আঙুলের নখে একদিন খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেছিলাম সাদা সাদা বিচিত্র আকারের সব আলপনা। ভয় পেয়ে মা'র কাছে ছুটে গেলে মা হেসে বলেন, " তোর জন্য উপহার নিয়ে উড়ে আসছে রঙিন প্রজাপতির দল।" মা আমার এমন করে কথা বলত যেটার মধ্য দিয়ে আমি এক একটা ছবি দেখতে পেতাম। প্রজাপতিকে আমি ভাবতাম একটা উড়ন্ত ফুল। অমন বর্ণিল একটা ফুল উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় ফুলের বনে, তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকাটাও একটা আনন্দ। তাই তার প্রেমে পড়তে আমার দেরী হয়নি খুব বেশীদিন। একবার স্কুলের এক দিদিমনিকে বলেছিলাম, " বড় হয়ে আমি প্রজাপতি হব।" আঙুলের নখে আলপনা ফুটে ওঠার পর প্রতিদিন আমি খুব কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করতাম প্রজাপতির ঝাঁকেদের জন্য, কী উপহার নিয়ে আসবে তারা শুধু তাই ভাবতাম। সপ্তাহের শেষদিন শহর থেকে বাবা আসত, আমাদের জন্য নিয়ে আসত দোহাজারী মেইলে বিক্রী হওয়া লেবেনচুষ। কী অদ্ভুত সে স্বাদ! শুক্রবার সকালে আমাদের তিন ভাইকে পুকুরে নিয়ে যেত বাবা, তারপর পেটের নীচে হাত দিয়ে পানির উপর এক একজনকে ধরে রেখে বলত, " এবার সাঁতার কাট।" আমাদের সাঁতার শিখতে খুব একটা বেশীদিন লাগেনি।
একদিন শহরে ফিরে যাওয়ার আগে বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, " প্রজাপতিদের কাছে তুই কী উপহার চাসরে?" ভেবে পেলামনা কোন উপহারটা আমার চাওয়া উচিত। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলাম, " আমি একটা রঙিন ঘুড়ি চাইব। তারপর স্কুলের মাঠে আনিসের সাথে ওড়াব। ওর একটা ঢাউস ঘুড়ি আছে বাবা।" আমাদের গ্রামগুলোতে ছেলেবেলায় রাত নামত সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই। রাতের ট্রেণ যখন হুইসেল বাজিয়ে থামত ধলঘাট বা খানমোহনা স্টেশনে, মা তখন বিছানা থেকে নামতেন, আমরা ভাইয়েদের তখন একঘুম হয়ে যেত, মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙলে দেখতাম মা ল্যাম্প জ্বালাচ্ছেন। গ্রামে পল্লীবিদ্যুৎ ছিল বটে, তবে তার তেজ আসতে আসতেই রাত কাবার হয়ে যেত। সে পল্লীবিদ্যুতের তেজ বোধয় এখনও আসেনি।
দু'হাতের আঙুলের নখে আমার আলপনা বেড়েই চলেছিল, প্রজাপতির ঝাঁকেরাও আসেনা, স্কুলের মাঠে দেখি আনিস তার ঢাউস ঘুড়িটাকে নিয়েএ মাথা ওমাথায় ছুটে বেড়ায়, আর আকাশে দারুণ সব কসরত দেখায় একটা ঘুড়ি, আমার মনটাও সে ঘুড়ির সাথে উড়ে বেড়াত। একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি বাবা হাসতে হাসতে আমার সামনে একটা রঙিন ঘুড়ি ধরে বললেন, " এই দেখ, প্রজাপতির দল তোর জন্য কী এনেছে!" আমার তো খুশি আর ধরেনা। কখন এলো তারা, কোন পথে এসে কোন পথে ফিরে গেল তারা? স্কুলে যাওয়ার পথে যত প্রজাপতিই সামনে পড়ল তাদের সবাইকেই ধন্যবাদ জানাতে ছুটে গেছি, তারা লজ্জ্বা পেয়ে দূরে দূরে উড়ে চলে গেছে। বিকেলে আমি আর আনিস দুজনে মিলে মাঠে গিয়ে উড়িয়ে দিলাম রঙিন দুটো ঘুড়ি। আমারটার কদর বেশী, প্রজাপতিরা নিয়ে এসেছে যে সেটি, আনিস যদিও একথা মানতে নারাজ। ঘুড়ি দুটো আকাশে নেচে চলে, একে অপরের গায়ের উপর ঢলে পড়ে, কানে কানে কথা বলে। আকাশে তারাও যেন কত জন্মের বন্ধু।
