নীল সবুজ কম্বিনেশনের সালোয়ার কামিজে অপর্ণাকে খুব সুন্দর লাগছে। মিষ্টি করে সেজেছে অপর্ণা। হালকা মেকআপের সাথে কানের ম্যাচিং নীল পাথরের দুল দুটিতে বেশ জমকালোও লাগছে ওকে। অপর্ণা নীলচে আই লাইনার আর কাজলের আড়াল দিয়ে ওর চোখের বিষণ্নতা ঢাকবার খুব চেষ্টা করেছে। অথচ আমি দেখেছি লাল-গোলাপি রঙেও ওকে বিষণ্ন লাগে। আর নীল হলে তো কথাই নেই। কাল রাতে চ্যাট করার সময় আমাকে ওর চোখের এই সাজের বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলের ছবি পাঠিয়েছিল। যেসব আইশেড, আই লাইনার ও নতুন কিনেছে সেগুলোর নাকি বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করছিল।
আমি ওর চোখের ছবি দেখেই বুঝেছি, সাজবার আগে খুব কেঁদেছে ও। হয়তো কেঁদেছে বলেই সেজেছে। কাল অপর্ণা বলছিল, আর্য নাকি জানতে চেয়েছে ও এতো রূপচর্চা করে কেন। ছেলেকে কি উত্তর দিয়েছিল অপর্ণা আমাকে বলেনি। অপর্ণা নিজ থেকে কিছু না বললে আমি অহেতুক কৌতুহলী হয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করি না। যদিও আমি ওকে যত দেখি ততই অবাক হই। সেই সাথে আমার কৌতুহলও বাড়তে থাকে। আমি তাই রোজ ফেসবুকে বা চ্যাটিং এর সময় ওর কোনো নতুন বা অভিনব কার্যকলাপের জন্য অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করি। আমি ওর হঠাৎ চিঠির জন্যেও কাতর হয়ে প্রতীক্ষা করি।
দু’দিন আগে ওর চিঠি পেলাম। গাঢ় বিষণ্নতায় ডুবতে ডুবতে অপর্ণা নিজেকে কি করে ভাসিয়ে রাখে আমি ভেবে পাই না। ওদের মা ছেলের খুনসুটি আর স্বাধীনতা উপভোগের অভিনব পন্থা থাকে চিঠি জুড়ে। পড়তে পড়তে আমি হাসি আর ভাবি অপর্ণা আমার খরা দিনে শুভ্রমেঘের ছোঁয়া। ওর চিঠি পড়বার আগ্রহে আমি খামকে এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলি যে পরে আমার খুব হাসি পায় খামের দুর্দশা দেখে। আসলে আমি কি একটু মুক্তির স্বাদ পাই অপর্ণার সঙ্গতে? নাকি আমার দুঃখের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ও আমাকে হাত ধরে নিয়ে যায় আমার স্বপ্নের চুড়োয় যার লোভে আমি বারবার ওর কাছে ফিরে যাই? সম্পর্কের হিসেবনিকেশ করাটা মুর্খামি, তার চেয়ে বরং বিলিবন্টন ভাল। আমরা তাই করি। স্বেচ্ছাবন্দি আমার কাছে উড়োঘুড়ির মতো অপর্ণার চিঠি প্রাণের বার্তা নিয়ে আসে। আমি অপেক্ষায় থাকি।
অপর্ণাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে। ওর গালের গোলাপি ব্লাশনের ছোঁয়ায় মুখটাও বেশ মায়াবী মনে হচ্ছে। যদিও আগের চেয়ে আরও মুটিয়ে গেছে ও।
-তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে অপর্ণা। দেখে মনেই হচ্ছে না তুমি ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া ছেলের মা।
অপর্ণা গলায় কপট বিরক্তি এনে বলে,
-আর কইও না মিয়া। ওয়েটটাই মার্ডার কইরা দিলো। আর্যর কোচিং, স্কুল আর অফিসের ঝামেলা না থাকলে দুই বেলা ব্যায়াম কইরা দশ কেজি ওজন কমায় ফেলতাম। এখন মনে কর খাওয়ার আগে পরে সালাদ শসা যা খাই কোনো লাভ নাই। ঘরে ঢুকলেই পাগলের মতো ক্ষুধা লাগে। মনে হয় আমি আট মাসের প্রেগনেন্ট। ঘরে যা পাই তাই খাই। কিছু না পাইলে ফ্রিজ থেইকা একটু গুড় বাইর কইরা খাইয়া ফেলি। আর্য হাসলে বলি, এইটা আমাদের সময়ের চকলেট।
অপর্ণার কথা শুনে আমি হাসতে থাকি। অপর্ণাও হাসে। ও হাসলে ওর বাম গালে টোল পড়ে। তাতে অপর্ণা সৌন্দর্য আরও নিখুঁত হয়ে ওঠে। আমরা গুলশান দুই এর ক্যান্ডি ফ্লস দোকানে বসে আছি। অপর্ণা হুড়মুড় করে একগাদা খাবারের অর্ডার দিয়েছে, হাঁড়ি তেহারি, মিক্সড সালাদ, কফি, আইসক্রিমও। অপর্ণা কানের কাছের খোলা চুল গুঁজে দিতে দিতে বলে,
-চুলগুলা রাফ হইয়া যাইতেছে। এই শুক্রবার চুলে মেহেদি আর ডিমের সাদা অংশ দিতে হইবো। টক দই দিলেও ভাল কাজ হয়। যাই হোক বিল কিন্তু তুমিই দিবা সুরভি। আমার আবার হিসাবের টাকা। তাছাড়া নতুন জামা তো কিন্যা দিলাই না। আজকা না হয় খাওয়াইয়া পোষায় দাও।
অপর্ণার ছেলেমানুষি আবদারে আমার আনন্দ লাগে।
-শোনো আমি কিন্তু অনেকক্ষণ থাকমু। স্কুল থেইকা ফিরা আর্যরে তার নানীর কাছে থাকতে বলছি। আর অফিস থেইকা একবারে বাইর হয়া আসছি। ফিরার সময় বইমেলা যামু। আর বেশিদিন নাই বইমেলা। তিন দিন গেছি। আজকাই শেষবার যামু। তুমি যাইবা?
-না আমার কাজ আছে। অফিসে ফিরতে হবে। তুমি যাও।
স্কুল কলেজের কোনো বন্ধু-বান্ধবীর সাথে এখন আমার ঠিক তুই-তোকারির সম্পর্ক নেই। সম্পর্কের গভীরতার জন্য সম্বোধন আমার আর অপর্ণার মধ্যে কখনো বাঁধা হয়নি। তাই স্কুল বা কলেজ লাইফে লাবণী, কণা, শিমুকে তুই করে বললেও অপর্ণার সাথে আমার হৃদ্যতা তুমি সম্বোধনেই বেশি। অপর্ণার অফিস মগবাজার। কাল রাতে চ্যাট করার সময় বলেছিল আমার সাথে দেখা করবে। অনেকদিন দেখা নেই ওর সাথে। আমি লাঞ্চ আওয়ারের এক ঘন্টা আগেই বের হয়েছি। শফিক ভাইকে বলেছি, ফিরতে একটু দেরি হবে।
অপর্ণা বেশ অস্থির গলায় বলে,
-আমি পড়ছি আরেক ঝামেলায়। আমার নতুন কলিগ রাজীব হোসাইনরে আমার খুব থাবড়াইতে মন চায়। হারামজাদা এত জ্বালাইতাছে।
-কি করলো সে?
