পিয়ানো শিখতে গিয়ে ছেলেটি স্যারকে প্রথম যে প্রশ্নটা করে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিতে চেয়েছিল সেটি ছিল, “ গুরুজি, চোপিনের কী কী সোনাটা আপনি বাজাতে পারেন?” গুরুজি বুঝলেন এ শিষ্য বড়ই ত্যাঁদর, বাহাদুরি ফলানোই ইহার কাজ, ভাবলেন সর্বসম্মুখে ইহার টিউন করিয়া লইবেন।তাই বললেন, “ ওহে মর্কট, চোপিন নামে এই ধরাধামে কেহই সোনাটা শোনাতে আসে নাই, পিয়ানো শিখিবার আগে তোমার ফরাসীটা শিখিয়া আসা অত্যাবশ্যক। কারণ যাহার নাম লইয়া তুমি এ গৃহে বিদ্যা ফলাইতে আসিয়াছ, ফরাসীতে তাহাকে সবাই ডাকে শোপাঁ। নামই ঠিকমত উচ্চারণ করিতে পার না যখন, তখন অত প্যাটপ্যাট কিসের?” বেলুন চুপসে গেল। ছেলেটি অতঃপর পিয়ানো শিক্ষা্র জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়ে গিয়ে হাজির হল “আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ”, “ আগে চাই ফরাসী ভাষার গাঁথুনি, পরে পিয়ানো শিখন” মনে মনে যুক্তি দাঁড় করিয়ে ছেলেটি তৎক্ষনাৎই ভর্তি হয়ে গেল চলতি কোর্সটিতে। তারপর বহুদিন পর জেনেছিল ফরাসীতে CHOPIN শব্দটি আসলেই উচ্চারিত হয় ঐ শোপাঁ হিসেবেই। তাহলে গুরুজিই ঠিক। কিন্তু?
- কিন্তু কী?
- যতদূর জানি, শোপাঁ তো ছিলেন পোল্যাণ্ডের মানুষ।
- বৎস, এইবার তুমি ভাল করিয়া ইতিহাসের জ্ঞান লইয়া আস, যাও।
ছেলেটি অতঃপর গুগলে ঢুঁ মারল। যা জানল তা খুবই আশ্চর্য্যজনক।
ফ্রেডেরিক শোপাঁ নামের কিংবদন্তীতূল্য পিয়ানো শিল্পীটি ঠিকই জন্মেছিলেন পোল্যাণ্ডে কিন্তু ঊনচল্লিশ বছরের স্বল্পস্থায়ী জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়গুলো কাটিয়েছিলেন ভালবাসার তীর্থ প্যারিসে যেখান থেকে রাজনৈতিক কারণে আর তিনি ফিরে যেতে পারেননি প্রিয় স্বদেশভূমিতে। কিন্তু মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার জন্য আমৃত্যু আকুল ছিলেন পিয়ানোবাদকদের পিয়ানো শিক্ষক নামে খ্যাত মহান এই শিল্পী। মৃত্যুর পর তাঁর শরীরটির শেষ ঠাঁই হয় প্যারিসের বিখ্যাত সমাধিস্থান ‘প্যের লা শেজ্’-এ , কিন্তু যে হৃদয়টির রক্ত ক্ষরিত হয়েছে অবিরাম স্বদেশে ফিরে যেতে না পারার কষ্টে শিল্পীর সেই হৃদয়টিকে দেহ থেকে তুলে গোপনে নিয়ে যাওয়া হয় ওয়ারশতে এবং জন্মভূমির বুকেই সমাধিস্থ করা হয়। সেই সমাধির উপর এপিটাফে লেখা আছে, “ যেখানে রয়েছে তোমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ, সেখানেই রবে তোমার হৃদয়।”
পিয়ানো শেখা আর হলনা, হৃদয় একবার ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রতিজ্ঞা করেছিল ছেলেটি হৃদয়ঘটিত ঝামেলায় আর না। কিন্তু ফরাসী ভাষাটা কেন জানি ছাড়তে পারেনি সে, বিনামূল্যে অতি উপাদেয় রেড ওয়াইন পাওয়া যেত সম্বৎসরে একবার ভাষা শিক্ষার ঐ স্কুলে, তার লোভেই কিনা কে জানে! ওদিকে গুরুজি “ আঙ্গুর ফলতো টক হবেই’’ বলে প্রায়শঃই দ্রাক্ষার(আমার) প্রতি কটাক্ষপাত করতেন। তাই পিয়ানো শিক্ষায় ছেদ পড়ল, টিকে থাকল মাথা উঁচু করে টক আঙ্গুর ফল। শোপাঁ নামটাও কিন্তু গেঁথে থাকল মনের ভেতর। গেঁথে থাকল আরও একটি নাম “ প্যের লা শেজ্”।
