দুটি মহাদেশে দুই পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকা মহানগরী ইস্তানবুল যার বুক চিরে চলে গেছে বিখ্যাত প্রণালী বসফরাস সেই ভুবনমোহিনী শহরে একদিন আগন্তুক হিসেবে এসে হাজির হব, মনে আশা ছিল বড়। হাজার বছরের কয়েকটি সাম্রাজ্যের ইতিহাসের শহর ইস্তানবুল। এক জন্মে গ্রীকরা তাদের রাজা বাইজাসের নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রেখেছিল বাইজ্যানটাইন, সাড়ে ছ’শ বছর পর রোমানরা এসে যখন গ্রীকদের হঠিয়ে দিল লোকে তাকে ডাকতে শুরু করল নতুন নামে, কন্সট্যানটিনোপোল, মানে এ শহর সম্রাট কন্সট্যানটিনের। আরেক জন্মে, তাও প্রায় হাজার বছর পর, পুব দিকে থেকে অটোম্যানরা এসে যখন দখল করে নিল এ শহর, কন্সট্যানটিনোপোল ভোল পালটে হয়ে গেল ইস্তানবুল। দুনিয়া চাপিয়ে দিয়েছে তার গায়ে কত কত নাম, অথচ শহরের লোকেরা ভালবেসে তাকে ডাকে অন্য আরেক নামে। বেয়োগলু। এক পারে ইউরোপ আর অন্য পারে এশিয়াকে রেখে মহানগরীর মাঝখান দিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলেছে মোহনীয় বসফরাস। মর্মর সাগরের হাওয়া নিয়ে ছুটে যায় সে কৃষ্ণসাগরে দিনরাত। দুটো আপাত বিপরীত সংস্কৃতির মানুষের পদভারে মুখরিত আশ্চর্য সে শহরে মনোরম গ্রীষ্মের শেষের দিকে একদিন এসে হাজির হলাম হাতে একটা বই নিয়ে।
ওরহান পামুকের ইস্তানবুল।
ইস্তানবুল নিয়ে আগ্রহ গড়ে উঠে মূলতঃ দুটো কারণে। এক- এ শহরের এক ভাগ পড়েছে ইউরোপে আর অন্য ভাগ এশিয়ায়। তার মানে ইস্তানবুল হল নির্জন, উদার ইউরোপীয় আর কোলাহলমুখর, রক্ষণশীল এশিয় সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র। তার মানে এশহরে সোনালী চুল আর নীল চোখের মানুষ হাসতে হাসতে গল্প করে কাল চোখ আর বাদামী চুলের মানুষের সাথে। দুই- ইস্তানবুল নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত অভূত;পূর্ব সব নির্মাণশৈলী, সুউচ্চ তা্দের মিনারেটগুলো, বিশালকায় তাদের সুগোল ডোমগুলো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নীল আর লালের আবছায়া ঢেকে আছে অনুপম এই স্থাপত্যগুলোকে। আয়া সোফিয়া কিংবা ব্লু মস্ক যাদের নাম।
আরেকটি কারণ অবশ্য প্রচ্ছন্ন, ইস্তানবুলের সাথে যার যোগাযোগ হয়ত সরাসরি নেই, সেটি হল আধুনিক তুরস্কের স্থপতি কামাল আতার্তুক, যার কারণে ধর্মীয় গোঁড়া অটোম্যান তুরস্ক হয়ে উঠতে পেরেছিল ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক তুরস্কে। সেই কৈশোরের নায়কের দেশে একদিন গিয়ে এগলি ওগলি ঘুরে গ্রীক, রোমান, অটোম্যানদের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নের পাশে বসে দু’দণ্ড জিরোব, মনে আশা ছিল বড়।
