একটা জানালা প্রতিটি বিষন্ন দিনের আগে আমাকে বেঁচে থাকার মন্ত্র শিখিয়ে দেয়।
ইদানিং খুব ভোরে উঠে পড়ি, খুব ভোর বলতে অন্ধকার নয়, সবে কোমল আলোটা চারদিক আলতো করে ছুঁইয়ে দিয়ে যাচ্ছে এমন সময়টায়। খোলা জানালার কাছে গিয়ে বুকটা ভরিয়ে নিঃশ্বাস নিই। আমার সামনে একটু দূরেই তখন কৃষ্ণচূড়ার দুলতে থাকা লাল-লাল থোকাগুলোর পাশে পৃথিবীর সমস্ত পেলবতা পাতায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটা কাঠবাদাম গাছ। তখন পৃথিবীতে শব্দ বলতে শুধুই শুনি পাখির গুঞ্জন। ছোট ছোট পাখি উড়ে যায় কৃষ্ণচূড়ার লাল থেকে কাঠবাদামের সবুজে, মাঝে মাঝে উঁকি দেয় শাখায় শাখায় লাজুক কাঠবেড়াল। এই যে দেখাটা, এই শান্তি, গুঞ্জরিত নীরবতা আমার কাছে তখন একটা ধ্যানের মত। অনেক দূরে যে বাড়িটার নাম 'কালিন্দি' তার ছাদের এ মাথা থেকে ওমাথা অব্দি খুব ফর্সা এক তরুনী দেখি রোজ হাঁটে, আমাকে তিনি কখনও দেখেন না, পাতার আড়াল থেকে লুকিয়ে যে পাখিগুলো আমাকে দেখে তাদের যেমন আমি দেখতে পাই না ঠিক তেমনই।
কোথাও ভ্রমণে যখন যাই- ট্রেণে,বাসে,বিমানে,কি ফেরীতে- বেছে নিই জানালার পাশের সিট। পৃথিবী দেখাটাও আসলে একটা শিল্প- বলেছিলেন কনস্তান্তিন পাউস্তোভস্কি। দৃশ্যপট মুহুর্তে বদলে যাচ্ছে, শহর ঢুকে পড়ছে গ্রামে, গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে ঘন সবুজ বনে, বনের সবুজ দেখতে না দেখতেই ধূসর মরু খেয়ে নিচ্ছে, মরুঝড় শান্ত হলে দেখি শুয়ে আছে মায়াবী রূপোর একটা নদী।কিংবা তুলোর পাহাড়ের মত মেঘের ভেতর দিয়ে ভেসে চলা, নীচে পড়ে থাকে নাম না জানা দেশ, শহর; সুতোর মত রাস্তাগুলো দিয়ে পোকার মত ছুটছে গাড়ি, ফসলের ক্ষেতগুলোকে মনে হয় একটা জামদানি শাড়ি, রাতের আলোকিত শহরকে মনে হয় তারাভরা উলটো কোন আকাশ, নদীকে মনে হয় একটা নিঃসঙ্গ সাপ। আমাকে যাদু দেখায় জানালা।
একটা নাম ভুলে যাওয়া ছবিতে মনে আছে এক বন্দীর কথা। যে ছোট্ট খুপরির মত ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল তাকে তাতে বাতাস চলাচল করার জন্য ছিল একটা ছোট্ট ছিদ্র।তাতে চোখ দিলেই ওপারে দেখা যেত মস্ত বড় এক আকাশ। ভোরের বেলা শান্ত সবুজ তার রঙ, দুপুরে নীল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার আগ পর্যন্ত সে কী রঙের খেলা! সে আকাশে দেখত সে ডিগবাজি খেয়ে খেয়ে উড়ে যায় পাখিরা, লম্বা সাদা ধোঁয়ার রাস্তা বানিয়ে অনেক উঁচুতে উড়ে যায় রকেট, চাঁদ ওঠে-বিচিত্র সব চাঁদ, নক্ষত্র ছুটে গিয়ে অনন্ত অন্ধকারে হারিয়ে যায়, হীরকমাল্য হয়ে ওরা অদৃশ্য কালো রমণীর গলায় ঝিকমিক করে; বৃষ্টিদিনে সে আকাশে চমকে ওঠে বিদ্যুৎ, কখনও অন্য কোন সুন্দরী ঋতুর ডাকে কোথা থেকে এসে হাজির হয় পাণিপ্রার্থী সাদা সাদা কোকড়ানো মেঘের যুবকেরা। বছরের পর বছর এই ছোট্ট জানালা বন্দীটিকে বাঁচিয়ে রাখে, সে কবিতা আওড়াতো, অনুচ্চ স্বরে গাইত গান; তারপর একদিন সে মুক্ত হয়ে ফিরে আসে যখন তার শহরে, হাতে তুলে নেয় সে তুলি আর রঙ আর আঁকতে থাকে তার বন্দীজীবনের সেই ছোট জানালা দিয়ে দেখা সমস্ত যাদুর ছবি। সেই ছবিগুলোর নীচে সে জুড়ে দেয় এক একটি কবিতা।