-আরে পাট নেয় আমার সাথে। ঢুলুঢুলু চোখে কয়, আপু চলেন কফি খেয়ে আসি। কাল রাতে মেসেজ পাঠাইছে, আপা আপনাকে কাজল দিলে সুন্দর লাগে। আজ সকালে মেসেজ পাঠাইছে, "if you not come to my house I will not work with u. " হারামজাদা তোর লগে কামের গুল্লি মারি।
অপর্ণার কথা শুনে আমি হাসি।
-তা দু’একদিন কফি খেতে গেলেই পারো। নাকি ছেলেটা তোমার প্রেমে পড়েছে?
-আরে নাক দিয়া সর্দি ঝরে এই পোলা আমার প্রেমে পড়বো? এইগুলা হইছে পাট। অফিসে মাইয়া কলিগ দেখলে জিহবা লকলক করে। খালি ধান্দায় থাকে কারে ফাও লাগান যায়। একদিন দেখবা আমার বদনাম তুইলা বিয়ার কার্ড লইয়া হাজির। আমিও চান্সে আছি, আর একদিন ঢুলুঢুলু ভাব দেখলে ফুফার সামনে চান্দি ফটাস কইরা দিমু। তবে উল্টাটাও হইতে পারে। এই ধর রাজীব যদি একবার ফুফার কাছে উল্টাপাল্টা লাগায় আমারে নিয়া কত নকশা শুরু হইবো জানো?
-আমি জানি তুমি এসব সামলাতে পারবে।
-আর কত সামলামু। জীবনের জটিলতাগুলো ঠিকই ঘুইরা ফিরা আমারেই বান্দে। তুমি মজা পাও ক্যান। আমি কিন্তু সত্যিই ঝামেলায় আছি। হারামজাদা রাজীবরে একটু ডলা দেওন লাগবো।
অপর্ণা রেগে উঠেছে। আমার কি বলা উচিত বুঝতে পারছি না।
-তুমি শান্ত হও। বিষয়টা টেক্টফুল্লি হ্যান্ডেল কর। চাকরি তো আর ছাড়তে পারবে না। সুযোগ থাকলে নতুন কোথাও এ্যাপ্লাই কর।
-তুমি বুঝতাছো না, একদিকে ফুফার ধারণা হইতেছে আমি আমার নতুন কোনো নাগরের জন্য ফিটফাট থাকি আর ডাটে অফিস করি আর এখন যদি রাজীব ইস্যু যুক্ত হয় আমি আর চাকরিই করতে পারমু না। তুমি তো জানো আমার জন্য এই চাকরিটা কত দরকার। তাই ঠিক করছি হারামজাদারে একটা বাঁশ দিমু। কেমনে দিমু এহনও বুঝতাছি না। তবে আমি দুই-তিন জায়গায় এপ্লাই করতাছি। জানি লাভ হইবো না। যেখানেই যামু একই সমস্যা হাজির হইবো। নতুন অফিসে যদি কই হাজবেন্ড আছে, তাও সমস্যা আর যদি কই হাজবেন্ড বিদেশে থাকে তাইলে আরও সমস্যা।
অপর্ণার গোলাপী মুখটা এখন রাগে থমথম করছে। ওর চারপাশে নিজের তৈরি একটা দেয়াল আছে। যেই দেয়ালের ওপারে কারো প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। সেখানে অযাচিত কারো উপস্থিতি বিড়ম্বনার সাথে বিরক্তি ঘটাবে সেটাই স্বাভাবিক। অপর্ণা কেমন ক্ষ্যাপার মতো বলে,
-আসলে আমি যখন খোপের মইধ্যে ঢুইকা থাকি তখন সবাই আমারে খোঁচায় খোঁচায় বিরক্ত করে, আমার জন্য ডিভোর্সি নয় বুড়া-হাবড়া পাত্র দেখে, কয় মাইয়াডার একলা চলা মুশকিল আর আমি যখন সাজগোজ করি, আর্যরে নিয়া হুলুস্থুল করি তহনো তারা খোঁচায় আর কয় ডিভোর্সি মাইয়্যার এত ফূর্তি কিয়ের!
আমাদের খাবার চলে এসেছে। আমি কথা না বলে খেতে শুরু করি। অপর্ণা বলে চলে,
-ঝামেলার শ্যাষ নাই। একলা মাইয়া পাইলে সবাই ছোক ছোক করে। কালকা অফিসে যাবার সময় রাস্তা পার হইতাছি এক ব্যাটা পিছন পিছন আসতাছে, কয় মেডাম আপনি একলা থাকেন? আমার নাম লুৎফর, আমিও একলা থাকি। ওই লুৎফর হারামজাদার পান চিবানি মুখটা দেইখ্যা ইচ্ছা করতেছিল ওর মুখটা ঠাইস্যা ধইরা দেয়ালে যাতা দেই। আমার অবস্থা কিসের মতো জানো? বাদামওয়ালা রাস্তার ধারে বাদাম নিয়া বইসা থাকে না? আর লোকজন পাশ দিয়া যাওনের সময় বাদাম না নিয়া মুফতে একটা দুইটা বাদাম মুখে পুরতে চায়। সেই রকম।
-তুমি এসব কি বলো! থামো তো, খাও।
-দুঃখে বলি সুরভি। আমার দুঃখের সাথে কি যে সখ্যতা!
আমি অপর্ণার দুঃখের গভীরতা মাপবার সাহস করি না। আমি চুপচাপ খেতে থাকি। আমি জানি একটু পরে অপর্ণা আবার স্বাভাবিক হবে আর ওর কথার ধিক্কারে ওর আশেপাশের সব কীট-পতঙ্গ পালাবে। তবু মনের মধ্যে কি একটা অস্বস্তি খচ খচ করে আমার। দিনভর কিছু একটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হারানোর দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো আর রাতভর সেই স্মৃতির সাথে এক্কাদোক্কা খেলে আমি ক্লান্ত বিপর্যস্ত। তাই নতুন করে অপর্ণার কষ্টের ভেতর আমি ডুব দিতে চাই না। আমি ওর উচ্ছলতা আমার গায়ে মেখে নিয়ে যেনো ওর আর নিজের কষ্টবোধ থেকে পালাতে চাই। অথচ আমার সব আকুলতার শব্দহীন ভাষা অপর্ণা ঠিকই বুঝে ফেলে। কখনো চ্যাটে, কখনো ভাইবারে, কখনো বা অপ্রত্যাশিত খামবন্দি চিঠিতে আমার বিচ্ছিন্ন যন্ত্রণাগুলো আরো বিচ্ছিন্ন আর হালকা করে দেয়। সেই অপর্ণার বিমর্ষতা এখন আমার অস্বস্তি বাড়ায়।
আমি ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। অপর্ণা নিজেকে সামলে নিয়েছে। ও হাসে। অপর্ণা ঠিক জানে আমি দু’দণ্ড মুক্তির সাধ পাই ওর মুখোমুখি বসে।
-আর্য কেমন আছে? আজ ওর কথা বললে না যে? ওর নতুন স্কুল কেমন লাগছে?
-আমার ছেলে তো ব্যাটা হইয়া গেছে। লম্বায় আমারে ছাড়ায় গেছে। আমারে কয়, মা আমার কেমন মাসল হইছে দেখছো? একেবারে ছোট মামার মতো। মাসল না কচু! জিরাফের মতো লম্বা হইতেছে আর গায়ে মুরগির মতো মাংস।
-ভালই তো ছেলে বড় হচ্ছে।
-হ, আমি বাইর হওয়ার সময় কয়, মা বইমেলায় যাবে, শাড়ি পড়ে যাও, শাড়ি পড়লে তোমাকে সুন্দর লাগে। আমি কইলাম, ব্যাটা ফুল নাই তো, হলুদ চন্দ্রমল্লিকা খোঁপায় গুঁজতে ইচ্ছা করে। নাইলে শাড়ি পিন্দা লাভ কি। আর্য বললো, মা আমি ফুল এনে দেই? ব্যাটায় তো বেঝে না, চুলে ফুল গুঁজলে মাইনষে আমার চুল ছিঁড়তে বাদ রাখবো। তবে খুব ইচ্ছা করে বসন্তের শাড়ি পিন্দা মাথায় চন্দ্রমল্লিকার মুকুট পড়ি। কিন্তু আমারে দেইখ্যা আমার ফুফা-ফুপু স্ট্রোক করতে পারে। তাগো ভালোর জন্য পিন্দি না।
খাওয়া শেষে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আমি অপর্ণার চোখমুখের কৌতুক উপভোগ করতে থাকি। অপর্ণা হাত ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট বের করে। নির্ঘাত ও আমার জন্য বই এনেছে। বইয়ের সুগন্ধি আমার মনটা ফুরফুরে করে দেয়। মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশো বছর ছাড়াও আরও চারটি বই। এর মধ্যে দুটো বইয়ের লেখকের নাম আমার অজানা। অপর্ণা নিজে অনেক বই পড়ে। ও আমার বই পড়ার অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনতে চাইছে।
-আমি তো ম্যালা প্যাঁচাল পাড়লাম। এইবার তোমার কথা বল সুরভি।
-কি বলবো? ভালই থাকি সব নিয়ে। হঠাৎ হঠাৎ কি যে হয় ভাল লাগে না। ভাল লাগে না বলতেও আর ভাল লাগে না।
-তবু কও। অনলাইনের কথা আর মুখোমুখি বসে কথা কওয়ার পার্থক্য তো আছেই। তখন তুমি হুট কইরা প্রসঙ্গ পাল্টাইতে পারো কিন্তু এখন পারবা না। তোমার চোখ দেখলেই আমি বাকি কথা বুইঝা যাবো। যত বলবা তত হালকা হবা। চেহারাটা যা বানায় রাখছো। ভ্রুটাও প্লাক করো না! পার্লারে যাও না!
অপর্ণার গলায় উষ্ণতা।
-তোমারে না বলছি, ফিটফাট থাকবা। কি সব বুড়া মাইনষের বাদামী রঙের তাঁতের শাড়ি পিন্দা আসছো। হাইফাই অফিসে চাকরি করো ফিনফিনে জর্জেট বা ওয়েট লেস সিল্কের শাড়ি পিনবা। তাইলে আর মোটা লাগবো না।
আমি হাসি।
-আমি তো মোটাই। দুটা সার্জারি হয়ে আরও পেট ঝুলে গেছে।
-আরে ওইসব কোনো ব্যাপার না। কত্ত পাহাড়ের মতো মানুষও দেখো গা কত ঢংসং কইরা কাপড় পিন্দে। আর পার্লারে যাও না ক্যান? একটু ফেসিয়াল-মেসিয়াল কর। পেডিকিওর-মেনিকিউর কর। কি সব হার্বাল ট্রিটমেন্ট বাইর হইছে না?
আমি অপর্ণাকে বলতে দেই। আমি ভাল করেই জানি, আমার ভেতর আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে ও। আমাকে হালকা করতে করতে ওর কথোপকথনের জালে জড়িয়ে ফেলে ঠিকই আমার ভেতরের সব কথা বের করে নিয়ে আসবে ও। এখন অপর্ণা চুপ করে গেছে। ও আমাকে সময় দিচ্ছে।
-কি জানি সব ভুলে যেয়েও কেন এমন অস্থির থাকি। রাতের সময়টুকু কাটানোই বেশি কঠিন আমার জন্য। রাত জেগে জেগে আবোলতাবোল ভাবি। হঠাৎ হঠাৎ কিছু একটা করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
আমি সরাসরি মৃত্যুর প্রসঙ্গটা তুলি না। হয়তো অপর্ণা রেগে উঠবে শুনে। তবু আমি ওর কাছে নিজেকে আর লুকোই না। আজ কি যেনো হয়েছে আমার। খুব বকবক করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মুনের মতো নিজেকে উজার করে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বলতে থাকি,
-খুব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে হাসানের সাথে ঝগড়া করি আজকাল। অফিস থেকে এসে সেই ইস্যু নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। হাসান বলছিল, তুমি ডিপ্রেশনে ভুগছো। চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তারের নাম শুনলেই রাগ হয়, ওষুধের নাম শুনলে বমি। তবু গেলাম সেদিন ডাক্তারের কাছে। কি ওষুধ দিলো, খেলে ঝিম ধরে তবু ঘুম আসে না। হাসানের সাথে শরীরের দূরত্ব আমাকে শারিরীক তাড়নার চেয়ে মানসিক কষ্টে রাখছে বেশি। আমি বোঝাতে পারবো না। এটা কি ডিপ্রেশন?
