আলোকের এই ঝর্ণাধারায়

সুমন চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন সুমন চৌধুরী (তারিখ: মঙ্গল, ২১/০২/২০১২ - ৪:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম প্রভাত ফেরী সম্ভবত ১৯৮৩ সালে। তার আগে দেখেছি মনে পড়ে কয়েকবার আবছা আবছা। আমার এক খালা থাকতেন আজিমপুর কলোনিতে। একেবারে সদর রাস্তার পাশে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই মানুষের ঢল চোখে পড়তো। প্রভাত ফেরীতে যাওয়া খুব বাহাদুরি ব্যাপার মনে হতো। ১৯৮৩ সালে একুশের ভোরে আবিদ ভাই (আমাদের খালাতো ভাই) আমাকে,সুজন'দাকে আর আমাদের আরেক খালাতো ভাই সঞ্জয়কে নিয়ে গেলেন প্রভাত ফেরীতে। আজিমপুর বেবী আইসক্রিমের মোড় পার হয়ে আরো একটু সামনে থেকেই মূল স্রোতে জুড়ে গিয়েছিলাম। ১৯৮৩'র একুশে ফেব্রুয়ারীতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিশেষভাবে উত্তেজিত ছিল এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে। আজকের দিন হলে ঐ অবস্থায় আমাদের নিয়ে বের হবার জন্য আবিদ ভাইকে বড়রকম তিরস্কারের মুখোমুখি হতো হতো। তখন হয়তো দিনকাল আজকের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। আশপাশ দিয়ে নানারকম ব্যানার চোখে পড়ছিল। সেখানে কী কী লেখা ছিল এতোকাল পড়ে সেইসব মনে নাই। তবে শ্লোগান মনে আছে কিছু কিছু। আমাদের একটু সামনেই ছিল জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিল। "লাল সুতা কালো সুতা/ এরশাদকে মারো জুতা" শ্লোগানটা বিশেষভাবে মনে পড়ে। বাকিগুলি ছিল বিভিন্ন ভঙ্গীতে ছন্দে ছন্দে এরশাদের গুষ্টি উদ্ধার। শহীদ মিনারে পৌঁছতে সেইবার ঠিক কতক্ষণ লেগেছিল মনে নাই। তবে সময়টা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রের জন্য অনেক লম্বা ছিল। তারপর একসময় চলে গেলাম বইমেলায়। কবিতা পাঠ চলছিল। সেখানেও এরশাদকে ছন্দে ছন্দে ভৎসনা। অসাধারণ অনুভূতি। একদিকে প্রভাত ফেরীর অ্যাডভেঞ্চার অন্যদিকে এরশাদকে ছন্দোবদ্ধ বাপান্ত। এমনিতে আশেপাশে তখন এরশাদের অনেক ভক্ত। এরশাদের স্তুতি করতে করতে অনেকেরই অজ্ঞান হবার জোগাড় হতো। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেওয়ালগুলিই অন্য কথা বলতো। আশেপাশে এরশাদের সরব সমর্থকের অনুপস্থিতি সেইবারই প্রথম দেখেছিলাম মনে পড়ে। পরিবারের ভেতরে আসলে একধরণের অন্ধ সামরিক শাসন বিরোধীতা ছিল। এরশাদের স্তুতিগুলি শুনতে পেতাম ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের বাইরের বৃত্তের ক্ষমতাবান/সুবিধাভোগী মানুষদের কাছ থেকে। আমার ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ এর স্মৃতি খুব স্পষ্ট। কোন সহজ সরল নিরীহ এরশাদ সমর্থকের কথা মনে করতে পারি না। পারিবারিক প্রবণতা আর একতরফা ঢাকা কেন্দ্রিকতার কারণেই হয়তো এমনটা হয়েছিল।

