[ স্কুলে পড়ি যখন প্রায়ই এ-বই সে-বইয়ে ঘুরে ফিরে একটা ইংরেজী বাক্য পেতাম এরকম, " Early to bed and early to rise makes a man healthy, wealthy and wise." আমি ছিলাম রোগা-পটকা ছেলে, স্বাস্থ্যবান হওয়ার জন্য কত চেষ্টাই না করতাম। বাবা'র দেওয়া দু'টাকা রোজ যাওয়া-আসার ভাড়া হয়ে টেম্পোঅলার হাতে চলে যেতো, আমি ছিলাম গরীবের গরীব। আর অংকে ছিলাম ভয়ানক। মানে ঐ কাঁচা আর কি! অংক ঢোকে না মাথায় যার সে তো গর্দভই হবে, জ্ঞানী তো বলবে না কেউ আর। আমি তাই স্বাস্থ্য, সম্পদ আর জ্ঞানের আশায় প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই ভোরে উঠে যেতাম (মা'র টানা ডাকাডাকিতে) আর প্রায়ই সন্ধ্যা গাঢ় হতে না হতেই ঘুমের কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করতাম।(এটা ছিল রাত ন'টার পর আসা স্যারের কাছ থেকে অব্যহতি পাওয়ার আমার একান্ত নিজস্ব এক কৌশল।) কিন্তু, আমার কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। শরীর বাড়ে না, বরাদ্দের দু'টাকার একচুলও বাড়ে না, মাথায় জ্ঞান বা বিজ্ঞান কিছুই ভাল ঢোকে না, ঢুকলেও কোনদিক দিয়ে যেন লিক করে বেরিয়ে যায় সব। একদিন রচনা পড়তে গিয়ে ঐ ইংরেজী লাইনটা পড়ে থাকব, স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, " স্যার, এই কথাটা কার?" সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে সেখানে উনি কী দেখলেন জানি না, আমার কানটা একটু মুচড়ে দিয়ে বললেন, " কাজের পড়ায় মন নেই, খালি বাজে প্রশ্ন করা।" অনেক বছর পেরিয়ে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আমাদের আমেরিকান লিটারেচার কোর্সে '' Poor Richard improved " নামের একটা প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে চোখে পড়ে ঐ " Early to bed and early to rise..."। আরে, কে লিখল এ কথা? ততদিনে আমিও বাসায় বাসায় ফেরি করে জ্ঞান বেচি, ছাত্র-ছাত্রীর প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজি মাথার উপর ঘুরতে থাকা বড় বড় সিলিং ফ্যানে। এবার আর উপরে না তাকিয়ে কয়েক পাতা উল্টিয়ে Poor Richard improved-শিরোনামের নীচে দেখলাম আরও একটা মানুষের নাম। Benjamin Franklin. কে ইনি? লাইব্রেরীতে গিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ঘেঁটে ভদ্রলোকের কুলুজি পড়ে জানলাম উনি যেই সেই লোক নন, আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব; তিনি একাধারে দার্শনিক, সঙ্গীতকার, লেখক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, আবিষ্কারক, কূটনীতিক আরও কত কি। মনে মনে বললাম, " নমস্য তুমি মশায়, তোমার মত হবার জন্যই বুঝি ঐ ' Early to bed and early to rise ' লেখা? সে কি আর সবার কম্মো? " ]
আটলান্টিক সিটির পাশেই এক ঘন্টা ড্রাইভ দূরত্বে থাকা শহর ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত হবার অনেকগুলো কারণের মধ্যে আছেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনও, এই শহরেই যে জন্মেছিলেন তিনি। একদিন রাতে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে পরদিন ভোরে ভোরে আমরা রওনা দিই সে শহরের দিকে যাকে আমেরিকানরা ভালবেসে ডাকে ' ফিলি ' নামে। গুগল করলে অবশ্য তার আরও একটি নাম পেয়ে যাই " The City of Brotherly Love "