ইস্তানবুলে ছিলাম সবমিলিয়ে সাড়ে পাঁচ দিন। এত অল্প-সময়ে দু’হাজার বর্গমাইলের চেয়ে বড় এই মহানগরীর দশটি দ্রষ্টব্য স্থানেও যাওয়া সম্ভবপর ছিলনা। আর ইউরোপের সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে যেহেতু ঘোষিত হয়েছে এই শহরের নাম, সুতরাং গ্রীষ্মের ইস্তানবুল কোন অংশেই প্যারিস বা লন্ডনের চেয়ে কম নয়। হুম, ইস্তানবুল নগরীর সাড়ে তের মিলিয়ন মানুষের মিলনমেলায় যোগ দিতে আসে এই সময় সারা দুনিয়া থেকে লাখে লাখে পর্যটক। তাই, ঐ সাড়ে পাঁচদিনে দুবলা এই আমি মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলে কতটুকুই বা আর ঘুরতে পারি? তারপরও যতদূর পেরেছি ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি পিঠে ঝোলাব্যাগ নিয়ে। আর দেখেছি মানুষ। বিচিত্র। অথচ ঘুরে ফিরে সেই আদি অকৃত্রিম মানুষ যাদের আমি রোজ দেখি আফ্রিকার ঘন অরণ্যে, বা আমার শহরের এধারে-ওধারে। সেই একই হাসি-আনন্দে-বেদনায়-ক্ষোভে মেতে থাকা মানুষ।
From Istanbul, Athens |
ইস্তানবুল নগরীর ইউরোপীয় অংশটাই মূলতঃ এর প্রধান আকর্ষণ। এখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যগুলো। বসফরাসের পাড় ধরে একে একে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সবগুলো ট্রাম, মেট্রোলাইন, পর্যটকের দল মোটামুটি যে বিশাল অঞ্চলটার দিকে ধাবমান তার নাম ‘সুলতান আহমেদ’। এখানেই একটু পরপর দেখা মেলে আয়া সোফিয়া, মিউজিয়াম, ব্লু-মস্ক, তোপকাপি প্যালেস, হারেম, সুলেইমানিয়া মস্ক, ইউনিভার্সিটি, গ্র্যান্ড বাজার, ঈজিপ্সিয়ান ওবেলিস্ক, আন্ডারগ্রাউণ্ড ব্যাসিলিকাসহ শত শত দর্শণীয় স্থান।
যেকোন একটাতে ঢুকে পড়লেই দিনের অর্ধেকটা সেখানে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দেয়া যায় কারণ প্রতিটা জায়গার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। ইস্তানবুলকে আক্ষরিক অর্থে মসজিদের শহর বললেও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবেনা। কোনটা ছেড়ে কোনটাতে যাব এটা নিয়েই বিশাল এক ধন্দে পড়ে যেতে হয়। আর অদ্ভুতভাবে প্রায় প্রতিটি মসজিদ দেখতে একই রকম। সেই উঁচু চোখা চোখা মিনার আর সুগোল ডোম।
তুর্কীরা কাউকে সম্ভাষণ জানাতে বলে, ‘মারহাবা’। আরে এতো আমাদের গানের জলসায় সাবাসী দেওয়ার ছলে আমরা কতবার বলি! আর কয়েকটা বাক্য পরপরই বলে ‘তামাম, তামাম’। ভেবেছিলাম তামাম দুনিয়ার মানুষের বিচিত্র খায়েশ মেটাতে মেটাতে বোধয় বেচারাদের তামা তামা হয়ে যেতে হয়। তাই হয়ত মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে ওঠা ‘তামাম, তামাম’। পরে জেনেছি তামাম মানে হল, ‘ঠিক আছে। অক্কে!’ ভেবেছিলাম মোটামুটি এই ‘তামাম’ আর ‘মারহাবা’ মেরেই হোটেলের রুম যোগাড় করে ফেলব এক চুটকীতে কিন্তু তুর্কীরা সে তরুনই হোক আর প্রৌঢ়, অত সহজে তাদের হারানো যাবে না। একদিন ‘সুলতান আহমেদ’ এর আশেপাশে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে আমরা মর্মর সাগরের বাতাস খেলাম, কিন্তু যুতসই হোটেল(মানে সস্তার আর কি) খুঁজে পাইনা। তবে তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি বলব, কারণ ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যাচ্ছিল তুর্কীদের প্রতিদিনকার জীবন। তুর্কীরা খুব চা ভালবাসে। ওরা বলে ‘শায়ে’।
From Istanbul, Athens |
হাতলহীন একটা লম্বাটে পেয়ালায় সেই লাল চা নিয়ে খাবারের দোকানে বসে গুলতানি মারছে বুড়োর দল। ঠেলাগাড়ি ভর্তি পাইকারি স্যান্ডেলের বোঝা নিয়ে ছুটছে কুর্দি শ্রমিক। হোটেলের ব্যালকনিতে বসে রোদ পোয়াচ্ছে বুড়ি দিদিমা।
‘সুলতান আহমেদ’ থেকে একটু দূরে আকসরই নামের একটা মেট্রো স্টেশনের পাশেই একটা হোটেলে রুম মিলল ৬০ লিরায়। এক লিরার বাংলাদেশী টাকায় মূল্যমান প্রায় ৪৫ টাকার মত। আমি আর তানভীর ভাই তো মহাখুশি কারণ ওদিকে আরিফ স্যার আর ভাবী প্রতিদিনই গুনছেন ৭০ ডলার করে কাছেই আরেকটা হোটেলে। ইস্তানবুলে প্রচুর কুর্দির বাস। কুর্দিদের দেখলে সহজেই চেনা যায়। চেহারায় একটা রুক্ষতার ছোঁয়া। লম্বাটে নাক। মাথার চুল একদম ছোট করে কাটা। আকসরই এবং আশেপাশের এলাকাটা মোটামুটি কুর্দি অধ্যুষিত বলেই মনে হল।
From Istanbul, Athens |
একদিন ভোরবেলা হঠাৎ পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করতে লাগলে আমরা ঢুকলাম একটা কুর্দি রেস্তোরাঁয়। ‘মারহাবা’ আর ‘তামাম’ পর্বের পর ইংরেজিতে জানতে চাইলাম খাবার কী আছে। তখন সবেমাত্র সে দোকান খুলেছে। কত কী যে সে বলে চলল তার বিন্দু বিসর্গ বোঝার সাধ্য আমাদের কারও ছিলনা। আমরা বহু কসরত করলাম, শূণ্যে মুরগি আঁকলাম, আঙুল দিয়ে গোল গোল করে রুটি বোঝাতে চাইলাম, ‘চিকেন’ ‘চিকেন’ বলে কুকুরু কু ও করলাম। কিন্তু কিছুতেই বেচারা আমাদের নৃত্যগীতের মর্মার্থ বোঝেনা। আশেপাশের একটা দোকানও তখন খোলেনি। আমি দেখলাম একটা বড় পাত্রে ডালের মত কী একটা জিনিসকে সে গরম করছে। ওটি দেখিয়ে ইশারায় বললাম, ‘ওটাই দে রে ভাই, খেয়ে তোর গুষ্টি ঊদ্ধার করি।’ সেই ডালসদৃশ সুপে শক্ত রুটি চুবিয়ে খাওয়ার মধ্য দিয়েই দিনটা শুরু করেছিলাম। পরে খাবারটার বাহারি একটা নাম জানতে পারি, ‘মেরসিমেক চোরবাসি’।
‘আয়া সোফিয়া’ বা ‘তোপকাপি প্যালেস’ নিয়ে নতুন করে লেখার মত কিছু নেই আর। তারেক অনু ভাই দূর্দান্ত দুটো পোস্টে ইস্তানবুলের প্রধানতম এই দুটি আকর্ষণ নিয়ে লিখেছেন।
From Istanbul, Athens |
‘আয়া সোফিয়া’র বিশালত্ব দেখে আমি মুগ্ধ। তার দেয়ালজুড়ে থাকা যিশু, মেরির মোজাইক প্রতিকৃতি; ক্যালিগ্রাফি, বিশালাকারের দরজা, বহু উপর থেকে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতি, দোতালায় ওঠার গা-ছমছমে সিঁড়ি সবকিছুই আমাকে একটা অন্যরকম অনুভূতি দিয়েছে।
From Istanbul, Athens |
From Istanbul, Athens |
অবাক লাগে, এখানে আসতে চেয়েছি কতদিন ধরে, এখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, মনেই হচ্ছেনা অত্যাশ্চর্য কিছু একটার ভেতরে বসে আছি, আবার দু’দিন বাদে অন্য ঘরে থেকে অন্য কোন শহরের জন্য মন আঁকুলি-বিকুলি করবে। ‘ব্লু-মস্ক’ এর নীচে একটা ছোট্ট বাজারের মত আছে। ওখানে গিয়ে দেখলাম সিরামিকের অদ্ভুত সুন্দর সব বাতি আর থালা-বাসন।
From Istanbul, Athens |
একটা দোকানে ঢুকে এটা ওটা দেখছি, হঠাৎ নজর পড়ল একটা কাঁচের উপর, ওতে সারি করে সাজানো অনেকগুলো দেশের মুদ্রা। সবার নীচে ঊজ্জ্বল একটা নোট। ওতে লেখা ‘পাঁচ টাকা’। মনটা খুশিতে ভরে গেল।
From Istanbul, Athens |
দোকানী হেসে বলল, ‘বাংলাদেশের এক বন্ধু আমাকে দিয়েছে ওটা। তুমি আরিফ হাসানকে চেন?’ বললাম, ‘ ভাই, আমার দেশে ১৭ কোটি মানুষ। তার মধ্যে নিশ্চয় এক লাখেরও বেশী মানুষের নাম ‘আরিফ হাসান’। ওদের মাঝে কোন সে আরিফ তোমার আরিফ সে আমি কী করে জানব?’ আমার পাশে থাকা আরিফ স্যার দেখলাম কথা শুনে হোহো করে হেসে উঠলেন।
‘তোপকাপি প্যালেস’ তুরস্কের সুলতানদের রাজপ্রাসাদ ছিল। বিশাল এলাকা জুড়ে এই প্রাসাদ। এখন অবশ্য এই প্রাসাদ রূপান্তরিত হয়েছে যাদুঘরে। একেকটা হলঘরে আছে এর বিভিন্ন দেশ লুঠ করে আনা মনি-মানিক্য। সিংহাসন। মনে হল, তুরস্ক যদি কখনও মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে তবে এই যাদুঘরের কয়েকটা হীরা, চুনি, পান্না, সোনা বিক্রি করলেই আবার সে উঠে দাঁড়াতে পারবে। আছে আব্রাহামিক ধর্মগুলোর প্রধানতম প্রবক্তা-পুরুষদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। যেমন- লাঠি, পাগড়ি, তলোয়ার ইত্যাদি। আছে তাঁদের পায়ের ছাপ, চুল কিংবা দাঁত। এসবের সত্যতা যাচাইয়ের কোন উপায় নেই। কয়েক হাজার বছর আগের পরিধেয় বস্ত্র ধবধবে সাদা আর বার্ণিশ করা চকচকে কাঠের লাঠি দেখে মনে একটু সন্দেহ জেগেছিল কিন্তু গাইড বারবার আমাদের বলে দিচ্ছিল এসব সামগ্রীর ঐতিহাসিক অস্তিত্বশীলতা নিয়ে কোনরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই সই। একপাশে গেলে চোখে পড়ে বসফরাসের নীল জল। ওপারে সূর্যালোকিত এশিয়া। সেখানে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু দেখি দালান আর দালান।
From Istanbul, Athens |
বিকেলের দিকে আমরা ট্রাম ধরে চলে যাই এমিনুনুতে বসফরাসের পারে। সেখান থেকে বাম দিকে তাকালে দেখতে পাই হালিস বা বিখ্যাত ‘গোল্ডেন হর্ন’। বসফরাসের একটা অংশ খাড়ির মতন ঢুকে গেছে শহরের অন্যদিকে। এমিনুনুর অদূরেই রয়েছে গালাতা সেতু। মজার এক সেতু বটে গালাতা কেননা তার উপরে চলছে গাড়ি কিংবা ট্রাম আর নীচে পানির উপরাংশে রয়েছে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ। মাঝখানের একটা জায়গা বেশ ফাঁকামতন যার ভেতর দিয়ে ‘গোল্ডেন হর্নে’র দিকে চলে যায় জাহাজ বা নৌকো।
From Istanbul, Athens |
সেই রেস্তোরাঁগুলো থেকে ভেসে আসে সদ্য ছিপ ফেলে ধরা এবং অতঃপর ভাজা মাছের জিভে জল এনে দেওয়া সুঘ্রাণ। মাছখেকো আমাদের মন সেই ঘ্রাণে কাতর হয়ে পড়লে ছুটে যাই রেস্তোরাঁগুলোর দিকে। কিন্তু কুর্দি বেয়ারাগুলো বড়ই বেয়ারা। আমরা বাঙালিমতে একটু দামাদামি করতে চাইলে তারা স্বরুপে আবির্ভূত হয়ে বলে, ‘ইয়াল্লা! ইয়াল্লা! গো! গো!’ আমরা তখন আর গোঁ ধরে বসে না থেকে পরবর্তী রেস্তোরার দিকে পা বাড়াই এবং একটা দোকানে দরদাম মিলে যাওয়ায় বসে পড়ি।
From Istanbul, Athens |
খেতে খেতে একটা ব্যাপার অবাক হয়ে খেয়াল করি। সেতুর উপর থেকে শ’য়ে শ’য়ে বসফরাসে নেমে পড়েছে সুতো। কী ওগুলো? বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ দেখতে পাই সে সুতোগুলোর কোনটা উঠে যাচ্ছে উপরে, সাথে করে বসফরাসের বোকা বোকা চেহারার একটা মাছ।
গ্র্যান্ড বাজারের এত নাম শুনেছি যে সেখানে না গেলেই নয়।
হাজারো রকমের সওদাপাতির পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা এখানে। অধিকাংশই স্যুভনিরের দোকান। ঝাড়বাতি, সিরামিকের তৈজসপত্র, ব্যাগ, কাপড়, মসলাপাতি, আনাজ, তুর্কি টুপি, ছবি- কী নেই এখানে!
‘তুর্কি নাচন’ বলে যে কথাটা শুনে এসেছি তা ছবিতে দেখলাম ঢের। লম্বা একটা আলখাল্লা, মাথায় ফেজ টুপি পড়ে দু’হাত বিশেষ ভঙ্গিমায় শূন্যে তুলে অধ্যাত্মবাদী সুফিরা চরকির মত ঘুরে ঘুরে বলে ‘আনাল হক’। এটাই তুর্কি নাচন। তবে নাচের এই আয়োজন এখন আর শুধুমাত্র ঈশ্বরকে ডেকে আনার জন্যই করা হয়না, নগদ-নারায়নকে ডেকে আনাটাই মনে হল এখন এই নাচের প্রধানতম উদ্দেশ্য। এখানে ওখানে প্রায়শঃই দেখা মেলে সুবেশী ছাত্ররা বিজ্ঞাপণ বিতরণ করছে, ‘ আমাদের শোতে আসুন, আমরাই ইস্তানবুলের শ্রেষ্ঠ সুফি নাচ দেখিয়ে থাকি, ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আলো আঁধারিতে ঢাকা গ্র্যান্ড বাজার যেন একটা গোলক ধাঁধা। যে পথ দিয়েই ঢু্কিনা কেন বেরুবার সময় দেখি এসে পড়েছি অন্য একটা পথে।
From Istanbul, Athens |
কাবাতাস নামের নৌঘাট থেকে এক বিকেলে চেপে বসলাম বসফরাসের উপরে ঘুরে বেড়ানো লঞ্চগুলোর একটাতে। লঞ্চের হালকা দুলুনি, সন্ধ্যের দিকে গড়িয়ে যাওয়া বিকেলের সোনালী আলো, ওপারের এশিয়া, বসফরাসের বোতল-সবুজ রঙ এসব দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে গায়ে। ‘আয়া সোফিয়া’র ভেতরে ঢুকে যে অনুভূতি হয়েছিল তা ফিরে আসে আবার। তখন গায়ে চিমটি কেটে দেখে নিতে ইচ্ছে করে সত্যিই আমি আছি কিনা বসফরাসের উপরে। কোথায় কতদূরে সে দেশ বাংলাদেশ, তার একটা অঞ্চল চট্টগ্রাম, তার গভীর ভেতরের একটা গ্রামে বেড়ে ওঠা কিশোরটি যৌবনের বিভিন্ন পথে ঘুরতে ঘুরতে এই মূহুর্তে এসে দাঁড়িয়েছে দু’টো মহাদেশের সঙ্গমস্থলে। এসব উল্টো-পাল্টা ভাবতে ভাবতেই ইউরোপে এশিয়ায় নেমে গেছে সন্ধ্যা। দু’পারের অজস্র দালানগুলোতে জ্বলে উঠেছে হলুদ, লাল, নীল, সাদা বাতি। বসফরাসের ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে আসতে থাকে রেস্তোরাঁ আর পানশালাগুলোর কোলাহল। মাঝদরিয়া থেকে দেখা যায় ঝালর-পরা নৃত্যশিল্পীর মত দাঁড়িয়ে আছে ‘ আয়া সোফিয়া’রা।
আরও একটু পর নজরে আসে পাহাড়ের উপর থেকে প্রণালীর উপর হলুদ চোখে তাকিয়ে থাকা পনেরশ শতকে নির্মিত দূর্গ ‘রুমেলি হিসার’। তার সাথে লাগানো ‘রুমেলি প্রাসাদ’।
লঞ্চ আরও এগুতে থাকে, দেখি নোনা জল এসে তার হাত বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ‘দোলমাবাসে প্রাসাদ’কে।
সন্ধ্যার আলোয় সেজে ওঠা কোন অপ্সরী যেন বসফরাসের জলে পড়া তার দীর্ঘ ছায়া দেখছে একমনে। আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পেলাম দু’টো মহাদেশকে এক করে করে দেওয়া সেতুদ্বয়ের প্রথমটিকে।
বসফরাস ব্রীজ বা বোগাযিসি কোপরুসু। তার গায়ে আলোর ফুল ফুটে আছে হরেক রঙের। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল বর্ণিল কতগুলো জোনাকী কিছু পরপর উড়ে গিয়ে বসছে সেতুর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
From Istanbul, Athens |
বসফরাসের ওপর এভাবে আরও একদিন লঞ্চে চেপে এশিয়ায় পা রেখে এসেছিলাম। এশিয়ার ইস্তানবুলে কানে আসেনি তেমন কোন শোরগোল।
ইস্তানবুলের রাতের জীবন কেমন তা দেখার জন্য শেষ সন্ধ্যায় আমরা গিয়ে হাজির হই তাকসিম স্কয়ারে। সেখানে সারি সারি রেস্তোরাঁ-পানশালা-হোটেল। এখানে ওখানে জটলা হয়ে আড্ডায় মশগুল তরুন তুর্কির দল। একটা পাথরে-বাঁধাই করা চাতালের মাঝখানে দেখলাম যুদ্ধবিজয়ের স্মারকের মত একটা কিছু। কিছু মানুষের মূর্তি। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটাই সেই বিখ্যাত মনুমেন্ট অফ দ্য রিপাবলিক। তাকসিম থেকে ফেরার পথে সেদিন আবার গিয়ে দাঁড়াই এমিনুনুতে বসফরাসের পাড়ে। দুনিয়ার কত বিচিত্র লোক। ইকুয়েডরের একটা ছেলের কাছ থেকে কিনে নিলাম সুদৃশ্য একটা বাঁশি, তাতে খোদাই করা যেন কোন আজটেক সম্রাটের মুখ। এমন সময় হঠাৎ কানে এল সিলেটি টানের বাংলা একটা বাক্য, ‘ভাইজানেরা বাংলাদেশী নাকি?’ মুখ ঘোরাতেই দেখি পাশের অন্ধকার কোনায় ভুট্টাপোড়া বিক্রি করছে এক তরুণ। মোজাম্মেলের গল্প হয়ত করা যাবে আর কোন একদিন।
মন্তব্য
সুমাদ্রিদা,
চমৎকার লেগেছে বর্ণনা। একদম জীবন্ত। ভাল লেগেছে সাথের ছবিগুলোও।
যাইবার মন চায়।
ঘুরে আসো মামুন সুযোগ যেহেতু আছে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
দারুণ পোস্ট। গিয়েছিলাম কয়েক ঘণ্টার জন্য। খুব বেশী ঘোরাঘুরি হয়নি । এখনও একটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে ইস্তানবুল নিয়ে। সময় নিয়ে যেতে মন চাই। চমৎকার একটা দেশ , সুন্দর একটা শহর এই ইস্তানবুল।
লেখা ও ছবিতে পাঁচ তারা ।
আসলেই সুন্দর শহর। ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
খুব অল্পে সারলেন! আরে ভাই ইস্তাম্বুল হচ্ছে কসমোপলিটান, এত তাড়াহুড়ো করে শেষ করলেই হবে? আবার আস্তে আস্তে লিখুন কিছু বিশেষ বিষয় নিয়ে।
প্রথম ছবিটা খুব দৃষ্টিকটু ভাবে কাৎ হয়ে আছে, একটু ঠিক করে দিন সময় করে। আর কয়েকটা ছবি ছোট আসছে অদ্ভুতভাবে!
কামাল তুনে কামাল কিয়ে ভাই- এর কামাল আতাতুর্ক নিয়ে আরও বেশী জানার আগ্রহ আছে - এই লোকের জন্য যেমন তুরস্ক জাতি এক অন্য যুগে পা রাখল, আবার ইতিহাসের প্রথম পরিকল্পিত গণহত্যা কিন্তু তারই অবদান, আর্মেনিয়ানরা মনে হয় আর কোন ব্যক্তিকে এতটা ঘৃণা করে না, যতটা তারা ঘৃণা করে কামাল আতাতুর্ককে।
facebook
ছবিগুলো ছোট আসছে কেন আমিও বুঝতে পারছিনা। আর কামাল আতার্কুক সম্পর্কে বিশদ জানতে হবে মনে হচ্ছে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অনেকগুলো ছবি ছোট হয়ে এসেছে, কারণ কী!
জানিনা। বুঝতে পারছিনা।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ধরে নিলাম এটা সারাংশ অতএব আরও কিছু আসছে...
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
সাড়ে পাঁচদিনের গল্প এতো অল্পতে সারলে কেম্নে কি? ছবিগুলো অসাধারণ এসেছে, লেখাটাও খুব ভালো লাগলো। কিছু ছবি ছোট দেখাচ্ছে।
ফারাসাত
ছবিগুলো নিয়ে আবার বসতে হবে বুঝতে পারছি।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ছবিগুলা দেখলাম শুধু। কয়েকটা ছবি এমন ছোট আসছে কেন সুমাদ্রী’দা? পোস্ট জটিল হয়েছে!
ভালো লেগেছে ।
মোজাম্মেলের কথা জানতে ইচ্ছে করছে। ছোট ছবিগুলো কষ্ট করে দেখতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।
গায়ে চিমটি কাটার বিষয়টি খুব মজার লেগেছে। সুন্দর কিছু দেখলে আমার ও এমন বোধ হয়।
ধন্যবাদ ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ছবি ও বর্ণন সুন্দর।
ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন।
ধন্যবাদ। আপনিও ভাল থাকবেন।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
লেখাটা পড়ে ভাল লাগল। ছবিগুলো চমৎকার হয়েছে।
মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান
ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
এর পরের বার ঢাকায় যাবার সময় টার্কিশ এয়ারলাইনসে করে যেতে হবে, এবং অবশ্যই কয়েক দিনের যাত্রাবিরতি
টার্কিশে একটা ছয় ঘন্টার ফ্রি সিটি টুরের প্রোগ্রাম আছে। ওটা ধরতে পারেন কিনা দেখেন।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
আরে, দারুণ, দারুণ, থুড়ি, তামাম, তামাম
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
বাহ ভালোই ভ্রমন চলছে !! এগুলো কি নতুন ক্যামেরার কাজ ?
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
না না। এগুলো তুলেছিলাম সনি সাইবার শট দিয়ে। নতুনটা ঢাকা থেকেই আসার সময় কিনেছিলাম। খবরাখবর দিও মাঝেসাঝে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
দারুন! ইস্তানবুল এখন গেলে ছবি না তুললেও চলবে - আপনার আর তারেক অণুর তোলা ছবি দেখিয়েই গল্প করতে পারব বন্ধুদের সাথে
কয়েকটা ছবি ছোট এসেছে পসিবলি ফ্লিকার সেটিঙসের ভজঘটের কারণে। মিডিয়াম ৬৪০ ইনটু ৪২৭ সাইজে এমবেড দিলে ঠিকমতো দেখানোর কথা।
ঢাকায় ফেরার সময় টার্কিশ এয়ারলাইন্সে করে যেতে হবে। এই হলো পাঠপরবর্তী মোদ্দা আইডিয়া।
বিটিডাব্লিউ, লেখাটেখা ছেড়ে দিলেন নাকি?
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন