সে যাই হোক। এরশাদের কথা বলতে টাইপ করতে বসি নাই। বলছিলাম প্রভাতফেরীর কথা। কেমন করে যেন ১৯৮৩'র পরে ১৯৯৫ এর আগে আমার আর কোন প্রভাত ফেরীতে যাওয়া হয় নাই। বইমেলাতে যেতাম প্রতি বছরই। কিন্তু ঐ ভোররাতে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া হয়ে উঠে নাই। ১৯৯৫তে আমি আর আমার আরেক খালাতোভাই ভোররাতে বেরিয়ে ফজলে রাব্বি হলের উল্টোদিকের সারারাত্রির হোটেলে পরোটা-ভূনা মাংস সাঁটিয়ে পলাশী দিয়ে ঘুরপথে ছায়ানটের অর্থাৎ ইউল্যাব স্কুলের সামনে চলে আসি। সুজন'দা তখন রীতিমতো ছায়ানটের ক্যাডার। ওদের সার্কেলের সাথে আমিও ক্রমশ মিশে যাচ্ছিলাম তখন ছায়ানটের ছাত্র না হয়েও। ওরা প্রায় সবাই আগের রাতে বিভিন্ন হলে থেকেছে। ভোরবেলা সবার চোখমুখ ফোলা ফোলা। ছয়টা সময় দেওয়া থাকলেও মোটামুটি বড় একটা সমাবেশ হতে সোয়াসাতটার মতো বেজে গেল। তারপর প্রথমে "একুশে ফেব্রুয়ারী" তারপরে একেরপর এক গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে ফুলার রোডের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম শহীদ মিনারের দিকে। পাক্কা সাড়ে চার ঘন্টা লেগেছিল সেদিন। এর মধ্যে জগন্নাথ হলের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তিন ঘন্টার বেশী। গণনাট্য সংঘ আর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অতোগুলি গণসঙ্গীত এর আগে আর কখনো একসাথে শোনা হয় নাই। সেই গানের টানেই থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত প্রতিবছর একুশের ভোরে যেকোন পরিস্থিতিতে ছায়ানটের প্রভাত ফেরীতে উপস্থিত থাকতাম। একই বছর ভর্তি হয়ে যাই ছায়ানটে। তবলায়। তবলাটা আসলে একটা উছিলা ছিল। আসল উদ্দেশ্য গাবরের মতো গান শোনা।
১৯৯৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রমজানের ঈদ পড়েছিল। সুজন'দার গায়ে সেদিন প্রচণ্ড জ্বর। প্রতিবছর প্রভাত ফেরীতে আসেন এরকম অনেকেই গাঁইগুঁই করছিল। পার্থদা নানারকম চিন্তুভাবনা করে সকাল সাতটা টাইম দিলেন। আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমরা হলাম সবমোট সতেরজন। কোথাও কোন ভিড় নাই। একটু পর পর আমাদের মতোই ছোট ছোট মিছিল এসে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে যাচ্ছে। সকাল নটার আগেই সব শেষ করে বই মেলায় উঁকি দিলাম। লোক যে নেই তা না। অত নেই। তখন সপ্তাহখানেক আগে খালেদা জিয়া ২য় দফা নির্বাচিত হয়েছেন মোটামুটি একদলীয় নির্বাচন করে। তারপর বইমেলার শুরুতেই জগন্নাথ হলে সেই পুলিশী তাণ্ডব সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যে খুব শান্ত ছিল তাও বলা যায় না। তারপরেও ঈদের প্রভাবটা ছিলোই। মেলার ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা ভরাতে সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত মেলায় পড়েছিলাম।
একুশের আগের রাত এরপরে আরো অনেকগুলি চলে গেছে। আজকে সন্ধ্যা থেকে ভালো লাগছে না। চোখের সামনে আশি আর নব্বই দশকের ঢাকার পথঘাট দেখতে পাচ্ছি। গানগুলি বাজছে। চিরতরুণ ওয়াহিদুল হক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সব চেনামুখগুলি সেই সমাবেশে দেখতে পাচ্ছি।
মন্তব্য
হুম, ওয়াহিদ কাকার কথা খুব মনে পড়তেছে, মনে পড়তেছে ওয়াদুদ ভাইয়ের কথা অতক্ষণ হারমনিয়াম গলায় ঝুলায়া গান গাইতে আর কাউকে দেখি নাই, পার্থ'দা থাকতো, সুমন'দা, শাকিল ভাই পরের দিকে মিতা আপারা আসতো তবে অনিন্দ্য সব সময় থাকতো।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
আশির দশকে আমরাও আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম। এরশাদের শাসন শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ছাত্রদের তুমুল প্রতিরোধের সেই দিনগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন আর ঝাঁঝালো মিছিলের রেশ ছড়িয়ে পড়তো কাছাকাছি জায়গাগুলিতেও। আজিমপুরের বাসার বারান্দা থেকে প্রায়ই দেখতাম ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া করে ঢাল আর বন্দুক হাতে কলোনির ভেতর ঢুকে পড়েছে দাঙ্গা পুলিশ, কখনো কখনো সেনাসদস্যরাও। শুনলাম ছাত্রদের মিছিলে উঠে পড়েছে পুলিশের ট্রাক, মারা গেছেন সেলিম-দেলোয়ার।
আজিমপুরের বিভিন্ন রাস্তা ধরে ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে শুরু হতো প্রভাতফেরী। সবাই খালি পায়ে হাঁটছে, ছোট বয়সে কতোটা যে অভিভূত হতাম এমন দৃশ্য দেখে। ফুল হাতে খালি পায়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে শহীদ মিনারে যেতে কতোটা যে ভাল লাগতো। শহীদ মিনার, ২১ ফেব্রুয়ারির সকাল, সেই অনুভূতি, সেই প্রভাতফেরী, সেই বিশেষ গান সব একই রকম আছে এখনো। আর জানি যে তা চিরকাল একই রকম থাকবে।
যদিও অনেক কিছুই হয়তো আর আগের মতো নেই। আশির দশকের ছাত্রদের সেই সাহসী চেতনা আজ কেন যেন চারপাশে তাকিয়ে অনেক দূরের জিনিস মনে হয়। এই সমাজে বাণিজ্যিকীকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলার আগ্রহের কাছে সেই চেতনাকে চর্চা করার, মনে রাখার প্রয়াস আজ হয়তো আর দরকারী নয়। আর তাই হয়তো সেলিম-দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়া, জয়নাল-জাফর-দীপালী সাহা আর নূর হোসেন কেন প্রাণ হারিয়েছিলেন তাও অনেকেরই মনে থাকে না, মনে থাকলেও তা নিয়ে তারা ভাবতে আগ্রহী নন। আশেপাশে তাকালেই আমাদের সমাজের এই বিস্মৃতি চোখে পড়ে।
দায়ী বদলে যাওয়া সামাজিক পরিবেশ; আর পরিবেশের বদলে যাওয়ার জন্য দায়ী এই সমাজে যারা বাস করেন তারা; আমরা।
ভাল লাগল
অনেকদিন যাওয়া হয়না প্রভাতফেরিতে।
একুশের শুভেচ্ছা।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
লেখা ভালো লাগলো। অনেক বছর পর গতরাতে আমাদের বাংলার বাউল শিক্ষা নিকেতনের শ্রদ্ধার্ঘ নিয়ে খুলনা শহীদ মিনারের গিয়েছিলাম রাত ০০০১টায় লাইনে দাঁড়িয়ে। মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে গিয়েছে এবং প্রভাত ফেরীতে যাওয়ার শখ একরকম মিটেই গিয়েছে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
জীবনে একবারই আসল প্রভাত ফেরি করেছিলাম। আবার কবে সুযোগ পাবো।
১৯৯১ সালে প্রথম গিয়েছিলাম বাবার হাত ধরে, টবের গাছে ফোটা প্রথম এবং একমাত্র একটা গোলাপ হাতে নিয়ে। তখনকার বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাও একই সময়ে হাজির হওয়ায় ধাক্কা দিয়ে আমাদের শহীদ মিনার থেকে সরিয়ে দিয়েছিল বলে বেদীতে আর সেই ফুল দেয়া হয়নি। ভেক ধরা দেশপ্রেমিকদের ভিড়ে আর যেতে ইচ্ছে করে না, দূর থেকেই তাই শ্রদ্ধা জানিয়ে যাই।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
কী সুন্দর স্মৃতিকথা... এখন কেমন রাত তেরটার বাতিক উঠেছে, আজব! আর কেন জানি না ভেক ধরা সিজনাল দেশপ্রেমিকদের ভীড়ে যেতে ইচ্ছা করে না, আজকে সকাল ঘুমিয়ে কেটেছে...
স্মৃতিকাতরতার কারণে হলেও বদ্দার লেখা নিয়িমিত বিরতিতে দুই-একটা এসে পড়াটা ভালো লাগছে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
আপনার লেখার সে কী স্বাদ, আহ!
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
অভিজ্ঞতা ভালো ছিলোনা আমার, তারপরেও হয়তো আরেকবার যাবো একদিন...
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
নতুন মন্তব্য করুন