ক্যাসিনোর শহর আটলান্টিক সিটি আর ফিলাডেলফিয়ার মাঝে সীমানারেখা হয়ে বয়ে যায় প্রমত্তা নদী ডেলাওয়্যার। ফিলাডেলফিয়া ঢোকার আগেই নদীর এ পাড়ে ছোট্ট শহর ক্যামডেনে আমরা যাব প্রথমে একুরিয়ামে হাঙ্গর দেখতে,
যেমনটি সবাই দেখে টিভিতে(এটা অবশ্য আমার মা'র বাসনা)। নয় লেনের হাইওয়ে ধরে ছুটে গাড়ি আর গাড়ি, কোথাও কোন বিরামচিহ্ন নেই। আমেরিকায় এসে দেখলাম কিলোমিটার শব্দটি উধাও, এখানে মাইল রাজত্ব করে মাইলের পর মাইল। দু'পাশে সবুজ কনিফারের জঙ্গল দেখি কেবল, হাইওয়েটাকে তখন মনে হয় বনের ভেতর শুয়ে থাকা একটা দীর্ঘ নীল সাপ।
ক্যামডেনে এসে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে রেখে সোজা চলে যাই এডভেঞ্চার এক্যুরিয়ামে সবাই। ডেলাওয়্যার নদীর একদম তীরে লাগানো এটি। ওপারে ফিলির বিশাল বিশাল আকাশচুম্বীগুলোর কাঁচে ঠোকর মারছে সোনালী রোদ, সে রোদ ঊচ্ছ্বল কিশোরেরর মত আবার ডিগবাজি খেয়ে লাফিয়ে পড়ছে শান্ত ডেলাওয়্যারের বুকে। নদীর ওপর আয়েশে ঝুলছে টন টন লোহার অলংকার পড়া রমনীর মত দু'টো সেতু। তাদের একটির নাম রাখা হয়েছে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের নামে। দৃশ্যটা এমনই সুন্দর যে এক্যুরিয়মে ঢোকার কথা ভুলে গিয়ে আমরা খালি একের পর এক ছবি তুলতে থাকলাম। ডেলাওয়্যারের জল কুলকুল বয়ে যায়, তাতে ডুব মারে মূহুর্মুহু সূর্য্যের সোনালী তীরগুলো।
এক্যুরিয়ামটা আসলে জলের প্রাণীদের একটা চিড়িয়াখানা। হরেক রকমের মাছ। জেলীফিশ।
ছবি তোলায় বাধা নেই। আমি সবার ছবি তুলে দেই, কত যত্ন নিয়ে ছবি তুলি, কিন্তু আমার ছবি যেই তুলে সে ছবিটায় আর আমাকে আমি খুঁজে পাই না। হায় সেলুকাস! আমেরিকায় শারীরিক প্রতিবন্দ্বীদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে কোন অসুবিধা নেই। যেখানেই যাও, আছে লিফট, হুইল চেয়ার চালানোর প্যাসেজ। আমি মা'কে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পুরো এক্যুরিয়ামটা ঘুরিয়ে দেখালাম। মাথার ওপর দিয়ে বিরাটকায় হাতুরি হাঙ্গর যখন ঘুরে বেড়ায় তখন ফুলের মত বাচ্চারা চিৎকার করে।
একটা হাঙ্গরের দাঁতের ধারালো পাটি দেখলাম।
একটা বিশেষ ডুবুরীর পোশাক পড়ে হাঙ্গরের সাথে সাঁতার কাটার একটা কেবিন আছে দেখলাম। অথচ কোথাও লেখা নেই, হাঙ্গর একটা মানুষখেকো, ভয়ংকর জলচর প্রাণী।
মাছ দেখা সাঙ্গ করে আমরা রওনা দিই নদীর অপর পারের দিকে।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সেতু পেরোতে পেরোতে শকট চালক আমার ভ্রাতা বলল, " তা, আমরা কোথায় যাচ্ছি? '' বললাম, '' সে আমি কি জানি? ডাউন টাউনের দিকে চল। উইকিতে দেখলাম ওখানেই আছে ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে বড় মিউজিয়ামটা, ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অব আর্ট।'' ভ্রাতা আমার তো চটে-মটে লাল। বলল, " কী, এতদূর এসেছি আমরা মিউজিয়াম দেখতে? " আমি বলি," মিউজিয়াম আর বাজার দেখেই একটা জাতির ইতিহাস আর রুচি চেনা যায়।" আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তখন মনে হল মিউজিয়াম-এর ঠিকানাই তো আমার জানা নেই। অতএব চুপ মেরে যাও। লুকিয়ে গুগল করে ঠিকানা বের করে জিপিএস এ ঢুকালাম। এই এক সুবিধা আমেরিকায়! ঠিকানা জানা নেই? পথ ভুলে গেছো? নো প্রবলেম, তোমাদের জন্য সবসময় সার্ভিস দিতে রেডি জিপিএসের কিন্নরীকন্ঠ। মিউজিয়ামের কাছাকাছি এসে পড়লাম আরেক ফাঁপরে। গাড়ি পার্কিং করার জায়গাগুলো সব বেদখল, আবার চাইলেই যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করা যাবে না। ভ্রাতা জানাল বড় শহরগুলোতে এই এক সমস্যা। দেখা যাবে হয়ত তোমার উদ্দিষ্ট জায়গাটি এখানে, আর তোমাকে গাড়ি পার্ক করে আসতে হচ্ছে দু’মাইল দূরে কোথাও। এবার ওখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে আসো তোমার গন্তব্যে।
বেশ কিছু সময় এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে আমরা অবশেষে সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম একরত্তির একটা পার্কিং লট। এরমধ্যে আমি দেখে ফেললাম চিবুকের উপর হাত রেখে বিষন্ন, গম্ভীর এক ভাবুক বসে আছে রোদ্যাঁ মিউজিয়ামের সামনে। এই সেই বিখ্যাত Penseur de Rodin।
মহান ফরাসী ভাস্কর রোদ্যাঁকে বলা হয় ভাস্করদের শিক্ষাগুরু, পৃথিবীর বহুদেশেই ছড়িয়ে আছে তাঁর শিল্পকর্মের ঊজ্জ্বল নিদর্শন, আমেরিকাও বাদ যাবে কেন? মিউজিয়ামের সামনের বিশাল বুলভারটি, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন পার্কওয়ে যার নাম, প্যারিসের বিখ্যাত শঁজে লিসে( Champs-Élysées)-র অনুকরনে তৈরী করা, তার দু’পাশে বীথিকা, একপ্রান্তে এথেন্সের এক্রোপলিসের মত দাঁড়ানো মিউজিয়াম অব আর্টস, অন্যপ্রান্তে সিটি সেন্টার।
দু’দিন আগেই এখানে হয়ে গেছে মেলা, কনসার্ট বা কিছু একটা। চারিদিকে দেখলাম মঞ্চসজ্জার উচ্ছিষ্টাংশ, রাস্তার দু’পাশে পৃথিবীর বহুদেশের পতাকা সারিসারি করে সাজানো।
আমাদের সাতজনের ছোটখাট দল, কারও পছন্দের সাথে কারও পছন্দের মিল নেই, আমি চাই যাদুঘর দেখতে, বাবা বলে ‘কী দেখার আছে, শুধু তো বিল্ডিং’, ভ্রাতা বলে ‘শুধু শুধু গুচ্ছের টাকা জলে ফেলে লাভ নেই’ মায় পুঁচকে দেড় বছরের সুনন্দিনিটাও কী যেন সব বলে ব্লা-গুব্লা-হুপু-হুপু করে। গ্রীষ্মের সুন্দর দিন, নির্ঝরের মত ঝরছে রোদ, অথচ এতদিন জেনে এসেছি এদেশে সারা বছরটায় শীতে কাঁপে লোকজন। মিউজিয়ামের সামনে একটা বড় গোল জায়গা জুড়ে আছে অনেকগুলো ভাস্কর্য, ফোয়ারা, কেরি করা ঘাসের লনের ভেতর দিয়ে পাথরের ইট বসানো পথ।
সেখানে গিয়ে বসলাম সবাই, ইউরোপীয় আদলে তৈরী ব্রোঞ্জ আর গ্রানাইট পাথরের সব মূর্তি, ফোয়ারা থেকে উপচে পড়ছে পানি, মাথায় পালক লাগানো এক রেড ইন্ডিয়ান চিফ অলস ভঙ্গিতে বিশ্রামরত; স্নানরতা জেলেনী, দুটো বাইসন আর দু’টো রেইন ডিয়ারকে উপর থেকে দেখছে ঘোড়ায় উপবিষ্ট ওয়াশিংটন।
পরে জেনেছিলাম এই চত্বরটাই বিখ্যাত ইকিংস ওভাল, আর ভাস্কর্যটা হল ওয়াশিংটন মনুমেন্ট।
মিউজিয়ামটায় যেতে হলে বাহাত্তরটা সিঁড়ি ঠেঙিয়ে উঠতে হবে, এই ভয়ে আর অনাগ্রহে কেউই ওমুখো হতে রাজী হল না। তারা সব ছুটল বিখ্যাত ‘রকি’র সামনে। ‘রকি’ ফিল্মটা নিশ্চয়ই অনেকেই দেখে থাকবেন, ‘রকি’(সিলভেস্টার স্ট্যালোন) ‘Gonna Fly Now’ গাইতে গাইতে সবগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে যায় একদম উপরে যেখানে পৌঁছে সে মুষ্ঠিবদ্ধ দু’হাত উপরে তুলে ধরে। সেই রকির মুষ্ঠিবদ্ধ দু’হাত উপরে তোলা ব্রোঞ্জ মূর্তির সামনে মানুষ ছবি তোলার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
বাকীদের রকির সানুদেশে ছবি তুলতে বলে আমি ভাগিনেয় প্রীতকে নিয়ে চলে গেলাম মিউজিয়ামের সামনে। কিন্তু বিধি বাম, যাদুঘরের কপাট বন্ধ। জানলাম, সেদিন কী যেন বিশেষ এক বার, সেদিন মিউজিয়ামের দরজা খোলে না। আমি কপালে চাটি মেরে ফ্রাঙ্কলিন পার্কওয়ের বুলভার দেখে মিথ্যে সন্তুষ্টি নিয়ে নীচে নেমে এলাম। ‘রকি’-র সামনে মানুষের ভীড় কমে না।
ভ্রমণে গেলে সঙ্গী যদি আপনার উল্টো রুচির হয়, তবে আপনার ভ্রমণ মাটি। রোদ্যাঁ মিউজিয়ামে ঢোকা হল না আমার। চিবুকে হাত দিয়ে বসে থাকা বিষন্ন ভাবুক আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল সারাটা পথ। আমরা ইতিউতি ঘুরলাম। ইচ্ছে ছিল ফেয়ারমাউন্ট পার্ক ধরে হেঁটে গিয়ে দেখে আসব ফিলাডেলফিয়ার দ্বিতীয় নদী শুইলকিলও। কিন্তু হায় ভ্রমণসঙ্গী!
আমি সবাইকে খুব করে বলছিলাম ফিলাডেলফিয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা; এর ওল্ড সিটিতেই আমেরিকার স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টারা লিখেছিলেন ‘ Declaration of Independence ‘; রচিত হয়েছিল আমেরিকার সংবিধান। সেখানেই আছে লিবার্টি বেল, ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি, ইন্ডিপেন্ডেন্স হল ইত্যাদি। আসলে বাকীদের পেট খিদেয় চোঁচোঁ করছিল বলে শহর দেখার কিংবা বেল-ফেল দেখার আগ্রহ আর কারও ছিল না, অথচ আমি চাইছিলাম এসবের লোভ দেখিয়ে শহরটা আরও একটু ভাল করে দেখতে। কেমন করে ছুটছে শহরটা? ‘লাভ পার্ক’ যেখানে সমকামীদের আসর বসে সেটাই বা কেমন? রিটেনহাউস স্কোয়ারে আকাশ ফুঁড়ে কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়ান লিবার্টি প্লেসের সুতীক্ষ্ণ চূড়া? আর শহরের স্থপতি উইলিয়াম পেন কেমন দেখছেন আজো শহরটা সিটি হলের চূড়ায় দাঁড়ানো তাঁর মূর্তি থেকে? আর বারবার বলছিলাম, আর কোথাও যাই বা না যাই, ম্যাজিক গার্ডেন না দেখে আমি ফিলাডেলফিয়া ছাড়ছি না।
ওকে, শেষ পর্যন্ত ঠিক হল আমরা ম্যাজিক গার্ডেনের দিকে যাচ্ছি, ওখানেই আশে-পাশে কোন রেস্টুরেন্টে বসে পড়বে সবাই এবং যাদু-বাগান দেখতে অতিউৎসাহীকে আধ ঘন্টার মধ্যেই প্রমোদ ভ্রমণ শেষ করে রেস্টুরেন্টে ফিরে আসতে হবে। ম্যাজিক গার্ডেন যাবার পথে আমরা একে একে অতিক্রম করলাম লোগ্যান স্কয়ার,
রিটেনহাউস স্কয়ার ঘিরে থাকা উঁচু উঁচু সব বিল্ডিংগুলো, লাভ পার্কের ফোয়ারা,
সিটি হল ইত্যাদি।
ম্যাজিক গার্ডেন মূলতঃ একটা মোজাইক গ্যালারী।
শিল্পী ইসাইয়া যাগার এর স্বপ্নের কলামন্দির এটি। শহরের বিখ্যাত সাউথ স্ট্রীটের বড় একটি বাড়িজুড়ে কেবল গোলকধাঁধার পর গোলকধাঁধা;
ভাঙ্গা রঙিন বোতল, সিরামিকের টুকরো, যন্ত্রাংশ, গাড়ির চাকা, চকমকি কাঁচ, টাইলস, অদ্ভুতুরে ছোট ছোট মূর্তি এসব দিয়ে নির্মিত শত শত শিল্পকর্ম,
আবার বলা যায় সব মিলিয়ে পুরো বাড়িটাই আসলে একটা শিল্পকর্মের প্রদর্শণী।
যাগার চৌদ্দ বছর একনাগাড়ে কাজ করে বিশাল জায়গা জুড়ে বানিয়েছেন অনেকগুলো সুড়ঙ্গ, গুহা, বহুস্তরের মোজাইক দেয়াল এবং বলা বাহুল্য, মসলা-পাতি বলতে সবই উল্লিখিত পরিত্যক্ত মালপত্র। ম্যাজিক গার্ডেনের বাইরেও শহরের বেশ কিছু দেওয়ালে যাগার-এর ম্যুরাল শোভা পায়।
