ডিসেম্বরের মিষ্টি একটা বিকেলে যখন আমার রুমের পেছনের বাউবাব গাছের মাথা থেকে “ ইয়াহু” বলে বাতাসে লাফ দিয়ে পড়ে তুলোর মখমল-কোমল ফুলেরা তখন এক মুহুর্তের জন্য ভুলে যাই দুঃখের বিলাসী কবিতার পংক্তিগুলো।
এখনও বেঁচে আছি এটা অধিকাংশ সময়েই ভুলে থাকি, জলের ভেতর থেকে ভুস করে ভেসে ওঠা বুদবুদের মত হঠাৎ করেই উদয় হয় ভাবনাটার, আরে দিব্যি আছি তো, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, দৌঁড়-ঝাপ করছি, লোভাতুর দুচোখে পৃথিবীর সবটুকু সৌন্দর্য উপভোগ করে ঘরে ফিরছি। তবু কেন বিলাসের আধার ফেসবুকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেমিকোলন আর প্রথম বন্ধনীর প্রথম ঠোঁটটা এঁকে দিয়ে পরিচিত মহল থেকে একটু আহা-উহু পাবার আশা করা? তীব্র এ শীতের রাতে কত লক্ষ-কোটি মানুষের গায়ে কোন গরম কাপড় নেই।
অক্ষত, রোগহীন বেঁচে থাকা, আহা কি যে সুখ! অথচ এ লেখাটা আজ লিখতে তো নাও পারতাম। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ-পীড়িত একটা অঞ্চলে একদিন উন্মত্ত ক্রুদ্ধ অস্ত্রধারী নারী-পুরুষ ঘিরে ধরেছিল আমাদের, পথরোধ করে রেখেছিল, সামনে যেতে না দেবার তীব্র সংকল্প ওদের আর দুচোখে তীব্র ঘৃণা। তখনই বুদবুদের মত ভুস করে ভেসে উঠেছিল ঐ ভাবনাটা, মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের চেহারা, চলে যাওয়া প্রেয়সীর মায়াময় দুচোখ। মৃত্যুকে চেটে-পুটে একবার খেয়ে নিয়ে কেউ কি আমাদের শোনাতে পারে তার স্বাদের কথা? মৃত দেখেছি ঢের, কিন্তু মৃত্যুর রুপতো অচেনা। তাই ভূতগ্রস্থ পথিকের মত ভয় শব্দটার অর্থ ভুলে গিয়ে আধুনিক এবং আদিম অস্ত্রে সজ্জিত কাল কাল মানুষগুলোর মাঝে বোঝাপড়া করার জন্য চলে যেতে পেরেছি সেদিন। কিংবা যে সন্ধ্যায় গেরেদের সারা গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল মোসিরা, তখন জ্বলন্ত ধানের গোলাঘর কিংবা পুড়ে ছাই হতে থাকা পাখির পালক দেখতে দেখতে মনে মনে বলেছি, “ এ জঙ্গল থেকে গুলি বা বিষাক্ত তীরের খোঁচা না খেয়ে বেরিয়ে রুমে ফিরে গিয়ে দারুণ একটা ঘুম মেরে কাল খুব ভোরের প্রথম আলোয় টংকেই পাহাড়ের বুকে মুখ গুঁজে থাকা লাজুক মেঘশিশু দেখতে পারাটা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উপহার।” সেই উপহার বুকপকেটে রেখে ডিসেম্বরের মিষ্টি একটা বিকেলে সোনালু ফুলগুলোকে হঠাৎ আমার ঊর্বশীর কানে ঝুলতে থাকা সোনার দুল বলে ভ্রম হয়।
সময়টা ঘড়ির কাঁটা দিয়ে মাপছি সবাই। প্রতিটা দিন তার পূর্ববর্তী দিনটির মত মনে হয় প্রায় সময়। তবে আমি সময়ের চেহারাটাকে দেখতে পাই প্রকৃতির দিকে যখন চোখ মেলে দিই। আমার এই স্বেচ্ছা-বনবাসে প্রতিদিন দেখেছি একটু একটু করে রঙ পাল্টিয়েছে প্রকৃতি। যখন প্রথম আসি আঠার পর্বত-ঘেরা মাঁতে, তখন উত্তরের ধূলিঝড় এসে ত্রাস চালাচ্ছে এখানে। ইউরোপের শীতল বাতাস ভূ-মধ্যসাগর পেরিয়ে সাহারার উপর দিয়ে ধেয়ে আসার সময় বুকে করে রাজ্যের সমস্ত ধূলি বয়ে এনে ছুঁড়ে মারে এ অঞ্চলে, কিসের এত তার ক্রোধ কে জানে! এ ঝড়ের নাম হারমাটান। ভোরের দিকে কুয়াশা এসে জঙ্গলে জঙ্গলে আটকে পড়ে থাকে, তখন মনে হোত এই নির্জনে বুঝি আমি ছাড়া আর কোন মানুষের বাস নেই। তারপর দীর্ঘ রোদেলা দিন। এমন রোদের রঙ দেখিনি কখনও আমার শ্যামল