(ছয় সপ্তাহের একটা কাজে সদ্যস্বাধীনতা প্রাপ্ত পূর্ব-তিমোর যাওয়া হয় ২০০২ সালের অক্টোবরে। চাকরীক্ষেত্রে তখনও অপেক্ষাকৃত নতুন, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়নি তেমন একটা। সাথে মিশে ছিল 'সদ্য প্রাপ্ত স্বাধীনতা' কথাটার আবেশ এবং কম বয়সের রোমান্টিসিজম। সবকিছু মিলিয়ে সেই সময়টা ভালই প্রভাবিত করেছিল আমাকে। যদিও এই আবেশ বেশী দিন ছিল না, কিন্তু সময়টা ভালই উপভোগ করেছি। সেখানে থাকা অবস্থায়ই, ঠিক সাত বছর আগে, ১২ অক্টোবর পার্শবর্তী বালিদ্বীপে ভয়বহ বোমা হামলা হয়, যার আঁচ ভালভাবেই লেগেছিল পূর্ব-তিমোরে। সব কিছু মিলিয়েই আমার এই ভ্রমনটা স্মরণীয় হয়ে আছ। পাঠকের সাথে কিছু ঘটনা শেয়ার করলাম। ইচ্ছে করেই আমার কাজের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু লিখলাম না।)
২০০২ সালে পূর্ব-তিমোর দুইভাবে যাওয়া যেত। অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন থেকে এয়ার নর্থে অথবা ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপ (ডেনপাসার) থেকে ম্যারপাতি (Merpati) এয়ারলাইন্সে। ডারউইন সম্বন্ধে ইন্টারনেটে আগ্রহ জন্মাবার মত কিছু না পেয়ে বালিদ্বীপ দিয়ে যাওয়াই ঠিক করেছিলাম তখন।
বেমভিন্দো সিনোর
অক্টোবরের এক রোদ ঝকঝকে সকালে বালিদ্বীপ থেকে ম্যারপাতি এয়ারলাইন্সে মাত্র ঘন্টাখানেক উড়ে পূর্ব-তিমোরে পৌছুলাম। তিমোরের রাজধানী দিলির এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবন আমাদের যেকোন অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্ট টার্মিলালের মতই। লোকাল বাসের টিকিট কাউন্টারের মত ছোট ছোট কয়টা টেবিলে বসে ইমিগ্রেশনের কাজ হচ্ছে। আমন্ত্রণ পত্র দেখাতেই কোন প্রশ্ন না করে ইমিগ্রেশনের সিল দিয়ে ছেড়ে দিল (এত সহজে ইমিগ্রেশন পার হওয়া এই প্রথম আর এই শেষ)। বলে রাখা ভাল মাত্র মে মাসে স্বাধীনতা পাওয়া পূর্ব-তিমোরে তখন সরকার পরিচালনা এবং একটা নতুন সরকার গঠনের জন্য কাজ করছিল ইউনাইটেড নেশন্স ট্রানজিশনাল এডমিনিস্ট্রেশন ইন ইস্ট তিমোর('ইউএনট্যাট')।
হাত থেকে ল্যাগেজ একরকম টেনে নিয়ে যিনি আমাকে তাঁর পরিচয় দিলেন, তিনিই আমার হোস্ট এবং পূর্ব-তিমোরের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো প্রায় ১৫ জনের একটি মাল্টি-কালচার টিমের লিডার। তাঁর সাথে একই বাসায় থাকতে হবে আগামী সপ্তাহগুলো। উত্তর আমেরিকাতে লেখাপড়া করা শক্ত চেহারার একজন মধ্যবয়সের আফ্রিকান, তাঁর কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত গভীর কাটা দাগটা প্রথম দর্শনে মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। মন কিছুটা খারাপ হল। কিন্তু দিলির নির্জন বিচের পাশ দিয়ে টানা রাস্থায় মাজদা স্পোর্টস মডেলের গাড়ীতে যেতে যেতে তাঁর প্রাণ খোলা হাসিতে মনের সব মেঘ কেটে গেল। কিছু কিছু উপদেশও পাওয়া গেল - টানা বিচে স্নোরক্যালিং করা রিস্কি - একমাত্র প্রটেক্টেড লেগুনে করা যাবে, ফ্যারেলের (ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ যেখানে আমি থাকব) বাইরে গেলে সাবধানে থাকতে হবে, নিজে গাড়ি চালানো নিষেধ (... ওকে, উই উইল সি আবাউট দ্যাট), ডোন্ট ট্রাই তিমোরী লেডিজ, হা হা হা। ভাল লাগল এটা উপলব্ধি করে যে তিনি নিজে বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিতে এসেছেন, ড্রাইভার পাঠিয়ে কাজটা সারতে পারতেন।
বাসায় যাবার পথে অফিসে থামলাম। চে'র ছবি আঁকা টিশার্ট পরা শ্মশ্রুমন্ডিত সুদর্শন এক যুবক আমায় অভ্যর্থনা জানালো, বেমভিন্দো সিনোর।
ঘরকন্না
দিলি ছোট্ট একটা শহর, লোকজন বা গাড়ীঘোড়া খুবই কম (পুরো পূর্ব-তিমোরের জনসংখ্যা মাত্র ৮ লক্ষ ছিল তখন)। আমার থাকার যায়গা হল ব্যান্ডা সাগরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া, বলা যেতে পারে দিলির সবচেয়ে সুন্দর রাস্তার মাত্র এক ব্লক পরেই, ফ্যারেল নামক ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভে। গাছ পালা দিয়ে ঘেরা বিশাল এক প্লটের মধ্যে প্রায় ৫০০০ স্কোয়ার ফিটের টিনের চালের একতলা বিশাল এক বাসা, সিটি-সেন্টার (এডমিনিস্ট্রেশন ভবন) থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটারের দূরে। বাসায় থাকি আমার হোস্ট এবং আমি। ঘরের কাজের সাহায্যের জন্য একজন মহিলা আছেন অবশ্য, কিন্ত রান্নাবান্না জানেন না অথবা জব ডেস্ক্রিপশনে নেই এবং তাঁকে মাত্র একদিনই দেখেছি। তিনি ন’টা-চারটা অফিসটাইম মেনে চলেন এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আসেন না। হোস্ট দুপুরে বাইরে খায়, রাতে খাওয়া দাওয়াই করেন না, যতক্ষণ বাসায় থাকেন দরজা জানালা বন্ধ করে বেড রুমে 'কী জানি কী করেন'। তিনি পুরো বাসা দেখিয়ে প্রথম দিনই বললেন, 'এটা তোমার বাসা', তারপর তাঁর স্টেট অভ আর্ট রান্নাঘর দেখিয়ে বললেন আমি ইচ্ছামত রান্নাবান্না করে নিতে পারি। রান্নাবান্না বলতে আমি অবশ্য থিওরিটিক্যালি খুব ভাল চা বনাতে পারি, লিকার কতটা ঘন হলে দুধ-চা ভাল হয়, পানি কতটা গরম করতে হবে, কিংবা...। তবে আমি স্টেট অভ আর্ট রান্নাঘর নিয়ে কোন এক্সপেরিমেন্ট করেনি, যতদিন তিমোরে ছিলাম, সেই রান্নাঘরের চুলা জ্বলেনি। একসেট চাবি দিয়ে দিলেন যেন যখন ইচ্ছে যেমন খুশি আসতে যেতে পারি।
