মেলেনি। কোথাও মেলেনি হদিস।
প্রিন্ট মেশিনে কালি ভরতে ভরতে আফজালের কাছ থেকে খবরটা শুনেছিল সে। আফজালও কার থেকে যেন পেয়েছে খবরটা। প্রথমটায় ঘটনাটার প্রকৃতি বুঝতে পারে নি সে, মনে মনে বলেছিল, 'আম্রিকাতেও দুইটা বিল্ডিং এরম গইলা গেসিল ক বছর আগে। ক বছর আগে?' মেশিনের ঐ পাশে কাগজ কাটতে থাকা মিন্টুকে যখন আফজাল আবার উত্তেজিত হয়ে বলল, ' সাভারে বহুত লোক মইরা যাবো রে মিন্টু, পুরা নয় তলা বিল্ডিংটাই ধইসা পড়সে শুনলাম ' আর মিন্টুও যখন গলায় বিস্ময় এনে বলল, ' কী কস? বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়সে? কখন শুনলি? ' তখনই তার মনে হল সাভার মানে আম্রিকা নয়, সাভার মানে ঢাকা, সাভার মানে ঐ গার্মেন্টসগুলো যেখানের একটা্য স্বপনটা কাজ করে। হঠাৎ করেই একটা রক্তের স্রোত তীব্র বেগে তার মাথায় ছুটে যায়। গতকালই না স্বপন ওকে বলল ওদের গার্মেন্টস বিল্ডিংটায় বেশ কয়েকটা ফাটল দেখেছে সে? ' খুব ডর লাগে বন্ধু, কুনদিন যে বিল্ডিংটা ভাইঙ্গা মাথার উপর পড়ে।' স্বপনের মোবাইলে আরেফিন রুমীর গান বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে যায়। আবার ঐ গানটা বাজে। গানটা বাজতেই থাকে বারবার। 'স্বপন, ভাই আমার, ফোনটা ধর!' বলেই আর্তনাদের মত একটা চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে দিদার। আফজাল মিন্টুকে বলে, ' দোকান বাইন্ধা আসিস তুই, চল দিদার, আল্লাহ ভরসা।' আব্দুল্লাহপুর থেকে সাভারের দিকে যেতে যেতে আরও বিশ পঁচিশবার কল করেছে দিদার স্বপনের নাম্বারে। গানটা শুনলেই বুকের ভেতরে বেদনাটা আরও বেশী পাকিয়ে ওঠে। বাসের মানুষের একেকজনের মুখে একেক কথা শুনে সে। কেউ বলে পাঁচশ, কেউ বলে হাজার জন মারা গেছে স্পটেই। কেউ বলে লাশ গুম করে ফেলছে মালিক কর্তৃপক্ষ। কেউ বলে এখনও ভেতরে আটকা পড়ে আছে অনেক মানুষ। 'স্বপনরে, ভাই আমার, ভিতরে তুই আইটকা থাক অন্তত' দু'চোখ ছাপিয়ে পানি পড়তে থাকে দিদারের। আফজাল তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ' আল্লার উপরে ভরসা রাখ।' আরেফিন রুমীর গলা শোনা যায় না আর, সে জায়গায় একটা মেয়ের কন্ঠ, ' দুঃখিত,এই মুহুর্তে মোবাইল সংযোগ......'
শত শত মানুষের ভিড় দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিল ওরা। কান্না। চিৎকার। গালি-গালাজ। অভিশাপ। কাকুতি। দোয়া-দরুদ। চারপাশ থেকে অজস্র তীরের মত এরা ছুটে এসে বিঁধছিল দিদারের কানে। মানুষের ভীড় ঠেলে যতই সে সামনে এগুচ্ছিল ততই সে একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছিল ধসে পড়া বিল্ডিংটির চেহারা। নয়তলা বিল্ডিংটা এখন তিনতলার মতন সাইজে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটা তলা একটার উপর আরেকটা লেপ্টে আছে যেন। এরকমই দেখতে একটা খাবারের ছবি মনে পড়ল তার হঠাৎ করে। কয়েকটা পাউরুটির ভেতরে ডিম ভাজি, মাংস, সবুজ লম্বা একটা পাতা। একটা পেটমোটা সাদা মানুষ বিশাল হা করে পাউরুটির পিসগুলোতে কামড় বসাচ্ছে। বাতাসটা ভারি হয়ে আছে। চারদিক উড়ছে ধূলি, সিমেন্ট। গরম। মানুষগুলোর গা থেকে দরদর করে ঝরছে ঘাম। বিল্ডিংটার একদম সামনে পৌঁছে তারা দেখতে পেল এক কোনায় সারি সারি করে রাখা সব মৃতদেহ। পুরুষ আছে। মহিলা আছে। অল্প বয়স। বেশী বয়স। মাথা থেতলে গেছে অনেকের। অনেকের বিস্ফারিত চোখ ফেটে রক্তের ধারা বেরিয়ে গেছে। দিদারের মাথা ঘুরে উঠল। না স্বপন এদের মধ্যে নেই। স্বপনের মোবাইলে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না বলছে বারবার। তার মানে স্বপন পাউরুটির পিসগুলোর