আম কোয়নিগস্ প্লাৎস্ :::: ৪

সুমন চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন সুমন চৌধুরী (তারিখ: বুধ, ০৮/০৪/২০০৯ - ১০:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব ৩

সোহাগের বাসার প্রধাণ আকর্ষন বারান্দা। হেসেন প্রদেশের উত্তর সীমান্তের এই ছোট্ট শহরটার দারুন একটা ভিউ পাওয়া যায়।

- আরে কেইজে বীয়ার আছে আরো চোদ্দটা। আইজকা গজব টানা টানুম।
- সাবাশ

দুই বোতল বীয়ার হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সোহাগ আর মাকসুদ।
- প্রোস্ট! (চিয়ার্স)
- শুভ বেকারত্ব !

দুই দোস্ত চুপচাপ বীয়ার টানে। সোহাগ একটা মার্লব্রোর প্যাকেট খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করে,

- কী ভাবোস?
- ভাবতাছি আবার যদি মুরগীর ফার্মে পাঠায় তাইলে কী হৈবো...
- যাইতে হইলে যাবি!
- আগেরবারের কথা মনে নাই। ঐখানে টিকা যাইবো না। দুই দিন উর্ধ্বে তিন দিন তারপরেই অন্যকাম ধরা লাগবো।
- নাও লগতে পারে। হয়তো এইবার গিয়া দেখবি মুরগীতেই প্রাপ্তিযোগ।
- তোর মনে আছে সেইবারের কথা? কী নাম জানি হালার?....ইয়র্ন। কুত্তার মতো খেউ খেউ করতো। তোর আর আমার একলগে চাকরি গেলো।
- এইবার হয়তো গিয়া দেখবি হালায় রিটায়ার করছে।
- বাদ দে এইসব। যেইখানেই হোক যামু।
- তোর প্রোজেক্টের কী অবস্থা?
- চলতাছে। গতকালকেও বাইর হইছিলাম ফিল্ডওয়ার্কে।

টিশার্ট খুলে তোয়ালে কাঁধে চাপিয়ে সোহাগ বলে,
- তুই থাক আমি একটু কাউয়া গোসল দিয়া আসি।

বারান্দা থেকে শহরের দিকে তাকায় মাকসুদ। কাসেল। হাতের বাঁয়ে ভেলহাইডেন, মাঝে কির্শডিটমল্ড, মধ্যডানে হার্লেস হাউজেন, তারপর নর্ড স্টাডট একেবারে একশ আশি ডিগ্রীতে ফিলিপিনহফ। এই পুরো শহরটা তার নখদর্পনে। দ্বিতীয় সেমিস্টারে কাজের খোঁজে এই শহরের কোনায় কোনায় ঘুরতে হয়েছে। খবরের কাগজ বিলি করেছে কাকডাকা ভোরে, পিৎসার দোকানের বিজ্ঞাপন বিলি করেছে প্রায়ই। এই কাজটা এখনো পায় মাঝে মাঝে। সেও আরেক নাটক। একেকটা কাজ একেকটা উপন্যাস। নাকি ছোট গল্প? নাকি নাটক? হবে একটা কিছু। তবে প্রবন্ধ কোন অবস্থাতেই না। প্রবন্ধ এগোয় একটা নির্দিষ্ট মেথাডে। জীবনের একেকটা ঘটনা কয়েক খাবলা করে মেথাডের জন্ম দেয়।

লেখালেখির অভ্যাস থাকলে এতোদিনে কতগুলি বই থাকতো বাজারে? লাইন ঘাট কম তাই বাজারে হয়তো থাকতো না, অন্তত খাতায় তো থাকতো! এই সব বিপদের মুখে তাতে অন্তত একধরনের ক্যাথারসিস পাওয়া যেতো।

ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল কিশোর বয়সে। প্রতিদিনের অর্থহীন কথাবার্তা টুকে রাখতো। ইন্টারমেডিয়েটের সময় ছেড়ে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে কিছুদিন কবিতা লিখেছে। কবিতার জ্বর বেশীদিন থাকে না। বিশেষ করে কবি যখন নিজে তার সৃষ্টির কাব্যগুণ অনুমোদন করতে পারে না তখন। এরপর ভেবেছিল প্রাবন্ধিক হবে। তা অবশ্য একভাবে হয়েছে। প্রতিটা সেমিনার রিপোর্ট একেকটা প্রবন্ধ।

শেষটানে ফিল্টারের খানিকটা পুড়লো। মুখে একটা বিশ্রী তেতো স্বাদ। সাতটার মতো বাজে। বাইরে এখনো গনগনে রোদ। রাত দশটা পর্যন্ত কমপক্ষে থাকবে। ইউরোপের গ্রীষ্মকালের এই বিষ্ময় মাকসুদ বরাবর উপভোগ করে। সোহাগটা গোসলে কতক্ষণ লাগাবে কে জানে? বলে গেলো কাউয়া গোসল দেবে এখন সেটা জলহস্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

