পশ্চিম আফ্রিকার গল্প-১

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: শনি, ১৯/১১/২০১১ - ৭:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আয়োলের গান
- মারি ফেলিসিতে এবোকেয়া

রাগে ফুঁসতে থাকা মহিলা জুতোর হিল দিয়ে যেভাবে মাটি দাবড়ায়, পৃথিবীটাকে ঠিক ওরকমভাবেই পেটাতে থাকা গনগনে সূর্যের নীচে মাথায় বোঝা চাপিয়ে আয়োলে অতিকষ্টে তার কুঁড়ের দিকে চলে যাওয়া পথটি ধরে এগোচ্ছিল। একবার মুহুর্তের জন্য থেমে সে নিঃশ্বাস নিল। একহাত দিয়ে মাথার উপরে থাকা কলসটিকে সামলিয়ে, অন্য হাতটি গোলাকার পেটের উপর রেখে দ্রুত একটা শুকনো বাতাস এক নিঃশ্বাসে বুকে টেনে নিল সে।

যখন থেকে মরুভূমি চারপাশটাকে গিলে নিতে নিতে এগোনো শুরু করেছিল, সে অনেক দিন আগের কথা, তখন থেকেই আয়ালের গ্রামে পানির অভাব। সেইসব মহিলারা, প্রকৃতিই যাদের এখানে ফেলে রেখে গেছে পুরুষেরা নয়, অন্য যেকোন কারো চেয়ে খুব ভাল করেই জানেন এই দূর্লভ বস্তুটির কী মূল্য। বাওবাব গাছের ছায়ায় বসা মুরুব্বিদের ভয়াবহ পঞ্চায়েত সভাটির পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে ঐ সময়ের পর থেকে মহিলারা গ্রামের বাইরে গিয়ে সন্তান প্রসব করবে এবং নবজাত শিশু পায়ে হাঁটা শুরু করার আগ পর্যন্ত তারা আর গ্রামে ফিরে আসবে না।

গলায় উঠে আসা বমির ভাবটাকে দমন করে আয়োলে চেষ্টা করল দুঃশ্চিন্তার ভারটাকে একটু হাল্কা করতে যা তার ভ্রুণশিশুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। আর মাত্র কদিন পরের অনিবার্য যাত্রাটির কথা মনে করেই কিনা কে জানে, উপযুক্ত সে ক্ষণটির জন্য অপেক্ষমাণ বাচ্চাটি নড়েচড়ে উঠল এবং ফুলে ফেঁপে উঠে শেষ সীমানায় চলে যাওয়া পেটের চামড়া যে সুরক্ষা-তাঁবু তৈরী করেছে সেটিকে উলটে পালটে দিল।

যার জন্য আয়োলের হৃদয় সব-সময় নেচে উঠত সেই মানিলে অনেক দিন আগে শহরে পালিয়ে গিয়েছিল পাগুলো তাকে যতটুকু দ্রুতবেগে চলার শক্তি দিয়েছিল তার সবটুকু দিয়েই। আয়োলে তার পিছু পিছু যেতে চায়নি। মানিলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিল, “ হরিণী আমার, যথেষ্ঠ শক্তি কী নেই তোমার!”

নীচু ছাদের একটা কুঁড়ের সামনে এসে আয়োলে মাথা থেকে তার সারা দিনের রসদ পানির কলসটি নামাল। মৃদু গোঙানির শব্দ পেয়ে ছোট ভাই আয়োলেলা দ্রুত তার কাছে ছুটে এল।

“ আজ সকালে আমার বোনটি কেমন আছে? তোমার গুনগুনানি আমাকে তোমার ঘরে ফেরার বার্তা জানিয়েছে আর তোমার জন্য আমি এটা নিয়ে এসেছি।” ভাঁজ করা আর আঠা দিয়ে দুইপ্রান্ত জুড়ে দেয়া একটা কাগজের টুকরো সে আয়োলেকে দিল। চিঠি! একটা অদম্য শিহরণ বুকটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল তার।

“ ভয়ের কিছু নেই, আমার মনে হয়, এটা মানিলের কাছ থেকে এসেছে।”

ভারী শরীরটাকে নরম মাদুরের উপর রেখে আয়োলে স্কার্টের কোনা দিয়ে আনমনে কপাল মুছল। তারপর ভাঁজ করা কাগজটা ছুঁয়ে দেখল, দুইদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিল এবং শেষে তার ভাইকে আবার সেটি ফিরিয়ে দিল।

“ নাও, খোল এটা আর যদি খারাপ কিছু থাকে তবে আমাকে বোলনা।”

এবার আয়োলেলার পালা এল চিঠিটা ভাল করে পরখ করার। “এটা অনেক দূর থেকে এসেছে।” ঘোষণা করল সে। কাগজটা বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ও, তারপর একটু মুচড়ে নিয়ে কয়েকটা জায়গাকে চিহ্নিত করল। “ শোন তবে...

হরিণী আমার,
আশা করছি যে তোমার শরীরের ভার খুব বেশী হয়ে পড়েনি। মুরুব্বিদের আইনে শুধুমাত্র বুড়ো সিংহগুলোই টিকে থাকবে, একবার তারা সব অল্পবয়সী বুনো পশুগুলোর অপরিপক্ক দাঁতগুলো উপড়ে ফেলতে পারলেই হল। প্রিয় আয়োলে, তোমার বাহুযুগল, যারা জানে কীকরে একজন পুরুষের স্বপ্নকে ধারন করতে হয়, সাকার করতে হয়; তাদের কাছ থেকে হঠাৎ করেই দূরে সরে আসার জন্য আমাকে তুমি ক্ষমা করো। সুন্দরী আমার, প্রিয়তমা, ওরা যেভাবে শহরটাকে এঁকেছে ছবিতে আদতে এর ক্যানভাস অমনটি নয়। মাতিকিন তোমার মতন একজন তরুনীকেই চায়। এখানে আমরা সৌভাগ্য রচনা করব। আমি বৃদ্ধ রাজা সাপিতিয়ের সাথে কথা বলেছি। তিনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এবং আমাদের অনাগত সন্তানকে নিজের সন্তানরূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করার পূর্বে ভেবে দেখ, আমাদের আর বাচ্চাটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কোরো। তবে বেশী সময় নিওনা। মহামহিম এখন মৃত্যুশয্যায়। তাঁর মৃত্যুর পর, অরাজকতাই রাজত্ব করবে এবং আমার জেলে যাওয়া বা আরো খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনাও আছে। প্রতিবার চাঁদ যখন পাহাড়ের উপর ওঠে আমি তোমার কথা ভাবি। কল্পনায় দেখি তোমার সোহাগ কিভাবে আমার রাতগুলোকে আনন্দদায়ক করে তুলছে, তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর থেকে জিভের তলায় যে তিক্তটা টের পেয়েছি সেটার প্রশমনকারী মধুর চেয়ে ঢের বেশী আনন্দদায়ক তোমার ঐ ভালবাসার ছোঁয়া।
তোমার মানিলে, তোমার সন্তানের পিতা।

আয়োলেলা কাগজটি ভাঁজ করে তার বোনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

“ সে ভাল করেই জানে যে আমি যাব না। এখানেই আমার পূর্বপুরুষেরা বাস করেছেন, এটিই আমার গল্পের এবং আমার অনাগত সন্তানের জায়গা।”

আয়োলে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসল। তার চোখ গিয়ে পড়ল ভাইয়ের চোখের উপর।
“ তাছাড়া, সময় হয়েছে নদীর পাড়ের রাস্তা ধরবার।” একটা স্বপ্নালু অভিব্যাক্তি মুখে রেখে পেটের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল সে।