প্রিয় নিঃসঙ্গতা
কাজ ছাড়া তেমন কিছু করার নাই, আর যে কাজে গেছি তার জন্য দু’সপ্তাহই অনেক। সাথে আছে মাত্র ২টা বই, এখানে কোন বই পাওয়া যায়না, মাঝে মাঝে শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার ফ্যাশন ম্যাগাজিন পাওয়া যায় (অবশ্য লিভিং রুমের পুরানো ফ্যাশন ম্যাগাজিনের মধ্যে জার্মানীর একটা আগুন-গরম ম্যাগাজিন পাওয়া গেছল)। ইন্টারনেটের কোন ব্যাবস্থা নাই, ইউএনের একটা এক্সেনশন হিসাবে অফিসের একটাই ইমেইল আইডি আছ শুধু। প্রতি একদিন পর পর সন্ধ্যায় দুঘন্টার জন্য বিদ্যুত চলে যায় (লোড-শেডিং কথাটা অফিসে আমি চালু করেছি, খোদ ইংরেজ মহিলাও এই ইংরেজী টার্মটা জানত না)। টিভি আছে, কোন চ্যানেল নাই, রেডিও নাই বা ফোনও নাই (টিম-লিডারের শুধু একটা স্যাটেলাইট ফোন আছে বিশেষ দরকারের জন্য)। কোন এক বিচিত্র কারনে ফুটপাথে প্রচুর ভারতীয় সিনেমার পাইরেটেড ভিসিডি এবং ইন্দোনেশিয়ার মিউজিক ভিডিও পাওয়া যায় - দুটার কোনটার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নাই। অখন্ড অবসর।
ভীষণ ভাল লেগেছিল আমার থাকার জায়গাটা। বাসায় থাকলে চারিদিক সুনসান। কাছেই সমুদ্র কিন্তু কোন শব্দ নেই। সারাদিনে হয়ত একটা বা দু'টা গাড়ী চলে যাবার হালকা শব্দ শোনা যায়। গভীর রাতে মাঝে মাঝে খুব হালকা ভাবে অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভারী গলার ডাক শোনা যায়, যা আমার খুব প্রিয়।
তিন শিফটে ২৪ ঘন্টার জন্য একজন চৌকিদার থাকে, গেট দিয়ে ঢোকে একটু এগিয়ে গেলে দেখা যায় চেয়ারে মুর্তির মত বসে আছে। এই চৌকিদারদের কয়েকদিন দেখার পর আমার মাথায় যে শব্দটা এসছিল তা হল - জম্বি। কখনো চেয়ার থেকে উঠতে দেখিনি। সাধারনত কোন কথা না, তবে খুব খেয়াল করে প্রতি সকালে রবোটিক গলায় বলত বোমদিয়া (সুপ্রভাত) এবং বিকেলে বা রাতে যথাক্রমে বোয়াতার্দে এবং বোয়ান্যায়তে। আর কোন কথা বলা হয়নি। অবশ্য আমি পর্তুগীজ বা টেটুম (দুই ব্যবহৃত ভাষা) ভাষার কিছু কিছু শব্দ মাত্র জানতাম।
আমার হোস্ট মাঝে মাঝে দুই এক দিনের জন্য দিলির বাইরে চলে যেতেন। তখন তো আরও নিঃসঙ্গ। আই অ্যাম দ্য মনার্ক অভ অল আই সার্ভে। এমনই এক গভীর রাতে কে যেন অসাধারন বাঁশি বাজাচ্ছিল। গভীর রাতে জম্বি চৌকিদার পার হয়ে রাস্থায় এসেছিলাম, কিন্তু খোঁজে পাইনি সেই গভীর রাতের বংশীবাদকের। স্বপ্নমুগ্ধের মত চলে এসেছিলাম বিচের ধারে। জম্বি কিন্তু ঠিকই পরের দিন রিপোর্ট করেছিল। সিরিয়্যাস ব্রীচ অভ সিকিউরিটি প্রসিডিয়্যর।
