিক স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে বাংলার মানুষ প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও এই বিকৃতি মেনে নিতে পারলেন না। তাই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে গণআন্দোলন শুরু হতেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তরফে একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুনর্প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও শুরু হল। রাজনীতির ওলোট পালটে খালেদা জিয়াও এই আন্দোলনে শামিল হলেন। আবার এরশাদ-জমানার অপসারণের দাবিতে মুখর হলেন জামাত-ই-ইসলামিও। এই পর্বেই রাজনৈতিক সুবিধাবাদের আশ্রয় নিয়ে এরশাদকে হঠাতে সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগও জামাতের সাথে আঁতাত গঠন করে।
যাইহোক, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর সমাজের সর্বস্তরে দাবি ওঠে বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ফিরিয়ে আনার, মুক্তিযুদ্ধে যে সমস্ত ঘাতক দালাল রাজাকাররা তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে তার বিচারের। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সমাজের বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে গড়ে উঠল ‘ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি’। এই কমিটির নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে বিগত প্রায় কুড়ি বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে ও ঘাতক-্ িএই কমিটির নেতুত্বে দালালদের ধারাবাহিকভাবে বিগত প্রায় কুড়ি বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে ও দালালদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত হয়ে আসছে নানা পদ্ধতিতে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করে নি। এই সুবিধাবাদ এবং দুর্নীতি ও শাসনপরিচালনার ক্ষেত্রে নানা ব্যর্থতার জন্যে ক্ষমতায় ফিরে আসে খালেদা জিয়া ও জামাতের জোট সরকার। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামাতপন্থীরা এবারসরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ৯/১১ এর অভিঘাতে দেশে দেশে সাধারণ মুসলিমজনতার মধ্যে ওয়াহাবি-ইসলামের আদর্শকে সামনে রেখে এই সময়ে মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক এই প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির জন্যে অনুকূল হয়ে উঠল।
বাংলাদেশের একটি বিশেষ বাস্তবতা সম্পর্কে বাইরের পৃথিবী শুধু নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক নানা পক্ষও অনেক সময় সচেতন থাকে না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হতে পারে, দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু তার বাঙালিত্বের বিসয়টি নিয়ে তাঁরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আধুনিক সময়ের কথা যদি ছেড়েও দিই মধ্যযুগেও দেখব, যখনই শাসক বা সমাজপতিরা বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতিকে হেয় করে অন্য ভাষাকে ঔজ্জ্বল্য প্রদান করার চেষ্টা করেছেন, তখনই গর্জে উঠেছে মানুষ। লক্ষ্মণ সেনের সময় বাংলায় ধর্মসাহিত্য বা অন্যান্য সৃষ্টিকর্মকে উৎসাহিত না করে যখন সংস্কৃতকে তুলে ধরার চেষ্টা হয় বা মুসলিম সমাজপতিদের ফতোয়ায় যখন আরবি ফারসি ছাড়া অন্য ভাষায় সাহিত্য কর্ম করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়, তখন বাংলার সমাজমানস তা মেনে নেয় নি। সে জন্যেই বাংলায় মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে নানা মুসলিম ধর্মসাহিত্যের জন্ম হয় এক প্রতিবাদী চেতনা থেকেই। এই প্রতিবাদী চেতনা আধুনিক সময়েও জাগ্রত রয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে যখন পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়েছে, তখনই পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলায় কোন ভাষা প্রতিষ্ঠিত হবে এই নিয়ে পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যেই তীব্র বিতর্ক ছিল। বাংলার দাবি তখনই জোরদার হয়েছে। এই ভাষা চেতনাই পরবর্তীতে পাকিস্তানচেতনা