ভেতরে আটকে আছে। বিশাল হা টা কামড় বসানোর আগেই ওকে টেনে বের করে আনতে হবে। দমকলের লোকেরা একদিকে ছোট একটা জায়গা দিয়ে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ পরপর মানুষ বের করে আনছে। শাড়ীর উপর ছেড়ে দিয়ে মানুষগুলোকে উপর থেকে নীচে নামিয়ে আনছে তারা। জীবিত অথবা মৃত- ঊদ্ধারকৃতদের দলে কোথাও স্বপনের দেখা পাচ্ছিল না দিদার। বার কয়েক সে নিজেই ঢুকে পড়তে চেয়েছিল বিল্ডিংটার ভেতরে। আফজাল ওর হাত ছাড়ে নি। দমকলের লোকগুলোও বলছিল, ' ভাই, পাগলামি কইরেন না, ভিতরে ঢুকন যাইতেসে না, বাতাস নাই, গ্যাস জইম্যা আছে, ছাদ আবার ধইসা পড়তে পারে।'
সারাটা দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যে ওরা খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও মেলেনি স্বপনের হদিশ। জীবিত কিংবা মৃত। কাছের হাসপাতালটাও তন্ন তন্ন করে দেখেছে ওরা তিনজন। এর মধ্যে মিন্টুও চলে এসেছে। মানুষের কান্না, হাহাকার, আহাজারি, গালি-গালাজ, অভিশাপ আর দোয়া-দরুদে কারও কথা শোনা দায়।
আফজাল আর মিন্টু ওর বাসায় এসে অনেক্ষণ থেকে গেছে। আফজাল বলেছে কালও দোকান বন্ধ রেখে ওরা স্বপনের খোঁজে যাবে। ছোট টিভিটাতে কিছুক্ষণ পরপর বিল্ডিংটার খবর বলছে। মৃতের সংখ্যা বলছে। হাসপাতালের আহতদের সাক্ষাৎকার দেখাচ্ছে। দিদারের মাথার ওপর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ করে শব্দ করে ঘুরছে ঝুলে ভরে যাওয়া ফ্যানটা। থেকে থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে সে। স্বপন তার কী হয়? ভাই? ছেলেবেলার বন্ধু? না তার আত্মারই একটা অংশ? টিভির পর্দায় কিছু পরপর ভেসে আসছিল মানুষের মুখ। আহত। মৃত। নাহ, স্বপনের দেখা নেই, নিশ্চিত সে আটকে আছে ভেতরে। দিদারের মনের পর্দায়ও থেকে থেকে ভেসে উঠছিল স্মৃতি। ওফ সুখস্মৃতিগুলোও কী ভীষণ বেদনা জাগানিয়া, মর্মন্তুদ হয়! হঠাৎ শিউলির কথা মনে পড়ে দিদারের।
ঐ মেয়েটাকে দেখেনি কখনও সে। স্বপনের মুখে শোনা ওর কথা। মেয়েটা নাকি রাগী। ভাল কাজ জানে। স্বপনের চোখের দিকে সোজা চোখ রেখে কথা বলে। স্বপনকে নাকি ডাকে স্বপ্নের ফেরিওলা। আর হাসে। স্বপনের নাকি সে হাসি ভাল লাগে। দিদার স্বপনকে শিউলির কথা জিজ্ঞেস করে খোঁচা দিলে সে লাজুক একটা হাসি দিয়ে বলত, ' মনে অই সে আমারে পছন্দ করে, মুশকিল হইল অরে কইতে পারি না, কাছে গেলেই সব আউলাই যায়।' একদিন দিদার ওকে বলেছিল শিউলির জন্য একটা গিফট কিনে নিয়ে যেতে। ' আরে বেকুব, মায়ামাইনসে কি তরে এম্নে এম্নে কইবো ভালবাসার কথা? ভালবাসা জমা রাইখতে হয়। একটা গিফট কিন্যা দে, হে বুইঝা লইবো ঐ গিফটের ভিতরে তোর ভালবাসা জমা আছে।' দিদারের নিজের কোন প্রেমের অভিজ্ঞতা নেই, অথচ স্বপনকে সে এন্তার পরামর্শ দিত এ ব্যাপারে। দিদারের উৎসাহ পেয়েই একদিন সে একজোড়া ঝুমকা কিনে এনেছিল শিউলিকে দেবে বলে। ঝুমকাটা দিদারের পছন্দ হয় নি মোটেও। স্বপনকে বলেছিল, ' এক কাম কর তুই, এইটার লগে একখান চিঠিও লিখ্যা দিস, চিঠির ভিতরে কয়েকটা ফুলের পাপড়ি রাখবি, ভাল খুশবু আইব, মাইয়ারা ভালবাসার চিঠিও জমাইয়া রাখে।' কথাগুলো মনে পড়তেই দিদারের চোখ চলে যায় একটা তাকের দিকে, ওখানে হাত দিয়ে দেখে সে একটা লেফাফা পড়ে আছে। স্বপনের চিঠিটা। ভেতরে গোলাপের পাপড়িগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে। গন্ধটা আছে। স্বপন চিঠিটা দিতে পারে নি শিউলির হাতে। বাসায় ফিরে সেদিন বলেছিল, ' চিঠি দিবার পারলাম না রে দিদার, শিউলিরে বড্ড ডরাই। তয় ঝুমকা দুইটা নিছে। কইছে পচা। আর কইছে অন্য কিছু যেন না দিই অরে।' দিদার চিঠিটা খুলে দেখে। কয়েকটা মাত্র শব্দ। স্বপনের হাতের লেখা ভাল না। হয়ত এটাও একটা কারণ হতে পারে চিঠিটা শিউলির হাতে না দিতে পারার। তেমন কিছু লিখে নি সে, কয়েকটা শব্দ। ' শিউলি, আমাদের বাড়ির আঙিনায় একটা শিউলি ফুল গাছ আছিল। অরে খুব ভালবাসতাম।মিস্টি ঘেরান। শিউলি ফুল আমি ভালবাসি।' এইই।
পরদিন ভোরে আব্দুল্লাহপুর বাস-স্ট্যান্ডে খালি মানুষ আর মানুষ। আফজাল আর মিন্টু একসাথেই আসবে। সারারাত আধো ঘুম আধো জাগরণে উল্টো-পাল্টা সব স্বপ্ন দেখেছে দিদার। একবার মনে হয়েছে স্বপনের ফোনটা যেন কে ধরল, কার যেন ক্ষীণ গলার আওয়াজ এল, একবার যেন তার মনে হল সে শুনতে পেল শিউলি ডাকটি। স্ট্যান্ডের এক কোনায় দেয়ালে আঠা দিয়ে পেপার সাঁটানো। লোকজন বিনা পয়সায় এখানে খবর পড়ে। দিদারও মাঝে-সাঝে পড়ে।এগিয়ে গিয়ে শেষের পাতায় চোখ বোলালো সে। বিল্ডিং ভেঙে পড়ার খবরে পত্রিকাটা ভরে গেছে। বিজ্ঞাপণ। খেলার খবর। হরতালের খবর। বিনোদন জগতটা তার পড়তে ভাল লাগে। কিন্তু আজ আর কিছুই ভাল লাগছে না। মানুষের কাঁধের উপর দিয়ে এ পাতা ওপাতা ঘুরে ঘুরে খবরগুলো দেখছিল সে। হঠাৎ কোনার একটা ছবিতে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর যেন রক্তের একটা প্লাবন বয়ে গেল। মানুষগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ছবিটার সামনে গিয়ে সে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গেল। লোকগুলো একটু গাঁইগুঁই করবে এমন সময় তীব্র একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে, ' স্বপনরে!! ' আশে পাশের লোকগুলো মুহুর্তেই সরে গেল যেন কোথাও কোন বোমা ফেটেছে। কেউ যেন বলে উঠল, '' কী অইছে ভাই, কী অইছে?'' একটা ভয়াবহ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হাউকাউ করে কাঁদছে দিদার, লোকগুলো কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। একজন ছবিটা দেখল। বিল্ডিং ধসে পিলার পড়ে আছে একটা যুগলের উপর। ছেলেটা উপুর হয়ে আছে মেয়েটার শরীরের উপর যেন নিজ পিঠ দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছে সে পড়ন্ত ছাদটাকে যাতে মেয়েটার গায়ে আঘাত না লাগে। মেয়েটার চেহারা অস্পষ্ট। তার দু'কানে ঝুলছে দু'টো ঝুমকো। দিদার ঝুমকোফুল দুটো চেনে।
মন্তব্য
জীবন এতো ছোট....!
জীবন ছোট, জীবন বড্ড নাজুক, ভঙ্গুর।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
সুবোধ অবোধ
সাহিত্য হিসেবে দারুন হয়েছে, কিন্তু এত কষ্ট আর নিতে পারছি না।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
নাহিয়েন
এরকম একটা ছবি তো আসলেই নাকি পত্রিকায় এসেছে, সেটা দেখেই কি লিখলেন? আমি ছবিটা দেখিনি। দেখার সাহস হয়নি শুনেই। আসলেই আর নিতে পারছি না। কি অদ্ভুত ভাবে জীবন্ত মানুষ গুলো গল্প হয়ে গেল।
হুম ছবিটা দেখে মনে এসেছিল লেখাটা। হতেও পারে ঐ লোকটি ভালবাসত নারীটিকে। হয়ত তাকে বাঁচানোর জন্যই পিঠের উপর নিয়েছিল পাথরের ভার।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
উঃ, বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো!
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
সাভারে গিয়েছিলি তোরা?
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ছবিটা দেখে এত বেশী কষ্ট পেয়েছিলাম... আপনার লেখা না বলা গল্প যেন বলে গেল।
কত সহজেই সবকিছু অতীত হয়ে যায়...
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
গল্পটা ভাল---
আরো গল্প চাই বন্ধু সুমাদ্রীর কাছ থেকে
নতুন মন্তব্য করুন