- ঐ হালা কতক্ষণ লাগাবি?
- - তুই বীয়ার খাইতে থাক। আমি আর দুই মিনিট।
- কয় ঘন্টায় দুই মিনিট হয়?
খ্যাক খ্যাক হাসির শব্দ আসে। প্রাণভরে আরো গোটা কুড়ি গালি দিয়ে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মাকসুদ।

- মোকসেদ !
- কি?
- তুই ফোন দে সবাইরে। আইতে ক এইখানে।

একে একে সাতটা ফোন করে মাকসুদ। কাজল ফ্রাংকফুর্টে, ফেরদৌস ফোন ধরে না, আরিফের কী জানি কাজ আছে, বিমল আর মঞ্জুর কামলা আছে, টোকনের ভাল্লাগতেছে না আর টুনি কৈজানি একটা পার্টিতে যাবে। অর্থাৎ কেউই আসবে না।

- তাইলে আমিও যাইগা।
মাথা মুছতে মুছতে সোহাগ বলে,
- কৈ যাবি এখন?
- ঘুমামু।
- এখন ঘুমাইলে রাইত তিনটায় উইঠা বইসা থাকবি। তার থিকা রান্দাবাড়া করি। মালমুল খাই। টাল হই। গালগপ্প করি।
- ঐ তো করলাম সারাজীবন।
- বাকি জীবনে কি তোর আসলে আর কিছু করার প্ল্যান আছে? আমার কিন্তু নাই।

মাকসুদ ঠা ঠা করে হাসে। হাসির কথা ছাড়া হাসতে পারাটা একটা ক্ষমতা। মাকসুদের এই ক্ষমতা আছে। সোহাগেরও আছে। ওদের দোস্তি টিকেও আছে সম্ভবত এই কারণে।

- একটা কোন প্রোডাক্টিভ আড্ডা দিতে হবে।
- আনপ্রোডাক্টিভ আড্ডা বইলা কি কিছু আছে?
- প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে আছে। যেমন ধর, কাঠিবাজি...
- এইটা তো খুবই প্রোডাক্টিভ ব্যাপার। এইখানে মানুষ তার ক্রিয়েটিভিটির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে।
- তা করে কিন্তু সেগুলি, মানে যেগুলি বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় হয় আর কি, তার সবই নথিবর্হি:ভূত নিয়মিত টাইম পাস অথবা ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঝাড়া।
- নথিভুক্ত কোনগুলি?
- পলিটিক্যাল কন্সপিরেসী মানে প্রাতিষ্ঠানিক দলীয় রাজনীতির অর্থে....আর এর বাইরে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদির আলোচনা....
- আমার তো মনে হয় কোন কাঠিবাজি বা গীবতই অপ্রাতিষ্ঠানিক না। নথিভুক্ত হওয়ার যোগ্যতার বাইরেও না।
- তা ঠিক। কিন্তু মনে কর আজকে আমরা যদি টুনি কোথায় কোথায় কার কার সাথে ঘুরে, সেইখানে কী করে তারপর কাজলের বৌ এতো দেমাক দেখায় ক্যান কিংবা দুলাল ভাই কেমনে কেমনে রোকন ভাইয়ের জার্মান বৌ নিয়া ভাগলো তারপর সেই বৌ আবার কবে কীভাবে ঐ আফগান মস্তান দিয়া দুইজনরে একলগে ধোলাই দিয়া সেই মস্তানরে বিয়া কইরা কৃতার্থ করলো....এই সব আলাপের ড্রামা একধরনের সাময়িক আনন্দ ছাড়া আর কিছু দেয় না সেইভাবে। সোজা কথায় টাইম পাস বা টাইম নষ্ট।
- ভুল কইলি। তোর হিসাব মতো সাহিত্য চর্চাও ঐ একই তালিকায় পড়ে।
- কেমনে?
- কারণ একটা উপন্যাস বা গল্প বা কবিতা বা নাটক শেষ পর্যন্ত একটা সাময়িক অনুভুতি ছাড়া কিছুই দেয় না। আমরা যেইটারে সমাজবোধ বা জীবনবোধ বলি সেইটাতো আসলে অভিজ্ঞতা বিনিময় থিকা আসে। সেইটা রেকর্ড রাখা বা তোর ভাষায় নথিভুক্ত বিনিময়ের বাইরে এইসব কাঠিবাজি, গীবত, ছিদ্রান্বেষন থিকাও হয়। যে কোন ধরনের বিশ্লেষনেই তো কোন না কোনভাবে ইন্টেলেক্টের ব্যায়াম হয়....
- হয় মানলাম। কিন্তু তার প্রয়োগের সম্ভাবনা তৈরী হয় বিশ্লেষিত অভিজ্ঞতাগুলি রেকর্ড কইরা আরো অন্য আরো বৃহত্তর অভিজ্ঞতার সাথে তুলনার জায়গায় গেলে। নাইলে আর কথা সাহিত্যের দরকার কী?
- তো কথা সাহিত্য আসে কৈত্থিকা? অভিজ্ঞতার বাইরে কী কল্পনা সম্ভব না কি? যেইসব ইন্টেলেকচুয়ালরা খাজুইরা প্যাচালের বিরোধীতা করে তারা আসলে চিন্তাপদ্ধতির মনোপলি ধইরা রাখার জন্য এগুলি করে।
- তুই এগুলা কী কস্ ! বীয়ার তো খাইলাম আমি!
- আমার টাল হৈতে মাল লাগে না। আমি এমনেই টাল। মাল খাইলে সেইটা একটু তরতাজা থাকে এই আর কী ।
- খিদা লাগছে বাল। আগে রান্ধাবাড়া কইরা খাইয়া লই। তারপর দেখুম প্রোডাক্টিভ আড্ডা কেমনে মারে ...
- যাক শেষ পর্যন্ত তাইলে কিছু একটা মারার লাইনে আইলি
- হ....

(চলবে)


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

চলুক। চলুক

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

এমন আড্ডা এত্তো অল্পে শ্যাষ!!!

সুমন চৌধুরী এর ছবি

শেষ না গো দাদা ! শুরু কৈতারেন দেঁতো হাসি



অজ্ঞাতবাস

ফারুক হাসান এর ছবি

থামলে খবর আছে
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

নাহ, পড়া বন্ধ করে দিলাম এই সিরিজটাও। এক টানে চার পর্ব পড়লাম। অপেক্ষা করে থাকা বড় কষ্টের। দারুণ হচ্ছে, বদ্দা। বই/ই-বুক আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রইলাম।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ইনফর্মেশন টেকনোলজির প্রসারের সাথে সাথে অদূর ভবিষ্যতে একটা ইনফো বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আছে। দেখা যাবে ইনফো সমুদ্র থেকে কামের ইনফো বের করাই টাফ হয়ে পড়ছে। ভাবতেছিলাম একটা দিনলিপি লিখুম। নামও ঠিক করেছিলাম "মন্দার দিনলিপি"। মনে মনে প্রথম দুই পর্ব লিখেও ফেলেছিলাম, টাইপ করাটাই যা বাকি। পরে ইনফো বিস্ফোরণের চিন্তা মাথায় আসলো। দিনলিপির প্ল্যান বাদ দিলাম। শালার দুইদিনের দুনিয়া, আঁচড় রেখে গিয়ে কোনো লাভ নাই। পরে যারা আসবে, তারা আমার অভিজ্ঞতা থিকা শেখা বুলি না নিয়া ভার্জিন অভিজ্ঞতাই লাভ করুক।

মাকসুদের দিনলিপি তবু চলুক, কাউকে না কাউকে তো চলতে হবেই।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ভার্জিন অভিজ্ঞতা আসলে সম্ভব কি না সেইটাও ভাইবা দেখতে হবে। যে কোন রেকর্ডেড তথ্যই (অভিজ্ঞতা অর্থে) এক এক ধরনের দিনলিপি। আবার যেগুলি অলিখিত সেগুলিও কিন্তু অবিরাম বিনিময় হইতেছে। শুধু তড়িকায় পার্থক্য।



অজ্ঞাতবাস

সবুজ বাঘ এর ছবি

বেশি প্যাছাইতাছো না তো? ঘ্যাছাঘ্যাঝ মারো.............খালি ঘ্যাছা ঘ্যাছ............

সুমন চৌধুরী এর ছবি

না প্যাচাইলে কি আর চৈনিক ফুদ হয়?



অজ্ঞাতবাস

সবুজ বাঘ এর ছবি

জগা বাবু কি খিছুরি প্যাছিয়া রানছে? রাজকুমার কি সাত্ত্বিক খিছুরি সত্যই রানবার পারে? অনেক প্রশ্ন কিন্তু উত্তর রাজকুমারো জানে না। তার মানে কি? তার মানে হইতাছে, প্রশ্ন প্রশ্নর মতো থাকপো, উত্তর দক্ষিণের মতো থাকপো না। খালি পাক পারবো। বাংলাদেশ কি একটা বিজ্ঞানভিত্তিক দেশ?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

পুরা।

যারে কয় বিজ্ঞানী ফিউজিটিভ।



অজ্ঞাতবাস

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আলাপটা কঠিন লাগতেছিল...

ডেইলি সোপ হিসাবে আকারে আরেকটু ছোট করে জায়গামতো থামাইতে পারেন। এইটা বদ্দা পারবেন, আমি জানি চোখ টিপি

সিরাত এর ছবি

অসাধারন লাগলো। এমন ন্যাচারাল ভাষায় লিখেছেন, ফিকশনই মনে হয় না। আর প্রবাসের সেই স্বাদটাও আছে। ধন্যবাদ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।