খেলার মাঠগুলো সব হারিয়ে যায়, কোথাও পাই না শরতে শেফালির ঘ্রাণ

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: বুধ, ১৪/০৫/২০১৪ - ২:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেশ ক'বছর আগে টিভিতে গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য্যের একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে শ্রীকান্ত বলছিলেন তাঁর শৈশবের কথা, তাঁর পিতার কথা। শহরের খুব ভাল একটা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন শ্রীকান্ত আর তাঁর বড় ভাই। কিন্তু তাঁর পিতা দেখলেন, সে স্কুলটিতে বাচ্চাদের খেলার জন্য কোন বড়, খোলামেলা জায়গা নেই, ছায়াময় গাছ নেই, ঘাসে ঢাকা মাঠ নেই। তাই শ্রীকান্তদের সেই স্কুলটিতে আর পড়া হল না। তাঁদের পিতা অন্য আরেকটি মধ্যমমানের স্কুলে দুই ভাইকে ভর্তি করিয়ে দেন যেখানে ছিল বেশ বড় একটি খেলার মাঠ আর অনেকগুলো কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। শ্রীকান্ত বলছিলেন, মাঠের সবুজ ঘাসের উপরে যখন কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো শুয়ে থাকত, সেদিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর কিশোর মন অপূর্ব আনন্দে ভরে উঠত, মনে গুনগুনিয়ে উঠত সুর। আর টিফিনের ছুটিতে বা স্কুল শেষে সারা মাঠে ছুটে বেড়াতেন বল নিয়ে, সে কী সুখ, সে কী আনন্দ! স্কুলটাকে কোনদিনও তাঁদের মনে হয়নি একটা বন্দীশালা, পড়াশোনাটাকে মনেই হয়নি একটা যন্ত্রণা। শ্রীকান্ত বারবার সশ্রদ্ধচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলেন তাঁর পিতার প্রতি, বলছিলেন খেলার মাঠবিহীন শহরের সেরা স্কুলটাতে ভর্তি না করিয়ে তাঁর পিতা তাঁকে জীবনকে ভালবাসার একটা সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

আমাদের শৈশবে বা কৈশোরে সারা শহরজুড়ে অনেকগুলো বড় খেলার মাঠ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় ছোট মাঠ ছিল বিস্তর। স্কুলগুলো ছিল বিশাল পরিসরের, সামনে ছিল খোলা মাঠ। আমরা দাপিয়ে খেলতাম স্কুলে, বাসায় ফিরে ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দু'টো মুখে দিয়ে ছুট লাগাতাম পাড়ার মাঠে। পায়ের তালুর নীচে নরম মাটি বা ঘাসের স্পর্শ আমাদের একটা শিহরণ দিত, আনন্দে উদবেলিত করত। আমাদের বিষন্নতা ছিল না কোন, আমরা পড়ালেখায় সবাই খুব বেশী খারাপ যে ছিলাম এমন নয়। সে খুব বেশী দিন আগের কথা নয়।

আমাদের বাসার সামনে ছিল বড় একটা মাঠ। মাঠের ভেতরে আবার লোহার খাঁচা দিয়ে ঘেরা দেয়া বড় একটা ফুলের বাগান। সে বাগানটায় ছিল হরেক রকমের ফুলের গাছ। আমগাছ ছিল। হাস্নাহেনা আর শেফালিও। শীত এলে শেফালি ফুলগুলো ফুটত, ভোরের কুয়াশা জড়ানো ঘাসের উপর ফুলগুলো শুয়ে থাকত, আর ফুল-কুড়ুনীর দল এসে ডালায় কুড়িয়ে নিত সব ফুল, অপূর্ব মিষ্টি একটা গন্ধে সকালটা ভরা থাকত।

মাঠে যারা খেলত তারা সবাই সবাইকে চেনে। দূরের পাড়া থেকে খেলতে আসত অনেকগুলো বন্ধু। পাড়ার কোন ঘরে সমবয়সী কোন ছেলেটা বা কোন অসমবয়সী বন্ধুটা থাকে খেলার মাঠের সূত্রে সব জানা ছিল আমাদের। ভিডিও গেমস এর দোকানগুলো তেমন টানত না আমাদের, বিকেলের মাঠের আকর্ষণ তার চেয়ে ঢের বেশী শক্তিশালী ছিল। আমাদের কারও তেমন অসুখ বিসুখ করত না, বৃষ্টিতে খুব ভিজে ফুটবল খেললেও না।

আমাদের সে খেলার মাঠগুলো সব দালানের তলায় চাপা গেছে আজ। কোথাও খেলতে দেব না কাউকে এই পণ করে শহরে নেমেছে একদল নিষ্ঠুর লোভী অসংস্কৃত মানুষের দল। খালি মাঠ দেখলেই কোথাও তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সিমেন্ট আর লোহা নিয়ে। মাঠ কমে যাচ্ছে স্কুলগুলোতেও। কোথাও কোন মাঠে শীতে ঘাসের উপর শিশির মেখে শেফালি শুয়ে থেকে গন্ধ বিলোয় না আর শহরে। স্কুল থেকে ফিরে আসা ছেলে-মেয়েদের চোখে খুশির ঝিলিক দেখি না আমি আর, ক্লান্ত আর বিষন্ন তাদের চেহারাগুলো। একটু রোদেই গলে যায় এরা, বৃষ্টিতে একটু চুল ভিজলেই জ্বরে কাবু। কিসে বিনোদিত হয় এতোগুলো প্রাণ? বোকা বাক্স আর গননাযন্ত্রে ডুবে থাকে তাদের মুখ, বিকেলের হলুদ রোদে আকাশে কোথাও কোন ঘুড়ির লেজ চোখে পড়ে না।

চারিদিকে শুধু বিশ্রি, কুৎসিত সব দালান আর তাদের ভীড়ে কোথাও মাথা তুলে দাঁড়ায় না একটা আম গাছ যার মুকুলের মৌঁতাতে শহরে ফিরে আসতে পারে মৌমাছির ঝাঁক। আমার কেবলই মনে হয়, শহরে গাছের চেয়ে দালানের সংখ্যা অনেক বেশী।

একটা প্রজন্ম এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কেউ তা খেয়াল করছে না। শেফালির গাছগুলো সব খুন হয়ে যাচ্ছে, কোন শহুরে শিশু কোনদিন জানবে না শেফালি ফুলের গন্ধ কেমন হয়- এটা ভাবতে গেলেই কষ্ট হয়।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

কোন শহুরে শিশু কোনদিন জানবে না শেফালি ফুলের গন্ধ কেমন হয়-

মন খারাপ

শিশুদের জন্য আজ বইয়ের বোঝা আর ইলেক্ট্রনিক খেলনা।
শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ আসলেই বুঝি না কেমন করে বড় হবে আমাদের আজকের শিশুরা!

মন উদাস করা দারুণ একটা লেখা --

- আনন্দময়ী মজুমদার

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আমি যে স্কুলে পড়েছি সেখানে সবুজ একটা ঘাসবিছানো মাঠ ছিল, মাঠের চারপাশে গাছ লাগানো ছিল। যে এলাকায় থাকতাম ওখানেও ছিল মাঠের ছড়াছড়ি। বড় ছোট মাঝারি কত জাতের মাঠ যে ছিল আমাদের। শহরের মধ্যে থেকেও আমরা বড় হয়েছি সবুজের মাখামাখিতে। কিন্তু আমার সন্তানদের জন্য সেই উপায় নেই। আগের সেই মাঠগুলো এখন আর নেই। এখনকার সব স্কুল মাঠহীন। বাচ্চারা কখনো সবুজ ঘাসে পা ছোঁয়াবার সুযোগই পায় না। আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠবে প্রকৃতির স্পর্শ ছাড়াই। ব্যাপারটা ভাবতে খুব খারাপ লাগে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ

মাসুদ সজীব

দীনহিন এর ছবি

পায়ের তালুর নীচে নরম মাটি বা ঘাসের স্পর্শ আমাদের একটা শিহরণ দিত, আনন্দে উদবেলিত করত।

আর এখনকার পোলাপাইনের শিহরণ যোগায় মাউস, কিবোর্ড!

অনেকদিন পর এলেন সুমাদ্রী; আপনার মত একজন ঋদ্ধ লেখকের নিয়মিত না হওয়াটা সচলের পাঠকদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অনেকগুলো ছোট্ট মফস্বল শহরে কেটেছে। সে সময়ে সবগুলো শহরেই অনেক খেলার মাঠ ছিল। পরবর্তিতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য আজ আর কোন শহরে খুব এএকটা খোলামেলা মাঠ খুঁজে পাওয়া যায়না। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ঢাকাতে অনেক এলাকাতেই মাঠ ছিল, আর স্কুলে তো ছিল বিশাল মাঠ। এলাকার মাঠ তো আগেই দখল হয়ে গেছে, আর স্কুলের মাঠ ছোট হতে হতে আর কিছুই বাকী নাই। আজকাল বেশির ভাগ স্কুল গড়ে উঠেছে ফ্লাট বাড়ির মতন করে, ফলে মাঠ থাকা তো এখনকার শিশুর জন্যে স্বপ্নের মতো।

-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত

সুমাদ্রী এর ছবি

লেখাটা পড়ে মন্তব্য করার জন্য আনন্দ দিদি, মেঘলা মানুষ, মাসুদ সজীব, দীনহীন, নীড় সন্ধানী, প্রৌঢ় ভাবনা ও অমিত- সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।

আমার চোখে কেন জানি শুধু নেতিটাই চোখে পড়ে। এই রুচিহীন, লোভী, অসৎ মানুষের দেশে খেলার মাঠের ইস্যুটা আসলে কোন ইস্যুই নয়, যেখানে যে খাবার আমরা সবাই খাই সেখানে আমরাই তো বিষ মেশাই, সেখানে আশাবাদী হবার মত কিছু চোখে পড়ে না আমার।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।