পশ্চিম আফ্রিকার রূপকথা-১

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/১১/২০১১ - ৩:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাউলে কাহিনী
-বের্নার বাঁলাঁ দাদিয়ে

অনেক অনেক বছর আগে শান্ত একটা লেগুনের কিনারে বাস করত আমাদের ভাইদের শান্তিপ্রিয় একটা গোত্র। তাদের যুবা পুরুষেরা সংখ্যায় ছিল অনেক, ছিল তারা মহৎ আর সাহসী। তাদের নারীরা ছিল রূপবতী আর সুহাসিনী। আর রূপশ্রেষ্ঠাদের মাঝে সুন্দরীতম ছিল তাদের রাণী, মহারাণী পোকু।

অনেকদিন ধরেই তারা শান্তিতে বসবাস করে আসছিল, এমনকি তাদের দাসেরাও, যারা মূলতঃ যুদ্ধবন্দীদের সন্তা্‌ন, তাদের সদাশয় প্রভুদের সাথে সুখে ছিল।

একদিন সাঁড়াশি পিঁপড়ে মাঞার মত দলে দলে শত্রুরা এল। তাই খড়ের কুঁড়েঘর, ফসলের ক্ষেত, মাছভরা লেগুন, জাল সবকিছু ছেড়েছুড়ে তাদের পালাতে হল।

পালিয়ে তারা জঙ্গলে এসে ঢুকল। কাঁটায় ছিড়ে গেল তাদের পরিধেয় পাইন, ক্ষত-বিক্ষত হল শরীর। তারপরও তাদের দৌড়ের উপর থাকতে হল, নেই কোন বিশ্রাম, নেই কোন থামাথামি, পেছনে ধেয়ে আসছে ভয়ংকর শত্রুর দল।

আর পিঠে শিশুপুত্রকে নিয়ে সবার শেষে চলছিল রাণীমা পোকু।

চলার পথে তাদের হায়েনা অট্টহাসি দিচ্ছিল, হাতি আর দাঁতাল শূকর ছুটে বেড়াচ্ছিল, শিম্পাঞ্জি হুঁৎহুঁৎ করে বন কাঁপিয়ে ফেলছিল আর হতবাক হয়ে পড়া পশুরাজ রাস্তা ছেড়ে দূরে সরে পড়ছিল।

অবশেষে ঘন জঙ্গল কমে আসতে লাগল, লম্বা ঘাসের মাঠ আর রোনিয়ের গাছ নজরে এল, আরও একবার পলায়নরত দলটি গেয়ে উঠল নির্বাসনের গান-

“ মি হুঁ আনো, মি হুঁ আনো, ব্লা ও
এবোলো নিগুয়ে, মো বা গ্নাঁ মাঁ।
( ও আমার মরদ আনো, ও আমার আনো, এসো
ঝোপের পরী আমায় তুলে নিল।)

বিধ্বস্থ, ক্লান্ত, শীর্ণকায় লোকগুলো এক সন্ধ্যায় এসে থামল বিশাল এক নদীর তীরে যার ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছিল পাথরের গায়ে।

নদীও গর্জে গর্জে উঠছিল, ঢেউগুলি তার ফুলে উঠে গাছের মাথা ছুঁইয়ে আবার পড়ে যাচ্ছিল, আর আতংকে জমে যাচ্ছিল পলায়নকারী মানুষগুলো।

শংকিত মুখগুলো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। এইতো কদিন আগেও এই পানিই তাদের জীবন বাঁচিয়ে রাখত, পানিই ছিল তাদের পরম বন্ধু। নিশ্চয় কোন অপদেবতা তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে।

ওদিকে ধাবমান শত্রুর দল আরো নিকটে এসে পড়ছিল।

আর তখনই প্রথমবারের মত মুখ খুলল গুনিন-
“ তেতে আছে পানি আর আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যা আছে তা তাকে না দেওয়া পর্যন্ত শান্ত হবেনা সে। ”

তখন তারা গেয়ে উঠল আশার গান-

“ এবে নাঁ ফ্লে নাঁ বা
এবে নাঁ ফ্লে নাঁ নঁ
এবে নাঁ ফ্লে নাঁ দ্‌জা
ইয়াপঁসে নি দ্‌জা ওয়ালি।
( কেউ তার ছেলেকে ডাক দাও
কেউ তার মাকে ডাকো
কেউ তার বাবাকে ডাকো
সুন্দরীরা এবার বিয়েতে বসবে।)

আর প্রত্যেকে তাদের নিজেদের স্বর্ন আর গজমোতির বালা আর যাবতীয় যা কিছু তারা রক্ষা করতে পেরেছিল সব দিল।

কিন্তু গুনিন এসব কিছু পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আঙ্গুল তুলে ধরল ছমাসের ছোট্ট রাজকুমারের দিকে, “ ঐ যে, আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান গহনা।”

ভয়ার্ত মা তখন বুকের সাথে চেপে ধরল তার শিশুটিকে। কিন্তু মা হলেও তিনি সবার রাণীমা, তৎক্ষনাৎ খাদের কিনারে গিয়ে শিশুটিকে তিনি মাথার উপর তুললেন আর ফুঁসে ওঠা পানিতে ছুঁড়ে মারলেন।

সাথে সাথেই বিশালকায় জলহস্তীরা পানি থেকে মাথা তুলল, তারপর একটার পিছে আরেকটা দাঁড়িয়ে বানিয়ে দিল একটা সেতু আর সেই দৈবী সেতুর ওপর দিয়ে নদী পার হতে হতে লোকগুলো গেয়ে উঠল-

“ এবে নাঁ ফ্লে নাঁ বা
এবে নাঁ ফ্লে নাঁ নঁ
এবে নাঁ ফ্লে নাঁ দ্‌জা
ইয়াপঁসে নি দ্‌জা ওয়ালি।
( কেউ তার ছেলেকে ডাক দাও
কেউ তার মাকে ডাকো
কেউ তার বাবাকে ডাকো
সুন্দরীরা এবার বিয়েতে বসবে।)

আর সবার শেষে সেতু পার হয়ে রাণীমা ওপারে উঠে দেখলেন তাঁর লোকেরা সবাই তাঁর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু রাণী হলেও তিনি তো মা, শুধু একটি শব্দই তার মুখ ফুটে বেরুল- “ বাউলি” যার মানে হল “ শিশুটি আর বেঁচে নেই।”

ইনিই হলেন রাণী্মা পোকু। সেদিন থেকেই লোকগুলো নিজেদের ডাকত “ বাউলে ” বলে।

* বাউলে- কোত দিভোয়ার ছেষট্টিটি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ দলটি হল বাউলে।

[ বের্নার বাঁলাঁ দাদিয়ে(Bernard Binlin Dadie) কোত দিভোয়ার সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বকারী লেখক। তিনি নিজেও একজন বাউলে।]


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

চলুক চালিয়ে যান। আফ্রিকার রূপকথা দারুন লাগছে।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

তারেক অণু এর ছবি
দ্যা রিডার এর ছবি

শুন্দর... আরও চাই ...

তাপস শর্মা এর ছবি

খুবই ভালো লাগছে। আফ্রিকার রূপকথা চলতে থাকুক। আগের কবিতা গুলিও ভালো লেগেছে, গল্প গুলিতেও একটা আলাদা স্বাদ পাচ্ছি। আমাদের চিরাচরিত গল্প থেকে প্রকাশ ভঙ্গি আলাদা হওয়াতে পড়ে বেশ লাগছে। একটা অন্যরকম পাওয়া

তানিম এহসান এর ছবি

পশ্চিম আফ্রিকার সাহিত্যসম্ভার এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এক এক করে, আপনাকে ধন্যবাদ। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অন্তরা মিতু এর ছবি

-
গল্পটি দারুন লাগলো.....

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর "দেবতার গ্রাস" ........

শুভেচ্ছা অনুবাদকের জন্য

হাসি
-

সিরাজুল লিটন এর ছবি

ভাল লেগেছে। চলুক

মামুন এর ছবি

সুমাদ্রিদা, খুব ভাল লাগলো পড়ে। পরবর্তী পোষ্ট এর অপেক্ষায় থাকলাম।

Zia এর ছবি

রবিন্দ্রানাথ এর দেবতার গ্রাস। আক্দম আক। আজ মনে পরচে দচ্তর মহাম্মাদ শাহিদুল্লার কথা। কন আক অতিতে শবাই আক শাথে থাক্তাম হয়্ত। হাও মাও খাও এর শাথে আই ইস্মেল থা ব্লাদ অব আ ব্রিতিশ মান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।