স্রেফ কবর দেখার জন্য যত মানুষ প্যারিসে আসে দুনিয়ার আর কোন শহরে অত মানুষ আর যায় কিনা আমার জানা নেই। কাদের কবর? সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, বিজ্ঞান, দর্শনের জগতকে আলো করে রাখা দিকপাল সব মানুষগুলো মৃত্যুর পর এসে জড়ো হয়েছে এ শহরের পূবদিকের বিশাল(৪৪ হেক্টর)এক গোরস্থানে। ২০তম আরঁদিস্মঁর বুলভার মেনিলমঁতঁ। ছোট্ট একটা টিলা জুড়ে শুধুই সমাধিস্থল। গ্রীষ্মের এক সোনালী আলোমাখা দিনে প্যের লা শেজ নামের মেট্রো স্টেশনেই নামলাম আমরা, মানে দ্রাক্ষাপ্রিয় আমি আর ফরাসিনী মুমু। প্যারিসে এসেই বেচারীকে জ্বালিয়ে মেরেছি শোপাঁর কবরে যাব, শোপাঁর কবরে যাব বলে। বিরক্ত হয়ে একদিন ও বলেই ফেলল, “ তোমার শোপাঁ উচ্চারণটা শুনতে এমন জঘণ্য লাগছে না।” “ এ বলে কী, আমার এমন জবরদস্ত ফরাসী উচ্চারণ! পাঁচ বছর ফরাসী শিখেছি হে, তুমি তো আর পয়সা খরচ করে, পিয়ানো শেখা ছেড়ে দিয়ে এ ভাষা শেখোনি!” পাতাল থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে যেতেই চোখে পড়ল একটা গেট, তখনো তো জানিনা আসলে এটা যেইসেই কোন কবরস্থান নয়, পুরো একটা ভুলভুলাইয়া, রাস্তা একবার হারিয়েছো তো সারাদিন ঘুরে মরবে, বেরুবার রাস্তা খুঁজে পাবেনা। ঢুকেই দেখলাম চোখের সামনে বিষন্ন দাঁড়িয়ে আছে শত শত সমাধিফলক। “এত লোকের ভীড়ে কোথায় যে পাই শোপাঁকে”, মনে মনে বললে আমার ফরাসী উচ্চারণ শতভাগ সঠিক হয়। এক পুলিশকে ধরলাম, “ আচ্ছা ভাই, পিয়ানোবাদক শোপাঁর কবরটা কোনদিকে একটু দেখিয়ে দাও না” বিশুদ্ধ ফরাসীতেই বললাম ওকে। সে একটু মাথা চুলকে বলল, “ দুঃখিত, ইংরেজী আমি ভাল বুঝিনা, আপনি আমার কলিগকে জিজ্ঞেস করুন ” বলে একটা লোককে দেখিয়ে দিল। আরে ব্যাটা আমিতো ফরাসীতেই... দেখলাম মুমু মিটিমিটি করে হাসছে।
মুমুর মোবাইলের জিপিএস ব্যাবহার করে আমরা একবার এদিক যাই, একবার ওদিক যাই। কিন্তু শোপাঁর সমাধি নজরে আসেনা। অবশ্য তাতে ক্ষতি হচ্ছিলনা তেমন। একে একে চোখে পড়ছিল বিখ্যাত সব মানুষগুলোর শেষ আশ্রয়। প্রতীকবাদের কবি গিয়োম আপোলিনের, ঔপন্যাসিক ওনোরে দ্য বালজাক, সংগীতকার বিজে, ব্যাঙ্গাত্বক কার্টুন আঁকার জনক ওনরে দ্যমিয়ে, শিল্পী ইউজেন দ্যলাক্রোয়া, পরাবাস্তবতার কবি পল এলুয়ার, মুকাভিনেতা মার্সেল মার্সো, নাট্যকার মলিয়ের, গায়িকা এদিথ পিয়াফ, শিল্পী কামিল পিসারো, ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্ত, হোমিওপ্যাথির জনক হ্যানিম্যান সহ বিখ্যাত অখ্যাত বিভিন্ন দেশের সব মানুষের কবর।
কোন কোন সমাধির ওপর পাথরের মূর্তি, কোথাও কেউ শ্রদ্ধা জানিয়ে রেখেছে তাজা ফুল। পাথর বসানো সুন্দর পথ, আসলে ফুটপাথ, আর আছে ছড়ানো ছিটানো প্লাতান গাছ। আগেই বলেছি, প্যের লা শেজ একটা গোলকধাঁধাঁ। মুমুর জিপিএস নির্দেশিত পথ ধরে গিয়ে কিছুতেই উদ্দিষ্ট কবরখানা খুঁজে পাচ্ছিলামনা। ধরেই নিলাম পথ হারিয়েছি। ঢোকার মুখ থেকে ম্যাপ নিইনি বলে নিজের উপর বেশ রাগ হচ্ছিল, আর পুলিশ ব্যাটার ফ্রেঞ্চ জ্ঞানের দুরবস্থার জন্য ফ্রান্সের শিক্ষাব্যবস্থার চৌদ্দগুষ্টি ঊদ্ধার করছিলাম মনে মনে। একটা ডিজুস মার্কা পোলাপাইনের দঙ্গল দেখলাম দুনিয়ার কোন শালারে আমি পুছিনা ভাব করে চলতে। বুঝে ফেললাম, ইনারা চলেছেন ঈশ্বরের কবর দেখতে। না, ঈশ্বরচন্দ্র কোলকাতাতেই সমাহিত হয়েছেন, ইনাদের ঈশ্বরের নাম জিম মরিসন, রক সংগীতের প্রবাদ পুরুষ, এলকোহল আর ড্রাগ গ্রহনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আমেরিকান ক্ষণজন্মা এই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল প্যারিসেই। এদের পেছন পেছন গিয়ে আমরা ঠিকই পৌঁছলাম শিল্পীর কবরের সামনে যেখানে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বেশ ভীড়। কেউ কেউ জিমকে শ্রদ্ধা জানাতে ফুলের বদলে রেখেছে হুইস্কির আধ-খাওয়া বোতল, একটা দুটো সিগারেট( আসলে শুকনা)। এক মাতাল দেখলাম আবেগে মথিত হয়ে কবিতা আওড়াচ্ছে, জিমের আমেরিকান প্রেয়ার থেকেই বোধয়। ওদের একজনকে বললাম, “ ভাই, শোপাঁর কবরটা একটু দেখিয়ে দেবে?” সে মধ্যমাটাকে সুন্দর করে তুলে ধরে বলল, “ ফাকিউ”। মধ্যমার ডিরেকশনের দিকে যাওয়া সম্ভব নয় জেনে আমরা অন্য দিকে পা বাড়ালাম।
মুমুর মোবাইল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তটাতেই আমরা এসে পৌঁছালাম শোপাঁর সমাধির সামনে। ছোটখাটো একটা সমাধি। একটা নারীমূর্তি ডান হাতের উপর মাথার ভর রেখে বসে আছে, বাম হাতে ধরে রেখেছে একটা বই। যে বেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে এ মূর্তি তার মাঝখানে খোদাই করা আছে শিল্পীর মুখমণ্ডল। বেদীমূলে বেশকিছু ফুলদানিতে ফুল। কে যেন একটা রিবন বেঁধে দিয়ে গেছে বেদীকে ঘিরে থাকা লোহার রেলিংযে। এই সেই সমাধিস্থল যার নীচে শুয়ে আছে পিয়ানোবাদকদের পিয়ানোশিক্ষক বলা হোত যাকে তিনি। যার হৃদয়টা সমাহিত করা আছে অন্য একটা দেশে, যে দেশটার জন্য হাহাকার করে উঠত নিশুতি রাতে তাঁর পিয়ানোর রীডগুলি।
বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফেরা মানে ভুলভুলাইয়া থেকে বেরুনোর পথ খোঁজা। দূর থেকে দেখলাম লম্বা কালমতন একটা ছেলে আমাদের দিকে আসছে। চুলও লম্বা, চোখে চশমা। মুমু ইদানিং একটা কাণ্ড করছে, ভারতীয় বা বাংলাদেশী চেহারার কাউকে দেখলেই বলছে, “ তোমার ভাই।” ছেলেটা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর ও আবার বলল, “ তোমার ভাই।” পেছনের ছেলেটা শুনল কিনা কে জানে!