কয়েক দিন পর, আয়োলে আর তার ভাই বিশাল বনটিতে একটিতে জায়গা বেছে নিল তাদের অস্থায়ী ঘর তৈরীর জন্য। ছোট্ট একটা জলাশয়ের কিনারে একটা জায়গা তাদের মনে ধরল যেখানে কিছু বৃক্ষ মিলে একটা গম্বুজের আকার ধারন করেছে। আয়োলের শ্বাস-প্রশ্বাস এখন দ্রুততর হয়েছে, তাই প্রসব হওয়ার আগে তারা দুজন কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তরুনী আয়োলে সারাদিন গান গাইত আর রাতে ছোট ভাইটিকে শোনাত দারুণ সব গল্প। সে বেশ ওয়াকিবহাল যে আয়োলেলা এখনও ছোট একটা ছেলে যে বোনের প্রতি নিবেদিত-প্রাণা এবং বোনের পাশে থাকতে রাজী থেকে নিজের সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছে।

বড় বড় গাছগুলোর পেছনে চাঁদের আলোর অনুপস্থিতি বনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিকে আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। শেষ রাতের দিকে আয়োলে দুটি শিশুর জন্ম দিল। পুঁচকে মেয়েটা, যার নাম মিনা্লে, সারা রাতভর চেঁচাল। একরত্তির ছেলেটা, হোহোলা যার নাম, মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল আর মিটিমিটি হেসে যেন চিরন্তন ভালবাসার ঘোষনা করে যাচ্ছিল। দুজনের প্রত্যেকেই মায়ের একটি করে স্তনে আঁকড়ে পড়ে থাকল আর লোভীর মতই দুধ খেয়ে যাচ্ছিল। তাদের মা পরিষ্কার পানিভর্তি একটা কলসের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আয়োলেলা মাছ ধরতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল।

দিনগুলো কেবল যায় আর আসে, চাঁদটাও কেবল উঠে আর ডুবে যায়; আর শিশু দুটি একটু একটু করে বড় হতে লাগল। তাদের কাছে জঙ্গলটি বিশাল এক খেলার মাঠ। যখন তাদের মা ব্যস্ত থাকত, মামা তাদের তুলে নিয়ে দীর্ঘ হাঁটার পথে নিয়ে যেত। তারা চিনতে শিখতে লাগল অপেক্ষাকৃত কম হিংস্র পশুগুলোকে। সন্ধ্যাগুলোয় আয়োলে গাইত তার গান আর বাচ্চাদের জন্য বুনত গল্পের জাল।

এক ভাগ্যবিড়ম্বিত দিনে, ছোট্ট মিনালে সাহস করে নদীতে নামতে গেল। একরত্তির ছেলেটা তখন হাত আর পায়ের উপর দিয়ে ভর দিয়ে মায়ের চারপাশে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। হঠাৎ মিনালে চিৎকার করে উঠল আর আয়োলের হাত থেকে সাথে সাথেই যে খাবারটা সে কলাপাতায় মুড়ে রাখতে যাচ্ছিল সেটি মাটিতে পড়ে গেল। আয়োলা যখন কাদাময় নদীটির দিকে ছুট লাগাল; ভীত, সন্ত্রস্ত্র হোহোলা তার মায়ের পা আঁকড়ে ধরে থাকতে চেষ্টা করল। যখন আয়োলা সেখানে গিয়ে পৌঁছাল, তখন কেবল অসহায়ের মত তাকিয়ে সে দেখল, ঘোড়ার পিঠে সওয়ার তিনজন লোক তার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, সাথে নিয়ে যাচ্ছে চিরজীবনের মত তার কান্না আর আর্তনাদকেও।

বিশ বছর পরের কথা। ছোট্ট মিনালে মাতিকিনের রাণী হয়ে গেছে ততদিনে আর সবকিছুর উপর তার জন্মেছে তীব্র বিতৃষ্ণা। তার স্বামী, বৃদ্ধ রাজার মৃত্যুতে কয়েক মাস ব্যাপী চলা ভাতৃঘাতী যুদ্ধের পর শান্তি ফিরে এসেছে আবার। মিনালে একটা সু্রের শিষ কাটল যেটা সবসময় তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আর দুঃখের মুহুর্তগুলোতে যেটি প্রায়ই তার জিভ ছুঁইয়ে যায়।

এখনও পর্যন্ত কেউই এই সুরের উপর কথা বসাতে পারেনি। প্রতিবছর মিনালে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করত যা দলে দলে আকৃষ্ট করত গল্পবলিয়েদের। কিন্তু আজ অবধি কেউ খুঁজে পেলনা সেই কথামালা যা রাণীকে খুশি করতে পা্রে। মিনালে তার বিশাল বৈঠকখানার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পায়চারি করতে লাগল। কেন সে তার বংশপরিচয় সম্পর্কে বেশী কিছু জানল না? সে জানে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার এই জানার তৃষ্ণা মিটছে, নিজের ভেতরে সে শান্তি খুঁজে পাবেনা। সে নিশ্চিত যে এই রহস্যের চাবিকাঠি পাওয়া যাবে সেই গানেই যার জন্য উপযুক্ত কথামালা এখনো অবধি কেউ তার কাছে নিয়ে আসতে পারেনি। রাজা সাপিতিয়ের মৃত্যুর পর থেকে, সে কিছু তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে যা রাজা তার কাছে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু সে চায় আরো বেশী করে জানতে।

দরজার উপর ছোট্ট একটা টোকা পড়ল যা কাছের বাগানগুলোতে এতক্ষণ ধরে বিরাজ করতে থাকা সুরের ছন্দপতন ঘটাল।

ভাঙা গলায় মিনালে গর্জে উঠল, “ কার এমন সাহস এ অসময়ে দরজার কড়া নাড়ে?”

“ আমি আপনার বিদূষক, রাণীমা। ”

“ ব্যাপার কী মানিলে?”

“ এখানে একজন বন্দী আছে যে তার কলা প্রদর্শণের পূর্বে আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি চায়। একজন গায়ক যে কিনা...”

“ ঠিক আছে, ওকে আসতে দিন।”

“ যথা আজ্ঞা মহারাণী ”

সাদা কাপড় পরিহিত ধূসর চুলের মানিলে দরজা দুটি খুলে দিয়ে শীর্ণ কাপড়ে ঢাকা তরুনটিকে ঢুকতে দেবার জন্য একটু সরে দাঁড়াল। এ আর কেউ নয়, হোহোলা, খালি পা তার, হাড়জিরজিরে গলায় ঝুলছে অদ্ভুত একটা বাদ্যযন্ত্র। মানিলে বিস্ফারিত নেত্রে ঘরে প্রবেশ করতে থাকা এই ভবঘুরের দিকে তাকিয়ে থাকল, তার নিজের ভয়ার্ত চেহারারই অবিকল প্রতিচ্ছায়া, শুধু বয়সে সে অনেক নবীণ। আপন নিয়তি সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে আলতো করে সে দরজাটা বন্ধ করল। গতায়ু রাজা সাপিতিয়ের রাজকাজ্যে আসার পর সে রাজার আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। আয়োলেলার কাছ থেকে তাদের অস্থায়ী ঘরের অবস্থানটি জানার পর সে নিজেই তার পরিবারের অপহরণের পরিকল্পনাটি তৈরী করেছিল। ঐ তিনজন লোককে সে বিদায় জানিয়েছিল এটা বিশ্বাস করে যে ওরা তাদের সঙ্গে করে আয়োলে, তার ভাই আর শিশু দুটিকে নিয়ে আসবে। উত্তেজনা তার চরমে পৌঁছেছিল যখন সে কল্পনায় দেখল আয়োলের গায়ের সুবাস আবার নিতে পারছে। তারপর, রাজপ্রাসাদের বারান্দায় হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া এক রাজকুমারের কাছ থেকে সে রাজার আসল অভিসন্ধির কথা জানতে পারে- শুধুমাত্র ছোট্ট মিনালের ব্যাপারেই সাপিতিয়ে যত আগ্রহ। ঘোড়সওয়ারদের উপর দায়িত্ব ন্যাস্তই ছিল শুধু মেয়েটিকে এনে দেওয়া। তারা মানুষজন নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারত।