তিমোরের বন্ধুরা
অফিসে গিয়ে বুঝলাম তিমোরী লোকজন খুব একটা মিশতে চায় না। এক্সপাট্রিয়েটরা আলাদাই থাকে, তবুও আমি তিমোরীদের সাথে মিশতে চেষ্টা করতাম। তবে এক সপ্তাহ যাবার পর কাঁচের দেয়াল ভেঙ্গে কিছুটা এগিয়ে এসেছিল। তবে বিকাল চারটার পর আর পাওয়া যেত না। ভাষা কিছুটা সমস্যা হয়ে থাকবে হয়ত। মেয়েরা অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি মিশতে চাইত অবশ্য। পার্ট-টাইম কাজ করা একটা মেয়ে ছিল, সিংগাপুরে পড়াশুনা করেছে, খুব ভাল ইংরেজী, টেটুম এবং পর্তুগীজ ভাষা বলতে পারত। (আমার হোস্টের ভাষ্য অনুযায়ী, 'দ্য স্পার্কলিং জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন')। সবসময় ঝলমল করছে যেন। ভীষণ ডিমান্ড, একই সাথে ইউএনে এবং আমাদের এখানে কাজ করে। আরও অফার আছে। বলে কয়ে আমি এখানে থাকা পর্যন্ত রাখার ব্যাপারে রাজি করানো হয়েছিল। (সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে মিটিংয়ের সময় দোভাষী হিসাবে সেই ছিলে একমাত্র ভরসা।)
ছেলেদের দাড়ি রাখা আর চে'র ছবি আঁকা টিশার্টের ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল দেখলাম। শেষে বোঝলাম কোন আইডিওলজির সাথে এর সম্পর্ক নেই, একটা ফ্যাসন স্টেটমেন্ট মাত্র। (সেদিন পত্রিকায় একটা লাইন পড়লাম, চে সারা জীবন ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর পর সেই ক্যাপিটালিজমেরই পণ্যে পরিনত হয়েছেন।)
তবে আশ্চর্যজনক ভাবে যেদিন আমি তিমোর থেকে চলে আসি, সেদিন অনেকে এসেছিল, বিমানবন্দরে আমায় জড়িয়েও ধরেছিল। সেদিন ছুটির দিন ছিল, এবং ছুটির দিনে তাঁদের কোন খোঁজই পাওয়া যায় না।
দিলিক্লাব, মালয়েশিয়ান রেঁস্তোরা এবং হ্যালো মিস্টার
ফ্যারেলে আমার থাকার জায়গা থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে ছিল অপেন-এয়ার দিলি ক্লাব। ক্লাব বলতে সমুদ্রের পারে রাস্থার পাশে বিরাট একটা টিন-শেডের আয়োজন। কিন্তু খুব জমজমাট। পিৎজা এবং সাউথ ইন্ডিয়ান খাওয়া পাওয়া যায়। আর পানীয়, বিশেষকরে সব ধরনের অস্ট্রেলিয়ান বিয়ার। এক লিটার বিয়ার এক ডলার, আবার হাফ লিটার মিন্যারেল ওয়াটার এক ডলার। সারাদিন কিছু কিছু লোকজন থাকে, বিশেষ করে ম্যাচো টাইপের বিশালবপু মুশকো অস্ট্রেলিয়ানরা। রাতে ভালই জমে। আমার পারমানেন্ট রাতের খাবার এবং আড্ডার জায়গা ছিল এই দিলি ক্লাব। যদিও গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, আমার হোস্ট আমাকে অ্যালাও করেছিল।