মন্তব্য
লম্বা কালমতন একটা ছেলে আমাদের দিকে আসছে। চুলও লম্বা, চোখে চশমা/ মজা দেখাচ্ছি।
facebook
হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। ঠাকুর ঘরে কে র্যা?
আমিই কলা খাইছি, কী অইছে তৈ?
কট!
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
আউট।
ছেলেটাকে আপনিও দেখেছিলেন নাকি?
ছেলেটাকে আপনিও দেখেছিলেন নাকি?
খুব ভালো লাগল .....................
ধণ্যবাদ।
প্যারিসের লোকেরা শোপাঁ রে ঠিক চিনে নাই। ওয়ারশর ওয়াজিয়েঙ্কি পার্কের ভাস্কর্যটা দেখেন। ওর দেশীভাইয়েরাই ওরে ঠিক চিনতে পারসিলো।
এইটা দেখতে পারেন।
হিংসা জাগানিয়া এইসব পোস্টের জ্বালায় সচলে এখন লগিন করতেই ভয় লাগে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বুঝেন তবে তারেক অনুর উপর মানুষের বদদোয়ার পরিমাণটা কত?
অনু ভাই তো বদ্দুয়ার ঠ্যালায় চরকির মত ঘুরতেছে... আর আমাদের হিংসাক্রান্ত করে দিচ্ছে...
এই লোকটা দেখি খালি গানই ভালো গায় না, লেখালেখিও ভালো করে! দুশ্চিন্তার বিষয়!
কয়েকটা জায়গার হিউমার মারাত্মক লাগলো ভাইয়া।
প্যারিস যেতে ইচ্ছা করে!
বিটিডব্লিউঃ আপনার গাওয়া 'আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ' শুনার জন্য কান নিশপিশ করছিল। রাহিনকে অনেকবার দিতে বললাম। আকাইম্যা পোলাটারে দিয়ে কিসসু হইলো না এই জেবনে!
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
আরে তারানা যে! সেদিনের খেলাটার শেষ রেজাল্ট কী হল? আচ্ছা আমি অঞ্জনকে বলে দেব কয়েকদিন পর ওর হল্যান্ড টুর আছে, ও আপনাকে ওর গানটা শুনিয়ে দেবে, প্যারিস ঘোরার সুযোগ মিস করবে না।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
চমৎকার সুমাদ্রী..তৃঞ্চা মিটলোনা।অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ স্যার। ভাল থাকবেন। আশা করি শীঘ্রই দেখা হবে।
ভালো লাগলো লেখা আর হিউমার
ধন্যবাদ চরম ভাই।
মনামি, লেখাটা অনেক ভালো লাগলো। সমাপ্তিটা কেমন লাগলো যেন,হঠাৎ
করে শেষ হয়ে গেল বলে মনে হল।
তোর মুখের আদল দেখি ভাস্কর্যের মত কঠিন হয়ে উঠেছে, কবরস্থানে গিয়ে ভড়কে গেলি নাকি!
হুম, হঠাৎ শেষ করেছি সঙ্গত কারণে। ঐ যে লম্বা, চশমাপড়া ছেলেটির কথা বললাম না, ওর জন্যই। আর খবরদার চেহারা নিয়ে কোন কথা বলবিনা কিন্তু? বেটা, ঐ ছবিটা পাখি ভাইকে দেব ভাবছিলাম।
জলদি ছবিটা পাখি ভাইকে দিয়ে দেন। পেছনে একটা ভারী দেখে নোঙর লাগিয়ে দিলে ওড়াউড়ি কোথায় যায় সে দেখা যাবে।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
নতুন মন্তব্য করুন