সে যাই হোক। এরশাদের কথা বলতে টাইপ করতে বসি নাই। বলছিলাম প্রভাতফেরীর কথা। কেমন করে যেন ১৯৮৩'র পরে ১৯৯৫ এর আগে আমার আর কোন প্রভাত ফেরীতে যাওয়া হয় নাই। বইমেলাতে যেতাম প্রতি বছরই। কিন্তু ঐ ভোররাতে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া হয়ে উঠে নাই। ১৯৯৫তে আমি আর আমার আরেক খালাতোভাই ভোররাতে বেরিয়ে ফজলে রাব্বি হলের উল্টোদিকের সারারাত্রির হোটেলে পরোটা-ভূনা মাংস সাঁটিয়ে পলাশী দিয়ে ঘুরপথে ছায়ানটের অর্থাৎ ইউল্যাব স্কুলের সামনে চলে আসি। সুজন'দা তখন রীতিমতো ছায়ানটের ক্যাডার। ওদের সার্কেলের সাথে আমিও ক্রমশ মিশে যাচ্ছিলাম তখন ছায়ানটের ছাত্র না হয়েও। ওরা প্রায় সবাই আগের রাতে বিভিন্ন হলে থেকেছে। ভোরবেলা সবার চোখমুখ ফোলা ফোলা। ছয়টা সময় দেওয়া থাকলেও মোটামুটি বড় একটা সমাবেশ হতে সোয়াসাতটার মতো বেজে গেল। তারপর প্রথমে "একুশে ফেব্রুয়ারী" তারপরে একেরপর এক গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে ফুলার রোডের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম শহীদ মিনারের দিকে। পাক্কা সাড়ে চার ঘন্টা লেগেছিল সেদিন। এর মধ্যে জগন্নাথ হলের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তিন ঘন্টার বেশী। গণনাট্য সংঘ আর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অতোগুলি গণসঙ্গীত এর আগে আর কখনো একসাথে শোনা হয় নাই। সেই গানের টানেই থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত প্রতিবছর একুশের ভোরে যেকোন পরিস্থিতিতে ছায়ানটের প্রভাত ফেরীতে উপস্থিত থাকতাম। একই বছর ভর্তি হয়ে যাই ছায়ানটে। তবলায়। তবলাটা আসলে একটা উছিলা ছিল। আসল উদ্দেশ্য গাবরের মতো গান শোনা।

১৯৯৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রমজানের ঈদ পড়েছিল। সুজন'দার গায়ে সেদিন প্রচণ্ড জ্বর। প্রতিবছর প্রভাত ফেরীতে আসেন এরকম অনেকেই গাঁইগুঁই করছিল। পার্থদা নানারকম চিন্তুভাবনা করে সকাল সাতটা টাইম দিলেন। আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমরা হলাম সবমোট সতেরজন। কোথাও কোন ভিড় নাই। একটু পর পর আমাদের মতোই ছোট ছোট মিছিল এসে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে যাচ্ছে। সকাল নটার আগেই সব শেষ করে বই মেলায় উঁকি দিলাম। লোক যে নেই তা না। অত নেই। তখন সপ্তাহখানেক আগে খালেদা জিয়া ২য় দফা নির্বাচিত হয়েছেন মোটামুটি একদলীয় নির্বাচন করে। তারপর বইমেলার শুরুতেই জগন্নাথ হলে সেই পুলিশী তাণ্ডব সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যে খুব শান্ত ছিল তাও বলা যায় না। তারপরেও ঈদের প্রভাবটা ছিলোই। মেলার ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা ভরাতে সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত মেলায় পড়েছিলাম।

একুশের আগের রাত এরপরে আরো অনেকগুলি চলে গেছে। আজকে সন্ধ্যা থেকে ভালো লাগছে না। চোখের সামনে আশি আর নব্বই দশকের ঢাকার পথঘাট দেখতে পাচ্ছি। গানগুলি বাজছে। চিরতরুণ ওয়াহিদুল হক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সব চেনামুখগুলি সেই সমাবেশে দেখতে পাচ্ছি।


মন্তব্য

সুজন চৌধুরী এর ছবি

হুম, ওয়াহিদ কাকার কথা খুব মনে পড়তেছে, মনে পড়তেছে ওয়াদুদ ভাই‌‌য়ের কথা অতক্ষণ হারমনিয়াম গলায় ঝুলায়া গান গাইতে আর কাউকে দেখি নাই, পার্থ'দা থাকতো, সুমন'দা, শাকিল ভাই পরের দিকে মিতা আপারা আসতো তবে অনিন্দ্য সব সময় থাকতো।

নাদির জুনাইদ এর ছবি

আশির দশকে আমরাও আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম। এরশাদের শাসন শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ছাত্রদের তুমুল প্রতিরোধের সেই দিনগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন আর ঝাঁঝালো মিছিলের রেশ ছড়িয়ে পড়তো কাছাকাছি জায়গাগুলিতেও। আজিমপুরের বাসার বারান্দা থেকে প্রায়ই দেখতাম ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া করে ঢাল আর বন্দুক হাতে কলোনির ভেতর ঢুকে পড়েছে দাঙ্গা পুলিশ, কখনো কখনো সেনাসদস্যরাও। শুনলাম ছাত্রদের মিছিলে উঠে পড়েছে পুলিশের ট্রাক, মারা গেছেন সেলিম-দেলোয়ার।

আজিমপুরের বিভিন্ন রাস্তা ধরে ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে শুরু হতো প্রভাতফেরী। সবাই খালি পায়ে হাঁটছে, ছোট বয়সে কতোটা যে অভিভূত হতাম এমন দৃশ্য দেখে। ফুল হাতে খালি পায়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে শহীদ মিনারে যেতে কতোটা যে ভাল লাগতো। শহীদ মিনার, ২১ ফেব্রুয়ারির সকাল, সেই অনুভূতি, সেই প্রভাতফেরী, সেই বিশেষ গান সব একই রকম আছে এখনো। আর জানি যে তা চিরকাল একই রকম থাকবে।

যদিও অনেক কিছুই হয়তো আর আগের মতো নেই। আশির দশকের ছাত্রদের সেই সাহসী চেতনা আজ কেন যেন চারপাশে তাকিয়ে অনেক দূরের জিনিস মনে হয়। এই সমাজে বাণিজ্যিকীকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলার আগ্রহের কাছে সেই চেতনাকে চর্চা করার, মনে রাখার প্রয়াস আজ হয়তো আর দরকারী নয়। আর তাই হয়তো সেলিম-দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়া, জয়নাল-জাফর-দীপালী সাহা আর নূর হোসেন কেন প্রাণ হারিয়েছিলেন তাও অনেকেরই মনে থাকে না, মনে থাকলেও তা নিয়ে তারা ভাবতে আগ্রহী নন। আশেপাশে তাকালেই আমাদের সমাজের এই বিস্মৃতি চোখে পড়ে।

দায়ী বদলে যাওয়া সামাজিক পরিবেশ; আর পরিবেশের বদলে যাওয়ার জন্য দায়ী এই সমাজে যারা বাস করেন তারা; আমরা।

মরুদ্যান এর ছবি

ভাল লাগল হাসি

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অনেকদিন যাওয়া হয়না প্রভাতফেরিতে। মন খারাপ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

একুশের শুভেচ্ছা।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

লেখা ভালো লাগলো। অনেক বছর পর গতরাতে আমাদের বাংলার বাউল শিক্ষা নিকেতনের শ্রদ্ধার্ঘ নিয়ে খুলনা শহীদ মিনারের গিয়েছিলাম রাত ০০০১টায় লাইনে দাঁড়িয়ে। মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে গিয়েছে এবং প্রভাত ফেরীতে যাওয়ার শখ একরকম মিটেই গিয়েছে। মন খারাপ

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

দুর্দান্ত এর ছবি

জীবনে একবারই আসল প্রভাত ফেরি করেছিলাম। আবার কবে সুযোগ পাবো।

শিশিরকণা এর ছবি

১৯৯১ সালে প্রথম গিয়েছিলাম বাবার হাত ধরে, টবের গাছে ফোটা প্রথম এবং একমাত্র একটা গোলাপ হাতে নিয়ে। তখনকার বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাও একই সময়ে হাজির হওয়ায় ধাক্কা দিয়ে আমাদের শহীদ মিনার থেকে সরিয়ে দিয়েছিল বলে বেদীতে আর সেই ফুল দেয়া হয়নি। ভেক ধরা দেশপ্রেমিকদের ভিড়ে আর যেতে ইচ্ছে করে না, দূর থেকেই তাই শ্রদ্ধা জানিয়ে যাই।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

কী সুন্দর স্মৃতিকথা... এখন কেমন রাত তেরটার বাতিক উঠেছে, আজব! আর কেন জানি না ভেক ধরা সিজনাল দেশপ্রেমিকদের ভীড়ে যেতে ইচ্ছা করে না, আজকে সকাল ঘুমিয়ে কেটেছে...

স্মৃতিকাতরতার কারণে হলেও বদ্দার লেখা নিয়িমিত বিরতিতে দুই-একটা এসে পড়াটা ভালো লাগছে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

ফাহিম হাসান এর ছবি

আপনার লেখার সে কী স্বাদ, আহ!

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

অভিজ্ঞতা ভালো ছিলোনা আমার, তারপরেও হয়তো আরেকবার যাবো একদিন...

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।