থেকে মানুষকে সরিয়ে এনে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বে দীক্ষিত করেছে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার এই বাস্তবতাকে সম্মান দেয় নি। তাই সময় আসতেই তাকে পরাস্ত করে আবার হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে সাধারণ মানুষ। হাসিনার এই প্রত্যাবর্তন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করার মানুষের আবেগের দ্বারাই অনেকাংশে চালিত হয়েছে। ফলে এবারের সরকার আসতেই বাংলাদেশের জাগ্রত সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও বুদ্ধিজীবী সমাজের তরফ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুনর্প্রতিষ্ঠা ও একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। এই আন্দোলনের চাপেই গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল। শুরু হয় বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। এই গোটা প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে যুক্ত হয়ে আছেন বাংলাদেশের আজকের তরুণ সমাজ। গ্রুপ থিয়েটার, ছাত্র সংগঠন, লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েব ম্যাগাজিন ইত্যাদির মাধ্যমে দুই প্রজন্মের বাঙালির চেতনার মিলন ঘটেছে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়। ফলে আজকের শাহবাগের আন্দোলনকে অনেকে হঠাৎ বিস্ফোরণ ভাবলেও এটা আকস্মিক ঘটনা নয়। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড শুধুমাত্র একটি অগ্নিশলাকার কাজ করেছে। উনিশ শ পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবের হত্যার পর সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সুপরিকল্পিত ভাবে যে আদর্শের অপসারণ চেয়েছে নানা রাজনৈতিক অপশক্তি, আজ তার বিরুদ্ধেই সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু হয়েছে শাহবাগ চত্বরে।
এই সংগ্রাম যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণতা দেওয়ার সংগ্রাম, আবার সারা পৃথিবী জুড়ে মৌলবাদ ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তারও অবিচ্ছিন্ন অংশ। এই সংগ্রাম জয়ী হলে শক্তিশালী সারা পৃথিবীর শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তাই কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা হয় চুপচাপ নয়ত ছলে বলে কৌশলে এর প্রাণভোমরাকে মারতে চাইছে। সারা পৃথিবীতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শেষ লড়াই লড়তে যারা নাকি বদ্ধপরিকর সেই মার্কিন সরকার মুখে কুলুপ এঁটেছে। নানা কায়দায় মৃত্যুদণ্ডের যৌক্তিকতা ইত্যাদি প্রশ্ন সুশীলবুদ্ধিজীবীদের দিয়ে উত্থাপন করে এই গণ-অভ্যুত্থানকে ছোট করতে চাইছে। এই সংগ্রাম নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন মা-মাটি-মানুষওয়ালারাও। একটি শব্দ উচ্চারণ করে নি পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল ও সরকার। পেছনের দরজা দিয়ে প্রচেষ্টা চলছে টিপু সুলতান মসজিদের ইমামকে সামনে রেখে শাহবাগবিরোধী আন্দোলন তৈরি করার। ওদের পাখির চোখ পঞ্চায়েত নির্বাচনে। এদের মালিকানাধীন একটি চ্যানেল কিছুদিন আগেই শাহবাগ নিয়ে প্রচার করতে যাওয়া অনুষ্ঠানকে শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির বাংলা সফর ও শেকড়ের টান বিষয়ক অনুষ্ঠানে পরিবর্তন করেন। অংশগ্রহণকারীদের স্পষ্ট অনুরোধ করেন, শাহবাগের কোন উল্লেখ যেন না থাকে। একটা বিষয় স্পষ্ট শাহবাগের লড়াই ক্রমে এই বাংলাতেও প্রসারিত হচ্ছে। এখানেও একদিকে জমায়েত হচ্ছেন শাহবাগের তরুণদের সহপথিকরা, অন্যদিকে জোট বাঁধছে মৌলবাদীদের দোসররাও।
মতিনভাই বলেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ইজ কন্টিনিউয়িং’। সত্যিই, সত্যিই শুধু কন্টিনিউয়িং নয়, শাহবাগ তাকে ব্যাপ্ত করছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
মন্তব্য
হু, ‘মুক্তিযুদ্ধ ইজ কন্টিনিউয়িং’...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অটঃ আপনি কি গান করেন?
মুক্তিযুদ্ধ ইজ কন্টিনিউয়িং...
মুক্তিযুদ্ধ ইজ কন্টিনিউং!
ফাত্রামি নাকি? হয় বাংলা নয় ইংলিশ লিখেন।
নতুন মন্তব্য করুন