শুরু করা যাক একটা নেগেটিভ তথ্য দিয়ে। গত মাসে প্রকাশিত ‘ডুয়িং বিজনেস ২০১০’ (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএফসির) রিপোর্টে দেখলাম বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় চার ধাপ নেমে গেছে।(বাংলাদেশের বর্তমান আবস্থান রিপোর্টে বিবেচিত ১৮২ টা দেশের মধ্যে ১১৯তম)। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ফান্ডের (BICF) এর বিশ্লেষকরা বলছেন এই সময়টাতে (জুন ২০০৮ থেকে মে ২০০৯) বাংলাদেশে সংস্কার (রিফর্ম) ভালই হয়েছে, কিন্তু অন্য কিছুদেশ তুলনামুলক ভাবে আরও ভাল করায় বাংলাদেশের এই চার ধাপ নেমে যাওয়া। আমার এই লেখাটা ডুয়িং বিজনেস ২০১০ রিপোর্টের কোন বিশ্লেষণ না বরং যে সংস্কার অথবা কাজ গুলো আমার কাছে ভাল মনে হয়েছে, সেগুলোরই একটা বিশ্লেষণ।
আমার ব্যাক্তিগত এই বিশ্লেষণে যাবার আগে ডুয়িং বিজনেস ২০১০ রিপোর্টে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ন সংস্কারের কথা বলা হয়েছে সেগুলো কী একটু দেখা যাক।
১। চিটাগাং বন্দর কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের স্বয়ংক্রিয়করণ, যাতে বলা হচ্ছে ৪০-৫০% খরচ বাঁচবে এবং আগের তুলানায় প্রায় ৯০% সময় কম লাগবে।
২। বিজনেস রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ (অনলাইনে করা), যাতে ধারনা করা হচ্ছে একটা নতুন ব্যবসা শুরু করার সময় আগের তুলনায় প্রায় ২৯ দিন কমে যাবে।
৩। কর্পোরেট আয়কর ৪০% থেকে ৩৭.৫% হ্রাস করা।
স্বয়ংক্রিয়করণ প্রক্রিয়া
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনটি ভাল কাজের মধ্যে একটি হল চিটাগাং বন্দর কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের স্বয়ংক্রিয়করণ। (কাজগুলো আমার ধারনা নির্বাচিত কোন সরকার এত কম সময়ে এত গ্রহনযোগ্য ভাবে করতে পারত না।)। এই স্বয়ংক্রিয়করণের ফলে খরচ এবং সময়ের সাশ্রয়ই শুধু না, মুল যে কাজটা হবে তা হল দুর্নীতি কমে যাওয়া। প্রেশার গ্রুপের (যেমন, যে সকল কর্মকর্তা দুর্নীতি করত, কাস্টমস এন্ড ক্লিয়ারিং এজেন্সীগুলো) বিরোধিতার পরও এই কাজটা ভাল ভাবে করা গেছে। সরকার আরও কিছু সিস্টেমকে স্বয়ংক্রিয়করণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যেমন টেন্ডারিং প্রসেস, আয়কর, ভুমি রেজিষ্ট্রিকরণ ইত্যাদি। এগুলো করতে পারলে অসাধারন কাজ হবে। এগুলো বলছি বড় বড় ক্ষেত্রের কথা। সরকারীভাবে অবশ্য কিছু স্বয়ংক্রিয়করণ গত কয়েক বছরে হয়ে গেছে, যার সুফল মানুষ পেতে শুরু করেছে। কিছু উদাহরন দেয়া যাক, যেমন – ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রকাশ, বোর্ড অভ ইনভেস্টমেন্টের অনলাইন ট্রেকিং বা সরকারী বিভিন্ন ফর্মগুলোর ডিজিটাল ডেটাবেজ। (শাবিপ্রবিতে অন-লাইনে আবেদন করার ব্যাপারটাতে চমৎকৃত হয়েছি।)
যদিও নির্বাচিত সরকার ভেস্টেড ইন্টারেস্টওয়ালাদের এবং চেলা-চামুন্ডাদের চাপ কতটা সহ্য করতে পারে দেখার বিষয়। স্বয়ংক্রিয়করণের ফলে যে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ব্যাপার চলে আসে তা হজম করাটা কঠিন। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যায়। উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পের প্লটগুলো বুয়েটের সহযোগিতায় স্বচ্ছতার সাথে লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়ার ব্যাপারটা এই সরকার চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে চমৎকৃত হয়েছিলাম। লজ্জার মাথা খেয়ে তিনটা ক্যাটাগরি শেষ করে আগের ফর্মে ফিরে গেছে বর্তমান সরকার। সিদ্ধান্ত হয়েছে বাকীদের সিলেকশনের (পড়ুন অনুরোধের আসরের) মাধ্যমে দেয়া হবে।
আর্থিক খাতের উন্নতি
আমার ধারনা গত কয়েক বছরে আর্থিক খাতের কয়েকটা ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিছুদিন আগে দেখলাম সরকারী ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপির হার বেসরকারীদের থেকে কমেছে। রেমিটেন্সের ব্যাপারটা আলোচনা করা যাক।
ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স
আলোচনার কেন্দ্রে কখনোই তেমনভাবে না আসা প্রায় ৬০ লক্ষ প্রবাসীদের অফিসিয়াল এবং আন-অফিসিয়াল চ্যানেলে পাঠানো টাকা যে দেশের অর্থনীতিতে কি ভূমিকা রাখে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই প্রবাসীদের অন্য কোন ব্যাপারে সরকার তেমন সাহায্যের হাত না বাড়ালেও টাকা পাঠানোর ব্যাপারটা বেশ সহজ করার চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় বিগত বছর গুলোতে। প্রণোদনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেমন সঠিক চ্যানেলে পাঠালে আয়কর মুক্ত ইত্যাদি (আমি নিজে এই সুবিধা পেয়েছি একবার, কোন রকম ঝামেলা ছাড়া)।
তবে পাঠানো টাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু রিপোর্টিং সিস্টেম আছে। কেউ কেউ এটাকে ব্যুরোক্রেসি হিসাবে দেখতে পারে কিন্তু সরকারকে এটা করতেই হবে টেররিস্ট ফান্ডিং এবং অন্যান্য অপরাধের ফান্ডিং বন্ধ করার জন্য। এই প্রেক্ষিতে ইদানিং সরকার জঙ্গীবাদ রোধে ‘ফাইনন্সিয়্যাল ইন্টালিজেন্স’ কার্যক্রমের কথা বলছে। চমৎকার পদক্ষেপ। সিঙ্গাপুরের জঙ্গীবাদ রোধের সাফল্যের পিছনে যে কয়টা পদক্ষেপ ছিল তার এক নম্বরে ছিল এই ফান্ডিং প্রতিরোধ, এবং দুই নম্বরে শক্ত ইন্টালিজেন্স নেটওয়ার্ক।
আউটওয়ার্ড রেমিটেন্স
আউটওয়ার্ড রেমিটেন্স নিয়ে দু একটা কথা বলতেই হয়। সাধারন একটা ধারনা আছে যে বিদেশী কোম্পানীগুলো অথবা বিদেশীরা ইচ্ছা মত ফান্ড বিদেশে নিয়ে যায়। আমার মনে আছে এন,বি,আরের তখনকার চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ সাহেব নিজে এধরনের একটা মন্তব্য করেছিলেন। আমার মনে হয় এরকম জেনারেলাইজেশন আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের চমৎকার পদক্ষেপ গুলোকে আন্ডারমাইন করে। লিগ্যালভাবে বাংলাদেশ থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। খুব সংক্ষেপে একটু আলোচনা করা যাক। (কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেখতে পারেন।) বিদেশীরা মোটা দাগে তিনভাবে বিদেশে টাকা নিতে পারে। প্রথমত বিদেশী নাগরিক যারা বাংলাদেশে কাজ করে তারা তাদের বেসিক বেতনের অর্ধেক পারিবারিক খরচের জন্য বিদেশে নিতে পারে। কিন্তু এই বেতন বিওআই দ্বারা অ্যাপ্রুভড হতে হবে এবং এর উপর আয়কর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত কোম্পানী গুলো তাদের নীট মুনাফার অ্যাপ্রুভড অংশ নিতে পারবে, কিন্তু এর জন্য অডিটরের সার্টিফিকেশন থাকতে হবে এবং এর উপর প্রযোজ্য কর্পোরেট আয়কর সঠিকভাবে পরিশোধ করতে হবে। এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল সঠিক মুনাফা দেখাতে হবে এবং তার উপর আয়কর দিতে হবে। মুনাফা কম দেখিয়ে কম আয়কর দিলে কম টাকা বিদেশে নিতে পারবে। তৃতীয়ত টেকনিক্যাল এসিস্টেন্সের আওতায় আয়ের ৬% পর্যন্ত বিদেশে নেয়া যায়, কিন্তু তার জন্য কেইস বাই কেইস বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিওআই এর অ্যাপ্রুভাল লাগে। এবং ব্যাপারটা বেশ কঠিন। আলোচনার কারন হল, আমার কাছে গাইডলাইন গুলো বেশ ভাল, কঠোর এবং সুচিন্তিত ভাবে করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
ইদানিং দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ‘মানি ট্রান্সফার ডিজিটালাইজেশনের’ জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। (যেমন, ইলেক্ট্রনিক প্রিপেইড কার্ড সিস্টেম, মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে টাকা পাঠানো ইত্যাদি)। এই পদক্ষেপ গূলো আশা করা যাচ্ছে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটা আরও সহজ করবে।
জাতীয় পরিচয়পত্র
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনটি ভাল কাজের অন্যটি হল ছবি যুক্ত ভোটার তালিকা তৈরী। প্রক্রিয়াটা শুরুর আগে এবং পরে অনেক সমালোচনার হলেও খুব কম সময়ে বিশাল একটা কাজ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ভোটার নম্বরকে (বা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর) অন্যান্য অনেক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে। (যেমন ব্যাংক হিসাব খোলা, নতুন পাসপোর্ট তৈরী, নতুন ফোন নেয়া এবং অন্যান্য)। বর্তমান বা ভবিষ্যত সরকারগুলো কিন্তু এটার উপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে পারে। খুব শক্তিশালী একটা ডেটাবেস তৈরী করা সম্ভব। চমৎকার একটা পদক্ষেপ।
আরও কয়েকটা ব্যাপার আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল, হয়ত পরে কখনো করা যাবে। আমার প্রিয় এনার্জি সেক্টারের কিছুটা আলোচনা করতে হয়।
এনার্জি সেক্টর
গতকাল রণদীপম বসু তাঁর ব্লগে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ হওয়ার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। হাসিব আজ তাঁর একটি মন্তব্যে সরাসরি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়ত গ্যাস চুক্তির কন্টেক্সট সৃষ্টি করার একটা প্রক্রিয়া। হতে পারে। তবে আমার ধারনা তা না। গ্যাস চুক্তিতো প্রায় হয়েই গেছে, এর জন্য আর কন্টেক্সট সৃষ্টির দরকার নেই। তবে আমার যে সন্দেহটা তা হল গ্যাসের সংকট সমাধানে যে ১০% এর মত ডমেস্টিক ব্যাবহার হয়, মানে আমরা আম জনতারা ব্যাবহার করি, তারাই ভুক্তভোগী হব প্রথমে।
ফিরে আসি জ্বালানি সেক্টারে। আমার ধারনা সরকার বেশ সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে এই সেক্টারকে। যেভাবে সর্ট, মিডিয়াম এবং লং টার্ম পরিকল্পনার কথা বলছে, শুনতে ভালই লাগছে। বিশেষ করে ব্যাপক ভিত্তিতে সিসমিক ম্যাপিং করার বা বাপেক্সকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা। এবং যদি সত্যিই করতে পারে, একটা অসাধারন কাজ হবে। অবশ্য রেটোরিকও হতে পারে। আমরাতো একসময় দুই ঘন্টায় চিটাগাং যাবার স্বপ্নও দেখেছি। প্রতিবেশীদের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের সমাধানের জন্য আজ খবরে দেখলাম জাতিসংঘের সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। ভাল লক্ষণ।
দুই কোম্পানীর সাথে গভীর সমুদ্রের তিনটি ব্লকের (একটা অবশ্য অগভীরে) পিএসসি স্বাক্ষর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদিও আমার মনে হয়েছে কনকো-ফিলিপ্সের ওয়ার্ক প্রোগ্রামের জন্য যে টাকা ধরেছে তা গভীর সমুদ্রের ব্লকের জন্য খুবই কম। এই ব্লক গুলোর থেকে গ্যাস পেতে, যদি পাওয়া যায়, অপেক্ষা করতে হবে ৭/৮ বছর। তা এখন কী হবে?
কেয়ার্ন এবছর ৩-ডি সিসমিক করছে ব্লক ১৬ তে। সাফল্য আসলে হয়ত ৪ বছরের মধ্যে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দিতে পারবে। কেয়ার্নের ছেড়ে দেয়া ১০ নং অনশোর ব্লকের প্রসপেক্ট গুলোতে যদি বাপেক্স কাজ শুরু করে তবে ৩ বছরের মধ্যে গ্যাস তুলতে পারবে। আলোর রেখা কি দেখা যাচ্ছে কিছুটা? অনেক “যদির” উপর দাঁড়িয়ে আছে পুরো ব্যাপারটা, তবে সবচেয়ে আগে দাঁড়িয়ে আছে সরকারের ভাল কিছু করার ইচ্ছাটুকু…।
মন্তব্য
খুব ভালো লিখেছেন। মন দিয়ে পড়লাম।
ধন্যবাদ, আপনি ভাল থাকুন।
খুবই বিশ্লষন ও মূল্যায়নধর্মী লেখা । পড়ে খুব ভাল লাগলো ।
নির্ভানা
আপনার সুচিন্তিত, সুলিখিত তথ্যবহুল লেখাগুলো সবসময়ই মন দিয়ে পড়ি। এটাও ব্যাতিক্রম নয়। ভাল লেগেছে।
নতুন মন্তব্য করুন