অফিসে থাকলে আমি আর আমার হোস্ট নিয়ম করে প্রতি দুপুরে দুই কিলোমিটার দূরে মালয়েশিয়ান এক রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম (সবচেয়ে ভাল লাঞ্চ নাকি পাওয়া যায়)। তিন ডলারের ব্যুফেতে খাবার ব্যবস্থা। খাবার আমার তেমন একটা ভাল লাগত বলব না, কিন্তু মালয়েশিয়ান মেয়েটার হাসি আর টুকটাক কথাবার্তা, এবং প্রতিদিন একই সময় খেতে আসা ইউএনট্যাটের এক জাপানী মহিলা পুলিশ সেই গ্যাপ পূরণ করত।
কেনাকাটার তেমন কোন ভাল দোকান ছিল না, তবে হ্যালো মিস্টার নামে বিশাল একটা সুপারস্টোর ছিল। প্রতিদিন আসা অস্ট্রেলিয়ান খাদ্যদ্রব্য খুব ভাল পাওয়া যেত। পকেট ভর্তি ডলার ছিল (বেশ ভাল একটা ডিইলি অ্যালাওন্স পেতাম আমি) কিন্তু খরচ করার তেমন জায়গা নেই। প্রায় লোডশেডিং এর বিকেলে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম সিটিসেন্টারে।
গোধুলীর আগন্তুক
লোড-শেডিংয়ের এক গোধুলীর আলো-আধারিতে হেটে যাচ্ছি সিটিসেন্টারের দিকে। সুনসান রাস্থাঘাট। কোন লোকজন নেই, দেখলাম অপরদিক থেকে একজন হেঁটে আসছে। কাছাকাছি এসে একরকম আশালীন ভাবেই সমস্থ শরীর মাপতে মাপতে পাশ দিয়ে চলে গেল। কিছুটা অস্বস্থি হওয়ায় পিছনে ফিরে দেখি লোকটা উল্টো দিকে ঘুরে আমার পিছু পিছু আসছে, দুরত্ব কমছে দ্রুতই। সতর্ক হলাম, আশে পাশে লোকজন নেই। হাঁটা দ্রুত করলাম, একটা ট্রাফিক সিগনালের কাছাকাছি এসে কিছু লোকজন দেখতে পেয়ে ঘুরে লোকটার মুখোমুখি হলাম, ইংরেজীতে জানতে চাইলাম, 'কিছু চাই'? সরাসরি বাংলাতে জানতে চাইল, 'ভাই, আপনি কি বাংলাদেশ থেকে আসছেন'? কেন জানি বাংলা কথা শুনে সব অস্বস্থি নিমিষেই চলে গেল। বোঝলাম আমার টিশার্টে লেখা বাংলায় দু'টি লাইনে আমাকে চেনা গেছে। ভদ্রলোক বললেন নিজের কথা, 'ভাইরে, আছলাম ইন্দোনেশিয়াত, আইলাম ওনো বুঝবার লাগি, বান্দরর দেশ এখটা। কিন্তু আটকি গেলাম'। শুনলাম জীবনবৃত্তান্ত। কথা দিলাম সুযোগ পেলে ওদিকটায় যাব। কথা রাখতে পারিনি।
গিজেলের সাথে পরিচয় এবং অন্যান্য
লোড-শেডিংয়ের আরেক সন্ধায় ঘন্টা খানেক হাটাহাটি করে বাসায় ফিরে আসলাম। জম্বি চৌকিদারের রোবটিক সম্বোধন পার হয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘন অন্ধকারে লিভিং রুমের সোফাটাতে বসে রাতের পরিকল্পনা ঠিক করছি। বিদ্যুত আসলে সময় নিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াব, তারপর একা একা দিলি ক্লাব, পানীয় সহযোগে রাতের খাবার...। 'ইউ মাস্ট বি ...'। - খুব কাছে পাশের সোফায় অকস্মাৎ কিন্নরকন্ঠি এক মহিলার গলায় নিজের নাম শুনে থেকে পুরো শরীর কেপে উঠল। 'ভয় পাইয়ে দিয়েছি নিশ্চয়, আমি গিজেল, আমার নাম শুনেছ আশা করছি'। হ্যা, গিজেল নামের এক ফরাসী সহকর্মী এখান থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে থাকে, কখনো দেখা হয়নি, কিংবা আজ এখানে আসবে এটাও জানতাম না। 'পরিচিত হয়ে খুশি হলাম গিজেল', উত্তর দিলাম। করমর্দনের জন্য অন্ধকারে হাত বাড়ালে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিপদের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে আর হাত বাড়ালাম না। এর মধ্যেই বিদ্যুত চলে আসল, ঝলমল করে উঠল লিভিং রুম। চেয়ে দেখলাম পাসের সোফায় সোনালী চুলের ঝলমলে একটা মেয়ে বসে আছে। সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালাম, দিলি ক্লাবে নয়, ভাল একটা রেঁস্তোরায়।
আরেক সন্ধ্যায় প্রায় এরকম ভাবেই পরিচয় হয়েছিল ইন্ডিয়ান এক মেয়ের সাথে, আমাদেরই সহকর্মী। সেই রাতে তাঁর সাথে গেছলাম মাত্র একঘন্টার ড্রাইভে হাজার ফুট উচুতে একটা অফিসে, উপর থেকে সমুদ্রের পারে দিলিকে খুবই সুন্দর লাগে।
জীবন বাজি রেখে... স্নোরক্যালিং
দিলিতে আমাদের অফিসের একমাত্র ব্রিটিশ মহিলার সবকিছুই কেন যেন আমার ভাল লাগত। বিশেষ করে নীল চোখ এবং আহ্লাদি কন্ঠস্বর। সময় পেলেই আমার রুমে চলে আসে, আড্ডা চলত অফিসেই। কিন্তু আমার হোস্ট কেন জানি একেবারেই পছন্দ করে না তাঁকে। ঢাকা থেকে আসার সময় আমার এক ওয়েস্টার্ন জীবনে অভ্যস্থ বাংলাদেশী সহকর্মী, যিনি বিদেশে বেশ অনেক বছর কাজ করেছেন বলেছিলেন, 'আপনারে তো চিনি, দেইখনে কিন্তু, ... থেকে সাবধানে থাইকেন'। অনেক চাপাচাপিতেও আর বিস্তারিত বলেন নাই।
ছূটির দিনের এক নিঃসঙ্গ দুপুরে বারান্দায় বসে আছি। হোস্ট দিলির বাইরে চলে গেছে একদিনের জন্য। দেখলাম নিজের গাড়ি নিয়ে সাতারের পোশাকে নীলনয়না উপস্থিত। জানতে চাইলেন তাঁর সাথে অরক্ষিত সমুদ্রতটে স্নোরক্যালিং করতে চাই কিনা। উনার কাছে একসেট এক্সট্রা গিয়ার আছে। আমরা দুজনেই জানি এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। রওয়ানা হলাম অরক্ষিত সমুদ্রতটে। দুঃখজনক ভাবে রাস্থায় পরিচিত আরেক ব্রিটিশ যুবকের সাথে দেখা (পরে আমাকে নীলনয়না তার ব্যাপারে বলেছিল - ইম্পর্চুনেট সুইটর)। সেও যেতে চায় (তার গাড়ির বুটে আবার স্নোরক্যালিং গিয়ারও আছে)। কি আর করা?
স্নোরক্যালিংএর আগে বিচে বসে কিছুটা আড্ডা হল। সাগর শান্ত, হালকা নীলাভ সবুজ, রং হঠাৎ করেই গভীর হয়ে গেছে। আমারা তিনজনেই জানি হঠাৎ গভীর হওয়া জায়গা থেকে আসলে সমুদ্র গভীর হয়ে গেছে, এবং হাঙ্গর গুলো ওখানেই সাধারনত থাকে, মাঝে মাঝে অগভীর জলে চলে আসে। আড্ডায় চলে আসল কেভ ডাইভিং, স্কুবা ডাইভিং এর মত ব্যাপারগুলো। আমি এসব বিষয়ে আমার ব্যাপক জ্ঞান দেখে নিজেই অবাক হলাম। মনে মনে ঠিক করলাম ঢাকায় ফিরে গিয়ে সেবা প্রকাশনীতে নিজে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসব। (হেল কমান্ডো, অন্যান্য মাসুদ রানা সিরিজ)
সিদ্ধান্ত হল নীলনয়না নামবে না। অনুভব করলাম আমার এবং পথে পাওয়া সুইটরের মধ্যে একটা আঘোষিত ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বাগানের পুকুর এবং সুইমিং পুল ছাড়া আমি একবারই বন্ধুদের সাথে কাপ্তাই লেকে সাতার দিয়েছি। এই আমিই স্নোরক্যালিং গিয়ার পরে অরক্ষিত সমুদ্রসীমায় নেমে গেলাম। অনেকক্ষণ পরে যখন ফিরে তাকালাম, তখন বিচ প্রায় দেখায় যায় না। অনেকক্ষণ হয় গভীর জলে চলে এসেছি। এই প্রথম ভয় পেলাম। ক্লান্ত আমি শরীরকে শুধু ভাসিয়ে রাখলাম, সমস্থ ইন্দ্রিয় সজাগ, কখন হাঙ্গর...।
কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আমরা দুই বলদ বিচে বসে হাপাচ্ছি, ঠান্ডা যুদ্ধ ঠান্ডা মেরে গেছে। আর নীলনয়না হাসছে ... সন্ধ্যায় আজ দিলি ক্লাবে না, আমরা যাব...।
বালি বোম্বিং
মনে আছে বালি বোম্বিং এর পরের দিন ছিল ছুটিবার। সকালেও কিছু জানাতে পারিনি, দুপুর বারোটার দিকে গেলাম দিলি ক্লাবে। পরিকল্পনা ছিল পানীয়তে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ সমুদ্র দেখে আস্থে ধীরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করা যাবে। কাউকে পেলে তো ভালই...। ক্লাবে গিয়ে দেখি টেন্সড অবস্থা, এবং এই প্রথম ইউরোপীয়ান সিকিউরিটির লোকজন দেখলাম। তারপর জানলাম বালি বোম্বিং এর কথা। কতধরনের গুজব চারিদিকে, হতাহতের সংখ্যার কোন হিসাব নেই, তিমোরে বোমা মারার পরিকল্পনার কথাও শুনলাম। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে এই প্রথম হোস্টের বন্ধ দরজায় টোকা দিলাম। দু'জনে ছোটলাম অফিসে, তিঁনি সেটেলাইট-ফোন অফিসে ফেলে এসেছেন। ইউরোপ-বেইজড হেড-কোয়ার্টারে ফোন করেই উত্তাপের আঁচ পাওয়া গেল। সকাল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে (তখনো ভোর রাত ইউরোপে)। সবচেয়ে ভয়ের কথা আমাদের এক ব্রিটিশ সহকর্মী গতকাল সকালে বালি হয়ে ইউরোপে ফিরে যাবে, সেকি বালিতে থাকবে? জানি না। টিকিটের টাকার দেয়ার পেমেন্ট ভাউচার খোঁজে বের করে, তারপর ট্র্যাভেল এজেন্সীর ঠিকানা নিয়ে ছুটলাম দুজনে। আজ বন্ধ। অনেক কষ্টে বাসা খোঁজে পেলাম। জানা গেল আমাদের ব্রিটিশ সহকর্মী গতকাল বিকালের ফ্লাইটেই ইউরোপ চলে গেছে।
তিমোরের উন্নয়ন ভাবনা
সারাদিনে সাধারনত সকালে নাস্তার সময় আমি আর আমার হোস্ট ঘন্টা খানেক কথাবর্তা বলতাম। আমি জ়োর গলায় বলতাম তিমোর খুব তাড়াতাড়িই উন্নতির শিখরে উঠবে। তাঁদের চোখে আছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, আছে জোসে রামোস-হোর্তার মত নোবেল পাওয়া লোক যে সরকারের সাথে জড়িত। আছে সানানা গোসমাওয়ের মত সর্বজন গ্রহনযোগ্য নেতা, যিনি এই স্বাধীনতার রূপকার। (সানানা কিছু একটা বলেছিল যার কাছাকাছি অর্থ একজন বিল্পবী, বিল্পবের পরে একজন ভাল শাসক হতে পারে না, বা এরকম কিছু।) অভিজ্ঞতার ভারে ন্যুব্জ আমার হোস্ট আমার স্বাপ্নিক মন্তব্যে হাসত, বলত তিমোরের উন্নয়নের কোন সম্ভাবনা নাই। লোকজনকে দেখ, কেমন নির্জীব। কাজ করবার কোন ইচ্ছাই নেই। উন্নয়ন নিজেদের মধ্যে থেকে আসতে হয়। বাইরের লোক জন পারে না। আমাকে বোঝাত এই স্বাধীনতায় তুমিইতো বেশি উত্তেজিত, কিন্তু যাদের হবার কথা তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখ।
আমি গোয়ারের মত তর্ক করতাম, কিন্তু ট্যুরিজমে উন্নতি করতে তো বাধ্য। এমন সুন্দর একটা দেশ, সমুদ্রের কয়েকমাইলের মধ্যে হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়...। হাসত আমার হোস্ট, অবকাঠামো কই, সিকিউরিটি কই, বিনোদনের ব্যবস্থা কই। নাহ্, আমি উন্নতি দেখিনা।
এখন ভাবি কত সঠিকই না ছিল আমার হোস্ট।
বিদীর্ণ বালি
আরেকটা গোয়ারের মত কাজ করেছিলাম। বালি দিয়ে ফিরে এসেছিলাম। মাত্র কয় সপ্তাহের ব্যাবধানে বালির কী অবস্থা। গেছলাম বোমাক্রান্ত জায়গাটাতে, যেখানে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও ঘোরে গেছি।
তবু বালি বালিই, আমর প্রিয়তে থাকবে সবসময়।
মন্তব্য
যা সুন্দর কয়েকখান ছবি আর কিছু ঘটনা শেয়ার করলেন এরপর আর কাজের ব্যাপার-টেপারে মাথা ব্যাথা নেইরে দাদা।
এস হোসাইন
---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
ধন্যবাদ আপনাকে। কিছু সুন্দর ছবি ছিল, কিন্তু ছবিতে লোকজনের উপস্থিতি থাকায় ইচ্ছাকৃত ভাবে দিলাম না।
খুব ভালো লাগলো বর্ণনা।
এটা সিলেটের টান। (যদি ভুল না-ক'রে থাকি)।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। পলাশ দত্ত ঠিকই বলেছেন, এটা সিলেটের টান (লেখার মাধ্যমে একসেন্ট প্রকাশ করা বেশ কঠিন মনে হয়)।
পাঁচ তারা।
ধন্যবাদ।
তিমুর সম্পর্কে জানতে পারলাম । ছবিগুলোর জন্যে লেখাটা আরও ভাল লাগছে ।
নির্ভানা
ধন্যবাদ আপনাকে।
চমৎকার।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সুন্দর লাগলো, তিমোর নিয়ে এতো কম জানি যে আপনার লেখা ভ্রমণকাহিনী হলেও একটু জ্ঞানপুস্তকের ভূমিকাও নিলো। আরো লিখুন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি ২০০২ সাল থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে তিমোরের খবরাখবর রাখতাম। এখন আর রাখিনা, খুবই হতাশ হয়েছিলাম।
বাহ, খুব সুন্দর বর্ণনা এবং ছবি। পূর্ব তিমুর সম্পর্কে আরো কিছু লিখুন না।
----------------------------------------------------------
সকলই চলিয়া যায়,
সকলের যেতে হয় বলে।
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
নতুন মন্তব্য করুন