সেদিনের পর থেকে, মানিলে কখনোই তার অপরাধবোধকে শান্ত করতে পারেনি। এটা স্বীকার করতেই হয় যে, রাজা তাকে সারাজীবনের জন্য উপদেষ্টা এবং বিদূষক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন ভবিষ্যৎ রাণীর সেবাযত্নের জন্যই এবং আয়োলের মৃত্যুর পর যখন আয়োলা এসেছিল, রাণীর প্রধান পাচক হিসেবে তৎক্ষণাৎ তার চাকরী হয়ে গিয়েছিল। একদিকে যেমন সে শোকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তার একটা ধারণা জন্মেছিল যে আয়োলের কাছে জমে থাকা ঋণ সে অংশত পরিশোধ করতে পেরেছে। আজ সে প্রথমবারের মত নিজের সন্তানকে দেখল এবং তার মনে হল যেন সে তার স্মৃতির সাথে, তার কাহিনীর সাথে, তার অতীতের সাথে এমনকি তার উচ্চাভিলাষের সাথে সমঝোতা করতে চলেছে। এতগুলো বছরের পর, রাণীমা অবশেষে জানতে চলেছেন সেই তাঁর প্রকৃত পিতা।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ অথচ গর্বোন্নত আয়োলে নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করল। মানিলে সুচতুরভাবে তাকে ঘরের কোনায় তার কাছে আসার জন্য ইশারা করল যেখানে তাকে দেখা যাচ্ছিল না।

“ সময় হয়েছে রাণীমা’র কাছে সত্যটা উন্মোচন করে দেওয়ার।” আয়োলের কানে চুপে চুপে বলল মানিলে। সবগুলো ঘটনা একটাই পরিনতির দিকে এগুচ্ছে। ভাইবোনের অবশ্যম্ভাবী মিলন এখন আর কেউই ঠেকাতে পারবেনা। “ যা করার তা আমাদের খুব দ্রুত করতে হবে, রাজপুত্ররা এরিমধ্যেই ফোঁসফাঁস করা শুরু করেছে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া গুজবের কারণে।”

“ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটা আমি তোমার উপর ছেড়ে দিচ্ছি মানিলে। আমার চেয়ে ক্ষমতার ব্যাপারটা তুমিই অনেক ভাল বোঝ, কিন্তু রাণীমাকে জানাতে ভুলোনা যে তাঁর মামা হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি। শুধু ওদের মা’র মৃত্যুই আমাকে তোমাকে খুঁজে বের করতে ঠেলে দিয়েছিল আর আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁকে।”

কিছুক্ষণ পর, মানিলের সাথে কয়েকজন ক্রুদ্ধ ব্যক্তির দেখা হল যারা তক্ষুণিই রাণীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছিল। এইসব অল্পবয়সী রাজকুমারেরা, খুব বেশী অল্পবয়সীও আর নয় তারা, এইমাত্র দেখল যে রাণী, তাদের রাণীমা তাঁর নিজের কক্ষে একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত লোককে ঢুকতে দিয়েছে। কিছু বলার জন্য মানিলে তার মুখ খুলল কিন্তু তারা কোনকিছুই শুনতে চাচ্ছিল না। রাজপুত্রদের থামানোর জন্য মানিলে সিদ্ধান্ত নিল তার গল্পটা ওদের সে বলবে। সে তাদের বলল যে রাণী আসলে তারই মেয়ে। যমজ সন্তান দুটির প্রথম জন্মদিনের আগেই একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত পুনরায় একত্রিত হওয়ার কাহিনী সে ওদের কাছে উন্মোচণ করে দিল। সে তাদের কথা দিল যে রাণী অবশেষে শান্ত হবেন আর তাদের মধ্য থেকেই যেকোন একজনকে স্বামী হিসেবে বেছে নেবেন। সে ভবিষ্যৎবাণী করল যে মাতিকিন এক নতুন শক্তি অধিকারী হবে।

