চার অনুচ্ছেদ।

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: রবি, ২৪/০৩/২০১৩ - ৬:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

।।ক।।

বৃষ্টিতে ভিজছে মহানগরী আবিদজান। চুপিসারে আমি উঠে এলাম ক্যান্টিনের ছাদে যেখান থেকে দেখা যায় অদূরের আতিকুবের ঝাপসা টিলা,ঘরবাড়ি,রাস্তায় ছুটন্ত সাদা কার। আমাদের মাঝে আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে আছে রূপোলী লেগুন এব্রিয়ে, মাত্র ঘুম ভেঙেছে তার্। এই সকালে শান্ত বৃষ্টির মধ্যে লেগুন জুড়ে চলছে শিকার্। সাদা পাখিগুলো ভেজা ডানা ঝাপটিয়ে বেশ উঁচুতে উঠে গিয়ে হঠাত গোত্তা খেয়ে ঝাঁপ দেয় লেগুনের বুকে,তারপর আবার ভেজা ডানা ঝাপটিয়ে ঠোঁটে একটি রূপোলি মাছ নিয়ে উড়ে গিয়ে বসে কোথাও কাছে কিনারে। নীরবে বৃষ্টিতে ভিজে যায় রূপসী লেগুন এব্রিয়ে। আমার মনে হয় দূর কোন দ্বীপবাসী হয়ে আছি আমি, ঘিরে রেখেছে বৃষ্টি। আমি এরকম ভাবতে থাকি কেবলই,তাতে আমি ক্ষনিকের জন্য ভুলে যেতে পারি আমার দেশে জ্বলে যায় যে ঘরবাড়ি,মানুষজন,গাড়ি আর গোয়ালের গরু তাদের কথা। আমার মিশে যেতে ইচ্ছে করে এই মেঘগলা বৃষ্টির জলে। আমার খুব ইচ্ছে করে ঐ সাদা বকটির মত হয়ে যেতে,ভেজা ডানায় উড়ে বেড়াব লেগুনের উপর দিয়ে, চোখে চোখে রাখব চতুর মাছেদের্। আমি জানি ঐ বকেদের ডানায় কোন ধর্মের নাম লেখা নেই।

।।খ।।

উপত্যকার শেষপ্রান্তে অতিকায় দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে যে পাহাড়গুলো তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওপারে পৌঁছাতে পারলেই দেখা দেবে আরেকটি দেশ। গিনি। না জানি কেমন সেখানের ফসলের মাঠ, অরণ্যের ঘ্রাণ, নদীর মোহনীয় বাঁকে থাকা গ্রামগুলি। পাহাড়গুলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা তুরা কিশোরকে ডেকে বলি, কী খোঁজ বন্ধু আমার্। বলে সে, '' যুদ্ধে ছিঁড়ে গেছে আমার গ্রাম, একদিন ঘর ছিল ঐ পাহাড়ের অন্য ধারে, আজ আমার সেই ঘর নেই আর, মানিয়কের বাগান উপড়িয়ে চলে গিয়েছিল ওরা, পুড়িয়ে ফেলেছে আমাদের ডুগুউগুর ঘর যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় আমরা বনদেবতার উদ্দেশ্যে গান করতাম।'' সেইদুগু এরপর আমায় বলে, '' তোমার কথা বল, কোথায় তোমার গ্রাম, কোন ফুল ফোটে সেখানে? '' সেইদুগু আমিও তোমার গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছি, তাই পাহাড় দেখলেই ছলছলিয়ে উঠে চোখ।

।।গ।।

এই অরণ্য, আমি ভালবাসি তাদের। পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে তারা শান্ত কোকড়ানো চুলের মাথাওলা কিশোরের মতন। হাওয়ার গতিতে চলছিল গাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু দেখি বনানী, কাজু ফুলের গন্ধে পাগলপারা। তাদের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে সলাজ রমণীর মত বেরিয়ে এসে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় নদী এক। বান্দামা। সুনির্মল চাকমা হঠাৎ আমায় বলে, '' সার, আমার একতা মেয়ে হইসে, একতা নাম বল?'' সুনির্মলের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে গেলে আমি ওকে বলি, '' সুনির্মল, আমি তো তোমার ভাষার সুন্দরতম শব্দটা কী জানিনা? '' সুনির্মলের হাসির মধ্যে কী যে মিষ্টি একটা সারল্য আছে সেটা কীকরে তোমাকে বোঝাই। সে বলল, '' সার, আমার নামতো বাংলা, আপনি একতা বাংলা নামই পছন্দ করে দাও।'' '' আচ্ছা সুনির্মল, তোমার এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কী ভাল লাগে? '' সুনির্মল কী যে বলল, বাতাসের ঝটকা সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলে দিল অরণ্যে। '' কী বললে বুঝিনি তো? '' সুনির্মল হঠাৎ আঙ্গুল তুলে আমায় দেখাল পাহাড়ের নীচে গিনি সীমান্তে জুড়ে থাকা ইরোকোর ঘন অরণ্য। এইসব অরণ্য যাদের আমি ভালবাসি, বহুদিন আগে ভেবেছিলাম যদি কোনদিন কন্যা সন্তানের জনক হই আমি তবে তার নাম দেব আমি বনানী। কথাটা মনে আসায় হাসি পেয়ে গেল। সুনির্মলকে বললাম, '' তোমার মেয়ের জন্য আমি দিলাম আমার অনাগত সন্তানের নাম, ভালবাসার নাম। ' বনানী ' ''। সুনির্মল হেসে বলল, '' বুনানী। হোচপানা।''

।।ঘ।।

পারভেজ ভাট্টি বিকেলে আমার সাথে ঘাসের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে ভালবাসে। সারাদিন একটা বিশ্রি বিমর্ষতা জুড়ে থাকলেও বিকেলের এই সময়টায় সে উধাও হয়ে যায়। ডানের পাহাড়গুলোর মাথা থেকে গড়িয়ে পড়া গোলাপী-লাল-কমলা রঙের রোদ সবুজে মিশে গিয়ে যে অদ্ভুত ছবি তৈরী করে রাখে তার মাঝে নিজে যখন একটা বিষয় হয়ে যাই তখন ভীষণ ভাল লাগে। অঙ্গুলিমাই পাখিগুলোর মতন ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে ঘাসদানার ঝোপে। পারভেজ ভাট্টির সাথে আমার কথা বলতে একটু সংকোচ হয় কেননা আমি জানি সে পাকিস্তানি। সেও দেখি আমার সাথে কথা বলতে গেলে একটু নতমুখ হয়ে থাকে। সেদিন বলল, '' আমি পাকিস্তানি, পাকিস্তানে আমার জন্ম, কিন্তু কী জান, দেশটাকে ঘর ভাবতে পারিনা আমি আর।'' আমি বেশ অবাক হলাম হঠৎ। পারভেজ বলে, '' আমার জন্ম হয়েছিল আহমদিয়া পরিবারে। আহমদিয়া মানে কী নিশ্চয়ই তোমাকে আর বুঝিয়ে বলতে হবেনা? কিন্তু ওটিই ছিল আমাদের আজন্ম পাপ, জানো? ভাই-বোনেরা আমার আজ দেশে দেশে ছড়ানো ছিটানো। পাকিস্তান আমার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। দেশটাতে শুধুই জন্ম আমার, কিন্তু যেখানে আমার ধর্মীয় পরিচিতির জন্য আমার গর্দান রাখাই দায়, যেখানে রাতের ঘুমে আমি কেবল জ্বলন্ত মশাল আর ঘৃণাভরা চোখে আগুন দেখি, যেখানে আমার পাড়ার কিশোরটাও পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে আমাকে বলে ' সুয়ার কা আওলাদ ', ও দেশ আমার ঘর নয়।'' পাহাড়ের মাথা থেকে গড়িয়ে পড়া রোদের রঙ বদলাতে থাকে, বদলাতে থাকে পারভেজের মুখ, নিস্তব্দ হয়ে আসে ঘাসের বন।

নোট- লেখা হচ্ছে না। আসলে লিখতে পারছি না। মাঝে মাঝে ফেসবুকে কিছু উল্টোপাল্টা লিখে অনুভূতির ভার কমিয়ে দিতে চেষ্টা করি। গত কয়েকদিন ধরে লেখা এরকম কিছু টুকরো স্ট্যাটাস এসব।


মন্তব্য

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

স্ট্যাটাসটি পড়েছিলাম, তৃষ্ণা জেগেছিল পুরো লেখা পড়ার।
মিটেছে তেষ্টা।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হা, সুমাদ্রী, তোমাকে জানাই, বনানীতে বন নেই, নেই কোন অরন্য।
লেখা ভাল লেগেছে। বিষন্ন একটা ভাব ! চলুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ঐ বকেদের ডানায় কোন ধর্মের নাম লেখা নেই।

সুমাদ্রী, বিষন্ন করে দিলেন । মাঝেই মাঝেই মনে হয়, কী প্রয়োজন ছিল এই সভ্যতার ? তারচেয়ে আরন্যক জীবনই ভালো ছিল । ছিল না কোন সীমান্ত, ছিল না মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, হিংসা...

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

বন্দনা এর ছবি

মন-কেমন করা লেখা, তবু ও আমার এমন লেখাই ভালো লাগে।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনুভূতিগুলির ব্যপ্তি অনেক......

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।