আঙুলের নখে এরপরও বাহারী সাদা উল্কিরা এসেছে। মা অবশ্য পরে পরে আর প্রজাপতির গল্প ফাঁদতো না, কিন্তু সবসময় বলত, " তোর জন্য একটা উপহার আসছে।" উপহার কখনো আসত, বেশীরভাগ সময়ই আসতোনা, আমিও ভুলে যেতাম তাদের কথা। খেলনা কেনার আবদার করতাম গ্রামে মেলা বসলে, বিচিত্র সব খেলনা, তার কোনটাই এখন আর দেখিনা কোথাও। নামও মনে নেই সেসব খেলনার। গ্রামের মানুষদের জন্মদিন থাকতনা বোধয়, তাই জন্মদিনের উপহারও জু্টেনি ঐ বয়সে। শহরে আসার পর দেখলাম আমাদের বয়সী ছোঁড়াগুলোর হাতে কতরকমের খেলনা, কতরকমের বল, কতরকমের গাড়ি। একদিন মেজদা বাবাকে বলেছিল, " আমাকে একটা গুলি কিনে দাওনা, বাবা। অন্তুর গুলিটা কী সুন্দর শব্দ করে, লাল লাল জ্বলে।" মা'কে অবাক করে দিয়ে বাবা সেদিন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল মেজদা'র গালে। আমরা কোনদিন আর খেলনা গুলির কথা বলিনি, না নিজেদের মধ্যেও না, লাল লাল জ্বলে, দারুণ একটা শব্দ করে। সেদিন রাতে মা'র কাছে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বাবা বলেছিল, " গুলি কীকরে খেলনা হয়? আমি চাইনা আমার ছেলেরা ছোট থেকেই গুলি নিয়ে খেলতে শিখুক।" বাবাটা কী যে সব বলত, বুঝতামনা কিছুই।
আঙুলের নখে এখন আর কোন আলপনা আসেনা। আমি প্রজাপতিদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন স্বপ্নে দেখলাম বাগানজুড়ে হাজার রঙের বাহারী সব প্রজাপতি। চিৎকার করে করে তারা আর্তরব তুলছে। জিজ্ঞেস করলাম, " কী হয়েছে?" তাদের একজন উদাস সুরে বলল, " কেউ এখন আর রঙিন ঘুড়ি উপহার চায়না, শুধু খোঁজে খেলনা পিস্তল, বিশ্রী শব্দের, রক্ত রঙের, বিভৎস, বিভৎস।"
আমার আনিসের কথা মনে পড়ে। বিকেলের আকাশে এখন কটা ঘুড়ি ওড়ে হিসেব করি মনে মনে। আমার চোখে ভাসে রঙিন দুটো ঘুড়ি। ওরা একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে, কানে কানে কথা বলে, আকাশ জুড়ে ফুটিয়ে তোলে তারা নৃত্যের শত শত অপূর্ব সব মুদ্রা।
মন্তব্য
কি অনবদ্য এই শব্দগুচ্ছ! পাঠককেও নিয়ে যায় আকাশের দেশে, অযুত স্মৃতির ঘুড়ি উড়ে চলে, প্রজাপতির ডানায় ভেসে বেড়ায় স্বপ্নের পালকগুলি, খুব নিবিঢ়ভাবে, জড়াজড়ি করে। কিন্তু এখন আর কেউ ঘুড়ি পেতে চায় না প্রজাপতিদের কাছে, এখন আকাশে ভেসে বেড়ায় গুলি, ঝাঁকে ঝাঁকে, ছুটতে থাকে দিক দিগন্তে, স্বপ্নগুলোকে লক্ষ্য করে।
অসাধারণ পোস্ট, সুমাদ্রী ভাই।
ধন্যবাদ। সত্যিই সময়টা বিশ্রীরকমভাবে বদলে যাচ্ছে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অসাধারণ
ধন্যবাদ ইয়াসির।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
খুব খুব ভাল লিখেছেন।
মন ছুঁয়ে গেল।
ধন্যবাদ প্রদীপ্ত।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ভাল লিখেছেন।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ রাজাবাবু।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
আমারো কেন জানি আনিসের কথাই মনে পড়ছে_ _ _
হুমমম।
হুমম।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
মন ছুয়েঁ গেল
ধন্যবাদ নাঈম।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
আপনার বাড়ি কি ডেঙ্গাপাড়ার আশে পাশে? ধলঘাট আর খানমোহনায় আমার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমার খালার বাড়ি ওখানে। ছুটি ছাটায় প্রায়ই যাওয়া হতো। দুই ষ্টেশানের মাঝে সেই রেল সেতুটার উপর বসে কতো বিকেল সন্ধ্যা পার করেছি। রেল লাইনের কটকটে শুকনো পাথর গুলো হাতে নিয়ে এদিক ওদিক কতো যে ছুড়তাম। আপনার লেখা পড়ে পুরো নস্টালজিক হয়ে গেলাম।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার বাড়ি খানমোহনার অদূরে দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রামে। গেছেন নাকি ওদিকে কখনও? ছোটবেলায় মামাবাড়ি( ধলঘাট) যাওয়ার পথে অনেক ব্রিজ চোখে পড়ত, এখনও আছে কিনা ওগুলো কে জানে। আর সেই দোহাজারী মেইলও বোধয় মৃতপ্রায়। নুড়ি পাথর, স্লিপার এগুলো আর অবশিষ্ট নেই মনে হয়। ভাল থাকবেন।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
গতকালই পড়েছিলাম, মন্তব্য করা হয় নি। চমৎকার হয়েছে, নিজের উপহার আদায়ের মুহূর্তগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন।
facebook
ধন্যবাদ অনু ভাই। খালি শৈশবের কথা মনে পড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে। মনে হয় যেন মহাজাতকের মত পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অসাধারণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
দারুণ লিখেছেন!
বাচ্চাদের স্বপ্ন আজকাল সত্যিই খুব বেশিরকম বদলে গেছে।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ। বাচ্চাদের ধ্বংসাত্মক, মারনাস্ত্র এরকম খেলনা কিনে দিলে ছোটবেলা থেকেই ওদের মধ্যে একটা খুনে প্রবৃত্তির জন্ম হতে পারে। বাচ্চাদের কত মজার খেলনা উপহার দেওয়া যায়। ওদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, ওদের সাথে নিয়ে খেলার মাঠে বলের পেছনে ছোটার মাঝে যে আনন্দ সেটার সাথে লাখ টাকা জয় করার আনন্দও তুলনীয় নয়।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অসামান্য
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ধন্যবাদ রিশাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
দোহাজারী ট্রেনের লেবেনচুষ! ছোটোবেলায় আমিও পেয়েছিলাম সেই স্বাদ। অপূর্ব!
আপনার বাড়িও কি ঐদিকে? সত্যিই, ঐ ট্রেনভ্রমণ খুব মিস করি। ভার্সিটির ট্রেনের ভ্রমণের চেয়েও ওটার স্মৃতিটা বড় বেশী নাড়া দেয়।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
খুব মায়াভরা একটা লেখা।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
ধন্যবাদ ঊচ্ছ্বলা।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
মন ছুঁয়ে গেল
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
খুব ভাল লাগলো।।।
ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ঝিম ধরানোর মতো গদ্য আপনার।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কেমন ঘুমালেন?
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
চমৎকার লেখা!
মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
নতুন মন্তব্য করুন