দেশে। জঙ্গলের বুক চিরে চলে যাওয়া মাটির পথ ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতাম ঊজ্জ্বল প্রজাপতির ঝাঁক দেখে। অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে যখন নীচে তাকিয়েছি এই পথকে মনে হয়েছে সবুজ ঘন চুলের মাঝবরাবর কাটা লম্বা একটা সিঁথি। প্রতিটা দিন অন্য আরেকটা দিনের মত, একঘেঁয়েমিতে ভরা সেই একই কাজ, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন করা, সেই একই মিথ্যে আশ্বাস দেয়া, তার মাঝে শুধু এতটুকু স্বস্তি প্রকৃতির মাঝের এই রঙের বদল দেখা।
তারপর একদিন বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ পাওয়া যায়। ফ্রমাজের গাছের মাথায় বাসা বাঁধা চাতক প্রেমিক গান গেয়ে চলে করুণ সুরে, একদিন আসে উদ্দিষ্ট চাতকী তার, সাথে নিয়ে আকাশের ব্যাকুল অশ্রুধারা। পাখির প্রতি আমার ঈর্ষা হয়, তার গানের সুরে কী আছে অমন যাদু যা টেনে আনে দূরে চলে যাওয়া প্রেয়সীকে, এমনকি বৃষ্টিকেও! আহা সে সুর যদি কণ্ঠে তুলে নিতে পারতাম একবার!
তারপর বৃষ্টিমুখর দিন, সন্ধ্যা, রাত। আমার রুমের সামনে ঘাসের লনে বৃষ্টির পানিতে খেলা করে সবুজ সাপেরা, আমার তখন কোলরিজের কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় আর অদ্ভুত এক ভাললাগার আবেশে আমি বুঁদ হয়ে যাই। মাঝে মাঝে বৃষ্টির তোড় এমন বেড়ে যায়, আমাদের প্রিফ্যাবের ছাদ ফুটো হয়ে গিয়ে টপটপ পানি পড়ে ঠিক আমার মাথার ওপর, ঘুম আসেনা আর সে রাতে। বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখি, আমাদের ছোট্ট চিড়িখানার হরিণ দম্পতি গলায় গলা জড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচাপ, কাছের পাহাড় থেকে ঝপঝপ করে পড়তে থাকা ছোট্ট ঝর্ণাটার শব্দ বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। এরকম একটা মুহুর্তে বেঁচে আছি সুস্থভাবেই এ ভাবনাটা আবার ফিরে আসে আর জীবনের প্রতি তখন এত ভালবাসা জন্মে যায় যে বহুবার ব্যর্থতার গ্লাণিতে আসা হতাশায় জীবনের গতিটাকে থামিয়ে দেব কিনা ভেবেছি বলে নিজেকে বেশ গালমন্দ করে বসি।
জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারি, মার্চ এসব নাম দিয়ে সময়টাকে একটা কাঠামো দেয়ার চেষ্টা করেছে মানুষ। আসলে সময়টার তো কোন শৃঙ্খল নেই। আজ যা কালও তা। ২০১০ বা তারও আগের যেকোন বছরের মতই ছিল ২০১১। সেই দৌঁড়ঝাপ, হাসি-কান্না। রাতে ঘুমে ঢলে পড়া আর ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর চোখ কচলাতে কচলাতে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে বলা, কই আমার চেহারাতো একটুও বদলায়নি, আমিতো আমিই রয়ে গেছি। আমাকে তাই একটা নতুন বছর এল কিংবা আরও একটা বছর চলে গেল ব্যাপারটা ভাবায় না। আমি যে আশ্চর্যরকম্ভাবে আজও বেঁচে আছি এটাই আমাকে আমোদ দেয়। অথচ দুঃখের বিলাসী পাখিরা প্রায়শঃ শিষ দিয়ে ওঠে হৃদয়ে, প্রিয় মানুষগুলো যারা চলে যায় তাদের না ফেরার কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরে একটা তোলপাড় উঠে যায়, বিষন্ন স্মৃতিগুলো রাতের পর রাতগুলোকে ব্যাথাতুর করে দেয়, তারপরও বিকেলের মৃদু আলো মার্গারিটা ফুলগুলোর উপর প্রনয়ে লিপ্ত মৌমাছিদের যখন রঙিন করে দেয় অথবা গভীর পূর্নিমা রাতে আমার ঘাসের লনে সোনালু ফুলগাছের ডালপালা যখন বাহারী উল্কি এঁকে দেয়, তখন সেই পরিচিত, লাজুক ভাবনাটা ভুস করে মনের পুকুরের উপরিভাগে জেগে উঠে। অক্ষত আছি, সুস্থ আছি, ভালই আছি।পৃথিবীটাকে দুচোখ ভরে দেখার সুখটুকু পাচ্ছি এর চেয়ে সুখকর আর কী আছে? চাই সবাই অক্ষত থাকুক, ভালবাসুক পৃথিবীকে প্রতিটা মুহুর্তে কারণ কাল পৃথিবীর সুন্দরতার সভায় আমাদের প্রবেশাধিকার নাও থাকতে পারে।
মন্তব্য
অসাধারন লেখা সুমাদ্রী। আমার ভাবনায় অ উকি দেয় জীবন বিলাসী, বেচে থাকার ঢেঁকুর উঠা আনন্দ। তবুও প্রকৃতির অপার দানে তোর আবাস এখন তা হয়ত তোকে আর তৃপ্তি দিচ্ছে।
ভাল থাক। জীবনের জয় হোক, আজ বা কাল; প্রতিদিনই.........।
ধন্যবাদ।
ভালো লাগল ঝরঝরে ভাষায় জীবনকে একটা আলাদা বোধ দিয়ে দেখার এই অঙ্গীকার।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ।
অনেক গ্লানি আর দুঃখের মাঝেও জীবন হতে পারে অসাধারণ। দৃষ্টিভঙ্গিটাই মুখ্য। জীবনকে রাঙানোর জন্য আমাদের প্রাত্যহিক জীবন এতসব উপাদান ও উপকরণে পরিপূর্ণ যে পৃথিবীর তাবৎ বেদনাকে তার কাছে তুচ্ছ বলা যায়। তদুপরি হাহাকার ও কষ্টকে সুখের মোড়কে উপভোগ করারও এক অদ্ভুত কৌশল আমাদের আয়ত্তাধীন। বিরহের বেদনার মধ্যে যেমন অনেকে পেতে পারেন অনাবিল এক সুখ।
লেখাটা মন ছুঁয়ে গেছে শুধু প্রকাশের ব্যতিক্রমি ভঙ্গির কারণে নয়,অধিকন্তু আবেগের পরিস্ফুটনে ছিল সাবলীলতা ও অকৃত্রিমতা।
অনুভবের এই মোহনীয় আবেশ আমাদের সকলকে মুগ্ধ করে রাখুক অনন্তকাল। পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।
বাণীব্রত রায়
এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের কথা মনে পড়ে।
facebook
মুগ্ধ হলাম সুমাদ্রী।জীবন তো আর পড়ে পাওয়া অচল সিকি নয়,অপচয়ের কোন মানেই নেই।দেখছি পৃথিবী প্রাণভরে,নিশ্বাস নিতে পারছি অক্লেশে এখনও......অনেকেই তো হারিয়ে গেছে..প্রিয়মুখ,প্রিয়বন্ধু .....উপলব্ধিটা আবার ফিরে এল।বুঁদ হয়ে গেলাম পাথরকুঁচির চেতনায়।ভালো থেক।শুভ হোক সব কিছু।আবারো মুগ্ধ হবার প্রত্যাশা রইল অতি শীগগিরই......।
ধন্যবাদ স্যার। ভাল থাকবেন।
প্রকৃতি ও জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, ভালো লাগলো, একাকী খুব গভীর থেকে জীবনকে উপলব্ধি করার প্রয়াস দেখে ,,,,
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ধন্যবাদ।
সুন্দর লেখা।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ।
"পৃথিবীটাকে দুচোখ ভরে দেখার সুখটুকু পাচ্ছি এর চেয়ে সুখকর আর কী আছে?"
এই লাইন্টা পড়ে মনে হোল কত কিছু দেখার বাকি এখন ও। শুধু পৃথিবীটাকে দেখার জন্য হলে ও অনেকদিন বেঁচে থাকতে চাই। আপনার বর্ণনা এত সুন্দর যে কি বল্বো।
ধন্যবাদ। সুস্থ থাকুন।
খালি দুঃখবিলাস! >:P
মজার মজার লেখা লিখেন
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
"বেঁচে আছি"...এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?
আপনার লেখাটি খুব ভাল লেগেছে।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অসাধারণ বন্ধু। আমি তোর লিখার অনেক ভক্ত।তোর লিখাগুলু পড়লে কেমন জানি বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়...
Well done once again।
ভাল থাকিস...
নতুন মন্তব্য করুন