মানিলের গল্প শেষ হওয়া মাত্রই, প্রাসাদের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ গান ভেসে এল। তাদের রাণীমা’র কণ্ঠ, সুরেলা এবং পরিষ্কার, তার সঙ্গে আর একটা বিষন্ন, চেরা কণ্ঠ, বন্ধ দরজার ওপাশের নীরবতা ভেঙ্গে দিল। সূর্যের আলোয় যেমন করে বৃষ্টির ফোঁটারা নাচে, ঠিক তেমনি স্বর্গীয় এ সঙ্গীত লোকজনকে প্রাসাদের দিকে আকৃষ্ট করে নিয়ে গেল। ইত্যবসরে, বহুদূরের গ্রামে যেখানে আয়োলে মাটির নীচে ঘুমিয়ে আছে সেখানে বৃষ্টির তীব্র একটা ধারা মুরুব্বিদের তাদের বাওবাব গাছের তলা থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। যখন কানে তালা লাগিয়ে দেওয়া বজ্রধ্বনি সমস্ত গ্রামটাকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল, তারা মনে মনে বলল, “ ঈশ্বর, আমাদের মার্জনা করুন। আমাদের সভা বসাতে হবে। মহিলাদের সন্তান জন্ম দান করার নিমিত্তে আর কোনদিন গ্রামের বাইরে পাঠানো হবেনা।”

আয়োলের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিল।

[ গল্পকার মারি ফেলিসিতে এবোকেয়া ক্যামেরুনের লেখিকা। ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি এখন বসবাস করছেন বেলজিয়ামে। আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত মূল গল্পটি ফরাসীতে লিখিত।
http://motspluriels.arts.uwa.edu.au/MP1600mfe.html ]


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

আফ্রিকার গল্প ভালই লাগলো। তবে অনুবাদটা আরও স্বচ্ছন্দ হতে পারত। অনেক হোচট খেতে হয়েছে। আরও লিখলে হয়ত ভাবানুবাদ ঝরঝরে হয়ে আসবে। সুতরাং না থেমে লিখে যান। নতুন নতুন গল্পানুবাদ চাই।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

রু (অতিথি) এর ছবি

গল্পটা ভালো লেগেছে। তবে জায়গায় জায়গায় বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল, কয়েকবার পড়ে বুঝতে হয়েছে।

হিমু এর ছবি

গল্পটার পেইস একেক অংশে একেক রকম। পশ্চিম আফ্রিকার আরো কিছু গল্প পড়েছিলাম, নাইজেরিয়ান কয়েকজন লেখকের, সেগুলোতেও এই জিনিসটা খেয়াল করেছি। এই গল্পগুলোর কথনভঙ্গি দেখে মনে হয়, এগুলো ঠিক লেখার গল্প নয়, বলার গল্প। বুড়ি দাদী বারান্দায় বসে নাতিকে শোনাচ্ছে, এমন একটা ব্যাপার আছে নেরেইশনে।

বিবিসির একটা ডকুমেন্টারি সিরিজ আছে, হিউম্যান প্ল্যানেট। ওটার একটা পর্ব আছে, ডেজার্টস। সেটা শুরুই হয় এক গর্ভবতী মহিলাকে দিয়ে। একটা বাচ্চা নয় মাস ধরে মায়ের পেটে জলীয় আধারে থাকার পর বেরিয়ে আসে পৃথিবীর সবচেয়ে জলবৈরী পরিবেশে। বিবিসির ডকুমেন্টারিকে আমি বেশ উঁচুতে জায়গা দিই, ঐ প্রোগ্রামটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একদম টানটান। এই গল্পটার শুরুটা পড়ে সেটার কথা মনে পড়ে গেলো।

চলুক, আপনার কল্যাণে পশ্চিম আফ্রিকার আরো গল্প পড়ার আশা রাখি।

তারেক অণু এর ছবি

মহিলাদের সন্তান জন্ম দান করার নিমিত্তে আর কোনদিন গ্রামের বাইরে পাঠানো হবেনা।”--- চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বাহ, ক্যামেরুনের কোন গল্প এই প্রথম বাংলায় অনুদিত দেখলাম। চলুক

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তাপস শর্মা এর ছবি

চমৎকার। আরও পড়তে চাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।