আমার ভাগ্য ভালই বলতে হবে, বয়সে ন্যুব্জ শিল্পীর সাথে দু’টো কথা বিনিময় করার সুযোগ মিলে গিয়েছিল। যাদুবাগানের গোলকধাঁধায় নাকাল হয়ে ঘন্টাখানেক পর বেরিয়ে রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে দেখলাম মা আমার আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন এক বাঙালি মেয়ের সাথে। পেনসিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত খুলনার মেয়েটি গরমের ছুটিতে কাজ করছে এখানে। নামটা তার বেমালুম ভুলে বসে আছি।
বাইরে দুপুরের রোদ মিইয়ে গিয়ে বিকেলের হলুদ রোদ নামতে দেখে সবাই বেরিয়ে গেছি। আমি ওদের বোঝালাম, ‘এতদূর কষ্ট করে এসে যদি লিবার্টি বেলটাই না দেখা হল তবে তো আসাটাই বৃথা।’ আমরা এক জায়গায় গাড়ী পার্ক করে রেখে হাঁটতে লাগলাম। একে জিজ্ঞেস করি, ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানকে জিজ্ঞেস করি, বিজ্ঞাপণ বিলি করতে থাকা যুবককে বলি, ‘ ভাই, ইন্ডিপেন্ডেন্স হল, লিবার্টি বেল এসব কোথায়?’ তারা আমাদের পথ দেখিয়ে দেয়। সে পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে আমি দেখি শহরটা। ফুটপাতের উপর পায়ে চলার ছাপ।
অফিস থেকে বেরিয়ে পরা মানুষের ঢল। হঠাৎ করে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক পাখি। কোন দালানের এক কোনায় চোখের উপর হাত দিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা কারও মূর্তি। এসব দেখতে দেখতে ডানে-বামে যেতে যেতে একসময় পৌঁছে গেলাম লিবার্টি বেল সেন্টারে যেখানে রাখা আছে বড় একটি ঘন্টা। কী এমন বিশেষত্ব এই ঘন্টার, যার মাঝখানটা আবার ভাঙ্গা, যেটি দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এমন ভীড় করে ফেলেছে ঘরটায়?
একটা ফলকে লেখা আছে, এই ঘন্টাটি বাজিয়েই আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষনা পাঠ করা হয় ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই। পরে উইকি পড়ে অবশ্য একটু ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। লিবার্টি বেলটি নাকি প্রথমবার বাজানোর সাথে সাথেই এর মাঝ বরাবর চিড় ধরে যায়, যদিও পরবর্তীতে এটিকে বার-কয়েক সারানো হয়েছিল কিন্তু আবার কোন এক সময় বাজানোর ফলে এর ফাটলটি বড় হয়ে গেলে এটিকে সরাসরি মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত করা হয়। লিবার্টি বেলের সাথে ছবি তোলার জন্য মানুষের আগ্রহের কমতি নেই, এদিকে বেল সেন্টারের লোকজন বারবার বলে যাচ্ছে, ‘ আর মাত্র কয়েক মিনিট।’
বেল সেন্টারের বাইরেই ইন্ডিপেন্ডেন্স হল।
এটিই আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র আর মহান সংবিধানের সূতিকাগার। এখানে বসেই থমাস জেফারসন তৈরী করেছিলেন সেই ঘোষনাপত্রের খসড়া যা আজো মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য রচিত দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। যেখানে বলা আছে, ‘We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their Creator with certain unalienable Rights, that among these are Life, Liberty and the pursuit of Happiness.
ইন্ডিপেন্ডেন্স হলের ভেতরে ঢোকা গেল না বলে আমরা শহরের মানুষের সাথে পা ফেলে ফেলে হাঁটতে লাগলাম পার্কিং লটের দিকে। অদূরে ওয়ান লিবার্টি প্লেসের বর্শার ফলার মত চূড়া বিকেলের রোদ লেগে সোনায় পরিনত হয়ে গেছে। শহরের মানুষগুলো কাজ শেষে কেউ বাড়ি ফেরে, কেউ ঢুকে পড়ে পানশালায়, কেউ একা একা হাঁটে পায়ের ছাপমারা ফুটপাতের ওপর। শহরটার মনে থাকবে না আমাদের কারোর কথা, আগামীকাল তার কাছে দূর-দূরান্ত থেকে আবার আসবে নতুন মানুষ। ফ্রাঙ্কলিন সেতুর নীচ দিয়ে শান্ত বয়ে যায় ডেলাওয়্যার নদী। আবার কখনও তাকে ডিঙিয়ে এসে যদি এ শহরে আসতে পারি, তবে রোদ্যাঁর ভাবুকের চিবুক ছোঁবই ছোঁব আমি।
**** এই লেখাটায় আমি বেশ কিছু পারিবারিক ছবি দিয়েছি, আমার দাদা-বৌদি, আমার বাবা-মা, আমার ভাগ্নে প্রীত আর চৌদ্দ মাস বয়সী আমার ভাতৃষ্পুত্রী সুনন্দিনির প্রতি অশেষ ভালবাসা জানানোর জন্যও এই লেখাটা।
মন্তব্য
লেখা, ছবি, বিষয় সব খুব ভাল লাগল। এ পোস্ট মনে থাকবে অনেক কাল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ আপনাকে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
দারুণ ! এক টানে পড়ে ফেললাম।
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
ধন্যবাদ তোকে
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
খুবই ভাল লাগলো
ইসরাত
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অসাধারন, আপনি ভ্রমন কাহিনী যে এত ভালো লেখতে পারেন সেটা জানা ছিলো না। ভ্রমণের পাশাপাশি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য সব কিছুই জানানো হলো। আপনার সাথে তাই আমারও অনেক কিছু জানা হলো, দেখা হলো। আশা করছি একদিন যাবো সেখানে। পরিবারের ছবি দেখতে ভালোই লেগেছে, আপনার বাবাকে দেখলাম না। সবার প্রতি শুভেচ্ছা থাকলো। ভালোথাকবেন।
মাসুদ সজীব
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
লেখা খুব ভালো লাগলো।
অনেক কিছুই জানা হলো।
আরো এমন লেখা পাবো আশা করছি।
ভালো থাকবেন সুমাদ্রী।
শুভেচ্ছা জানবেন।
----------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ধন্যবাদ।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ওমা, আপনি তো বাচ্চা ছেলে একেবারে!! (এইরে, এই কথাটা লেখা বোধহয় ঠিক হলো না, সরি)।
লেখা ভালো লেগেছে যথারীতি।
____________________________
আপনার মুখে চন্দন,ফুল এসব পড়ুক স্যার।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ফিলাডেলফিয়া গিয়েছিলাম ২০০৯ এ, কিন্তু তেমন ঘুরা হয়নি ব্যস্ততায়। আপনার ছবি দেখে ফিলিকে চিনলাম নতুন করে, ফিলি সত্যিই সুন্দর।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩
আসলেই সুন্দর শহরটা। আমি তো তেমন কিছু দেখতে পারি নি। একদিনে আর কীই বা দেখা যায় একটা শহরের।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ম্যাজিক গার্ডেনটা আসলেই মজার, অনেকটাই খেয়ালখুশি মত বানানো। শিল্পি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ব্যবহার করেছেন যেন এখানে।
সিরিজটা ভালো লাগছে, সামনেরটার অপেক্ষায় থাকলাম।
শুভেচ্ছা
ম্যাজিক গার্ডেন দুর্দান্ত একটা জায়গা।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
আমিও যাব বড় হয়ে-
facebook
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
দোয়া রাখছি, আপানো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যান
সুমাদ্রী, যথারীতি চমৎকার বর্ণণাশৈলী আর প্রাঞ্জল উপস্হাপনা।অপেক্ষা করে থাকি সবসময় তোমার লেখা আর ছবির জন্য।।।।
নতুন মন্তব্য করুন