-আরে দুর। এইসব ডিপ্রেশন-টিপ্রেশন কিছু না। তোমারে ব্যস্ত থাকতে হইবো। এই সব মানসিক ডাক্তার দেখাইয়া, ওষুধ খাইয়া, কোনো লাভ হইছে? হয় নাই। লাভের লাভ একটা হইছে আশেপাশের মাইনষে জানছে, সুরভির মাথায় সমস্যা হইছে। তোমার শাশুড়ি নিশ্চয়ই কইছে, বাচ্চা নেওয়ের তো আর মুরোদ নাই, এখন যেইটা আছে সেইটারো যত্ন নেয় না আর মাইয়াডারে শেষ করবো।
আমি চমকে যাই। কি অদ্ভুতভাবে অপর্ণা আমার মনোজগতে ঢুকে যায়। কিন্তু সত্যি কি আমি আস্থাকে অবহেলা করছি? ক্রমশ আস্থার অস্তিত্ব কি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে? যেই ছেলেকে বুকে করে অপর্ণা ফিরে এসেছে, আমি কেন আস্থাকে নিয়ে পারছি না। আমি অপর্ণার দিকে তাকাই। ও রহস্যময়ভাবে হাসছে। আমি অপর্ণার চোখমুখের মেকি সাজগোজের আড়ালে ওর দুঃখের বক্ররেখাগুলো খুঁজতে চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য মায়াবলে ক্ষণে ক্ষণে অপর্ণা আমার দৃষ্টিতে বিভ্রম তৈরি করতে থাকে। অদ্ভুতভাবে পথ ভুলিয়ে ও ঠিকই আমাকে আমার পথের শুরুতেই দাঁড় করিয়ে দেয়।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
মন্তব্য
পড়লাম এক নিঃশ্বাসে। সুরভি অনেকদিন পরে এমন কোথাও গেল-না? চমৎকার, দারুণ-এই শব্দগুলো কতবার আর বলা যায় বলুন? তবে আমার শব্দভাণ্ডারে টানও পড়েছে বোধহয়-তাই আবারও বলছি চমৎকার লেখা।
দেবদ্যুতি
প্রিয় দেবদ্যুতি, সুরভির প্রাণের মাঝে প্রাণের দোলা অপর্ণা। দুজনকে মুখোমুখি দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব, লিখে ফেললাম। অশেষ কৃতজ্ঞতা। ভুলত্রুটিও ধরিয়ে দিবেন প্লিজ।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আপনার লেখা আমার ভাল লাগবেই। বারবার বলতে বা লিখতে কষ্ট হয়, চিরদিনের জন্য বলে দিলাম
আর ইয়ে, আমি একটা টাইপো পেয়েছি মনে হয়।
এখানে মুন না হয়ে মন হবে না?
এবার ইয়ার্কি বাদ দিয়ে একটা কথা বলি- আপনি উপন্যাস লিখুন, এ গল্পটা নিয়েই লিখে ফেলুন না।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
না না না। প্রতি লেখার জন্য আলাদা আবদার। ভুল, টাইপো, পরামর্শ চাইই চাই।
হুম আমি গল্পই শুরু করেছিলাম। আমার বন্ধু অপর্ণা মিতুর উৎসাহে একে একে নয়টি পর্ব লিখেছি তবে সচলে দিয়েছি বা দিবো মোট সাতটি পর্ব কারণ বাকি দুটি পর্ব সচলে অন্যগুলো পোস্টানোর পরে লিখেছি। ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে বলে পর্ব দুটি দেইনি। কি জানি এত ছোট কি উপন্যাস হয়? লিখলাম, লিখে কেমন যেন আরাম হলো। বুকের কষ্ট কমলো।
টাইপো না তো ইচ্ছে করেই মুন লেখা। মুনের কথা কয়েকটি পর্বে এসেছে। মুন সুরভির কলিগ। উচ্ছল, প্রাণবন্ত একটি মেয়ে। আসলে ধারাবাহিক লেখা অনেকদিন পর পর পড়লে মনে দাগ কাটে না সব কিছু। শুভকামনা গান্ধর্বী।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ও তাহলে পাঠকের অমনোযোগ ছিল, ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন
এত ছোট হবে কেন, আরো লিখুন সুরভির কথা, আস্থার কথা, অপর্ণার কথা। আমরা আছি তো, তাড়াহুড়োর কিছু নেই
অনেক ভাল থাকুন।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
দুরো! ক্ষমো আমায়।
আর না, ভেতরের স্রোতটা বন্ধ হয়ে গেছে এই লেখার জন্য। নতুন কিছু লিখি আবার।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
খুব ভালো হয়েছে
কৃতজ্ঞতা
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
এই পর্যন্ত যতটুকু পড়লাম সুরভীর মনোজগতের চিন্তা বেশি, ও ভাবে বেশি। এটা যদি শেষ পর্যন্ত উপন্যাসই হয় তাহলে সুরভীর ডায়ালগের ব্যাপারে একটু ভাবতে পারো। মানে ডায়ালগ কম কম লাগে। আর সুরভী এত গম্ভীর ক্যান ? কম হাসে, কম কথা কয় ক্যান ? এরপরের পর্বে সুরভীকে পার্লারে পাঠাইবা, কালারফুল ড্রেস পরাইবা। বুঝছ
ময়ূরের গল্পের কন্সেপ্টে একটা কথা বলি যদিও এটা এই পর্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। যখন দেশের বাইরে ছিলাম একটা ভাবী কাম বান্ধবী ছিল। বিয়ের আট বছর চলছিলো তাদের যে সময়ে আমার সাথে তার পরিচয়। তারা সে সময় নিঃসন্তান ছিলেন। অনেক চিকিৎসায়ও কাজ হয়নি। হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় ভাবী খবর দিলেন উনি মা হচ্ছেন। তার আনন্দটা নিঃসন্দেহে মনে হচ্ছিলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আমরা যারা ইতিমধ্যেই মা হয়েছি। এখন তার দুই বাচ্চা এবং বাচ্চাদের দুষ্টুমিতে তিনি অতিষ্ঠ থাকেন আর মার লাগান ধরে ধরে । যারা মা হয়েছেন তাদেরও মা হতে চাওয়ার ইচ্ছাটা আমার কাছে মনে হয় চিরন্তন। এই ফিলিংসটা মা মাত্রই বুঝবেন।
এইবার এই পর্বের বা এই লেখার প্রসঙ্গে বলি। যেদিন তুমি পুরো লেখাটা শেষ করে আমাকে একটা মেইল দিলে সেদিন আমি ঐ মুহূর্তে বাইরে ছিলাম। মোবাইল থেকে মেইল পড়ছিলাম। আমার হাসব্যান্ড জিজ্ঞেস করছিলো , কি ব্যাপার এমন ইমোশনাল হইলা কেন? তোমার গলার আওয়াজ কাঁপে কেন ? সাদিয়া তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এটা তো ভাল খবর। আমি ওকে বললাম , তুমি বুঝবা না। তার উত্তর ছিল - তোমাদের কবি সাহিত্যিকদের এই এক ব্যাপার কিছু হলে বলো আমরা বুঝব না ! ঐ দিনটা আমার জন্য অনেক আনন্দের ছিল। তাই শেয়ার করলাম ব্যাপারটা।
সামনের পর্বে শেষ করে দিলে পাঠকদের মনে হতে পারে গল্পটা একপেশে হয়ে গেছে। আরেকটু বাড়াতে পারো। সুরভীর স্বামীর অংশ আনতে পারো যেখানে সে ব্যক্তিও সমান বা কিছুটা হলেও অনুভূতিশীল।
এত লম্বা কমেন্ট দিলাম জানি না এ কমেন্ট প্রকাশ হবে কিনা!
অপর্ণা মিতু
তুমি তো অপর্ণার মতই বললা দেখি। দুরো সুরভি পার্লারে যায় না, এমনিই সুন্দর, হেহেহে।
তোমার বিশাল মন্তব্যের জন্য কি আবার ধইন্যা দিতে হইবো?
ভাইয়াকে সালাম দিও। ভাল থেকো তোমরা। সংসারী হইয়া লেখার দিকে মনোযোগ কম দিও না। যত মন দিয়া কমেন্টস করছো, ঠিক ততখানি মনোযোগ দিয়ে একখান লেখা লিখো তো দেখি। সচলে পোস্ট দাও।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
সে কি! সামনের সংখ্যাতেই শেষ হয়ে যাবে? যা আমি লিখতে চাই, লিখতে পারি না, তেমন লেখা এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হেহেহে, মজা পাইলাম ইমোতে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আগের পর্বগুলো পড়া ছিল না। পড়লাম একটানে। মুগ্ধতা জানানো ছাড়া আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
স্বয়ম
কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া কিচ্ছু বলার নেই।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
একটা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে পৌছে যাওয়া ,চারটি খানি কথা নয়। আপনি ও তেমন বোধহয়। দারুন এগু্চ্ছিল সামনেই সমাপ্তি।
-----------------
রাধাকান্ত
ধন্যবাদ রাধাকান্ত।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
গল্পটা পড়লেম।
তোমার লেখার সবচে' যেটা আমার ভালো লাগে সেটা হচ্ছে 'তারপর?' এর কৌতুহলটা জাগিয়ে রাখা। যা এই সিরিজটায় কাজ করিয়াছে ব্যাপকভাবে। খুব সাধারণভাবেই লিখো তুমি কিন্তু এত মায়াময় হয় কেম্নে বুঝিনা ঠিক! বড় হয়ে তুমি সত্যি বড় লেখক হইবা কয়া দিলাম আবারও!
প্রশংসা হলু এবার এট্টু অন্যরকম কিছু বলি:
অপর্ণা তার অফিস কলিগরে নিয়ে তার খারাপ লাগা বিষয়ে বলছিল রাইট? এখানে সুন্দর লাগার কী আছে হে!
বরং ভালোই তো, যেতে পারো তো ওর সাথে আউটিংয়ে/কফি খেতে ইত্যাদি বলতে পারতো সুরভি।
ওর 'আসলেই তো সুন্দর লাগে' বাক্যে কেন জানি অমনোযোগিতার একটা ছাপ ফুটে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।
অথচ সুরভি অপর্ণার কথা শুনতে ভীষণ পছন্দ করে তবে? এ লাইনটা তাই এট্টু কেমন জানি লেগেছে।
দন্ড ভানাম দণ্ড হয় বলে জানি। তুমার টাইপো তো খুঁজেও পাওয়া যায় না। আজ কি তবে পেলেম তাকে পেলেম?
চিঠি'র ি ঠিক মত পড়েনাই একখানে।
তোমার চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। বাহবা, ঠিক করে নিচ্ছি।
বিস্তারিত মনের কথা লিখতে পারলাম না, এখন কাজ ডাকছে। ভাল থেকো।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন