সের্হিওর সাথে এ জীবনে আমার আর দেখা নাও হতে পারে। তবে নামটা মনে থাকবে বহুদিন। মানুষটার চেহারা বদলে যাবে, ক্ষয়ে যাবে। যদি কোনদিন ঘটনাচক্রে দেখা হয়েও যায় আমাদের, আমরা কেউই হয়ত কাউকে চিনতে পারব না। ততদিনে জীবন আমাদের গল্পগুলোকে বহুবিধ উপাদান দিয়ে আরও লম্বা করে দেবে।
কাকুম নামের একটা বনে দেখা হয়েছিল দিয়েগো সের্হিও লোপেজের সাথে আমার। বনটার মাঝখানে বড় বড় গাছের মাথা থেকে ঝুলছে একটা সেতু। তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নাম নাকি ক্যানোপি ওয়াক। শুভ্র চুল আর দাড়িওলা সের্হিও আমার সামনেই ছোট ছোট পা ফেলে এগুচ্ছিল। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করল, ‘ঘানায় তুমি কেন এসেছ?’ বললাম, ‘ ছুটি কাটাতে এসেছি। শুনেছি এই জঙ্গলে হাতি আছে। কপাল ভাল থাকলে সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে নীচে হাতিদের পাতা খাওয়া আর মারামারি দেখা যাবে।’ সের্হিও আমার কথা শুনে একটু হাসল, তারপর বলল, ‘ হাতি-ফাতি কিচ্ছু এখানে নেই, আমি এতবার এলাম একটা বানর দেখার সুযোগও হয়নি কখনও।’ সের্হিওর ইংরেজীতে লাতিন টান দেখে আমি জানতে চাইলাম কোথায় তার দেশ, সে কেন এল ঘানায়। সের্হিও খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘ চিলে আমার দেশ। নাম শুনেছ তুমি চিলের? সে দেশের পশ্চিমটায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়।’ ‘ হুম, আন্দিজ। তুমি নেরুদার দেশের মানুষ। সালভেদার আয়েন্দের কথা পড়েছি আমি।’ ‘বাহ, তুমি তো দেখছি বেশ খবর রাখো। আমি ঘানায় এসেছি এখানে বাকি জীবনটা কাটাব বলে। তুমি কি ভারতীয়?’ ‘ নাহ, আমি বাংলাদেশী। বাংলাদেশের নাম শুনেছো সেনিওর?’ সের্হিও টিলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল ধীর পায়ে। আমার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপ করে রইল। মনে হল যেন কাউকে খুঁজছে সে কিংবা কারো কথা মনে করার চেষ্টা করছে যাকে সে ভুলে আছে দীর্ঘদিন। সের্হিও বলল, ‘ পৃথিবীকে দেখব ভেবে একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম ঘর থেকে। সে ঘরে আর ফিরে যাই নি। আমার পরিবার, বন্ধু সবাইকে পেছনে ফেলে আমি কেবল বেরিয়েছি ঘুরে এখানে ওখানে। বাংলাদেশে গিয়েছি আমি। সুন্দরবন। চিটাগাং। একজনের সাথে কয়েকমাস আমি আমার জীবনের অসাধারণ সব মূহুর্ত কাটিয়েছি। তোমাকে দেখে তার কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু নামটা তার আজ আর মনে নেই।’ আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘ আরে, আমার বাড়ি চিটাগাং। তোমার সেই বন্ধুটি নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিল।’ সের্হিও আমাকে একটু থতমত করে দিয়ে বলল, ‘ সুন্দর ছিল সে খুব। ভীষণ সুন্দর কাল চোখ ছিল তার।’ সমকামী বন্ধু যে আমার একদম নেই এমন নয়। তারপরও সের্হিওর কথায় একটু কেন যেন দমে গেলাম। ধাতস্থ হয়ে বললাম, ‘ তোমার সেই বন্ধুর সাথে কোন যোগাযোগই কি নেই তোমার?’ শুভ্র চুলের প্রৌঢ় মানুষটি মাথা নাড়াল। ‘ একটা সুন্দর নদী ছিল সেই শহরে। সে নদীর নামও আজ ভুলে গেছি। নদীর একপাড়ে শহর, অন্যপাড়ে পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর ছোট ছোট গ্রাম। আমার মনে আছে ক্যাথলিক মিশন আমার লেখালেখির কাজে সুবিধা হবে ভেবে আমাকে জঙ্গলের ভেতরে নিরিবিলি, শান্ত একটা জায়গায় থাকতে দিয়েছিল। পাহাড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়ালে নদীর অন্যপাড়ে শহরের বড় বড় দালানগুলো দেখা যেত। জেলেদের গ্রামে তাদের মাছ শুকোতে দেওয়ার ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে। কতদিন বিকেলে আমি সূর্যাস্তের সময় সে পাহাড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সে ঐ জেলেদের গ্রাম থেকেই এসেছিল একদিন আমার কাছে শুকনো মাছ নিয়ে।’ এতটুকু বলে সের্হিও থামল। আমি ওকে বললাম, ‘ নদীটার নাম কর্ণফুলি। সেই পাহাড়গুলোর ভেতর মরিয়মের আশ্রম এখনও আছে। আমি বহুবার গেছি সেখানে। তো, তোমার সেই জেলে বন্ধুটির কথা বল।’ সের্হিওকে তখন আমার একটু বিষন্ন মনে হল। ‘ ও প্রায়ই বিকেলে আসত। আমরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে চলে যেতাম। কোন কোনদিন নৌকায় চড়তাম। আমরা কেউই কারো কথা ভাল করে বুঝতে পারতাম না। তারপরও আমার নিঃসঙ্গ মূহুর্তগুলো সে মুখর করে রাখত। একটা অদ্ভুত খেলা শিখিয়েছিল ও আমাকে। একটা ছোট লাঠি দিয়ে আর একটা ছোট লাঠিকে পিটিয়ে দূরে পাঠানো। তারপর সেই ছোট চোখা লাঠিটা দিয়ে বিঘত গোনো। এ খেলা পৃথিবীর কোন প্রান্তে আমি আর কাউকেই খেলতে দেখিনি।’ আমি মনে মনে বললাম, ‘ এ খেলার নাম ডাংগুলি সেনিওর।’ সের্হিও বলে যায়, ‘ আমার মনে আছে, একটা বড় উপন্যাস লিখছিলাম তখন আমি। নির্জনতাই চাচ্ছিলাম আমি লেখাটার খাতিরে। অথচ কয়েকটা দিন ওর সাথে কাটানোর পর লেখাটা থেকে আমার মনোযোগ চলে গিয়েছিল। প্রতিদিন বিকেলে আমি খুব অধীর আগ্রহে তার জন্য পাহাড়ের মাথায় চেয়ার নিয়ে বসে থাকতাম। অনেক দূর থেকে যখন তাকে আসতে দেখতাম ধান ক্ষেতের মাঝ বরাবর চলে যাওয়া ছোট রাস্তা ধরে, আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠত। যেদিন সারাটা বিকেল কেটে যাওয়ার পরও তার দেখা মিলত না, সেদিন আমি কিসের একটা অপ্রাপ্তিতে যেন খুব কষ্ট পেতাম। জেলে পাড়ার কোন বাড়ি থেকে সে আমার কাছে আসত কখনও গিয়ে দেখে আসি নি। মিশনের ফাদার মাঝে মাঝে পাহাড়ে এলে উনার কাছ থেকে তোমাদের ভাষাটা শেখার চেষ্টা করতাম। উহুঁ, মোটেও এগুতে পারি নি। আর মাস তিনেক পর সে প্রয়োজনটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল।’ ‘ মানে?’ ‘ কী যেন একটা কাজে আমাকে একবার নদীর অন্যপাড়ে শহরে আসতে হয়েছিল। মনে আছে, তখন খুব বর্ষা। কয়েক সপ্তাহ কাজটার প্রয়োজনেই আমাকে থেকে যেতে হয়েছিল শহরে। আমি প্রায় বিকেলেই কিছু সময় নদীর পাড়ের ক্লাবে গিয়ে কাটিয়ে আসতাম। তখন ঐ পাড়ের পাহাড়গুলোর মাথায় সূর্য্যের আলো সো্নারঙ মেখে দিলে আমার খুব মনে পড়ত আমার বন্ধুটির কথা। সে কি আমার প্রতীক্ষায় বসে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে এ সময়? সপ্তাহ তিনেক ছিলাম শহরে। তারপর নদীর ঐপাড়ে ফিরে গিয়ে পাহাড়ের মাথায় ওকে আর কোন বিকেলেই আসতে দেখি নি।’ সের্হিওর গল্পে আমি ডুবে গিয়েছিলাম। আমি একটা বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করার পর সে বলল, ‘ আমি কয়েকদিন পর নিজেই খোঁজ নিতে জেলে পাড়াটায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি লোকজন আমাকে দেখেই দূরে সরে যাচ্ছে। সবার চোখে কেমন যেন একটা রাগ কিংবা কী বলব ঘৃণা? কেউ আমার সাথে একটা কথাও বলে নি সেদিন। মঠে ফিরে এসে শুনলাম যখন আমি শহরে ছিলাম তখন জেলে পাড়ার একটা ছেলেকে কারা যেন খুন করে তার দেহটা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। আমি তখন বুঝে গিয়েছিলাম পাহাড়ের মাথায় আমার সে বন্ধুটি আর কোনদিনও আমার কাছে আসবে না। জেলেপাড়ার মানুষগুলোর চোখের সে ক্রোধের ভাষা আমি বুঝে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুটির অমন করুণ পরিনতির জন্য আজো আমার নিজেকেই দায়ী মনে হয়। আমি ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসি। আমার অর্ধেক লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা আমি নদীর পানিতে ছুঁড়ে দিয়ে এসেছিলাম। কী মনে করে কে জানে!’
সের্হিওর দু’চোখে একটা ক্ষীণ অশ্রুধারা দেখতে পেয়েছিলাম কি আমি? আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেতুর গোড়ায় এসে পড়লে গল্পটা ওখানেই শেষ হয়ে যায়। বিশাল বিশাল ইরোকো গাছের উপর ঝুলছে একটা সেতু। তার উপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পুরো সেতুটাই নড়ে উঠে। ভয় হয়। মনে হয় নীচের এই নিবিড় অরণ্যে পড়ে যাব। এত উপর থেকে পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু হবে। কেউ জানবেও না আমার শরীর পড়ে আছে কোথায় কোন গহবরে। সের্হিওর সেই বন্ধুটির মত, বা তার অর্ধেক লেখা হওয়া উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির মত কেউ আর আমার কোন খোঁজ পাবে না।
মন্তব্য
মন ভারী হয়ে গেল।
গল্প বলা হয়েছে সুন্দর করে। তবে, সের্হিওর সাথে জেলেপাড়ার ছেলেটির সমকামী বন্ধুত্ব ঘটেছিল - এমন কথা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। লেখকের অনুমান হিসেবে আভাষ দেওয়া হয়েছে। তার ফলে সের্হিওর বন্ধুত্বের সাথে জেলেপাড়ার ছেলেটির খুন হয়ে যাওয়ার যোগসূত্রটা একটু আলগা, কোনভাবে আটকে নেওয়া ধরণের লেগেছে। কিন্তু গল্প বলার ধরণ ভাল লেগেছে।
মন্তব্যে নাম দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
- একলহমা
আমার উচ্চতাভীতি সাঙ্ঘাতিক। এই লাইনগুলো পড়েও ভয় পেলাম!
ইসরাত
নতুন মন্তব্য করুন