দু'টো চোখ আমার মনের জানালা। সেই জানালা দিয়ে মনের কাছে প্রতিমুহুর্তে পৌঁছে যাচ্ছে বেঁচে থাকা বা মৃত হয়ে যাওয়ার রসদ। আমি ভীষনভাবে বেঁচে থাকার পক্ষের মানুষ। সারাটা দিন এই শহর তার সমস্ত ক্রুরতা, মূর্খতা আর ঘৃণা দিয়ে আমাকে পিষে ফেলে। আমাকে ক্লান্ত করে, হতাশ করে। তবু আমি বেঁচে থাকি এই বিষাক্রান্ত শহরের মাঝে। ঐ বন্দী লোকটির মত আমি শুধু অনুচ্চ স্বরে গান গাই, কবিতা পড়ি আর মনের জানালা দিয়ে দেখি কৃষ্ণচূড়ার লাল লাল থোকা দুলছে, পৃথিবীর সমস্ত মসৃণতা নিয়ে কোমল হয়ে আছে একটি কাঠবাদাম গাছ যার ডালে ডালে উড়ছে অচেনা সব ছোট ছোট পাখিরা, দূরে যে বাড়ির নাম 'কালিন্দি' তার ছাদে খুব দ্রুতলয়ে হাঁটছে খুব ফর্সা একজন নারী, লাজুক কাঠবেড়ালের লেজ দেখে আমার মনে পড়ে যায় শৈশবে বর্ণমালায় আরও একটি বর্ণ ছিল ' ৯'(লি)।
গান শুনুন।
মন্তব্য
অ সা ধা র ণ!
প্রথম পাতায় ছবিটা ডান দিকে বেরিয়ে গেছে। ঠিক করে দেওয়া যায়?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দেবদ্যুতি
অসাধারন....
আর্য
এই শহরে নিজস্ব একটা জানালা ছাড়া বাঁচা বড় কঠিন।
খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
স্বয়ম
সুমাদ্রিদা, । খুব প্রিয় একটা গান। সাথের ভাবটুকু অসাধারণ হয়েছে। অনেক সৃতি মনে উকি দিচ্ছে।
অনেক দিন পর লিখলেন।
খুব ভাল লাগলো।
পড়ে খুব ভালো লাগলো। (সুপম রায়)
খুবই চমৎকার।
ছবিটার দরকার ছিল কি?
..................................................................
#Banshibir.
বাসে আমিও সাধারণত জানালার ধারের আসন বেছে নেই। কানে গান গুঁজে বাইরে দেখতে দেখতে যাই। ছোট ছোট অসংখ্য গল্প পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাই...
চমৎকার
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
অনেকদিন পরে আপনার লেখা পড়লাম। ভাল লাগলো, বরাবরের মতই। দেখা আর তাকানোর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। আমরা অধিকাংশই তাকাই, দেখিনা। আপনার সেই দেখার চোখটি আছে।
আমারও অমনই একটা জানালা ছিল। জোসনা রাতে বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকতাম। মানুষের অবহেলায় অভিমান করেই বোধহয় চলে গেল!
[img]DSCN0024 by Kabir Ahmed 26, on Flickr[/img]
ধীর, বিষণ্ণ এবং সুন্দর...
অঞ্জনের এই গানটা আপনি গিয়েছিলেন। য়্যুট্যুবে আমি শুনেছিলাম। এই গানটা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে শুধু দু'একটা শব্দ বদলে দিয়েই প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন